#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-২২)
#আরশিয়া_জান্নাত
তোমার কি হয়েছে তাইয়্যেবা বলবে তো? আমার উপর রেগে আছ কেন? কি করেছি আমি বলবা তো?
স্ট্রেইঞ্জ! কে বলেছে রেগে আছি?
বলতে হবে কেন? ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট।
মোটেই না। আমি খুব স্বাভাবিক আছি।
আমি তোমাকে কতবার ডাকলাম, ইশারা করলাম রুমে আসতে তুমি আসোনি। ইগ্নোর করেছ ইভেন আমি যতক্ষণ বাসায় ছিলাম তুমি একবারো রুমে আসোনি। এসবের মানে কি?
আমি সবার সঙ্গে বিজি ছিলাম। সারাক্ষণ রুমে বসে থাকার মতো মেয়ে আমি না।
ওমর কি বলবে ভেবে পেলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, তুমি কি এই বিয়েতে অসন্তুষ্ট? মায়ের জন্য বাধ্য হয়ে রাজী হলে? কিংবা আমি কি তোমায় হার্ট করেছি কোনোভাবে? প্লিজ তাইয়্যেবা ক্লিয়ার ইট সুন।
তাইয়্যেবা ওমরের গলা জড়িয়ে বললো, আমার অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের বিয়ের প্রথম রাতটা ঘিরে। বিয়ে নিয়ে ফ্যান্টাসী যা ছিল কালের বিবর্তনে ক্ষয়ে গেছে। এই জীবনে আর সেটার আশা রাখিনি। কিন্তু স্বপ্নের পুরুষকে জীবনে পাওয়ার পর আমি ভেবেছি এই ইচ্ছেটা বুঝি পূরণ হবে। কিন্তু তুমি,,,,,, যাই হোক ওটা নিয়ে অভিমান করা হয়তো আমার মতো আইবুড়ির মানায় না।
আমি দুঃখিত তাইয়্যেবা। আমার মনমানসিকতা ঠিক নেই। এমন না আমি তোমায় নিয়ে ভাবছি না, কিন্তু প্রকাশ করার মতো বা সত্যিকার অনুভব করার মতো ফুরসত পাচ্ছিনা।
ধুরর বাদ দাও তো। এসব ভেবে আর মন খারাপ করতে হবে না।
আমি বোকাসোকা মানুষ, মনের অনুভূতি প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার কম। তুমি প্লিজ আমাকে বলে দিও তোমার ইচ্ছে কি। আই প্রমিজ আমি চেষ্টা করবো তোমার সব শখ পূরণ করার।
তাইয়্যেবা ওমরের নাক টেনে বললো, তোমার আসলেই বুদ্ধি কম, বৌ গলা জড়িয়ে ধরলে বরের উচিত তার কোমড় জড়িয়ে ধরা। এটাও তুমি জানোনা,,, একটা আনরোমান্টিক বর জুটলো আমার। তাকে পদে পদে রোমান্স শেখাতে হবে, হাহ!!
ওমর মাথা চুলকে বললো, ধরতে চেয়েছিলাম কিন্তু লজ্জা লাগছিল পরে যদি খারাপ ছেলে ভেবে বসো!
তাইয়্যেবা ওমরের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো, তোমার যতো ঢং আর কি। দেখি এবার ধরোতো শক্ত করে।
ওমর দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো তাইয়্যেবাকে। প্রিয়তমার আলিঙ্গন বুঝি এতো প্রশান্তির হয়?
