অনূসুয়া ২

0
464

#অনূসুয়া
#পর্ব২
#রাউফুন

সময়টা ২০১৩!
মা বাবার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করে সুসমা। বাবা মায়ের বরাবরই বাধ্য মেয়ে একবারও পাত্রর সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেনি পর্যন্ত। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই তাকে বিয়ে দেওয়া হলো। অত্যন্ত সুন্দরী হওয়াই স্বাভাবিক ভাবে অনেক বিয়ের ঘর আসতে থাকে। সেভাবেই একদিন রাশেদের পরিবার তাকে দেখতে আসে। মেপে মেপে কথা বলা মেয়েটা পুতুলের মতো বিয়েতে বসে গেছিলো বাবা মায়ের কথায়।

বিয়ের পর যখন সে শশুর বাড়িতে পৌঁছায়, তখন দেখে তার শ্বশুর বাড়ির টিন সেটের একটা ঘরের দুটো রুম। একটা ঘরে তার দেবর আর ননদ থাকে। ননদ টার বয়স চোদ্দ আর দেবর টার বয়স দশ বছর। অন্য যে রুমটা সেটাতে শ্বশুর শাশুড়ী থাকে। সেই ঘরে দুটো চৌকি। যে ঘরে শ্বশুর শাশুড়ী থাকে সেই ঘরে বিয়ের রাতে একটা চৌকিতে তাদের থাকতে দেওয়া হলো। সুসমা নতুন বউ, সে কিভাবে কিছু বলবে? মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। রুমের মধ্যেই দুই চৌকি রাখা। মাঝখানে একটা কাপড়ের পর্দা টানিয়ে সেখানেই থাকতে দেওয়া হলো নতুন দম্পত্তিদের। তার শ্বশুর অবশ্য একবার বলেছিলো, ‘ হেগো প্রজা, আজ বরং রিয়া আর মিথুন এই ঘরে থাকুক। রাশেদ আর নতুন বৌমাকে ঐ রুমে থাকতে দেওয়া হোক।’

‘তুমি এসব কি বলো রাশেদের বাপ? আমার ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে এই খটখটে চৌকিতে থাকবে? ওঁদের ঐ ঘরের খাট ছাড়া ঘুম হয় না জানো না? তুমি চুপ থাকো একটা কথাও বলবা না। বেশি দরদ দেখালে যাও বাইরে গিয়ে ঘুমাও!’

সুসমা বুঝে গেছিলো তার শ্বশুরমশাই শাশুড়ী মাকে ভীষণ ভয় পাই। তাই আর দ্বিতীয় কোনো কথা বলতে পারেনি। ওমন দাম্ভিক আর রুঢ় আচরণের সঙ্গে সে প্রথম বারের মতো পরিচিত ছিলো। তার শ্বশুর শুধু রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলেন, ‘তোমার লজ্জা না থাকতে পারে কিন্তু আমার লজ্জা আছে প্রজা! তাই আমি এই রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। এই বাড়িতেই আমি থাকবো না।’

‘হুহ্ হ্যাঁ যাও যাও!’

সুসমার খারাপ লাগছিলো এই রাতের বেলায় এমন ভাবে শ্বশুর মশাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াতে। কিন্তু সেও লজ্জায় নুইয়ে গেছিলো। সেই মুহুর্তে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিলো না। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ওঁর মনে হচ্ছিলো মাটি ফাঁক করে তার মধ্যে ঢুকে পরতে।

তার আর রাশেদের বিয়েটা হয়েছিলো সম্পুর্ন ঘরোয়া ভাবে। তাছাড়া সে শুনেছে রাশেদের কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। শুধু একটা মামা আছে তারা থাকে শহরে। তারা আসতে পারেন নি বিয়েতে কোনো বিড়ম্বনার জন্য। শাশুড়ীর ব্যবহারে হ্রদয় ছলকে উঠেছিলো সুসমার। কান্নারা ছিটক বেরিয়ে এসেছিলো তার। মাথা নত করে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না তার।

