অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১৬

0
362

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১৭)

#আরশিয়া জান্নাত

ওমর কি হয়েছে বাবা তোর বলতো? কেমন যেন অন্যমনস্ক থাকিস আজকাল! ভাত খেতে বসে কোথায় মন তোর? ডালের বাটিতে পানি ঢেলে দিলি, ভাজি পাতে না নিয়ে টেবিলে রাখলি। এমন অদ্ভুত কার্যক্রম কেন বাবা?

ওমর তাকিয়ে দেখলো সে আসলেই সব এলোমেলো করে ফেলেছে, সে কখনোই সবকিছু প্লেটে নিয়ে একসঙ্গে মেখে খায় না। কিন্তু এখন তার প্লেটে সব খিচুড়ী হয়ে গেছে। ওমর খানিকটা বিব্রতস্বরে বললো, কিছু হয় নি মা, অফিসে প্রেশার তো তাই মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। মনোযোগ দিতে পারছি না।

শামীমা ওমরের প্লেটটা নিয়ে ওকে নতুন করে ভাত বেড়ে দিলো। ওমর বললো, মা খাবো না আর। ভালো লাগছেনা খেতে। তুমি খেয়ে নাও।

তুই জানিস আমি একা খেতে পারিনা। এই ঘরে এখন কেবল তুই আছিস যার সঙ্গে বসে দুটো ভাত খাই। আমার জন্য হলেও একটু মুখে তুল না বাপ?

ওমর চুপচাপ চেয়ারে বসলো। শামীমা দেখছে তার ছেলে কেমন একটু পরপর পানি খেয়ে খাবারটা গলাধঃকরণ করছে। শামীমা ওকে থামিয়ে বললো, থাক তোকে কষ্ট করে খেতে হবেনা এমনিই বসে থাক। অনুর খবর নিয়েছিস? কেমন আছে? ঐখানে সব ঠিকঠাক তো?

হুম। চিন্তা করো না, ঐখানে সব ঠিক আছে।

আগামী সপ্তাহে তো যাবি তাই না?

হু। কেন?

আমার তো শহরের বাইরে যাওয়া হয়নি তেমন। পাহাড় দেখিনি কখনো, কত শখ ছিল সাগর দেখার। সুযোগই হলো না। তোর বাবা তো সব জায়গায় একা ঘুরেছে, আমায় নেয়নি কখনো। তাছাড়া তোদের পড়াশোনা, প্রাইভেট পালাক্রমে এই টেস্ট ঐ টেস্ট,,,, সবমিলিয়ে আর বেড়ানো হলো না। আগে ভাবতাম যখন তোরা বড় হবি পড়াশোনার পাট চুকে যাবে তখন সব জায়গায় ঘুরবো। হাহাহা ভুলেই গেছিলাম তখন আর ঘোরার বয়স থাকবেনা,

মা তুমি যাবে চট্টগ্রাম? ঐখানে সাগর পাহাড় সব আছে। তুমি বললে অফিস ছুটি নিবো,

না রে এখন‌ না, গরমটা একটু কমুক তারপর। মেয়েটার জন্য বুকটা খালি লাগে, মেয়েটা একা দূরে পড়ে আছে। যাওয়ারো সাহস হয় না, বাসায় তো একজন নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরছেন, সুযোগ পেলে বিস্ফোরণ ঘটাবে।

তুমি এখনো তাকে এত ভয় পাও? এতো অপরাধ করেও যার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই তার রাগ কে মান্যি করছো?

৩০বছরের আনুগত্য, ভয়ডরের অভ্যাস এতো সহজে ছুটবে? এখন তো তাও একটু এড়িয়ে চলছি, এই সাহসও বুকে ছিল না। আমি তার করা সকল পাপ রবের জন্য জমা রেখেছি। আমি তার বিচারের অপেক্ষা করেছি। কিন্তু বুঝিনি তার পাপের শাস্তি আমার সন্তানের উপর পড়বে। যদি জানতাম আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম এই পাপীর থেকে আমার সন্তানদের রক্ষা করতে। আসলে আমারো দোষ আছে। তুই ছোটবেলায় ঠিক বলতি, অন্যায় করা এবং সহ্য করা সমান অপরাধ।।। আমার সহন করাটাও পাপ ছিল।
শামীমার চোখ ভিজে গেল। ওমর কিছু বললো না, এই প্রথম তার মা নিজের স্বামীর সম্পর্কে বলে কাঁদছে, হালকা হয়ে নিক না বেচারি। ওমর তার মায়ের কোলঘেষে হাত ধরে বসে রইলো। মনে মনে বললো, তোমার অপূর্ণ সব ইচ্ছা আমি পূরণ করবো মা, তুমি দেখো। আল্লাহ যেন আমায় সেই তৌফিক দান করেন।


