অনুবদ্ধ আয়াস ৩১

0
450

#অনুবদ্ধ_আয়াস ?
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩১

নোংরা টি শার্ট গায়ে জড়ানো। বিশ্রী গন্ধে গাঁ ক্রমশ গুলিয়ে উঠছে। তবুও এই টি শার্টটা খুলতে ইচ্ছে করছে না। সাতদিন হয়েছে ধোয়া হয়না। ধুলেই রৌধিকের শরীরের তীব্রতম সুবাসটা মিলিয়ে যাবে। বাইরে ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি আঁচড়ে পড়ছে। বজ্রসহিত বৃষ্টি। অর্থাৎ কালবৈশাখী ঝড়। আমি ভারাক্রান্ত অন্তঃকরণ নিয়ে বসে আছি। রৌধিকের সাথে কথা হয়না বললেই চলে। তিনি সচরাচর ‌ফোন দেয় না। সপ্তাহ পেরিয়েছে তিনি গমন করেছেন। অফিসের বদ্ধ কার্যের মাঝে আমাকে ফোন দিয়ে দুই মিনিট কথাও বিশাল ব্যাপার। রৌধিকের পাঠানো টাকার বিনিময়ে বাড়ি ছাড়ানো হয়েছে ব্যাংকের থেকে। আগামীকাল থেকে বাড়িতে ফিরে যাবো।

হুট করেই বৃষ্টিস্নাতে সর্বাঙ্গে লেপ্টাতে স্পৃহা প্রকাশ পেল। আমি দ্রুত ছাদে চলে গেলাম। বর্ষন ধারা প্রখর হল। আর্দ্র মেঝেতে পা স্পর্শ করতেই কম্পিত হল দেহ। বৃষ্টির ধাঁচ ভিজিয়ে তুলল আমায়। আমি মাটিতে আসন পেতে বসলাম। রৌধিক নেই, আমার প্রাণটাও যেন নেই। যাওয়ার পূর্বে স্মৃতিগুলো এতোটা প্রখর করেছেন, যে মুহুর্মুহু তাকে অনুভব করছি। আমি নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টির ফোঁটা সরাসরি পতিত হল মুখশ্রীতে। কতক্ষন ওভাবে শুয়ে ছিলাম জানিনা। যখন চোখ মেললাম তখন নিজের অস্তিত্ব সিলিং ফ্যানের নিচে উপলব্ধি করি। আমাকে কেন্দ্র করে রয়েছে সকলে। এখানে আসার কারণটা বোধগম্য হল না। আমার পিটপিট করা নেত্র দেখেই মা বললেন,

“জোনাকি ঠিক আছিস তুই? কী হয়েছিল তোর মা? ছাদে গিয়েছিলিস কেন? ওভাবে পড়ে ছিলিস কতটা ভয় পেয়েছিলাম, জানিস?”

“মা, চুপ করবে তুমি। মেয়েটা সবে চোখ মেলেছে ইতোমধ্যেই তুমি শুরু করে দিলে। দিলে তো দিলে একসাথে এতগুলো প্রশ্ন।”

মা নিশ্চুপ আদ্রিতার কথায়। গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। গলাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে শুধালাম, “পানি, পানি খাবো।”

তৎক্ষণাৎ আদ্রিতা পানির গ্লাস দিয়ে নিজেই পানি পান করতে সহায়তা করেন। নিজের দিকে অবলোকন করতেই দেখতে পারলাম ব্লাঙ্কেট দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে আমায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে আছি। নিশ্চয়ই জামা কাপড় চেঞ্জ করেছে, তাহলে রৌধিকের কি শার্টটা কোথায়? পরক্ষণেই বিচলিত হলাম।

“আমার পড়নের টি শার্ট কোথায়?”

“কেন ওটা পড়তে ইচ্ছে করছে, তাহলে পড় গিয়ে। ব্যালকেনিতে মেলে রেখেছি। নিয়ে আসব?”

