#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বসার ঘরে গুরুগম্ভীর ভাব। সকালের নাস্তা সুহা ঘরে বসেই করেছে। মামি ঘরে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন। সকাল পেরোতেই মা এসে উপস্থিত হলেন। মামাই খবর পাঠালেন মুঠোফোনের মাধ্যমে। সুহাকে ডাকা হলো। আ*ত*ঙ্কি*ত চেহারায় বসার ঘরে পায়ের ছাপ ফেলতেই এক শুভ্র মুখশ্রীর দেখা মিললো। থমকে গেল পা জোড়া। দুই জোড়া চোখের দৃষ্টি মিলিত হয়ে স্থির হয়ে রইলো। আকস্মিক ডান গাল জ্বলে উঠলো। স*পা*টে মায়ের হাতের চ*ড় খেয়েও দৃষ্টি এদিক সেদিক হয়নি সুহার৷ সরল চোখে মাকে পর্যবেক্ষণ করে গেল। খানিকটা সময় পেরোতেই মামার গলা পরিষ্কার করার শব্দে সুহা মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মায়ের মুখভঙ্গি থমথমে। মামা তারচেয়েও বেশি গম্ভীর। তিনি ধারালো নজরে একবার তাকালেন সুহার দিকে। অতঃপর বোনের দিকে নজর ঘুরিয়ে বললেন,
“তোর মেয়েকে কী করবি, কোথায় নিয়ে যাবি, তার ব্যবস্থা কর। আমার বাড়িতে আমি তাকে আর এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করবো না।”
সুহার মা বেশ বিচক্ষণ মহিলা। প্রথমদিকে ততটা বোধবুদ্ধি না থাকলেও, এতগুলো বছর সংসার সামলে বেশ বুদ্ধিমতীর পরিচয় দিলেন। ভাইয়ের মুখোমুখি বসে কৌশলে বললেন,“মেয়েটা আমার নয় ভাইজান। শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। মেয়েটা আপনার আর ভাবির। ছোটো থেকেই আপনাদের কাছে ছিল, আপনারা তাকে মানুষ করেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন। তাহলে এখন কেবল আমার মেয়ে হয়ে গেল? আমি তো তার ধারেকাছেও ছিলাম না। দেখা হতো কদাচিৎ।”
বোনের বিচক্ষণতা দেখে দুর্বোধ্য হাসলেন সুহার মামা। বললেন,“আমরা ওঁকে মানুষ করেতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে না। যদি সত্যিই মানুষ করতে পারতাম, তাহলে আমার মুখের উপর কপাট টে*নে সেদিন বাড়ি ছাড়তে পারতো না।”
“যা ব্যবস্থা নেওয়ার আপনিই নিন। আমি এখানে কিছুই না।”
মামা রাশভারি গলায় বললেন,“এই বাড়িতে থাকার কোন জায়গা নেই ওঁর। এতদিন যেখানে ছিল, সেখানেই থাকুক। ওঁর সম্বন্ধে আমি আর কিছুই জানি না।”
সুহার টলমল চোখের জল গড়িয়ে পড়লো টুপ করে। ক্রমাগত ফুঁপিয়ে কান্না হুঁ হুঁ করে বেড়ে গেল। হাউমাউ করে মামার পায়ের কাছে পড়লো। হাত জোড় করে মিনতি করলো,
“এবারের মতো আমাকে ক্ষ*মা করে দিন মামা। আমি আর কখনোই আপনার মুখের উপর কথা বলবো না। আপনি যা বলবেন, সেটাই হবে।”
মামার চেহারা বেশ কঠিন। ধারণা করা যাচ্ছে তিনি নিজের কথা থেকে একচুলও নড়বেন না। সুহাও হাল ছাড়লো না। মামার পা জোড়া জড়িয়ে বসে রইলো।
মামির বুকটা জ্বালা করছে। তিনি আকুতি করে স্বামীকে বললেন,“মেয়েটা একটা ভু*ল না-হয় করেই ফেলেছে। ক্ষ*মা করে দিন না। কতজনের অনুশোচনা হয় বলুন তো? যারা ভুল করে অনুতপ্ত হয়, তাদের ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। মানুষকে শোধরানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। অনুশোচনায় দ*গ্ধ হওয়ার চেয়ে বড়ো শা*স্তি আর কী হতে পারে?”