পরদিন সকালে সেকি লজ্জা সুসমার৷ শ্বশুর শাশুড়ীর ঘরে কিভাবে ওঁদের থাকতে দিলো? অন্যরুম টাতেও তো থাকতে দিতে পারতো একটা দিন? রাশেদও মায়ের মুখের উপর কথা বলেনি। বরং নির্লিপ্ত ছিলো পুরোটা সময়। রাশেদের মধ্যে কোনো রকম ভাবান্তর লক্ষ্য করেনি সুসমা। সে বুঝে গেছিলো রাশেদ মায়ের উপর কথা বলে না। সে নতুন বউ তার সঙ্গে ভালো ভাবে দুটো কথাও বলেনি রাশেদ। অথচ রাতে নিজের শরীরের খিদেটা ঠিকই মিটিয়েছেন। তাকে নিয়ে এমন খামখেয়ালি পোনা কেন? রাতে তার কাছে রাশেদকে নরপশু লাগছিলো।

মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলো বাবা মায়ের উপর সুসমা। তার জন্য যখন এই বাড়ি থেকে সম্বন্ধ নিয়ে যাওয়া হয় তখন বলা হয়েছিলো তার বাবা মাকে, দু-তালা বাড়ি আছে রাশেদদের। তার বাবাও খোঁজ নিয়ে জানেন বাড়িটা রাশেদের নিজের। রাশেদ ভালো একটা চাকরি করে। সবদিক থেকে ভালো পেয়ে এমন সুপাত্র হাত ছাড়া করতে চাইনি সুসমার গরীব বাবা রহিম মিয়া। অথচ এই বাড়িতে এসেই বিয়ের রাতেই সে এই চরম সত্যি জেনে গেলো। রাশেদরা তাদের থেকেও অনেক বেশি গরীব। ঠিক আছে মানুষ গরীব হতেই পারে তাই বলে মিথ্যা বলবে একটা পবিত্র সম্পর্ক শুরু আগে?

কল ঘরে যখন সকালে গোসল করতে গেলো সুসমা তখনই বাঁধলো আরেক বিপত্তি। কল ঘরের এক পাশে টিন দেওয়া আর বাকি তিন পাশে সম্পুর্ন খোলামেলা। সে অত্যন্ত অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো৷ ফজরের আজান পরেছে অনেকক্ষণ। সে সময় তার শাশুড়ী ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে নতুন বউ কাপড় চোপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে তখনও রাশেদ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলো। তার শাশুড়ী নাক ছিটকে বললো,

‘হে গো বৌ এই তোমার আক্কেল জ্ঞান? চৌকির চাঁদরটাও তো ধুয়ে দিতে হবে সে খেয়াল নেই? আর তোমার শ্বশুর এই এলো বুঝি অজু করতে! তুমি নতুন বৌ, তারাতাড়ি গোসল করে নিবে। তা না সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছো! লাজ লজ্জা কি সব ভুলে গেছো? বাপ মা লজ্জা দিয়ে প*** করেনি?’

সুসমার কলিজায় লাগলো কথাটা৷ বিয়ের একটা রাতও পেরোলো না শাশুড়ীর বাপ মা তুলে এমন কটুবাক্য শুনে তার দিনটা শুরু হলো? ভেতরটা ভীষণ ভাবে দগ্ধ হচ্ছিলো তার। সে বুঝে গেলো এখান থাকতে হলে তাকে একেকটা দিন নরক যন্ত্রণা সয়ে থাকতে হবে। শাশুড়ী মায়ের বলা কথায় তখন খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিলো,’ আপনাদের কেমন আক্কেল মা? ছেলে আর নতুন বউকে নিজেদের ঘরেই থাকতে দেন?’ মুখের কথা মুখ থেকেই পেটে চালান করলো সে। মাথা নত করে বললো,

‘মা, এই গোসলখানার তো ভালো করে ঘেরাও করা নাই। এখানে কিভাবে গোসল….!’

