অনুবদ্ধ আয়াস ১৭

0
486

#অনুবদ্ধ_আয়াস ?
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭

লম্বা আঁচলটা বারবার বিরক্ত করছে আমায়। কোমরে গুঁজে নেওয়ার পরেও অহেতুক ডিস্টার্ব করছে। এই পুঁটি মাছের চক্করে তিন ঘণ্টার বেশি গড়িয়ে গেছে। বিকেলের রোদ এখন রাতের আঁধারে আবৃত হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়াতে রাস্তা ঘাট নিরিবিলি। গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটা শুধু। চিংড়ি মাছ আর সবজি কাটতে কাটতেও ঘণ্টা দুই লেগেছে। অসহায় আমি। ভিশন অসহায়। বাড়িতে এতো এতো লোকজন থাকার ফলেও কারো থেকে কোনরুপ সাহায্য নিতে পারছি না। রৌধিকের বারণ। আজ কেউ কিচেনের দিকে এক পা এগুতে পারবে না। চক দিয়ে দাগ টেনে রেখেছে।
আজকের রেসিপি ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি। পুঁটি মাছগুলো ধুয়ে ফ্রিজে রাখতে বলেছে। আমি হান্ডেট পার্সেন সিউর, আমাকে শাস্তি দিতে এই মাছগুলো নিয়ে এসেছে। ইচ্ছে করে, গাল চেপে সবগুলো মাছ খাইয়ে দিতে। অস’ভ্য ছেলে একটা।
আমি রান্না করতে ব্যস্ত। তদানীং নিজের উন্মুক্ত পেটে শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। থমকে উঠলাম আমি, ভিশন চমকালাম। কম্পন ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। খুন্তি চেপে ধরলাম আমি। হাতের স্পর্শ আরো গভীর হয়ে উঠল। গলায় উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ল। হিম হয়ে এলো দেহ। স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। ঘাড় কাত করে মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করতেই চিবুকের উপর জ্বলজ্বল করা লালচে তিলটা নজরে এলো। বোধগম্য হতে সময় লাগল না, এই মানুষটি কে। আমার পেটের উপর রাখা রৌধিকের হাতের উপর হাত রেখে টেনে টেনে বললাম,

“ক কী করছেন?”

থমথমে গলায় বলল, “কী করছি?”
পুড়ে যাওয়া গন্ধ নাকে ভেসে এলো। আমি হাতার সহায়তায় নাড়াচাড়া দিতে দিতে বললাম,

“ছাড়ুন, রান্না করতে পারছি না। তরকারি পুড়ে যাচ্ছে।”

দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলেন। অন্য হাতটা সামনে থেকে ঘুড়িয়ে কাঁধে রাখলেন। রৌধিক নিজে দুলছে সাথে আমাকেও দুলাচ্ছেন। ফোড়ন কেটে বললেন,

“সাপের মতো এতো মুচড়ামুচড়ি কেন করছ, আশ্চর্য! মানুষ রান্না করে হাত দিয়ে। আমি তোমার হাত ধরি নি। তাহলে ডিস্টার্ব করব কিভাবে।”

আমি রৌধিকের স্পর্শ উপেক্ষা করে কাজে মন দিলাম। তৎক্ষণাৎ গলায় কিছু পড়িয়ে দিলেন রৌধিক। পেটের দিকটায় শাড়ি টেনে ঢেকে দিলেন। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ” আমার একটু ছোঁয়াতেই তুমি বাঁকা হয়ে যাচ্ছ। অন্যকিছু করার চেষ্টা করলে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। নিজের জিনিস আগলে রাখতে শেখ। সেটা হোক তোমার অলংকার, হোক তোমার স্বামী।
আর হ্যাঁ, শাড়ি পড়লে অবশ্যই পেট ঢেকে পড়বে। তোমার এই রুপে, একজন সিদ্ধ পুরুষকেও তার পথভ্রষ্ট করে দিতে সক্ষম।”