নাহিদ ২দিন চিটাগং থেকে ঢাকায় চলে যায়। এর মাঝে অন্তরার সাথে আর কথা হয় নি। নাহিদও তাকে আর ডিস্টার্ব করেনি। অন্তরা যতদিন খাগড়াছড়ি ছিল নাহিদ তাকে রোজ দেখেছে। তার খোঁজখবর পেয়েছে, কখন কি করছে সব তথ্য পেয়েছে। কিন্তু ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর নাহিদ মরিয়া হয়ে গেছে। তাইতো অন্তরাকে দেখতে আর্জেন্ট লিভ নিয়ে এসেছে। অন্তরা কি এখনো বুঝবেনা কত বড় একটাপাথর বুকে বয়ে চলছে সে? লোকের কথা ভেবে তার ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দিয়ে সে নিজেও কি ভালো আছে? মাঝেমাঝে তার ইচ্ছে করে জোর করে অন্তরা তুলে নিয়ে যেতে। অন্তরাকে যদি বুক চিড়ে দেখানো যেত কেমন দগ্ধ হয়ে আছে, একটু শান্তি মিলতো বুঝি। সে যে অন্তরাকে কেবল ভালোইবাসেনা, অনেক সম্মানও করে। তাইতো অন্তরার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছে। দূরে সরে গেছে। ন্য কাউকে জীবনে আনার কথা ভাবতেও পারেনা। তার মা কত মেয়ের ছবি দেখায় কত বায়োডাটা মেইল করে, সে কি একটা মেয়ের ছবিও ওপেন করেছে? নাকি দেখেছে সেই সিভিগুলো? এই যে সেদিন ভোরে এলো, ঘুমের রেশ ছিল অন্তরার চেহারায়। চোখ ফোলা, গলা ভার, অথচ কোমল মুখখানি। স্নিগ্ধ চোখদুটোয় অন্যরকম মায়া। সেই চেহারা দেখে তার মনের যন্ত্রণা কত সহজেই মুছে গেছে। নাহিদ তো তাকে সেই প্রথমদিন থেকে মন দিয়ে ফেলেছে। অন্তরার সাথেই দেখতে চেয়েছে জীবনের প্রতিটা ভোর, অফিস শেষে বাড়ি ফিরে ক্লান্তি দূর করার সঙ্গীনিরূপে অন্তরাকেই কল্পনা করেছে,মাঝরাতে ঘুমভাঙা চোখে অন্তরাকে হাতড়ে বেড়িয়েছে, আধো আলোয় তার মুখখানি দুহাতে আগলে ধরতে চেয়েছে। তবে কেন সে এতো একা? কেন অন্তরা নেই তার জীবনে? কেন সে কষ্ট পাচ্ছে? অন্তরা কেন তাকে দয়া করে মেনে নিচ্ছে না? ওর কি একটুও মায়া লাগেনা? দিনশেষে তবুও আশায় বুক বাধে এই বুঝি অন্তরা আসবে, ওর ঘরের রাণী হয়ে কিরণ ছড়াবে।
কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন।
নতুন সকালগুলো কপাল ছুঁলো তোমারই
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই
শুধু আমারই,,,,
🍀🍀🍀🍀🍀🍀🍀
বিকেলে বসে অন্তরা স্কুলের কিছু নোটস রেডি করছিল তখন ওর ফোন বেজে উঠে। আবরার স্যারের নাম দেখে কল রিসিভ করে সে। আবরার তাদের স্কুলের ইংলিশ টিচার। সে খুব চঞ্চল আর রসিক মানুষ। অন্তরার সঙ্গে তার বেশ খাতির। যদিও এখানে জয়েন করেছে কয়েক মাস হলো। কিছু মানুষ থাকে যারা অল্পতে আপন হয়ে যায় আবরারো তেমনি একজন। অন্তরা কল রিসিভ করতেই আবরার ঝরঝরে গলায় বললো, হ্যালো ম্যাম অসময়ে ডিস্টার্ব করি নি তো?
নাহ বলুন কেন ফোন করেছেন?
উমম আপনার কি ধারণা আমি এমনি কল দিতে পারি না? সবসময় কাজেই ফোন করি? এতো সেলফিশ ভাবেন আমাকে? ওহ নো!!
আপনি পারোনো বটে! আমি কখন বললাম আপনি সেলফিশ?
তা বলেননি কিন্তু অর্থ তো সেই দাঁড়ালো
মোটেই না! আপনিই কথাটাকে টেনে হিচড়ে এই অর্থে দাড় করলেন।
তার মানে বলতে চাইছেন আমি আমার ইচ্ছামতো লজিক দিয়ে আইনের আওতায় ফেলি? এতো বড় কথা!!
হাহাহা। আচ্ছা জনাব ঘাট হয়েছে আমার। ক্ষমা করুন।
এমনি এমনি তো ক্ষমা করবোনা।
তা কোন শর্ত দেয়ার ফন্দি আটছেন?
বেশি কিছু না, আমরা কলিগরা সবাই ছোটখাটো একটা ট্রিপ দিবো। আপনাকেও যেতে হবে।
আমি আসলে ,,,
কথাটা শেষ করবার আগেই আবরার বললো, কোনো বাহানা শুনবো না। আপনি যাচ্ছেন এটাই ফাইনাল। আপনি বললেন না সাগর দেখেননি, আমরা সাগর দেখতেই যাবো।
পতেঙ্গা?
নাহ। পতেঙ্গা না।
তাহলে?