অনীল বেশ আয়েশ করেই কোচে বসে আছে, তার সামনেই পারভীন বসা। দেখে বোঝা যাচ্ছে গত কয়েক রাত তার ঘুম হয় নি। খাওয়াও হয় নি বোধহয়। এই করুণ মুখটা দেখতে বেশ আরাম লাগছে তার। নিরবতা ভেঙে পারভীন বললো, রাফিকে কি করেছ তুমি? কোথায় ও?

অনীল রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো, তোমার ভাইটা নিজেকে কি ভেবেছিল বলোতো? পাতিগুন্ডা ? নেতাজী? এই শহরে আমি কত বছর আছি জানো? ওর মতো জলজ্যান্ত ছেলে গুম করা আমার বা হাতের খেল। তোমাদেরকে আমি সর্বোচ্চ সুখ দিয়েছি, বিনিময়ে তোমরা কৃতজ্ঞ তো হলেই না বরং পিঠে ছোড়া বসালে। এখন ভুগো,,,,

পারভীন দৃঢ় কন্ঠে বললো, তুমি কি ভাবছো আমি কিছুই করতে পারবো না? তোমার নামে আমি কেইস করবো, যা যা করা লাগে সব করবো। আমার ভাইয়ের যদি কিছু হয় তোমার রক্ষা নেই,,

হাহাহা তা টাকা কড়ি আছে তো হাতে? এতো বড় লড়াই লড়বে খালি হাতে নেমো না যেন। আর শুনো কাল কিছু লোক তোমার ফ্ল্যাটে যাবে, উনারাই ওটার নিউ ঔনার। আর তোমার কার্ডটা আমি ডিজ্যাবল করে দিয়েছি। কোথায় যাবে কি করবে তা তোমার ইচ্ছা। পারলে আজ রাতের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে।

পারভীন হতবিহ্বল চোখে চেয়ে বললো, তুমি কি ভাবছো এসব করলে আমি নেতিয়ে পড়বো? কিছু করতে পারবো না?

পারভীন রে পারভীন, বহুতদিন পর হাসাইলি, আমার মেয়েটার দিকে হাত বাড়ানোর আগে তোদের উচিত ছিল বোঝার সূর্যের দিকে তাকালে চোখ জ্বলসে যায়। এর শাস্তি তোদেরকে আমি এমনভাবে দিবো তোরা কল্পনাও করতে পারবি না। এই তো সবে শুরু। পুরনো অনীলকে ফিরিয়ে এনেছিস যখন ভোগ কর,,, আর শোন তোর ভাইয়ের প্রেমিকা আছে না কি যেন নাম? ও হ্যাঁ ফাহমিদা। মেয়েটার জন্য তোর ভাইয়ের জান যায় তাই না? তুই ও তো ওরে কত কি কিনে পাঠাইছোস, আহারে আমার টাকায় ফকিন্নির কত লীলাই না দেখলাম।

কি করেছ তুমি ফাহমিদাকে? ওর কি দোষ ওকে কেন টানছো?

অন্তরার যে দোষ ওরো সেই একই দোষ,,, ভালো হয়ছ গেছিলাম তোর সহ্য হয় নাই? এখন আর ভয় নাই আমার, সন্তানেরা তো জেনেই গেছে তাদের বাপ খারাপ। তো খারাপই। এখন আমি আমার খারাপের সর্বোচ্চটা দেখাবো।

নক্ষত্রেরো পতন হয়। এত অন্যায়ের ফল পাবে না ভাবছো? নিশ্চয়ই পাবে। এই কালে না হলেও পরকালে পাবে,,

মা*গী তোর বিষ এখনো কমেনাই তাই না? তোরে তো আমি এতো সহজে মারমুনা, তোর প্রতিটা প্রিয় মানুষের জীবন বরবাদ করমু। তোর চোখের সামনে সব হবে। এনজয়,,,,

পারভীন দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। কোথায় যাবে সে কাকে বলবে তার ভাইকে খুঁজে দিতে? আর ফাহমিদাকে কি করেছে? ও বেঁচে আছে তো?