“মানে..
প্রত্যুত্তর না দিয়েই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। তার কথাগুলো এখনো কানে বাজছে। এতোকথা বললেন, সবকিছু কেমন গুলিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়াশা লাগছে। নিজেকে সংযত করে আমি গলায় হাত দিলাম। একটা লকেট হাতে এলো। অনুভব করলাম অপ্রত্যাশিত কিছু। তবুও মনে হলো, এর আগেও বহুবার এটা স্পর্শ করেছি। যথারীতি হাত পা কাঁপতে লাগল। পুরোনো কিছু ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধল মনে। গুছিয়ে রাখা খালা বাসনের ভেতর থেকে স্টিলের প্লেট তুলে দেখলাম নিজেকে। জমে গেলাম আমি। নিজের প্রিয় জিনিসটা ফিরে পাওয়ার আনন্দ। সেদিন বাবার অসুস্থতার কারণে হসপিটালের বিশ পরিশোধ করার জন্য লকেটটা পঁয়ত্রিশ হাজারে বিক্রি করেছিলাম। বড্ড শখের ছিল এটা। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমার গলায় থাকত। আজ হুট করে এটা ফেরত পারো ভাবতেই পারিনি। কিন্তু রৌধিকের কাছে গেল কিভাবে? তিনি বুঝলেনই বা কিভাবে, এটা আমার। এই বাড়িতে থাকতে এটা পড়ি নি কখনো।

রান্নার কাজ সেরে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ল্যাপটপ বেডের একপাশে পড়ে আছে। আশেপাশে রৌধিক নেই। শরীর থেকে আঁশটে গন্ধ আসছে, তাই শাড়ি চেঞ্জ করে চুরিদার পড়ে নিলাম। জীবনের মতো শাড়ি পড়ার শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। রৌধিকের জন্য তো কখনোই শাড়ি পড়ব না।
____________
মাথার উপর মস্ত বড় অন্তরিক্ষ। এখন শরৎকাল। শরৎ মানেই নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। শরৎ মানে আকাশের গায়ে যেন মেঘ–তুলোর ওড়াউড়ি! কখনো সাদা, কখনো কালচে রূপ ধারণ করে শরতের আকাশে ভাসা–ভাসা মেঘের দল। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় শরতের আকাশ। নীল আকাশে সুতো-নাটাইহীন সাদা ঘুড়ির মতো দিনভর উড়ে বেড়ায় মেঘের দল। গোধূলিলগ্নে সোনারঙে রঙিন হয়ে ওঠে আকাশ। রাতের আকাশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। দূর থেকে গানের সুর শোনা যাচ্ছে। রৌধিকে রেলিংয়ের ওপর বসে আছে। একহাত মাথায়, আরেকহাত রেলিংয়ের ওপর দিয়ে আছে। সামনের দিকে মুখ করে বসে আছে বিধায় রৌধিকের মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে না। আমি গিয়ে রৌধিকের ঈষৎ দূরে বসলাম। রৌধিক আড়চোখে অবলোকন করলেও ঘাড় কাত করল না। নিরবতার সমাপ্তি টেনে ফোড়ন কেটে বললাম, ” আপনি আমার লকেট কোথায় পেলেন?”

“ইচ্ছে হলে রাখো, নতুবা ফেরত দাও।” রৌধিকের একরোখা জবাব।

“ফেরত দেবো, মানে কী? আমার জানার অধিকার নেই?”

“ধীরে ধীরে এবং আস্তে আস্তে কথা বলবে। জোরে জোরে কথা বলা আমার পছন্দ নয়।
তুমি সেদিন যখন বিক্রি করতে জুয়েলারি দোকানে গিয়েছিলে, আমি তখন সেখানেই ছিলাম। তোমাকে ফলো করে তোমার হসপিটাল এবং তোমার বাড়ি অবধি গেছিলাম।”

তাজ্জব বনে গেলাম আমি। রৌধিক কিভাবে আমাদের বাড়িতে গেছিল, তা তো তার থেকে জানা হয়নি। আমি তাকে কখনো ভুলবশতও বলি নি। আমি যখন গভীর চিন্তায় ব্যস্ত তখন তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ” কালকে নাকি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি আমরা?”

“মানে, আমি তো শ্বশুর বাড়িতেই আছি!”

