অন্তঃপুরে দহন পর্ব ১৪

0
361

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-১৪)
#আরশিয়া_জান্নাত

পাখি ফুচকায় পুর দিয়ে প্লেটে রাখছে আর আরোহী তেঁতুলের টক তুলে বাটিতে রাখছে। একটু আগেই দুজন এসেছে অন্তরার প্রিয় ফুচকাবাড়ির ফুচকা নিয়ে। অন্তরার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকা যে কজন আছে তার মধ্যে ওরা দুজন অন্যতম। অন্তরার বন্ধুভাগ্য ঈর্ষনীয় বলা চলে। অন্যসময় হলে এতোক্ষণে বেশ কয়েকটা ফুচকা অন্তরা মুখে পুরে ফেলতো নিশ্চিত। অথচ তার কোনো হোলদোল নেই। অবশ্য কিভাবে হবে মেয়েটার জীবনে এতো বড় ঝড় বয়ে গেছে ও কিভাবে আগের রূপে থাকবে? একটুপর পর ডুকরে কেঁদে উঠে, রাতে তাকে একা ছাড়ার সাহস কেউ দেখায় না। পালাক্রমে আরোহী কিংবা পাখি ওর সঙ্গে ঘুমায়। রাতেও মেয়েটা ঘুমের মাঝেও শান্তি পায় না। দুঃস্বপ্নে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। এই ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো আদৌ কি মুছবে? অন্তরা নাহিদের সাথেও দেখা করে না। ছেলেটা এসেছে শুনলেই দরজা আটকে বসে থাকে। ওর এমন অবস্থা দেখে নাহিদও বিয়ের টপিক তোলার সাহস পায় না। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্তরার সঙ্গে কথা বলার।
আশেপাশের সকলের কানাঘোষা এড়িয়ে চার দেয়ালে বন্দী জীবনটাই যেন টানছে তাকে। আরোহী কত করে বলে বাইরে চল দূরে কোথাও ঘুরে আসি,, কিন্তু অন্তরা রুমের বাইরেও পা রাখেনা। তার ধারনা সে বাইরে গেলেই সবাই তার দিকে আঙুল তুলে বলবে আরে ও না সেই ধর্ষিতা! তারচেয়েও বড় ভয় ফের যদি কেউ তাকে তুলে নিয়ে যায়? যে শহরে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠেছে, একা একা কত ঘুরে বেড়িয়েছে সেই শহরে কি আর একা চলতে পারবে? অন্তরার মানসিক অবসাদ দিনকে দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। যত দিন যাচ্ছে সে ততোই গুটিয়ে যাচ্ছে যেন। জীবনটাকে ঘিরে কত রঙবেরঙের স্বপ্নই না ছিল তার, সব যেন নিমিষেই ধূসর হয়ে গেছে,,

আরোহী– অন্তরা সাজেক যাবি নাকি সেন্টমার্টিন?

অন্তরা–হঠাৎ?

আরোহী– আরেহ বল না। মনে নেই আমরা সবসময় বলতাম আমরা বেড়াতে যাবো, পাহাড়-সাগর, চা বাগান সব দেখবো। এই পাখি তোর কোথায় যাওয়ার শখ?

পাখি– বোইন আমি সাতার পারি না, পানি পার করে সেন্টমার্টিন যেতে হবে ভাবলেই মাথা চক্কর দেয়। তারচেয়ে পাহাড় ভালো,,

আরোহী–সাতার আমরা কেউই পারিনা। নদীরদেশে থেকে কয়টা পানিপথ এভোয়েড করবি? দেখা গেল তোর শ্বশুরবাড়ি বরিশাল কিংবা সন্দীপ। পানি বাদ দিয়ে যাবি কেমনে তখন?

পাখি– বরিশাল হলে পদ্মাসেতু আছে প্যারা নাই।

আরোহী–ওহ আচ্ছা জেনেশুনেই তাইলে মাহফুজ ভাইয়ের চক্করে পড়ছো! মনু বরিশালে যাইবা?

