অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১৮

0
381

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১৮)
#আরশিয়া_জান্নাত

অফিসার মিজান ওমরকে বললো, জানি না এটাকে কি নিউজ বলবো। গুড নাকি ব্যাড!
ওমর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মিজান নিজেই বললো, অন্তরার রেইপ কেইসের ছয়জন আসামীর মধ্যে চারজন, সাজু,পাপ্পু,কাদের ও বশির নৃ*শং*স*ভাবে হত্যা হয়েছে। তাদের বডি এতোটাই জঘন্যভাবে জখম করা হয়েছে যে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায়নি। বিশেষ করে তাদের হাত দুটো,,,,,,
ওমর খানিকটা অবাক হয়ে বললো, এর পেছনে কারণ হিসেবে কিছু কি পেলেন?

— আসলে ওরা হচ্ছে এলাকার বখাটে শ্রেণীর। মাঝে মধ্যে চুরি ছিনতাই করে। তবে গুরুতর অপরাধ বলতে এই কেইসটাই। জানি না এটা কি বড় কারো চাল নাকী কেবলই কাকতালীয়। তবে ব্যাপারটা খুবই সন্দেহজনক।

— বাকী ২আসামীর কোনো খোঁজ পেলেন?

— ওরা তো পলায়িত। আমাদের সব থানায় এদের ছবি পাঠানো হয়েছে। খবর পেলে জানাবে নিশ্চয়ই। তা মিস অন্তরা ভালো আছে তো?

— জ্বী ভালো আছে।

— একটা কথা না বললেই নয় সে খুব লাকী আপনার মতো ভাই পেয়ে। আমাদের অনেক সহযোগীতা করেছেন আপনি। আর আমি খুবই দুঃখিত প্রথমদিনের জন্য।

— আমারও একটু সংযত হওয়া উচিত ছিল। তবে অফিসার ঐ রাফি আর আজমকে ফাঁসির দড়িতে না ঝুলানো পর্যন্ত আমার মন শান্ত হবেনা।

— We’re trying our best.. Don’t worry..

ওমর কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। অফিসারের কথা শুনে তার মনে একটা তীব্র সন্দেহ দানা বেঁধেছি। রাফি আর অন্যান্য আসামীদের শনাক্ত করার পর কত ঝড়টাই না উঠেছিল। রাফির পরিচয় পাওয়া আর উদ্দেশ্য জানতে পারাটা ছিল তার পরিবারের সবার সামনে উন্মোচিত হওয়া এক কঠিন বাস্তবতা। সেই ঝড়ে অনেক কিছু বদলে গেছে। গত কয়েকমাসে এত বড় বড় ঝড় সয়ে তারা বড়ই ক্লান্ত। এখন আবার নতুন ঝড় আসছে না তো?


আজকাল গরম এমনভাবে দগ্ধ করছে বোঝার সাধ্যি নেই এটা কোন কাল! বৃষ্টি হবে হবে করেও হয়না। তাপও কমে না। আবার আকাশে সাদা মেঘ চকচকে নীল আকাশ! এ যেনো একাধিক ঋতুর মিশ্রণ।
তাইয়্যেবা ছাতা মাথায় করে সবজি দরদাম করছে। দ্রব্যমূল্যের যে আগুন লেগেছে তা তো এই রোদের চেয়ে ঢের বেশি। ৫০০ টাকা দিয়ে আগে তার অনায়াসে সপ্তাহ চলে যেতো আর এখন ২ দিন যাওয়াও বেশ শক্ত। তাইয়্যেবা একলা একটি প্রাণ তাও হিমশিম খায় না জানি অন্যদের কী হাল। দর কষাকষি শেষে কয়েক পদের কাঁচা সবজি আর লাল শাক নিয়ে হাঁটা ধরলো বাসার উদ্দেশ্যে।

পথিমধ্যে ইরার সাথে তার দেখা, ইরা তার কলেজের ব্যাচম্যাট ছিল। অন্য সবার মতো সেও জানতো তাইয়্যেবার প্রবাসীর সাথে বিয়ে হয়ে গেছে। তাই হাস্সৌজ্জ্বল মুখে বললো, এই তাইয়্যেবা বিদেশীর বৌ এতো বাজারসদাই একাই বয়ে নিচ্ছিস যে? দুলাভাই কী এখনো বিদেশেই? এমন হাড়কিপ্টে,বৌকে দিয়ে বাজার করায়?

তাইয়্যেবা হেসে বললো, ঢাকা শহরে বাস করে এমন অদ্ভুত কথা বলছিস কী করে? দেশী বর হলেও তো বাজার তো বউদেরই করতে হয়!

ইরা টিপ্পনী কেটে বললো, কী জানি ভাই আমার উনি তো বাজার করতে দেয় না। ঐসব কাজ শ্বশুরই করে। তা বাচ্চা নিস নি? কয় জন হলো?

তাইয়্যেবা ভদ্রতার হাসি দিয়ে বললো, সংসারই তো হলো না বাচ্চা আসবে কোত্থেকে। হলে অবশ্যই তোকে জানাবো।

ইরা চমকে বললো, এই দাঁড়া দাঁড়া। সংসার হয়নি মানে? তোর না টেলিফোনে,,,,,

তাইয়্যেবা তাকে থামিয়ে বললো, হ্যাঁ হয়েছিলো কিন্তু দেশে ফেরার পর সে ডিভোর্স দিয়েছে।

— কেনো?