‘এই থামো, তুমি তো দেখছি আসলেই বেহায়া। এমন বেহায়া মেয়েকে আমার ছেলের যে কেন এতো মনে ধরলো আল্লাহ মালুম। এখানেই গোসল করতে হবে। বেশি ফ্যাচাং ফ্যাচাং না করে তারাতাড়ি কল ঘর থেকে বের হও! আর বিছানার চাঁদর কেঁচে দাও। বাসি চাঁদর বিছানায় রাখার নিয়ম নাই আমাদের বাড়িতে।’

সে কথা মতো ঘরে গিয়ে চাঁদর উঠাতে গেলো৷ দেখলো রাশেদ উপর হয়ে শুয়ে আছে। গায়ের কাথাটা পিঠ থেকে সরে কোমড়ের উপর ঠেকেছে। সে আস্তে আস্তে চাঁদর টেনে বের করতে চাইলো৷ তখনই রাশেদের ঘুম ভেঙে গেলো। কড়া কন্ঠে বললো, ‘রাতে ঘুমাতে পারিনি, আর সকাল সকাল চাঁদর টানাটানি শুরু করেছো? আশ্চর্য ঘুমাতে দিবা না হ্যাঁ?’

সুসমা ভয়ে ঢুক গিলে বললো, ‘মা বললেন বাসি চাঁদর ধুয়ে দিতে হবে তাই…!’

মায়ের কথা শুনে বিরক্ত হলেও চাঁদর নিতে দিলো সুসমাকে। সুসমা বললো, ‘এমন গোসল খানায় গোসল করতে অস্বস্তি হচ্ছে আমার। আপনি কিছু করবেন একটু? আপনি যদি দাঁড়িয়ে থাকেন বাইরে তাহলে একটু ভালো হয়।’

তা শুনে রাশেদ বললো, ‘এই জন্যই মানুষ বলে বিয়ের পরই সব কিছু বিতৃষ্ণা হয়ে যায় বউরা ঘরে এলে। সক্কাল সক্কাল মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছো! আজকের মতো সবটা সামলে নেও। এরপর তো ঢাকায় যাবোগা তোমারে নিয়ে।’

সুসমার দু চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পরলো। এ কোন নরকে তাকে তার বাবা মা পাঠালো? হ্যাঁ তারা গরীব। ওতো বড়লোক ঘরে তার বিয়ে হতো না। কিন্তু এরকম নিম্নবর্গের একটা ফ্যামিলিতে তার বিয়ে হলো ভাবতেই পারছে না সে। এতোটাই অভাগী বুঝি সে? সে কোনো রকমে গোসল করে ঘরে আসলো। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে সে। এরকম বিপাকীয় অবস্থায় বিয়ের পরদিনই পরতে হবে সে কি কল্পনাতেও ভেবেছিলো?

মাথার গামছাটা খুলে বাইরে নাড়তে আসলো সে। কাপড় নাড়ার বাশটা কেমন কালচে হয়ে গেছে। তখনই সুসমার শাশুড়ী এলো। বলল, ‘বৌ আসো রান্না ঘরে। রাশেদ আবার সকাল সকাল খাবার না পাইলে রেগে যায়।’

সে শুনেছিলো রাশেদ একটা ওষুধ কোম্পানির চাকরি করে ঢাকায়। তাকেও ঢাকায় নিয়ে যাবে রাশেদ। এই কটা দিনই কষ্ট করতেই হবে।

‘তা বৌ রুটি বেলতে পারো তো?’

‘আপনি শিখিয়ে দিলে পারবো মা!’

‘আয় হায় কথা শুনে তো মনে হচ্ছে কিছুই পারো না। পুঁড়া কপাল আমার। আসো, এখন আমাকেই সব করতে হবে! নাহলে যাও, কিছু তো পারোই না, হুদাই রান্না ঘরে থেকে কি করবা!’

সুসমা সাহস করে বললো, ‘আপনি রুটি বেলে দিলে আমি ভেজে দিতে পারবো। আমার মা রুটি বানালে আমি ভেজে দিতাম,মা অনেক খুশি হতো।’

‘থাক বাপু, জমিদার বংশের মাইয়া তুমি তোমার কিছু করতে হবে না। যাও শুয়ে থাকো গে গিয়ে!’

অগত্যা সুসমা চলে গেলো ঘরে। সে কি করবে সে তো আর বাড়িতে কাজ করেনি। তার মা তাকে কুটো টিও নাড়তে দিতো না। এখন সে কিভাবে রুটি বেলবে? অন্তত ভেজে তো দিতেই পারতো কিন্তু সেটাও তো করতে দিলো না তাকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here