পাখি– তুই মানুষ হবিনা।ঘুরাইপ্যাঁচাই এর কথা তোর আনতেই হবে। অন্তরা তুই বলবি কোথায় যাবি নাহয় এখানে চুলাচুলি হয়ে যাবে আরোহীর সাথে।

অন্তরা যেন এখানে ছিল না। আনমনেই বললো, আমি কই যাবো? এই পৃথিবাটা এখন ভয়ঙ্কর লাগে,,,

পাখি চুপ করে যায়। অন্তরাকে দেখলে আজকাল ওর বুক ভার হয়ে আসে। প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কেমন মিইয়ে গেল। কিভাবে ওকে ঠিক করবে ওরা বুঝে পায় না।


অনীলের আজকাল সবকিছু অসহ্য লাগে। অফিস থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লার সবাই অন্তরার খবর নিতে আসে। সহানুভূতির নামে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঘটনার বিবরণ শুনতে চায়। কিন্তু অনীলের গাম্ভির্যতায় তারা বেশিক্ষণ ঘেঁষতে পারেনা। তবে সবার চাপা গুঞ্জন ঠিকই তার কানে আসে। অনীল কত শখ করে সবাইকে মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে না দিলেই ভালো হতো, দেওয়াতেই সবাই আরো বেশি জেনেছে। তখন কি ভেবেছিল তার একমাত্র মেয়ের জীবনে এমন কলঙ্ক আসবে যাতে মুখ লুকোতে হবে সমাজ থেকে? মাঝেমধ্যে মনে হয় অন্তরা মরে গেলেই ভালো হতো। আচ্ছা মরে গেলেও কি সবাই রোজ এভাবে এসে জিজ্ঞাসা করতো? পরক্ষণেই অনীল ভাবে, সে আসলেই অমানুষ বনে গেছে। অবচেতন মনে কেমন নিষ্ঠুরের মতো সন্তানের মৃত্যু কামনা করছে! সমাজ তো তখনো পিছু ছাড়তো না,, না না অনীল নিজের জঘন্য মস্তিষ্কের কথা আর ভাবতে চাইছে না। আচ্ছা তার কি উচিত ঢাকা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া? পৈতৃকনিবাসেও যাওয়া ঠিক হবেনা তারচেয়ে বরং এমন শহরে যাওয়া উচিত যেখানে কেউ তাকে চিনবেনা,,, এতো কিছুর মাঝেও স্বস্তি নাহিদের পরিবার এখনো অন্তরাকে পুত্রবধূ করতে রাজী আছে। এই মত বদলানোর আগে বিয়েটা দিতে পারলে শান্তি লাগতো। কিন্তু ওমর যেভাবে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে অনীল এখন কিছুই বলতে পারেনা। একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা কেমন করে সব উলোটপালোট করে দিলো! যে সংসারে তার মতের বাইরে কিছু হয়নি সে সংসারে সে এখন নিরবদর্শক। অন্তরা কেন তার মুখদর্শন করতে চায়নি তা জিজ্ঞাসা করার বা জানবার চেষ্টাও সে করেনি। সে নিজের কৃতকর্মের মুখোমুখি হতে চায় না। সে মানতে নারাজ সে পাপী, যদিও বিবেকের দহনে টিকে থাকতে পারেনা। রোজ রাতে দু চারটা পিল নেওয়া ছাড়া চোখজোড়া এক হয় না। অতীতের সবযেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে মনে খুঁজতে থাকে সেই কার্লপ্রিটকে।
_________
অফিস থেকে ফেরার পর ওমর বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সারাদিনের পরিশ্রমের প্রভাব দূর করে, মেজাজ স্বাভাবিক করে তারপরই অন্তরার রুমে যায়। কিন্তু আজ অন্তরাকে তার রুমে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলো বটে। প্রায় ৩মাস পর অন্তরা নিজ রুম থেকে বের হয়েছে।
–কি রে কিছু বলবি?
অন্তরা মাথা নিচু করে বললো, ভাইয়া ফ্রেশ হয়ে নে তোর সাথে জরুরি কথা আছে।
ওমর মুচকি হেসে পাশে বসে বলল, আগে শুনি শেহজাদীর ফরমায়েশ কি? রাজ্যের বাকি কাজ পরেও সামলানো যাবে।
–ভাইয়া আমি খাগড়াছড়ি চলে যাবো। ওখানকার একটা হাইস্কুলে আমি এপ্লাই করেছিলাম, আজকে রেজাল্ট দিলো।

ওমর খানিকক্ষণ ভেবে বললো, নাহিদ কে রিজেক্ট করছিস তাহলে?