সুহার টলটলে চোখের দৃষ্টি গিয়ে মামির উপর পড়লো। একবার মামার পাশে বসে থাকা মাকেও লক্ষ করে নিলো। এতটা কঠোর আচরণ তার হজম হতে চাইছে না। যেই মা শশুর বাড়ি থেকে এসেই তাকে আগে বুকে জড়িয়ে নিতো, সেই মা তাকে দেখেও কীভাবে এতটা নির্লিপ্ত! নিজের মনকে প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষা করতে হয়নি। মন ঝটপট উত্তর দিল, “এটা তোমার কাজের ফল”। তবুও যেন অবুঝ মন শান্ত হতে চাইছে না। যেখানে মামি তাকে দেখেই বুকে আগলে নিলেন, সেখানে মায়ের এই দূরত্ব তার সহ্য হচ্ছে না।
ভাবনার মাঝেই মামা মুখ খুললেন।
“মেয়েটার এত অধঃপতনের পেছনে কিছুটা তোমার আশাকারাও রয়েছে। কই, তার মা তো কিছু বলছে না।”
“আমি তো ওঁকে লালন-পালন করেছি।”
ভাই-ভাবির কথায় নড়েচড়ে বসলেন সুহার মা। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“আমি সবটা ভাইজানের উপরই ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই হবে। তাই আর ওঁর হয়ে সাফাই দিতে চাচ্ছি না। ভু*ল যখন করেছে, তখন শা*স্তি*টা ওঁর প্রাপ্য।”
মামি বললেন,“মেয়েটাকে যদি বের করে দেন, তবে আমিও ওঁর সাথে বেরিয়ে যাব।”
কথাটি বলার পরপরই ধ*ম*কে মৃদু কেঁপে উঠলেন মামি। মামা বললেন,“তো যাও না। ধরে রেখেছে কে?”
তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন মামি। থমথমে মুখভঙ্গি নিয়ে বললেন,“ঠিক আছে। চল সুহা, আর এখানে থেকে এক মুহূর্ত অপচয় করার মানে হয় না।”
সাথে ছেলেমেয়েদের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,“আমার সাথে যাবি নাকি তোদের বাবার সাথে থাকবি?”
সকলেই মাথানিচু করে নিলো। মিনমিনে গলায় বলল,“দুজনের সাথেই থাকবো।“
স্ত্রীর সাহস দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারলেন না সুহার মামা। বিস্ময়ে চোখ দুটো কোটর ছাড়িয়ে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
“তোমার সাহস তো দেখছি কম নয়! আমার ছেলে-মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাবে তুমি? নিজে যেখানে যাওয়ার যাও।”
সুহা মামির উদ্দেশ্যে বলল,“তুমি কেন আমার সাথে যাবে? আমি একাই যাব। দো*ষ যেহেতু আমি করেছি, শা*স্তি*টা*ও আমিই ভো*গ করবো।”
কথাখানা শেষ করে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো সুহা। কেউই বাঁধা দিলো না। চৌকাঠ মাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বেই হাঁক ছাড়লেন মামা,
“সাহস দেখছি দিনদিন বেড়ে চলেছে! তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি আমি?”
