অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১৫

0
414

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১৫)

#আরশিয়া_জান্নাত

পাহাড়ের কোল ঘেষে বেশ পুরনো ছোট্ট দোতলা বাড়ি। বাড়িওয়ালার দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুটো বৌ বাচ্চা নিয়ে শহরেই থাকে। আর মেয়েটা পাশের এলাকায় থাকে। একমাত্র মেয়েকে দূরের বাসিন্দা করতে চাননি বলেই এখানেই বিয়ে দিয়েছেন। এই বাড়িতে কেবল তারা দুজন থাকে। ভাড়াটে দেওয়ার ইচ্ছে তাদের কখনোই ছিল না। মনে আশা ছেলে মেয়েরা মাঝেসাঝে যখনই আসুক না কেন ঘরগুলো তো লাগবেই। অযথা ভাড়া দিয়ে লাভ কি? কিন্তু পরপর দুই ঈদে কোনো ছেলেই যখন এসে দুটো দিন থাকলো না আরিফ সাহেব রাগ করে দোতলা ভাড়া দিলেন। সেখানেই উঠলো অন্তরা। এই এলাকায় আরিফ সাহেবের বেশ দাপোট আছে, তাছাড়া গেটে দুজন পাহাড়াদারসহ কাজের লোকই চারজন। সবকিছু বিবেচনা করেই ওমর এখানে অন্তরাকে শিফট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গেইটের ভেতর দিয়ে ঘাসের উপর সরু পথ, পাশেই অনাদরে গুছিয়ে রাখা দোলনা। নানান বাহাড়ি গাছের সমারোহ আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ ব্যতিত এখানে আর কোনো কলহ নেই। ঘাট বাধাই করা পুকুর দেখেই অন্তরা সিঁড়িতেই বসে পড়লো। এতো সুন্দর একটা জায়গায় কেউ কেন নেই? কেমন অসহনীয় নিরবতা এদিকে! অবশ্য ভালোই হয়েছে, অন্তরা এখন নিরবতাকেই শ্রেষ্ঠ মানে। জনসমাগম যত কম ততোই তার মঙ্গল।
তাদেরকে দেখে হাফসা বেগম বললেন, অনেকদিন পরে আমার বাড়িতে মেহমান এসেছে। ছেলে দুটো তো পরেই থাকে শহরে, মেয়েটাকে কাছেকিনারে বিয়ে দিলাম তাও মাসে একবার আসার সময় পায় না। বুঝলা বাবা সন্তানেরা বড় হয়ে গেলে মা বাপ বড় একা হইয়া যায়। কত শখ কইরা এই বাড়িডা বানাইছিলো তোমার আঙ্কেল। ছেলেমেয়ে লইয়া হৈ হুল্লোড় করতো, বরশি বাইতো, আম পাড়তো, এমন কোনো ফল গাছ নাই যা এখানে লাগানো নাই। অথচ দেখো খাওনের লোক নাই।
আরিফ সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, আহা রাফুর মা থামো। এসব কইয়া ওদেরকে বিব্রত করতাছ ক্যান? শোনো বাবা, এখানে তোমার বোন থাকবো কোনো সমস্যা নাই। নিরাপত্তা নিয়া ভাবিও না। তবে আমার এখানে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। সপ্তাহে একদিন এই বুড়াবুড়ির সাথে খাইতে হবে। আমাদের গল্প করার কেউ নাই, আমি ঠিক করছি যারে ভাড়া দিমু প্রথম শর্ত হইবো যখনই সময় পাইবো চায়ের আড্ডা দিতে হইবো। কি মা পারবা না?
অন্তরা মুচকি হেসে তাকালো।
ওমর চারদিন থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিলো, আশেপাশের খোঁজখবর নিলো, বেশ কিছুজনের কনট্যাক্ট নিলো। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সঙ্গে কথা বলে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে তবেই ঢাকায় ফিরলো। তবে অন্তরাকে জানালো না এই বাসাটার খোঁজ তাকে কে দিয়েছে।


