#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
প্রকৃতিতে শীতের আগমন। তবুও যেন হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে চমকে দিচ্ছে। ঝিরিঝিরি মন মাতানো প্রেমের বৃষ্টি। সুহা অফিস শেষ করে বের হলো মাত্র। মিঠু গাড়ির কাঁচ নামিয়ে তার দিকে তাকিয়েই বসে আছে। সুহা দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নিলো। পিছু ডাকলো মিঠু।
“সুহা, আমি অপেক্ষা করছি তো।”
না চাইতেও একবার পেছন ঘুরে তাকালো সুহা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি যেতে পারবো। সাথে অবনি আছে।”
মিঠু বলল,
“অবনির এভাবে একা চলাফেরা উচিত নয়। বলুন বিয়ে করে নিতে। আর আপনার জন্য তো আমি আছিই।”
অবনি বলল,“চলাফেরা করতে হলে বিয়ে করতে হবে কেন?”
মিঠু বলল,“আশেপাশে শকুন থাকে।”
অবনি ফোঁড়ন কে*টে বলল,“আপনিও বুঝি শকুন?”
সুহা কড়া সুরে বলল,
“বড্ডো বেশিই কথা বলেন আপনি।”
“আপনি চুপচাপ গাড়িতে বসলেই তো আর আমার কথা বলার প্রয়োজন পড়ছে না।”
সুহা চারপাশে সাবধানী চোখে তাকিয়ে হাল ছেড়ে দিল। অবনিকে বলল,
“তুই বাসায় যা, আমি আসছি।”
অবনিকে বিদায় দিয়ে মিঠুর গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। মিঠু ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। ফ্রন্ট সিটে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিতেই মিঠু ভুরু উঁচিয়ে তাকালো। সুহা কিছু বুঝতে না পেরে শুধালো,“কী, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“আপনাকে সিট বেল্ট কে বাঁধতে বলেছে? আমাকে কি চোখে পড়ছে না?”
সুহা বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। রিমঝিম বৃষ্টিতে গাড়ি অবনির বাসার রাস্তা না ধরে অন্যদিকে ঘুরলো। সুহা জিজ্ঞেস করলো,
“এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে মুখ ভিজে আছে সুহার। ঝলমলে মুখশ্রী, দৃষ্টি স্বচ্ছ। চোখের চাহনি কতটা গভীর। মিঠুকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে সবকিছু। বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না সে। ড্রাইভিং এ আছে। এই মুহূর্তে একটা অ*ঘ*ট*ন ঘটে যেতে পারে। তার আগেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সুহা জবাব না পেয়ে দ্বিতীয়বার আর জিজ্ঞেস করলো না। সামনের কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা নেমে যাচ্ছে। এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে রইলো সুহা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তুমুল বর্ষণে রূপ নিলো। সাথে বাড়লো ঠান্ডার প্রকোপ। ওড়নাটা চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে নিলো। মিঠু বৃষ্টির গতি দেখে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ সুহার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“বেশি ঠান্ডা লাগছে?”
একটা ওড়নায় শীত নিবারণ হচ্ছে না। তবুও সুহা চুপচাপ রইলো। মিঠু বুঝতে পারলো ঠান্ডা লাগছে সুহার। তার নিজের কাছেও লাগছে। বাড়তি কোন কাপড়ও নেই, যা সুহাকে দিতে পারবে। সুহা আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার ঠান্ডা লাগছে না?”
সুহার কাছ থেকে এই প্রশ্নটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। মিঠু ভারি অবাক হলেও পরক্ষণে প্রফুল্লচিত্তে হাসলো। ধীর গলায় বলল,
“এখন একটুও ঠান্ডা লাগছে না। বিশ্বাস করুন!”
সুহা জড়োসড়ো হয়ে জানালার দিকে মুখ করে বসলো। প্রশ্নটা সে মানবিকতার দিক থেকেই করেছে। কিন্তু পাশের মানুষটার রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে সে দু-একটা চুমু দিয়ে বসেছে।
মিঠুর কথায় তার দিকে ফিরতে বাধ্য হলো সুহা। সে বলল,
“আমার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে সুহা। একটু কাছে এসে বসবেন?”
মিঠুর এমন আবদারে সুহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমায় বাসায় দিয়ে আসুন। আপনিও বাসায় যান৷ ঠান্ডা কমে যাবে।”
মিঠু সুহার কথা উপেক্ষা করে বলল,
“বৃষ্টিতে ভিজবেন?”
