অনুবদ্ধ আয়াস ২৭

0
437

#অনুবদ্ধ_আয়াস ?
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৭

“আচ্ছা, এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা একটু রোমান্টিক হলে কোনো দোষ হবে জোনাকি? আজ বড্ড বেহায়া হতে ইচ্ছে করছে। কেন এমন হচ্ছে, একটু বলতে পারবে? আচ্ছা তোমার কী হচ্ছে না।”

বলেই মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরিয়ে ফেললেন। লহমায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি ধারা পতিত হলো মুখশ্রীর উপর। ঘনঘন পলক পড়ল চোখের। হিম ধারায় লোমকূপ দাঁড়িয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। চটজলদি রৌধিকের ছাতা ধরা হাত স্পর্শ করলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম,
“কী করছেন? ভিজে যাচ্ছি তো!”

“কী হয়েছে তাতে? একদিন একটু ভিজলে দোষের কী?”

“জামা কাপড়গুলো ভিজে যাচ্ছে যে, আন্টি রাগ করবে!”

পরক্ষণেই বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সাহায্যে হাতে রক্ষিত জামা কাপড় গুলো কেড়ে নিলেন। অন্য হাতে মুঠোয় ছাতাটা গুঁজে দিলেন। অতঃপর জামা কাপড় নিয়ে ধাবিত হলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অপেক্ষায় মাশগুল।‌ পরক্ষণেই অন্তঃকরণে হানা দিল, তিনি নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। তখন তার সামনে হাঁটা সম্ভব হবে না। তাই ধীরে ধীরে হাঁটার প্রয়াস করলাম। তৎক্ষণাৎ রৌধিক জামা কাপড় রেখে উপস্থিত হলেন। হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন অদূরে। হাত ধরে ঘুড়াতে লাগলেন। দৃঢ়ভাবে মাটিতে বারবার পা করার নিমিত্তে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছি। তবুও হাসার চেষ্টা করছি। ধীরে ধীরে পায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই রক্ত দেখতে পেলাম। পানির সাথে বয়ে চলেছে। কী করা উচিত ভুলে গেলাম। যখন তখন রৌধিকের দৃষ্টি সেদিকটায় যেতে পারে। তখনই প্রশ্ন করবে। কী উত্তর দিবো আমি।

পড়নের ওড়নাটার সাহায্যে রৌধিকের মুখ ঢেকে দিলাম। পানি মুছতে মুছতে বললাম,

“চলুন না, অন্য একদিন ভিজব। শরীরটা ভালো লাগছে না।”

রৌধিক বিচলিত হলেন। ওড়নাটা সরিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ” কী হয়েছে জোনাকি? বলো আমাকে। প্লীজ বলো। শরীর খারাপ লাগছে।”

“চলুন না।”

“ঠিক আছে, চলো।”

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রৌধিক কিছুদূর গিয়ে ফিরে এলেন। ডানহাত ধরে কৌতূহলী স্বরে বললেন, “কী হয়েছে বলো তো। ভিজবে না বলছ, আবার যেতেও চাইছ না। ব্যাপার কী?”

“কোলে নিন না।” আদুরে আবদার।

ভ্রু কুঁচকালেন রৌধিক। রৌধিক তোয়াক্কা করলেন না। হাত ধরে টান দেওয়ার প্রয়াস করল। দু’পা ফেলতেই চোখ মুখ কুঁচকে গেল। সন্দিহান চোখে অবলোকন করলেন। হুট করেই নিচের দিকে চাইলেন তিনি। হাঁটু গেড়ে বসলেন। ডানপা হাঁটুর উপর তুলেন স্বযত্নে। স্পর্শ করলেন পায়ের পাতা। দাঁতে দাঁত চেপে ধরলাম। কেঁপে উঠলাম। কিয়ৎক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“কী হয়েছে তোমার পায়ে? চুপ! মিথ্যা একদম বলবে না। বলতে ইচ্ছে করলে বলবে, নতুবা নয়।”

গম্ভীর কণ্ঠে শাসালেন। থমকে গেলাম আমি। তার কণ্ঠ অতিশয় সরল হলেও আমার সমীপে সরল লাগল না। মিনমিনে স্বরে বললাম,

“ও ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমে পা স্লীপ করে পড়ে গেছিলাম। দেখতে পাই..