সুহা থেমে গেল। গুটিগুটি পায়ে ঘুরে দাঁড়াতেই মামা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
“এরপর আর কোন ভুল হলে আমি তা বরদাস্ত করবো না। সোজা কে*টে টু*ক*রো টু*ক*রো করে ফেলবো।”
বলে গটগট করে লম্বা কদম ফেলে বসার ঘর ত্যাগ করলেন মামা। মামি সহাস্যে এগিয়ে গেলেন সুহার দিকে। স্বামীর মন গলানোর জন্য মিছেমিছি তিনিও বাড়ি ছাড়ার অভিনয় করলেন। সুহার চোখে আনন্দাশ্রু। মায়ের ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসির রেশ। তিনি এখন পরের সংসারে আছেন। মেয়েকে সেখানে নেওয়াও সম্ভব না। এসব ঘটনার পর তো আরো আগেই না। তাই তো সকল সিদ্ধান্ত ভাইয়ের উপর ছেড়ে দিলেন নিজে চুপ থেকে। তিনি জানতেন ভাইজান উপরে বেশ কঠিন হলেও ভেতরে নরম মনের। সুহার জন্য উনার যেই স্নেহ -ভালোবাসা আছে, তার টা*নে হলেও মেয়েটাকে দূরে ঠে*লা*র সাহস করবেন না।
দু’একটা হুমকি-ধমকি দেওয়া কেবলই সুহার মনে ভ*য় জাগানো ছাড়া আর কিছুই না। এরচেয়েও বড়ো শা*স্তি তার প্রাপ্য।
মায়ের চোখেও পানি চিকচিক করছে। এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। সুহা চমকে উঠলো। এতক্ষণ যাবত যে মা নির্লিপ্ত ছিল, এখন তার ভালোবাসা দেখে অনেকটাই অবাক হলো। মা বোধহয় সুহার চোখের ভাষা পড়ে ফেললেন। বললেন,“সব করেছি তোর জন্য। তুই এখানেই ভালো থাকবি। আমি চাইলেই তোকে আমার সাথে নিয়ে যেতে পারতাম না। আমার হাতে যে কিছুই নেই।”
সুহা মায়ের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে নিজেও মাকে জড়িয়ে ধরলো। অবুঝ বাচ্চার মতো কেঁদে ফেলে বলল,“আমাকে ক্ষ*মা করে দাও মা।”
মা সুহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,“তোর মামার কথা শুনবি। একটুও এদিক-ওদিক করলে আমি বা তোর মামি আর কিছুই করতে পারবো না।”
সুহা অনবরত মাথা দুলিয়ে জানান দিলো সে মামার সব কথা শুনবে। দ্বিতীয়বার আর পরিবার হারাতে চায় না সে।
★★★
রাতের খাবারের পর যে যার ঘরে ঘুমাতে গেল। অরু এ বাসাতেই ছিল। ওঁদের বাসার জন্য বের হতে নিতেই রামি এসেই বাঁধা দিলো। বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস? চল, আজ ছাদে যাই।”
ভুরু কুঁচকে গেল অরুর। শুধালো,“ছাদে কেন?”
রামি শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। অথচ শান্ত চোখের আড়ালে রয়েছে একরাশ হতাশা। নতুন নতুন বিয়ে করে মানুষ ছাদে কেন, চাঁদেও চলে যায়। আর এই মেয়ে সব কিছুতে কারণ খুঁজে বেড়ায়। নিজের রা*গ*টু*কু হজম করে বলল,“ছাদে যাব, তুই আমাকে ধরে আড়াই ঘন্টা পে**টা**বি। এই জন্য।”
অরু মুখ ভেংচি কে*টে বলল,“অফুরন্ত সময় আমার নেই। পড়তে হবে। এমনিতেই তুমি বাসায় এলে আমার পড়া হয় না।”
অরুর পড়াশোনাকে আজ নিজের সতীন মনে হলো রামির। দাঁত কিড়মিড় করে আপনমনে আওড়ালো,“পুরুষ হয়েও সতীনের অভাবটা পূরণ হয়ে গেল। আমার মতো ভাগ্যবান পুরুষ আর কতজন হয়!”
অরু তীক্ষ্ণ চোখের বান ছুড়ে দিয়ে বলল,“কী বিড়বিড় করছো?”