সুহা কাঠকাঠ জবাব দিলো,“না।”
“বৃষ্টি আপনার পছন্দ না?”
“এখন ভেজার ইচ্ছে নেই।”
মিঠু সুহার চোখে চোখ রেখে অনুরাগী স্বরে বলল,
“বিয়ের পর দুজন ভিজবো, একসাথে। তখন কিন্তু কোন বারণ শুনবো না আমি।”
সুহা শক্ত থাকতে গিয়েও বারবার দুর্বল হয়ে পড়ে। সে এত সহজে ধরা দিতে চায় না। আরেকটু বুঝতে চায় মিঠুকে। বৃষ্টির তেজ কমতেই মিঠু গাড়ি স্টার্ট করলো। ধীরে ড্রাইভ করছে। যেন তাড়াতাড়ি পথ না ফুরিয়ে যায়। অবনির বাসা আসতেই গাড়ি থেমে গেল। সুহা নেমে বাসার দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার পিছু ফিরে এলো। মিঠু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সুহা দু-কদম এগিয়ে বলল,“একদম বৃষ্টিতে ভিজবেন না।”
মিঠু আলতো হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। সুহা ফিরতে গিয়ে আরও একবার পিছু ফিরলো। মিঠু অপলক তাকিয়ে রইলো। আজ মনের কালো মেঘগুলো কে*টে গিয়েছে। কেন যেন মনে হলো সুহার মনে তার জন্য একটু হলেও জায়গা আছে!
★★★
অরু ফোন হাতে বসে আছে। রামিকে বলল,
“তুমি তো দুদিন পর আসবে। আমি তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করবো। আমার খুব শখ ড্রাইভ করে তোমাকে বাসায় নিয়ে আসা।”
রামির চোখ কপালে। বুকে থুতু ছিটিয়ে বলল,
“তোর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে? ড্রাইভিং ও তো জানিস না। না জানি দুদিন পরই আমার শেষদিন হয়! সাথে পুলিশের ঝামেলা তো আছেই।”
অরু সূঁচালো নজরে তাকিয়ে রইলো। রামি বলল,
“কী? ভুল কিছু বলেছি? সেবার মনে নেই? বাড়ির সামনের রাস্তায় কী করেছিস! আমি আর মিঠু ছিলাম বলে বেঁচে গিয়েছিস। অন্যকেউ থাকলে তোকে মে*রে আলুভর্তা বানিয়ে দিতো।
ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে আমাদের দুজনকে নিয়ে গাছের সাথে গাড়ি মে*রে দিয়েছিস।”
“তো? শিখতে গেলে এমন একটুআধটু হয়ই।”
“তুই যেখানে ড্রাইভিং টাই জানিস না, সেখানে আমাকে ড্রাইভ করে বাসায় নেওয়া বিলাসিতা।”
“তবুও আমি বিলাসিতা করতে চাই।”
“তোর বিলাসিতার জন্য আমি ম*র*তে পারবো না।”
“ম*র*তে কে বলেছে? বড়োজোর হাত-পা ভাঙবে। তোমার জন্য বরং ভালোই হবে। বেশ লম্বা একটা ছুটি পাবে।”
“কোন বউ স্বামীর হাত-পা ভাঙা কামনা করে? তোর মতো ডা*কা*ত আমি দুটো দেখিনি।”
“অন্যদিকে চোখ দিলে, একেবারে চোখ তুলে অন্ধ বানিয়ে রাখবো। তখন দুটো কেন, একটা ডা*কা*তও দেখার সৌভাগ্য হবে না।”
রামি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“না, দেখছি অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”
“আমাকে আবার বিয়ে দেবে না-কি? ছেলে ঠিক করেছো? দেখি, ছবিটবি দেখাও। পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে না! প্রথমবার নাহয় সবাই গরু ধরে বিয়ে দিয়েছে। এবার আর তেমন ভুল চাই না।”
রামি কটমট চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“খুব বিয়ে করার শখ তোর, না? আমি একবার বাড়ি এসে নিই, তারপর তোর বিয়ে করার শখ মেটাচ্ছি।”
রামি কল কে*টে দিল। অরু কল ব্যাক করলেও রামি ফোন তুললো না। দুদিন আর কোন কল দেয়নি, না অরুর কল মেসেজের রিপ্লাই করেছে।
রামি বাসায় ফিরবে। অরুর তখন ক্লাস। তাই এবার আর ইচ্ছে পূরণ হলো না। রামি প্রতিবারের মতো বাসায় পৌঁছে গেল। সবার সাথে দেখা করলেও অরুর সাথে দেখা হলো না। সারাদিন গড়িয়ে বিকেল গড়ালো। তারপর সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। অরু এ বাসায় আসলো না। রামি প্রচন্ড রেগে আছে। সেদিন অযথাই রাগ উঠিয়ে দিল, এখন রাত হয়ে গেল, অথচ তার দেখা নেই। রাতের খাবার খেয়ে গম্ভীরমুখে রুমে ফিরে গেল। অরুর কল পেয়েও ধরলো না। মেসেজ আসতেই চেক করলো।
❝ছাদে আসো।❞
রামি যাবে না বলে ঠিক করলো। পরক্ষণেই চিন্তা হলো একা একা নিশ্চিয়ই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। ঝটপট ছাদে পা বাড়ালো। অরু তাদের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। রামি ছাদে উঠতেই তারদিকে একটা কাগজ ছুঁড়ে মা*র*লো। কাগজ এসে পড়লো রামির শরীরে। ছাদের লাইট জ্বালানো। আলোতে কাগজ মেলে ধরলো রামি।
“হেই বালক, ডেটে যাবা?”