হালিশহর।
ওহ।
তা যাবেন তো?
জানাচ্ছি পরে।
উত্তর কিন্তু না হতে পারবেনা। অন্য ম্যামরাও যাচ্ছেন। কেউ বাদ যাচ্ছেনা। রাখছি তবে কেমন? ভালো থাকবেন।
অন্তরা ফোন রেখে বসে রইলো। আচ্ছা বিপদে পড়েছে সে। কি অজুহাতে এড়ানো যায় এটা?
ওমরের ফুফু তাহেরা এসে যখন তাইয়্যেবাকে দেখলো ভ্রু কুচকে ফেলল মুহূর্তেই। শামীমা তাইয়্যেবাকে দেখিয়ে বললো, বৌমা এ হচ্ছে তোমার ফুফু শাশুড়ি। আপাকে সালাম করো।
তাইয়্যেবা সালাম করতেই তাহেরা বললো, দুনিয়াতে আর মেয়ে পেলি না ভাবি? আমার রাজপুত্রের মতো ছেলেটার জন্য এটা কি আনলি? ভাই মরতে দেরি হইছে তোর মনমর্জি চালানো দেরি হয় নাই। আমাদের পরামর্শ নেয়ারো প্রয়োজন মনে করলি না!
তাইয়্যেবা বিমর্ষ হয়ে গেল মুহূর্তেই। ওর চোখ জ্বালা করছে। তবুও ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শামীমা নিজেও বিব্রত হয়ে গেল। তাহেরার স্বভাব মুখের উপর কথা বলা, এই ভয়টাই পাচ্ছিলো সে। কিন্তু কি করবে, আত্মীয়কে তো আর এড়ানো যায় না। তাহেরা বলতে লাগলো, আমাকে তো দাওয়াত ও দিলা না, চোরের মতো বিয়া করাইছো। ছেলে কি তোমার দশটা? অনুষ্ঠান করো নাই কেন? আমার ভাই তো কম সম্পদ রেখে যায় নাই, তারপরো কিসের এতো কিপ্টামি তোমার?
না আপা সেরকম কিছু না। আসলে হঠাৎ করেই,,
হঠাৎ করে কি? এটা কী প্রেমের বিয়া নাকি? ওমর পছন্দ কইরা বিয়া করছে? এই মাইয়া বিয়ার আগেই পেট বান্ধাইছো তুমি?
ছি ছি আপা কি বলেন এগুলা! এসব কিছু না।
তো আর কি?
আপনি সবে আসছেন, আগে ফ্রেশ হন খাওয়া দাওয়া করেন। তারপর নাহয় সব বলবো। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয় নাই তো? দুলাভাই আসেনাই যে?
উনি আছে উনার কাজ নিয়ে। এতো দূরে বাড়ি বান্ধছোস আইতেও একদিন লাগে। আগেই ভালা ছিল। ৩ঘন্টায় ঢাকা আসা যাইতো। এইখানে আমাগো পুরা গুষ্টির কেউ নাই, এনেই শেষকালে ভাই ঘর বান্ধলো। যাক ভাইয়ের মর্জি, আমার ভাইরে আল্লাহ বেহেশত নসীব করুক।
তাহেরা ভেতরে যেতেই শামীমা তাইয়্যেবার হাত ধরে বললো, মারে মনে কষ্ট নিস না। উনি এমন করেই বলে। আমারেও ছাড় দেয় না। তুই উনার কথায় কষ্ট পাইস না।
তাইয়্যেবা মুখে হাসলেও ভিতরে ভিতরে অনেক কষ্ট পেলো। ও তো পারলে এখনি কান্না করে দিতো। গায়ের রংটা কত ম্যাটার করে তাই না। আজ যদি ওর জায়গায় রূপবতী কেউ থাকতো তবে কি তিনি এমন করে বলতেন? নিশ্চয়ই না।
আসলে যারা সুন্দর তাদেরকে প্রথম দেখায় সবাই অনেক পছন্দ করে, তাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যেই মানুষের মনে পজিটিভ ভাইব চলে আসে। অথচ ওরা ভাবে না রং দিয়ে সব হয় না। তার উপর তাহেরা যেসব কথা বলেছে কারো পক্ষেই সহজে হজম হবার মতো নয়। তাইয়্যেবা চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু চোখের পানিও তার কথা শুনছে না। অবাধ্যের মতো বড় বড় ফোঁটায় ঝরছে। সব কষ্ট কি আজকেই দু’চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে?
চলবে,,,,