“বর বাড়িতে থাকলে কীসের এত পড়ালেখা? ফার্স্ট প্রায়োরিটি পাওয়ার কথা আমার, অথচ পেয়ে বসে আছে তোর পড়াশোনা। শোন্, পড়াশোনা আমরাও করে এসেছি। দু’মিনিট বইয়ের এমাথা থেকে ওমাথা চোখ বুলিয়ে নিলেই যথেষ্ট।”
অরু মেকি হেসে বলল,“পড়াশোনা তো একেবারে সহজ। মেডিকেল তো আরো সহজ।”
রামি বলল,“আসলে কী জানিস? মেধা থাকতে হয়। মেধা না থাকলে তো রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা পড়লেও কাজ হবে না। মেধাবীদের জন্য দুই মিনিটই যথেষ্ট।”
রামির কথাতেই সূক্ষ্ণ খোঁ*চা স্পষ্ট। অরু তেতে উঠে বলল,“হ্যাঁ, আমার তো মেধার ‘ম’ টাই নেই। ঘু*ষে*র জোরে আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি।”
রামি চাপা স্বরে বলল,“ওই তেমনটাই।”
অরু ফোঁসফোঁস করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। নাকের পাটা ফুলে উঠছে। চিবুক শক্ত হয়ে আছে। রামি আড়চোখে একবার দেখে ভাবলেশহীন রইলো। অরুর জ্বলন্ত চোখজোড়া তার উপরই নিবদ্ধ। অথচ মুখে টুঁশব্দ টুকু নেই। রামি বিছানায় শরীরের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিতেই অরুর খোঁ*চা*নো কথা শুনতে পেল।
“ফেল্টুস। সে এসেছে আমার কাছে বড়াই করতে।”
রামি তেড়ে উঠে এলো। অরুর সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,“এই আমি কখন ফেল করেছি? বল।”
অরু ফিচেল হেসে বলল,“ভুলে গেলে? তুমি আর মিঠু পঁচা কুমড়া এসএসসির প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় এক সাবজেক্ট করে ফেল করেছো। মাহমুদ ভাই কী পে*টা*নো*টা*ই না পে*টা*লো তোমায়। আহা! ভাবতেই হৃদয়টা জুড়িয়ে যাচ্ছে।”
চোখের সামনে অনেক বছর আগের স্মৃতি ভেসে উঠতেই অপমানে মুখ লাল হয়ে এলো রামির। তিরিক্ষি গলায় বলল,“ওই এক সাবজেক্ট এমন কী? মানুষ বোধহয় জীবনে ফেল করে না। আমাকে আর কখনো ফেল করতে দেখেছিস? ওটা নেহাৎ তোর ভ*ন্ড ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে পড়ালেখা তালগাছের আগায় উঠার কারণেই এক সাবজেক্ট…”
প্রথমদিকে গলা চড়ে গেলেও শেষের কথাগুলো মিনমিন করে বলতে গিয়েও সম্পন্ন করলো না রামি।
অরু বিদ্রুপ হেসে বলল,“মেধার ‘ম’ থাকলে ফেল করতে না। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! এই তুমি না দু’মিনিট বইয়ে নজর বুলিয়ে নিলেই পড়া হয়ে যায়? তাহলে ফেল করলে কীভাবে?”
এত এত অপমানে রামির রাগ তরতর করে বেড়ে গেল। চেপে রাগা রাগটাকে উগলে দিতেই বালিশ হাতে নিয়ে অরুর দিকে ছুড়ে মা*র*লো। সরে গেল অরু। নিচ থেকে বালিশ তুলে রামিকে আ*ক্র*ম*ন করলো। বিছানা থেকে আরেকটা বালিশ নিয়ে রামিও যু*দ্ধে সমান তালে এগিয়ে গেল। রামির সাথে সমানে না পেরে ক্লান্ত অরু ছুটে বেরিয়ে যেতে নিয়েও থেমে গেল। পা ঘুরিয়ে আলমারির কাছে গেল। ঝটপট কপাট খুলে রামির একটা নতুন শার্ট বের করে থুতু মিশিয়ে পগারপার। তাকে আর পায় কে। রামির চোখ ছানাবড়া। মনে পড়ে গেল আজ থেকে কয়েক বছর আগের ঘটনা। মিঠুর স্কুলের ইউনিফর্মে থুতু মিশিয়ে দিয়েছিল সে। আজ তারই প্রতিশোধ নিলো মিঠুর বোন। মিঠুর জন্য গর্বে রামির চোখ ভিজে এলো৷ বিড়বিড় করে বলল,“শাবাশ ব্যাটা, নিজে যেমন রা*জা*কা*র, বোনকেও ঠিক তেমনি গড়ে তুলেছিস রা*জা*কা*র। আমার জীবনটাকে ছু**রি দিয়ে ফা*লা*ফা*লা করে ফেললো!”
#চলবে…….