রামি কাগজ সরিয়ে অরুর দিকে তাকালো। দেখলো মেয়েটা মিটিমিটি হাসছে। রামি কাগজ ছুঁ*ড়ে ফেলে বলল,
“লজ্জা করে না বখাটেদের মতো আচরণ করতে?”
“তোমাকে দেখলে আমার লজ্জা করে না জান। প্রেম প্রেম পায়।”
বলে চোখ মা*র*লো অরু।
রামি একটা চিকন রড তুলে নিলো নিচ থেকে। এটা দেখিয়ে বলল,
“মা*র না খেতে চাইলে এখান থেকে যা। বরের সাথে ফ্লার্টিং। কতবড়ো সাহস!”
অরু দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল। রামি রাগ ধরে রাখতে চাইলেও পারলো না। অরু নেমে যেতেই হেসে ফেললো। অরুকে বোঝাতে হবে সে এখনো রে*গে। ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নিচে নেমে এলো। নিজের ঘর পর্যন্ত গিয়েও আবার ফিরে এলো কলিংবেলের শব্দে। এতরাতে কে হবে ভাবতে ভাবতে দরজা খুলেই থমকে গেল। অরু দাঁড়িয়ে আছে, তাও আবার শাড়ি পরে। তাকে সরিয়ে দিয়ে সোজা রামির ঘরে গিয়ে ঢুকলো।
রামি দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে ঢুকে গম্ভীর স্বরে বলল,
“এসব কী শুরু করেছিস? রাত বিরেতে শাড়ি পরে আমার ঘরে কী?”
অরু দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ধীরে ধীরে কাছে এসে বলল,“রা*গ কমেনি এখনো? দেখ আমি শাড়ি পরেছি। সুন্দর লাগছে না?”
রামি ঢোক গিললো। রাগের অভিনয়ট টুকুও ঠিকমতো ধরে রাখতে পারলো না। অরুর দিকে দু-কদম এগিয়ে অরুর গালে হাত রাখলো। ব্যাকুল স্বরে বলল,
“কেন এত জ্বালাচ্ছিস অরু?”
অরুর মিটিমিটি হাসি ভয়ঙ্কর শব্দে রূপ নিলো। চমকে উঠলো রামি।
“হাসছিস কেন?”
অরু বলল,
“আমি যাচ্ছি।”
“যাচ্ছি মানে?”
অরু হাসতে হাসতে বলল,
“তুমি কতক্ষণ আমার উপর রাগ ধরে রাখতে পারো এটাই দেখার ছিলো। দেখা শেষ, এবার আমি যাচ্ছি।”
অরু বেরিয়ে গেল। রামি পেছন থেকে বলল,“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না অরু। আমাকে জ্বালিয়ে কী শান্তি পাচ্ছিস?”
অরু ছুটে বেরিয়ে গেল। বাসায় এসে শাড়ি খুলে ফেললো। সাহস করে গিয়েছে। কিন্তু রামির কাছে আসায় প্রচন্ড লজ্জা হচ্ছিল। ভাবতে পারেনি রামি এত সহজে গলে যাবে। তাই তো দ্রুত কে*টে পড়েছে।
#চলবে………