রৌধিকের শক্তপোক্ত হাতটা আমার গালে বিকট শব্দে বিচরণ করল। পুড়ে উঠল জায়গাটায়। তবে ব্যাথাটা তিক্ষ্ম হলো না। বৃষ্টির পানির নিমিত্তে শব্দ হলো একটু জোরে। থেমে গেল কথন। ঈষৎ ফাঁক হওয়া ওষ্ঠদ্বয় পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্নই রইল। সেকেন্ড খানেকের নিমিত্তে চোখের পলক থমকাল নিঃশ্বাস টানলাম। রৌধিক চোখ রাঙালেন। আমি মাথানত করলাম। বুকে হাত গুজলেন তিনি। ললাটে সরু ভাঁজ ফেলে ত্যাঘা গলায় বললেন,

“থামলে কেন? বলো। শুনি কত মিথ্যা বলতে পারো।
সাহস কী করে হয়, একবার বারণ করার সত্বেও মিথ্যা বলছ। এখন তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে, ওয়াশরুমে পড়ে গেলে ব্যাথাটা কেমন হয়।”

পরবর্তীতে মিথ্যা বলার দুর্সাহস হলো না। ততক্ষণে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি উভয়েই। রৌধিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছু মুহূর্ত। অতঃপর কোলে তুলে নিলেন। একদম ড্রয়িং রুমে এসে থামলেন। মিতা আন্টি, মা আর ইয়ানাত উপস্থিত ছিল শুধু। আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলেন। টি টেবিল টেনে পা রাখলেন উপরে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমরা দেখে বলো তো, এটা কীভাবে হয়েছে? জোনাকি তো বলছে, ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে এমন হয়েছে। তোমাদেরও কী তাই মনে হচ্ছে?
স্লীপ করে পড়লে কালচে দাগ পড়বে, নতুবা ভেঙে যাবে। এমন খাদ খাদ কী হবে?”

রৌধিক নির্বিকার দৃষ্টিতে ইয়ানাতের দিকে চেয়ে বলেন। মিতা আন্টি বসলেন। পায়ের জখমে হাত বুলালেন। বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। মুখ তুলে বললেন, “সূচালো কিছু ঢুকেছিল নিশ্চয়ই। লাইক সেফটিপিন, সূচ, আলপিন। তবে এত আঘাত কেন পাবে?
ইচ্ছে করে এমনটা কেউ করেছে।”

মিতা আন্টির বিচক্ষণতার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ইয়ানাতের দিকে। আমাকে সহ্য করতে পারে না, এটা নতুন কিছু নয়। গম্ভীর গলায় বললেন,

“ইয়ানাত, এটা কী তুমি করেছ?”

“আমি কেন করব..

“স্টপ। হ্যাঁ অথবা না। আমি ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে কথা পছন্দ করি না।”

“সামান্য একটু ধাক্কার লাগার কারণে ইয়ানাতের ফোনটা মাটিতে পড়েছিল। স্ক্রিন একটু ভেঙেছিল। তাই বলে সেদিন কষে চড় বসিয়েছি জোনাকির গালে।” রৌধিক সোজাসাপ্টা বললেন।