অনীল আজ ছয়দিন বাসায় এক ফোঁটা পানিও গ্রহণ করে না। বাইরে থেকেই খাওয়া দাওয়া করে আসে, শামীমার দিকে ভুলেও তাকায় না। সবসময় নাকের ডগায় রাগ আর মেজাজ নিয়ে খিটখিট করে। তাই শামীমাও তাকে ঘাটতে যায় না। সে নিজের মতো সংসারের যাবতীয় কাজ দেখে, অবসরে টিভিতে সিরিয়াল দেখে। মাঝেমধ্যে পার্কে বেড়াতে যায়। মোট কথা তাকে দেখে কেউ বলবেই না কিছুদিন আগে তাদের জীবনে কি ভয়ঙ্কর ঝড় এসেছিল। এসবে অনীল আরো রাগান্বিত হয়। কিন্তু প্রকাশ করার ঠিকঠাক সুযোগ পায় না। অন্তরা তাকে না বলে চলে গেছে, কোথায় গেছে সেটাও কেউ তাকে জানায় নি। যেই সংসারে কি রান্না হবে তা পর্যন্ত তার পারমিশন ছাড়া হয় নি, সেই সংসারে নাহিদকে রিজেক্ট করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার স্পর্ধা দেখালো কি করে? আর ওমর এতো বড় হয়ে গেছে তার প্রেজেন্সকে তোয়াক্কা না করে নিজের মতো চলছে! শামীমাটাও এখন তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। ইদানীং তো সে অন্তরার ঘরে ঘুমায়। ভুলেও অনীলের মুখোমুখী হতে চায় না। অনীল রেগে ফুসতে থাকে, কিন্তু কিছু করবার জো পায় না। ছেলেটা যদি ফের মুখের উপর কিছু বলে ফেলে কিংবা শামীমাকে নিয়ে অন্তরার মতো চলে যায়? এই শেষ বয়সে একাকীত্ব অনীল চায় না। আবার দাম্ভিকতার আবরণ খুলে সহজও হতে পারেনা। সে ভেবেছিল দু বেলা ঘরে না খেলে শামীমা আগের মতোই পায়ে ধরে বসবে, অথচ শামীমা সেটা করা তো দূর চোখেই দেখছে না যেন।
একটা সত্যি মানুষের জীবনটা এমনভাবে বদলে দেয়?
সেদিন মামলাটা বন্ধ করতে গিয়ে যখন শুনলো এই সবকিছুর পেছনে আর কেউ না পারভীন রয়েছে কি কঠিনভাবেই না আৎকে উঠেছিল সে। হয় মেয়ের কেইস বন্ধ করো নাহয় নিজের কেইস সামলাও। কত বছরের হিসেবের খাতা খুলে বসেছিল পারভীন! সবকিছুর কি দিরুণ প্রমাণাদি গুছিয়ে রাখা ফাইল। অনীল তো এমনিও কেইসটা বন্ধ করতোই, কিন্তু ওমর কিছুতেই করতে দিলো না। উল্টো তার কলেজ বন্ধু মারুফকে লাগিয়ে মূল শেকড় টেনে তুললো।

পারভীন! তার পরনারীদের মধ্যে সবচেয়ে রুপবতী একজন। যার জন্য অনীল এতোটাই পাগল ছিল শেষে তাকে বিয়ে করতে পর্যন্ত মরিয়া হয়েছিল। কিন্তু পারভীনের একটাই কথা বৌ সন্তানদের না তাড়ানো পর্যন্ত সে তাকে বিয়ে করবে না।একটা সময় অনীল ভেবেছিল শামীমাকে ছেড়ে দিবে, তবুও পারভীনকেই তার চাই। এমন কমনীয় লাবণ্যতা যার সারা শরীর ঠিকরে পড়ে, তাকে কেবল একদিন ভোগ করলে সাধ মিটবে না। অনীল অস্থির হয়ে যায়, পারভীনের সান্নিধ্য পেতে কি কি না করে সে! তার নামে উত্তরার ফ্ল্যাট লিখে দেয়, যখন যা চাইছে সব দিয়েছে। এমনকি তার ছোট ভাইকে পর্যন্ত মানুষ করেছে। অথচ তারাই কি না পিঠে ছোড়া হয়ে বসলো? সামাজিকতার ভয়ে শামীমাকে ছাড়ে নি এ কথা সত্যি না। সে যতোকিছুই করুক যত ঘাটেই পানি খাক দিনশেষে শামীমাই তার অন্তঃপ্রাণ। এমন পতিভক্ত স্ত্রীকে বাদ দিয়ে নিজের উপর ছড়ি ঘুরাবে এমন নারী কোনো পুরুষই ঘরে তুলবে না। তাই তো পারভীনকে কৌশলে প্যাঁচে ফেলে এমন হাল করেছে পারভীন নিজেই তার কাছে ধরা দিয়েছে।
তার বিরুদ্ধে জমিয়ে রাখা ক্ষোভ শেষে কি না তার আদরের মেয়ের উপর পড়লো! রাফি তার বোনের উপর করা জুলুমের শাস্তি এভাবে দিলো? এতো নিমকহারাম। তার টাকায় তারই মেয়েকে,,,
দুধকলা দিয়ে আসলেই সে কালসাপ পুষেছে। অবশ্য পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। অনীল জানে সে নিজের সবকিছুর শাস্তি পাচ্ছে। যৌবনের উচ্ছাসের খেসারত সে এখন দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছে করে লাইসেন্স করা বন্দুকটায় ৬টা বুলেট ভরে পারভীন আর রাফিকে শেষ করে নিজের মাথায়ও শ্যুট করতে। আজকাল এই টা নিয়েই ভাবছে সে। এমন অবহেলিত জীবন সে চায় না।সিংহ গর্জনে কাঁপতে থাকা ভীতুর দল দেখে অভ্যস্ত, সে নিজে কাঁপতে পারে না। এই পরাজয়ের চেয়ে মৃত্যু অধিক সহজ,,,,