— জানি না। দেখা হয়নি, জিজ্ঞাসাও করতে পারিনি।

ইরা লজ্জিত হয়ে বললো, দোস্ত সরি। বিশ্বাস কর আমি এসব কিছুই জানতাম না। তুই একই শহরে থেকেও ভুলেও যোগাযোগ করিস নি, আমি যতবার তোকে নক করেছি এড়িয়ে গেছিস। তাই অনেক রাগ ছিল তোর প্রতি। সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মাফ করে দে বোন।

— আরে ধুর কী যে বলিস। আমি কিছু মনে করি নি।

— সত্যি?

— হুম সত্যি।

— বিশ্বাস করবো যদি তুই এখন আমার সাথে ফুচকা খেতে রাজী হোস।

— এসব হাতে নিয়ে ফুচকা?

— এটা কোনো ব্যাপার হলো? চল তো।

বহুদিন পর পুরোনো সাথীকে পেয়ে ইরাও দুনিয়ার গল্প খুলে বসলো। তাইয়্যেবাও সুখদুঃখ বলার একজনকে পেয়ে বুক হালকা করলো। কেউকে তো অন্তত পেয়েছে এসব বলার। এই পৃথিবীতে তার কাছের মানুষের যে বড্ড অভাব। যারা ছিল তাদের সে যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখেনি। কী যেনো এক চাপা অভিমান কিংবা গুটিয়ে রাখার প্রয়াস! তবে আজ কেনো বলে ফেললো ইরাকে? সে তো কাউকে জানাতে চায় না কত নিঃসঙ্গ যন্ত্রণাময় জীবন বয়ে চলছে….
_________________
একটা নিস্তব্ধ রাত, চারদিকে ঝি ঝি পোকার শব্দ। দূরে কোথাও দু একটা কুকুরের ডাক ব্যতিত কোনো অস্থিরতা নেই। সবকিছুই শান্ত, সবাই হয়তো আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছে। কিছু মানুষ এই আধারেই বিষন্ন মন খারাপের প্রহর গুনছে, কেউবা প্রিয়জনের সাথে বাক্যালাপে ব্যস্ত। অনলাইনের যুগে শহুরে কেউই রাত ১২টায় ঘুমোয় না। অন্তরা নিজেও কত রাত জেগে গ্রুপের আড্ডায় বিজি ছিল। কখনো বা কেডিতে ডুবেছে। এখনো সে ঘুমাতে পারে না, দিনে তাও বাচ্চাদের মাঝে থাকে, অফিশিয়াল নানান কাজে ব্যস্ত সময় কাটে, কিন্তু রাত তার কাছে বিভীষিকাময়। আজকাল স্লিপিং পিলেও কাজ দেয় না। সাইক্রিয়ার্টিস্টের পরামর্শে অন্তরা মেডিটেশন করছে, একটা সেশনও শুরু করেছে সপ্তাহখানেক হলো। জীবনটায় তবুও যেন এতোটুকু শান্তি নেই। চার পাঁচজন ছেলে একত্রিত হতে দেখলেই আত্মা কেঁপে উঠে, সিএনজিতে ওঠা তো অসম্ভব। সিএনজি দেখলেও সেদিনের কথা তীব্রভাবে নাড়া দেয়। এইসব বিস্মৃতি হয় না কেন? কেন ভুলে না এটি মুহূর্তও? পাখি আরোহী তাকে মোটিভেট করতে এই রিলেটেড কত মুভি সাজেস্ট করে। কত মেয়েই তো সব হারিয়ে ফের শুরু করেছে, জীবনের যুদ্ধ একা লড়েছে। তবে সে কেন পারে না? সে কেন এমন ধুমড়ে মুচড়ে যায়? সে এতো দূর্বল কেন?
অন্তরার চাপা কান্নার শব্দে মনসুরার ঘুম ভেঙে যায়। সে ঠিকই টের পায় মেয়েটা বালিশে মুখ চেপে কান্নার শব্দ লুকায় পাছে তার ঘুম না ভাঙুক। মনসুরা এই পরিবারের সঙ্গে ১৭বছর আছে। এক প্রকার মায়াই বসে গেছে ছেলেমেয়ে দুটোর প্রতি। তাই এদের কষ্ট তার বুকে নিজ সন্তানের কষ্টের মতোই বিঁধে। মনসুরা জানেনা কিভাবে এই অভাগীর দুঃখমোচন হবে, অন্ধকারে শুয়েই হাত তুলে ফরিয়াদ করে, হে পরওয়ারদিগার, অন্তরা মার দুঃখ দূর কইরা দাও। তুমি পারো না এমন কোনো কাজ নাই। ওর মন থেইকা ঐ দিনটা মুইছা দাও মাবূদ। ওর দুচোখে শান্তির ঘুম দাও, মন শক্ত করো, গরীবের দোআ কবুল করো আল্লাহ,,,,
বলতে বলতেই দুচোখ ভিজে আসে তার।

পরদিন সকালে অন্তরার নামে একটা চিঠি আসে। অন্তরা প্রথমে অবাক হলেও প্রেরকের নাম দেখে চিঠিটা গ্রহণ করে। তারপর বেলকনীর ইজি চেয়ারে বসে চিঠিটা পাশের ছোট্ট টুলে রেখে চোখবন্ধ করে দুলতে থাকে।
চিঠির খামে চিরচেনা হাতের লেখায় তার বাবার নাম লেখা। অন্তরা মনের মাঝে মিশ্র অনুভূতি নিয়ে দ্বিধায় ভুগে চিঠি খুলে পড়বে কি পড়বে না। কেন সে হঠাৎ চিঠি পাঠালো? কি লেখা এই চিঠিতে?

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here