অনীল চোখের কোণ মুছে বলল, আমার মেয়েটা না জানি কোথায় আছে কেমন আছে, আমার আদরের মা টা এখন আমায় ঘৃণা করে, আমার মুখ পর্যন্ত দেখতে চায় না। কতদিন ওর মুখ দেখিনা, বাবা বলে ডাকে না,,,,, এই যন্ত্রণা কি জাহান্নামের চেয়ে কোনো অংশে কম? আমার জন্যই যখন এসব হয়েছে শেষটাও আমিই করবো। সবকয়টাকে কু*পিয়ে মারবো। একটাকেও ছাড়বো না,,,এতে আমার ফাঁসি হলেও দুঃখ থাকবে না।
অন্তরার ছবির দিকে তাকাতেই বুকটা ভার হয়ে যায় তার। আমার কলিজাটারে ভালো রাখিও মাবুদ। ওর জীবনটায় আমার প্রভাব আর দিও না। আমার পাপের শাস্তি আমারেই দিও। ওরে সুখী করিও।

তাইয়্যেবা স্কুল শেষে বেশ কিছুক্ষণ মাঠে বসে থাকে। ধীরে ধীরে হৈ হুল্লোড় থেমে পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে যায় ক্যাম্পাস। একটু আগে যেখানে শান্তিতে বসা যায় নি সেখানেই এখন জনমানব নেই। তাইয়্যেবা উঠে দাঁড়ায়, এখান থেকে বের হয়ে সে ঘুরে বেড়ায় নীলক্ষেত, টিএসসি কিংবা এয়ারপোর্টের ওদিকের লেকটায়। জীবনটা তার কাছে এমনই এখন। একা একা উড়তে থাকা গাঙচিল। আশেপাশে কেউ রাখেনি যাকে, অপয়া বোঝা ভেবে সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাও ভেবেছিল সংসার হলে হয়তো সবটা বদলাবে, ওমর নিশ্চয়ই তাকে অনাদর করতো না? তারো একটা সুখী পরিবার হতো। কিন্তু উপরওয়ালার অন্য পরিকল্পনা ছিল। অনার্সে ভর্তি হবার পরপরই তার টেলিফোনে বিয়ে হয় জাবের নামক প্রবাসী ব্যবসায়ীর সাথে। কথা ছিল বছরের শেষে সে দেশে ফিরবে, তারপর তাইয়্যেবাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে রিয়াদে। মামার মুখের দিকে চেয়ে ওমরকে বিসর্জন দিয়েছিল বটে কিন্তু মন থেকে মুছতে পারেনি। তাছাড়া ওমর তখন মহাব্যস্ত তার ক্যারিয়ার নিয়ে। তাইয়্যেবার সাথে যোগাযোগ রাখেনি। তাছাড়া সেই মানুষটাকে কোন অধিকারে সে বলতো বিয়ে করে নাও আমায়। আমি তোমায় মন দিয়েছি, এই মন যে এখন অন্য কাউকে মেনে নিবে না। তবুও শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে তাইয়্যেবা গিয়েছিল কিন্তু ওমর তখন ঢাকার বাইরে ট্রেনিং নিচ্ছিল।
ভাগ্যে নেই ভেবে বুকে পাথর বেঁধে কবুল বলেছিল ঠিকই কিন্তু সংসার আর করতে পারেনি। কি জানি কি ঘটেছিল জাবেবের মনে। সংসারটা তাসের ঘরের মতোই ভেঙে গেল, কারণটা পর্যন্ত জানা গেল না। দেশে ফিরে জাবের দেখা করার আগেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলো। তারপর সারা এলাকায় কত কলঙ্ক রটলো, মামী তাকে কত হেনস্থাই না করেছিল। আশেপাশের লোকের কথা বাদ ঘরের লোকের টিপ্পনীতেই আর বাঁচা যাচ্ছিল না।
তাই তো মামার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই, কেউ না। যাদের বাবা-মা থাকে না তাদের আর কেউ থাকে না।
মাঝেমধ্যে তার জিজ্ঞাসা করতে মন চায়, কেন এই নাটক হলো? কেন বহু মাইল দূরে বসে টেলিফোনে বিয়ে হলো? কেনই বা বিয়ে ভাঙলো? মাঝে ডিভোর্সী খেতাব জুড়ে দিলো মাথায়। কেন হলো এমন? কোন অপরাধের শাস্তি এটা? এই অলিখিত দন্ড কতদিন পাবে সে?
এই ছোট্ট জীবনে সুখপাখি কি আর আসবে না??

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here