মুখ কৃষ্ণের ন্যায় কালো করে রইলাম। আমি জানি আদ্রিতা আপু আমাকে বিদ্রুপ করছেন। মা তো বলেই দিয়েছে, রৌধিককে ফোন করে আমার বর্তমান অবস্থার কথা জানাবেন। একবার রৌধিকের কাছে খবর পৌঁছে গেলে অবিলম্ব এসে হাজির হবেন তিনি। আমি অনেক জোর করে অবশেষে ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা দিলাম।
___
এভাবে গড়িয়ে গেল মাসখানেক। নিজের মনমর্জি চলছি। চারিদিকে সবকিছু বিষাদ পূর্ণ রৌধিকহীনা। দূরে থাকলেও সর্বদা তিনি আমার মনে বিরাজ করেন। আমাকে সর্বদা হাসিখুশি রাখতে আদ্রিতার বিয়ের তোড়জোড় করছেন। আজ আদ্রিতা আপুর শপিংয়ে নিমিত্তে বেরিয়েছে সবাই। আমাকে শতবার বলার সত্বেও যাইনি। এত আনন্দময় পরিবেশের মাঝে মন কষাকষি সর্বদা থাকে। আমার মনে শান্তি নেই, খাওয়াতে অনিয়ম না হওয়ার সত্তেও শরীরটা ক্রমাগত মন্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মাথা সর্বদা ধরে থাকে। উগ্র মেজাজের সঙ্গি আমি। হ্যাঁ। বলাই তো হল না, আমরা এখন আমাদের বাড়িতে থাকি। আজ একটু বেশিই মন খারাপ। নিদ্রা ভঙ্গের পর থেকেই মনের মাঝে কু ডেকে চলেছে।
সেদিনই পরই ঐবাড়ি থেকে চলে এসেছি। এরমাঝে ঘটে গেছে অন্যরকম একটা ঘটনা। একটা খবর বদলে দিয়েছে আমায়।

এইত সেদিনের কথা, আদ্রিতা আপু তৈরি হচ্ছিল। তার সাজ অন্তের পথে। ইয়ানাত আপু সাজিয়ে দিচ্ছেন আদ্রিতা আপুকে। আমিও একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পড়েছি। তেমন সাজ নেই। নিচে সকলে বসে খোষ গপ্পে মেতেছিল। ডাক পড়ল মিতা আন্টির। ইয়ানাত আপু ধরে ধরে নিচে দিকে অগ্রসর হলেন। আমি পা বাড়ানোর পূর্বেই ফোন বেজে উঠল। আমি চরণজোড়া স্থির করে হাতে রক্ষিত ফোনের দিকে চাইলাম। রৌধিক ফোন করেছেন। মুহুর্তেই হাসির রেখা ফুটে উঠল। চটজলদি ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশের উগ্র কণ্ঠে বলে,

“সমস্যা কী তোমার? লাইনে এসো জলদি।”

আমি ইন্টারনেট কানেকশন অন করতেই কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। একের পর এক ম্যাসেজ। কল আসছে। তৎক্ষণাৎ তুমুল শব্দে ফোন বেজে উঠল। আমি ফোন রিসিভ করলাম না। ভিডিও কল ছিল। কেটে গেল। পরক্ষণেই ভয়েজ এলো রৌধিকের। বাজখাঁই কণ্ঠে বলেছেন,

“ফোনের টাকা কী তোমার শ্বশুর দেয়? ধরছ না কেন?”

পুনরায় কল বেজে উঠল। আমি ধরফরিয়ে রিসিভ করলাম। টেনে হাসলাম।

“একটা ফোন রিসিভ করতে কতক্ষন লাগে?”

“সে যাই হোক। টাকা কিন্তু আমার শ্বশুরই দেয়।”

“হোপ। একদম চুপ। তোমার শ্বশুর কী গাছ লাগায়? লাড়া দিবে আর ঝড়বে? আমি দিনরাত পরিশ্রম করি, বুঝছ?”

“সে যাই হোক, আমার জামাইয়ের টাকা আমি নষ্ট করি। আপনার তাতে কী?”

রৌধিক ফোনের ওপাশ থেকে এক গাল হাসলেন। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলেন, শাড়ি পাল্টে নিতে।‌ আমাকে না-কি আজও শাড়ি পড়ে ফুটবলের মত লাগছে। পাক্কা দশ মিনিট সময় দিলেন, পাল্টে নেওয়ার জন্য। খবরদার বলেছেন। সরাচার খবরদার শব্দটি উচ্চারিত করেন না। তবে ইদানিং করছেন। একেই তো শরীর ভালো লাগছে তার উপরে তার আদেশ। আমি দ্রুত রুমে গিয়ে একটা থ্রী পিস বের করে‌‌ পড়ে নিলাম। কাঁটায় কাঁটায় যখন দশ মিনিট অতিবাহিত হল, এক সেকেন্ডও এদিক ওদিক নড়াচড় নয়। তখনই ফোন করলেন রৌধিক। ফোন নিয়ে নিচে যেতে বললেন।

