অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১৯

0
362

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১৯)

#আরশিয়া জান্নাত

প্রিয় মা অন্তরা,
কেমন আছিস জিজ্ঞাসা করার মুখ নেই। জানি ভালো নেই, তবুও আশা রাখি আল্লাহ তোকে ভালোই রেখেছেন। আমি কেমন আছি তা তোর জানতে ইচ্ছে করবেনা তবুও বলছি, ভালো নেই। ডায়বেটিস বেড়ে গেছে, হাটুর ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারি না। কড়া ঘুমের ঔষধ খাই তবুও দু’চোখের পাতা এক হয় না।

পরকথা, এই চিঠিটা যখন হাতে পাবি ততক্ষণে আমি ব্যতিত তোর আর কোনো অপরাধী পৃথিবীতে জীবিত নেই। আজকে এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য দুইটা, ১)তোর কাছে শেষ স্বীকারোক্তি দিবো, ২) ক্ষমা প্রার্থনা।
এই চিঠি লিখতে গিয়ে আমার বারংবার হাত কেঁপেছে। নিজের কর্মের ওপর আলোকপাত করে ঘৃণা এসেছে। আমি জানি আমার মতো জঘন্য ব্যক্তি এই পৃথিবীতে খুব কম আছে।

আমি খুব খারাপ মানুষ, আজীবন কতৃর্ত করে এসেছি। আমার উপর কেউ কথা বলার সাহস করে নি। এমনকি তোর দাদা দাদীও না। টাকা ইনকাম করা আমার মধ্যে এক ধরনের অহমিকা সৃষ্টি করে যার ফলে আমি বেপরোয়া হয়ে উঠেছি, কারো কারো ভাষ্যমতে আমি হিংস্র। এই জীবনে আমি অনেক পাপ করেছি রে মা। যার পরিসীমা হয় তো আকাশসম। আল্লাহ আমায় মাফ করবে কি না জানি না তবে বোধ করি দুনিয়াতে তোর উপর দিয়ে যে শাস্তিটা আমাকে দিয়েছে এর চেয়ে কঠিন শাস্তি জাহান্নামে হবে না।
একটা কথা না বললেই নয় এই পাপী বান্দার জীবনে অশেষ নেয়ামত হচ্ছে তোর মা।যাকে আমি অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। সে আমায় ভালোবেসেছিল আমি তার মর্যাদা দিতে পারি নাই। আমি না থাকলেও তোরা তোদের মায়ের আশ্রয় হবি এই ভরসা আমার আছে। তোর মাকে আমি কিছু দেইনি, কিছু না। না সুখ না শান্তি। তার জন্য আমি একাউন্টে কিছু টাকা রেখে যাচ্ছি। না না এটাকে আবার প্রায়শ্চিত্ত বা ক্ষমার উপটৌকন ভাবিস না। তার বদলে আমি বহু নারীর পেছনে খরচ করেছি। এটা সেই তুলনায় যৎসামান্য। বলতে পারিস নিজের মনকে বুঝ দিতে এটা রেখে যাচ্ছি। সে খুব ভালো মানুষ। হজ্জ করার অনেক সাধ। ওমর জানলে কখনোই এই টাকায় হজ্জ করতে দিবে না। তাই তোর কাছে দিয়ে যাচ্ছি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেছিস আমি কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। হ্যাঁ আমি চলে যাচ্ছি। আমার জীবনের প্রায়শ্চিত্ত করতেই যাচ্ছি। তোদের কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ নেই আর আত্মঅহং এতো বেশি যে সেটা চাইতেও পারিনা। তাই ভাবলাম চিঠি লিখি।

অন্তরা মা , আমার কলিজাটা! বাবাকে মাফ করে দিস। আমি তোকে একটা সুখী জীবন দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারি নি। আমি গুছিয়ে লিখতে পারছি কিনা তাও জানি না। আমার ভেতরটা যদি খুলে দেখাতে পারতাম বুঝতি কি দহনে পুড়ছি। তোর ভাই আমার বড় আদরের ছেলে। সে আমাকে ঘৃণা করে, তুইও আমায় ঘৃণা করিস। একটা বাবার জন্য এরচেয়ে যন্ত্রনার আর কিছু হতে পারেনা। জানি আমি ঘৃণার যোগ্য তাও মানতে পারিনারে। বুক খাঁ খাঁ করে। আমার এতো বড় বাড়িটা ফাঁকা লাগে। তাই আমি ঠিক করেছি চলে যাবো। কোথায় যাবো জানি না। তবে যদি কখনো খবর পাস আমি নিহত হয়েছি বুঝে নিস আমার পাপেরাই আমাকে শাস্তি দিয়েছে।
আমি জীবনে যদি একটাও ভালো কাজ করে থাকি আল্লাহ যেন সেটার উসিলায় তোদের ভালো রাখে, আমার পাপের ছায়া যেন তোদের উপর না পড়ে সেই ফরিয়াদ করি।
মা রে কতদিন তোর মুখে বাবা ডাক শুনিনা,, মনটা বড় পুড়েরে মা। ভালো থাকিস আর পারলে এই বুড়ো ছেলেটাকে ক্ষমা করিস।।
তোর অভাগা পাপী
বাবা

অন্তরা চিঠিটা পড়ে অঝরে কাঁদলো, বাবার মুখটা যেন চোখে ভাসছে। সে কি একবার ফোন দেবে তার বাবাকে?