রৌধিক পা তুলে ভেতরের দিকে মুখ করে বসলেন। আমার দিকে ঈষৎ ঝুকে বললেন,
“আমি আমার শ্বশুর বাড়ির কথা বলছি, তোমার নয়।”

নিজের মাথায় নিজেই মৃদু শব্দে চপল মার’লাম। তুই এতো বোকা কেন জোনাকি? সবাই তোরে বোকা বানাচ্ছে‌। বিশেষ করে এই রৌধিক। তোকে একদম মুরগি বানিয়ে দিচ্ছে ইদানীং। কদাচিৎ পর দেখা যাবে, ঘুম থেকে উঠে তুই মুরগির মতো কক কক করছিস। ডিমও পারছিস। গাঁধী একটা, ছাগল একটা।

“মাছির মতো ভনভন না করে, জোরে জোরে বল। আমিও একটু শুনি, নিজেকে কী বলে গা’লাগা’লি করছ?”

আমি সিউর, এই ছেলেটা জ্যোতিষী ছিল। আমি মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ফট করে সেটা বলে ফেলবে।

“কালকে তোমার বাবা সব সত্যিটা জানতে পারবে। আমাদের যেতেই হবে সেখানে, কিন্তু কাল তিনটা বাজে একটা ডিল আছে।”

“কিসের ডিল?”

“সেদিন যে ডিলটা ক্যান্সেল করা হয়েছিল সেটা। ডিলটা না করলে আমাদের অনেক লোকসান হয়ে যাবে। তাই বাধ্য আমি। কিন্তু..

“কিন্তু কী?”

“ওরা চাইছে কালকে তুমি আমার সাথে যাও। তারা জানে, তুমি অফিসের স্টার্ফ। বাবার সাথে তুমি অনেকবার ডিল ফাইনাল করতে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি তোমাকে এইসবে ইনভল্ট করতে চাইছি না।”

চমকে উঠলাম আমি। ধীরে ধীরে শুধালাম, “কী বলছেন আপনি? এতোবড় একটা ডিল। আমি অবশ্যই যাবো। কালকে বাবাকে সবটা জানিয়ে আমরা একসাথে যাবো।”

আর কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে এলাম। এই বাড়ির মানুষগুলো আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার জন্য এই বাড়ির লোকেদের কোনো ক্ষতি হোক আমি তা চাই না।
____________________
সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে এলাম। আমি রৌধিক, বাবা মা আদ্রিতা সবাই একসাথে। রৌধিক আজকে অফিসে যায়নি। অফিসের দায়িত্বটা আপাতত আরু নামক মেয়েটাকে দিয়েছে। বাড়িতে গেলে বাবা এতোজনকে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আমাকে কিছু বলতে দেয়নি, মৌমিতা আর আদ্রিক আহম্মেদ। তারা দু’জনে বাবার সাথে কথা বলছে। আমি আদ্রিতা আর রৌধিক অন্যরুমে বসে আছি। চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আমাকে এতো চিন্তা করতে দেখে আদ্রিতা সান্তনা দিয়ে বলল,

“জোনাকি চিন্তা করিস না। দেখবি বাবা ঠিক তোদের মেনে নিবে।”
আদ্রিতার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুসুলভ। সে আমাকে তুই করে আর আমি তাকে তুমি বলে সম্বোধন করি।
“আমি চিন্তা করতে চাই না আদ্রিতা আপু। কি করব বল, এমনিতেই চিন্তা হয়।”

আর কিছু বলার আগে নক পড়লো দরজায়। বাবা ডাক পাঠিয়েছে। আমি ধীর গতিতে গিয়ে হাজির হলাম।‌ মাথা নত করে রইলাম। বাবা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমার থুতনি ধরে উপরে তুললেন। পলকহীন চোখে চেয়ে আছে। তাঁর চোখেও অশ্রু। অশান্ত লাগল নিজেকে। বাবা কী তাহলে আমার কথা কাজে কষ্ট আয়াস পেলেন। বিচলিত হয়ে বললাম,

“বাবা কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?”

[চলবে ইনশাআল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here