বিলম্বে তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। আমি দ্রুত মুখ চেপে ধরলাম। রৌধিক চ্যাঁচিয়ে উঠলেন, “ওয়াট হ্যাপেণ্ড জোনাকি? কী হয়েছে?”
প্রতুক্তি দেওয়ার ন্যায় শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। আমি ফোনটা ফেলে ওয়াশরুমে ছুটলাম। লহমায় বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। মাথা ঘুড়ছে, তবে একটু ভালো লাগছে। ট্যাপ খুলে কুলি করলাম। মাথায় পানি দিলাম। অতঃপর পরিষ্কার করে ঘরে ঢুকলাম। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে নিলাম। এখনও রৌধিক কলে আছেন। আমাকে দেখেই জোনাকি জোনাকি বলে ডেকে উঠলেন। আমি ফোনের কাছে যেতেই ধমকে উঠলেন তিনি!

“খাওয়া দাওয়া করো না তুমি। শরীর দুর্বল লাগছে নিশ্চয়ই। বমি হয়েছে?”

“হম। তবে এখন ঠিক আছে।”

“আমি ওখানে থাকলে ঠিক থাকতে পারতে না। চড়িয়ে তোমার দাঁতগুলো ফেলে দিতাম।
কিছু খেয়েছ?”

“হম। তাহলে কেন এমন হল? পেইন কিলার আছে?”

না বলতেই ধমকে উঠলেন তিনি। পেইন কিলার কেন নেই হ্যান ত্যান ইত্যাদি ইত্যাদি। আবারও দশ মিনিট সময় দিয়েছে। লাইনে রেখেছেই মায়ের কাছে গিয়ে ফোনটা দিতে হবে। যা বলার তিনিই বলবে। আমি মুখ গোমড়া করে অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকটায়। সম্পূর্ণ পথ অতিক্রম করতে ব্যর্থ হলাম। কিছুদূর যেতেই মাথা ঘুড়ে উঠল প্রচণ্ড। সিঁড়ির রেলিং ধরলাম ফটাফট। অন্ধকার দেখছি সবকিছু। রেলিং মাথা ঠেকিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস টানলাম। অতঃপর জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমারে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা। কেউ কিছু বলছে না। নিশ্চিত মুখশ্রী প্রত্যেকের। ইভু হেসে বলে,
“সুখবর টা আগে কাকে দিতে চাও? নিজের পরিবারকে না-কি রৌদুকে?”

“মানে!” মিনমিনে গলা আমার।

“এই, আমি মামা হতে চলেছি!”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম আমি। তার মামা হওয়ার সাথে আমার সম্পর্ক কিসের? পরক্ষণেই মস্তিষ্কে এসে হানা দিল। আমি মাথানত করে রইলাম। বড়রা আশির্বাদ করলেন। আদ্রিতা আপু তো চূড়ান্ত খুশি। একই দিনে দু’টো খুশির খবর। আমি শুধু পেটে হাত রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে বসে ছিলাম। কার্নিশ গড়িয়ে জলকণা গড়াল। অনুভূতিরা পূর্ণতা পেল। আচ্ছা রৌধিক তিনি জানলে খুশি হবেন তো! নিশ্চয়ই হবে। তবে আমি তাকে বলব না, একদম বলব না। আমি স্বচোখে দর্শন করতে চাই।

“প্লীজ আপনারা কেউ ওনাকে কিছু বলবেন না। তিনি দেশে ফিরলে আমি বলব।”

“কিন্তু ভাইয়া ইতোমধ্যে অনেকবার ফোন করেছে। কী বলব তাকে।”

প্রতুক্তি করলাম না। সেদিনের পর থেকে নিজের প্রতি যত্নটা হাজার গুণ বেড়ে গেছে। রৌধিককে সময় দেওয়া কমে গেল। হুট করে বদলে যেতে শুরু করলাম। বাড়ির সকলে একটু বেশিই যত্ন নিতে শুরু করেছে।
.
.
বর্তমানে আমি ফোনে গেমস খেলছি। রৌধিকের সাথে কথা হয়নি। তিনি জানেন না, আমার প্রেগন্যান্সির কথাটা। হুট করেই ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার দেখে রিসিভ করলাম না। আমার বেজে উঠল। আমি দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করতেই মহিলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

“এটা কী রৌধিকের ওয়াইফের নাম্বার?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?”

“আমি হসপিটাল থেকে বলছি। রৌধিক নামক একজন যুবক হসপিটালে ভর্তি আছেন। আমি তার ফোন থেকে নাম্বার কালেক্ট করে ফোন দিয়েছি।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here