ইয়ানাত নিশ্চুপ। তার দৃষ্টি বিরক্তকর। নাক ফুলিয়েছে। মুখশ্রীতে বিরাগী একটা ভাব। মিতা আন্টি পরপর দুই চড় দিলেন ইয়ানাতের গালে। আমি ধরতে গেলে বাঁধা দিলেন আন্টি। স্টার্ফদের নির্দেশ দিলেন মেডিসিন বক্স আনতে। অতঃপর আন্টি সোফায় বসলেন। ইয়ানাতকে কড়া আদেশ দিলেন আমার পা ব্যাণ্ডেজ করিয়ে দিতে। যেহুতু আঘাত তিনি করেছেন তাই তাকেই ব্যাণ্ডেজ করে দিতে হবে। তিনি আমার বড়, ব্যাণ্ডেজ করাতে হলে অবশ্যই পায়ে হাত দিতে হবে। আমি না করলাম। কিন্তু রৌধিক শুনলেন না। আমাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখলেন। তার কথা একটাই, আরেকবার কিছু বলেনি বলে এবার সুযোগ পেয়েছে। এবার শাস্তি দিলে এমন করবে না।
মিতা আন্টিও সায় দিলেন। ব্যাণ্ডেজ না করে দিলে ইমতিয়াজ আমহৃদের কাছে বিচার দিবেন। ইয়ানাত তার বাবা বলতে ভীতিগ্রস্ত। তাই ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন।
_________________
আমি পায়ের উপর পা তুলে তেঁতুলের দানা চিবুচ্ছি। দানা দুটো আমার ব্যাগে পেয়েছি। শুকিয়ে শুঁটকি হয়েছে। কবে রেখেছিলাম জানা নেই। রৌধিক শাওয়ার নিতে গেছে। আধঘণ্টা হয়ে গেছে, বের হওয়ার নামই নেই। অদ্ভুত মশাই। এতক্ষণ কী করে? একে সাবানের এড করতে দেওয়া উচিত। সাবানের ‘স’ ও থাকবে না।
আমার প্রগাঢ় মানসিক উদ্‌বেগের ছেদ ঘটল মৃদু শব্দে। মস্তক উঁচু করতেই রৌধিকের বলিষ্ঠ দেহ নজর কাটল। পুনরায় মাথানত করলাম। মশাইয়ের তবে শাওয়ার শেষ হয়েছে। স্বচ্ছ দর্পণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে স্পষ্টবাদী কণ্ঠে বললেন, ” যাও, নিচে গিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে এসো।”

আমি পায়ের দিকে আশাহত দৃষ্টিতে চাইলাম। ব্যথাহত পা বিধেয় তিনি আমাকে কোলে করে এনেছেন, এখন বলছে আমাকে গিয়ে কফি বানিয়ে আনতে। আমাকে নড়তে না দেখে পুনরাবৃত্তি করলেন, “যাবে?”

আমি পা নিয়ে নিচের দিকে ধাবিত হলাম। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই কফির কাপ ধরিয়ে দিলেন মিতা আন্টি। আমি কাপ নিয়ে উপরে উঠে এলাম। উনি কাপ নিলেন ঠিকই তবে কথনভঙ্গি দেখালেন না। আমি নামক একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী এখানে আছি, তাকে দেখে মনে হচ্ছে না। হুট করেই তিনি বললেন,

“এক পায়ে নাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো!”

“মানে!” হতবাক আমি।

“এটা তোমার শাস্তি। প্রথমত আমাকে কিছু জানাও নি। দ্বিতীয়ত মিথ্যা বলেছ!
যদি কানে না ধর। তাহলে তৃতীয় শান্তি হিসেবে, কাল তোমার বাড়িতে চলে যাবে।”

আমি মুখ ভার করে কান ধরতে গেলাম। তৎক্ষণাৎ ধমকে বললেন, তিনি নাক ধরতে বলেছেন। কানে নয়। এটা তার স্পেশাল শাস্তি।
ধরলাম কানে। বেশিক্ষণ বা’পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার জোর নেই। এই ছেলেটা অদ্ভুত ধরনের। একদম বিচ্ছু। এভাবেই কাটল মিনিট বিশেক। পা ভেঙে আসছে। উনি ধীরে ধীরে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে।

আমি আদুরে গলায় বলি, “এবারের মতো ছেড়ে দেওয়া যায় না।”

“যায়, তবে একটা শর্ত আছে!”

আমি ফট করে পা নাড়িয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। উনি আঙুল তুলে পা উঁচু করতে বললেন। পেঁচা মুখ করে দাঁড়ালাম। তিনি আয়েস করে বললেন,

“শর্ত হচ্ছে। এই যে, তুমি এখন প্রতিজ্ঞা করবে আর কখনো আমার থেকে কিছু লুকাবে না। যদি লুকিয়েছ, তাহলে তোমার তুলতুলে নরম নাকটা গুলে পড়ে যাবে। তখন সবাই তোমাকে নাক পড়া জোনাকি বলে ডাকবে।
রাজি থাকলে, হ্যাঁ বলো। তবেই এই শাস্তি থেকে মুক্তি।”

ঈষৎ ফাঁক হলো ওষ্ঠদ্বয় পরস্পরের থেকে। ঘনঘন পলক ফেললাম। হাত গিয়ে ঠেকল নাকের ডগায়। এটা কেমন প্রতিজ্ঞা?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here