অনীল ডাইনিং টেবিলে বসে বললো, শামু চটজলদি দুটো ভাত দাও তো। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে।

শামীমা অনেকটা অবাক হলো বটে। সেটা প্রকাশ না করে ঝটপট খাবার গরম করে সবকিছু আগের মতোই টেবিলে সাজালো।

অনীল বেশ আরাম করে বহুদিন পর ভাত খেলো।

বুঝলে শামু আজ মনটা অনেক ভালো। ওমরকে বলবা চট্টগ্রাম বদলি নিতে, এক জায়গায় পুরোজীবন কাটানোর মানে হয় না। তাছাড়া অন্তরারো যখন ওখানেই মন বসেছে সবাই ওখানেই যাও।

আপনি যাবেন না?

অনীল হাসলো। বহুবছর পর শামীমার দিকে চেয়ে হাসলো। এইতো সেই হাসি যেটা দেখে কিশোরী শামীমা প্রথম প্রেমে পড়েছিল। তার জীবনের এতোগুলি বছর সে এই মানুষটাকে ভালোবেসে কাটিয়েছে। কি নিষ্পাপ সেই হাসি!

পকেট থেকে পানের খিলি বের করে বললো,খাবা মিষ্টি জর্দার পান? ধরো দুই খিলি এনেছি খাও এক খিলি। কায়দা করে গালের একপাশে পান ঢুকিয়ে আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে বললো,

বুঝলা শামীমা তোমার নসীব অনেক খারাপ। বাপ ভালা পাও নাই, স্বামীও ভালা পাও নাই। তবে দোআ করি পোলা মাইয়া ভালো পাও।

আপনার কি হইছে কন তো এমন অদ্ভুত কথা বলেন কেন?

কিছু হয় নাই। নতুন কইরা কি হইবো আর।
যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে,,

কি হবার কথা কন?

কিছু না। তোমার ছেলে কই? কখন ফিরে?

একটু পরেই আসবে।

ওহ,, আচ্ছা আমি এখন ঘুমাবো। বহুদিন পর শান্তি লাগতেছে ঘুম ভালো হইবো মনে হয়।

শামীমা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল কি হলো আজ?

ইরা না?

আরেহ ওমর ভাইয়া! কত দিন পর দেখা। কেমন আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ ভালোই তোমার কি অবস্থা।

ভালোই। কপাল দেখেন যখন পুরনো মানুষের দেখা মিলে সিরিয়ালে মিলতেই থাকে। কি অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা!

মানে ঠিক বুঝলাম না কার সাথে দেখা হলো আর?

পরশু তাইয়্যেবার সাথে দেখা হলো।

ও তো তোমার ফ্রেন্ড ই দেখা হওয়া অস্বাভাবিক নাকি?

না না ভাইয়া এটা স্বাভাবিক না। ও তো একদম ভ্যানিশ হয়ে গেছিলো। টোট্যালি যোগাযোগ অফ। ওরে পাওয়া আমবস্যার চাঁদ পাওয়ার মতোই শক্ত।

মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে এমনই ঘটে। আগের মতো বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ থাকে না। তা কি অবস্থা ওর স্বামী সংসার নিয়ে ভালো আছে তো?

তাইয়্যেবার স্বামী সংসার হয়নি তো। ও একা মোহাম্মদপুর থাকে,

তারপর সবকিছু খুলে বললো ওমরকে। ওমর স্তব্ধ হয়ে সবটি শুনলো। কিন্তু ইরাকে বুঝতে দিলো না তার সঙ্গে তাইয়্যেবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল। ইরা আফসোসের সঙ্গে বললো, বুঝলেন ভাইয়া মেয়েটা জনমদুখী। মামার বাসায়ও শান্তি পায়নি এখনো শান্তি পাচ্ছেনা।আমরা সবাই তাকে কত ভুল বুঝেছি ভাবলেই লজ্জা লাগে।

আসলেই দূর থেকে কাউকে বোঝা যায় না।

সেটাই। আচ্ছা ভাইয়া যাই আমার মেয়ের স্কুল ছুটি হবে এখন। আমার বাসায় আসবেন কিন্তু এইতো সামনে ডানের গলিতেই বাসা।

আচ্ছা যাবো সময় করে এখন যাই ভালো থেকো।

ওমর পুরো রাস্তা তাইয়্যেবার কথাই ভাবলো। এতোকিছু ঘটলো মেয়েটার জীবনে অথচ কিছুই বলেনাই। রিসেন্ট না হলেও ৫/৬ বার দেখা হয়েছে। একটাবার চোখের চাহনীতেও দুঃখ দেখেনি। এতো শক্ত তাইয়্যেবা? এতো মজবুত ওর সহনশীলতা? তাইয়্যেবার প্রতি ওমরের সম্মান যেন বেড়ে গেল বহুগুণ।


হ্যালো ওমর তাড়াতাড়ি ধানমন্ডিতে আয়। ইমারজেন্সী

কি হয়েছে বলবি তো হঠাৎ ধানমন্ডি কেন?

তুই আগে আয় তারপর বলছি।

ওমর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ধানমন্ডি গেল। ঐখানে পুলিস কমিশনার পর্যন্ত উপস্থিত। কমিশনার ওমরকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বললেন, ওমর তোর বাবা,,,,,
ওমর সেইসব কানে না নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল, ধীর পায়ে সামনে এগোতেই তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। ওমর যেন বিশ্বাসই করতে পারছেনা নিজ চোখকে।

ঐ রুমে তার বাবার র*ক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে, ওমর সামনে তাকিয়ে দেখলো পারভীন ওর দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো সেই চোখ স্থির পলক পড়ছেনা,,,,,,

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here