বহুদিন পর তাইয়্যেবার ইচ্ছে হলো ওমরের সঙ্গে দেখা করার। তাই অফিস ছুটির সময় ইচ্ছে করেই রাস্তার ধারের ফুচকা স্টলে বসে আছে সে। ওমর নিশ্চয়ই তাকে দেখে দাঁড়িয়ে যাবে, তখন আর ইচ্ছাকৃত সাক্ষাতের বিড়ম্বনায় পড়তে হবেনা তাকে।
ওমরকে আসতে দেখে তাইয়্যেবা ব্যস্তভঙ্গিতে বলল, মামা ঝাল একটু বাড়িয়ে দেন, এতো কম ঝালে ফুচকা জমে না!
তাইয়্যেবার বিখ্যাত গলার স্বর যে কারোরই নজরে পড়তে বাধ্য। কিন্তু ওমর আজ তার দিকে ফিরলো না। সে ফোনে কথা বলতে বলতেই চলে গেল। তাইয়্যেবা বিষন্ন ভঙ্গিতে ফুচকা মুখে পুরতেই ঝালের চোটে কাঁশতে লাগলো, ও মাগো এত্তো ঝাল মানুষে দেয়! ফুচকায় আলু দিছেন‌ নাকি সবটাই মরিচের পুর দিয়েছেন?

ফুচকাওয়ালা বিরক্ত মুখে বললো, আমনেই তো বাড়ায়া ঝাল দেন ঝাল দেন কইরা চিল্লাইছেন, আমার দোষ কি?
তাইয়্যেবা ঝালমুখ সামলাতে হিমশিম খেলো বলে, নয়তো এই ব্যাটারে সে বাকি ফুচকা সব গিলাইতো। আশে পাশে আইসক্রিম আছে কি না দেখতে চারপাশে দেখছিল ওমনি কেউ একজন তার মুখে চকবার আইসক্রিম দিলো। শান্তিতে তার গলাটা ঠান্ডা হলো। আহ কি শান্তি! ঝালটা বেশ কমেছে আর জীবনেও সে এমন করে ঝাল চাইবে না। মরে গেলেও না। যার জন্য খেলো সে তো দেখলোই না শুধু শুধুই এমন ভুগলো হুহ!
আইসক্রিম খাওয়া শেষে হুশ ফিরলো কে আইসক্রিম দিলো! সামনে তাকিয়ে দেখে ওমর দুহাত বুকে ভাঁজ করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। ওলিভ কালারের ফুল হাতা শার্টটা যেন তার গায়ের রংটা আরো উজ্জল করে তুলেছে, সে কি আরো লম্বা হয়ে গেল? নাকি শুকিয়েছে বলে বেশি লম্বা লাগছে? তাইয়্যেবাকে চুপ করে থাকতে দেখে ওমর নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ব্রাশ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ঝাল খেতে পারো না যখন এমন চেচিয়ে ঢাকাবাসীকে শোনালে কেন ঝাল বাড়িয়ে দিন? নাকি কারো মনোযোগ কাড়তে চেয়েছিলে হুম?

তাইয়্যেবা নাক ফুলিয়ে বললো, আমি কারো মনোযোগ কাড়তে এমন করবো আমি? এই চিনো তুমি আমাকে?

এমন নাক ফুলিয়ে কথা বলছো কেন? তুমি না করলে তো রাগ করবার কথা না।

আমি রাগ করিনি জিজ্ঞাসা করছি।

জিজ্ঞাসা করলে কারো নাক এমন লুচি হয়?

কি বললে আমার নাক লুচির মতো?

এতো মহামুশকিল হলো, যাই বলছি উল্টো রিয়েকশন। কোথায় ধন্যবাদ দিবে আইসক্রিম খাওয়ালাম তা না ঝালের ঝাঁজ কথায় শোনাচ্ছ!

যাও বলছি না আর কথা। ধন্যবাদ আইসক্রিমের জন্য। বায়

আরেহ চললে কোথায় দাঁড়াও,

তাইয়্যেবা একছুটে দৌড়ে পালালো। এতো লজ্জা সে রাখবে কোথায় উফফ।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here