–ওকে রিজেক্ট করার মতো যোগ্যতা তোর বোনের আর নেই। তবে এটাও সত্যি আমি এই সম্পর্কে জড়াতে চাইছিনা,,,,,
ভাইয়া আমাদের বিয়ের সব এরেঞ্জমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। ওর আমার দুজনের পরিবারের সকলে উপস্থিত ছিল। আর যা ঘটেছে কারোই অজানা নেই। হয়তো নাহিদ বা তার বাবা-মা আমায় মেনে নিয়ে কিছু বলবেনা কান্তু আত্মীয়দের এড়ানোর উপায় আছে? আমি চাই না আমার চেনাজানাদের বিশেষ করে এই ঘটনা যারা জানে তাদের মুখোমুখী হতে। এতে তুই আমায় ভীতু ভাবতে পারিস। আসলেই তোর বোন ভীতু। তবুও আমি এই বিয়ে করবো না,,,

ওমর প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, খাগড়াছড়ি কোথায়? আর একা থাকবি ওখানে?

–মাটিরাঙা উপজেলায়। একা না মনসুরা খালাকে নিয়ে যাবো সাথে। উনি বলেছেন আমার সঙ্গেই থাকবেন।

— একটা অচেনা জায়গায় যাওয়াটা রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না?
— আমার জীবনে আর কি নিয়ে ভয় পাচ্ছ? যা হারানোর তা তো হারিয়েছেই তাও চেনা শহরেই,,,
ওমর চুপ করে গেল। অন্তরা যে পণ নিয়ে এসেছে ওখানে যাবেই তাকে আর যুক্তি দিয়ে আটকানো যাবে না।
— বাবা-মাকে বলেছিস কিছু?

–মাকে বলেছি। উনি রাজী নন। উনি চাইছেন নাহিদকে বিয়ে করে যেন নিউইয়র্ক চলে যাই, ঐটাই নাকি বেস্ট হবে।
— পরিবার কিংবা সমাজের দোহাই দিয়ে ছেলেটার মন ভাঙছিস না তো? ও তোকে ভালোবাসে, অন্যরা কি বলবে সেটা ভেবে ওকে এড়ানো ঠিক হচ্ছে?
— ও আমায় ভালোবাসে বলেই ওর থেকে পালাচ্ছি ভাইয়া। ইনফ্যাক্ট তোমরা যারা যারা আমায় ভালোবাসো তাদের সবার থেকে বাঁচতেই দূরে যাচ্ছি। আমার ভালো লাগেনা এসব। তোমরা তোমাদের জীবনের গতি থামিয়ে আমার পেছনে পড়ে আছ। এইসব আমার গলায় কাটার মতো বিঁধছে। আমি এখানে থাকলে মরেই যাবো। প্লিজ ভাইয়া আমাকে ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। আরেকটা কথা আমার ঠিকানা নাহিদকে দিবা না। আমি ওকে চিঠি লিখে দিয়ে যাবো। ও যেন আর ফ্লাইট ক্যান্সেল না করে,,,
ওমরের মনে হলো তার দুষ্ট চঞ্চল বোনটা হুট করে বুঝদার হয়ে গেছে।কেমন করে ধীর অথচ শক্ত গলায় জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত বলছে। এটা কি সেই মেয়েটা যে নিজের পছন্দের কিছু কোনোমতেই হাতছাড়া করতো না। কিন্তু ওমন পাহাড়ী অঞ্চলে বোনকে একা পাঠানোর সাহসও তার হচ্ছে না। এই মুহূর্তে কি করা উচিত তার?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here