অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী (সিজন২) পর্ব ১৯

0
550

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

আকাশে কালো মেঘ জমেছে। সেই সাথে সুহা’র মনেও নেমেছে নিকষ কালো অন্ধকার। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একে একে সবকিছু গুছিয়ে নিলো। অবনির সাথে আগেই কথা হয়েছে ফোনে। আপাতত এই বাসা ছেড়ে অবনির কাছে উঠবে। বাসা ম্যানেজ করতে পারলেই মাথা থেকে একটা বোঝা দূর হবে। সকাল সকাল অবনি এসে উপস্থিত। নিচে মালামাল বহনকারী গাড়ি দাঁড় করানো। খুব বেশি আসবাবপত্র নেই। টুকটাক কিছু জিনিস। ওগুলো পাঠিয়ে অবনির সাথে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সুহা।
অবনি ঠিক করলো ইবতেসামকে সুহা’র আর কোন ইনফরমেশন দেবে না। অনেক হয়েছে। মেয়েটার ভালো চাইতে গিয়ে খা*রা*প*টা*ই হলো। অযথা একটা অপ*বাদ নিয়ে বাসা ছাড়তে হলো। অফিসে ঢুকার আগে মিইয়ে যাওয়া স্বরে ডাকলো,
“সুহা।”

সুহা পেছন ফিরে অবনির নতমুখের দিকে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহা বলল,
“কিছু বলবি?”

“সরি!”

সরি বলাটা সুহার বোধগম্য হলো না। তাই ফের প্রশ্নবাণ ছুঁড়লো,
“সরি? সরি কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অবনি। বলল,
“তোর এতটা ঝা*মে*লা পোহানোর পেছনে আমিও অনেকটা দায়ী।”

সুহা হাসলো। স্বচ্ছ হাসি। সেই হাসিতে নেই কোন দুঃখ কিংবা বি*দ্রু*প। মুহূর্তেই যেন প্রানবন্ত হয়ে উঠলো মেয়েটা। বলল,
“ধূর, নিজেকে কেন দায়ী করছিস? আমি কাউকেই দো*ষ দিচ্ছি না। যা ভাগ্যে লিখা আছে, তা হওয়ারই ছিলো। বরং তুই না থাকলে আমি এই শহরের বুক থেকে সেই কবেই হারিয়ে যেতাম। ছি*ন্ন*ভি*ন্ন হয়ে যেতাম।”

অবনি একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সুহার গালে গাল মিশিয়ে দিল। আদুরে স্বরে বলল,
“আমি সবসময় তোর পাশে থাকতে চাই। এভাবেই থেকে যাবো তোর জীবনে। ঝঞ্ঝা মনে করে দূরে ছুঁ*ড়ে দিলেও আমি তোর পিছু ছাড়বো না।”

সুহা নিজেও হেসে জড়িয়ে ধরলো অবনিকে।

★★★

তিনদিন হচ্ছে, অথচ এ-কটা দিনে একবারও সুহা’র দেখা মিললো না। ওর জানালার কাছেও আলো জ্বলছে না। ফোন সুইচড অফ। চিন্তিত হলো মিঠু। দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করলো সুহা’কে একপলক দেখার।
বাড়িওয়ালা উপর থেকে মিঠুকে নজরদারিতে রেখেছেন। এক ঘন্টা ধরে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। এবার সিঁড়ি ধরে নেমে এলেন তিনি। গলা খাঁকারি দিতেই হকচকিয়ে উঠলো মিঠু। তার দৃষ্টি ছিলো সুহা’র বারান্দায়। আকস্মিক মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে খানিক নড়েচড়ে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের দিকে নজর দিলো। তিনি বেশ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“এতরাতে এখানে কী করছেন, বাবা? এটা ভাড়া বাড়ি। এভাবে কারো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়।”

মিঠু ভদ্রতা ভুলে বসলো। ভদ্রলোকের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়েই সুহার জানালায় তর্জনী তাঁক করে দেখালো। অতঃপর উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“সুহা, সুহা কোথায়? সে কি বাসায় নেই?”

ভদ্রলোক বললেন,
“বাসা ছেড়ে দিয়েছে।”

চমকে উঠলো মিঠু। তার কপালে সৃষ্টি হলো বলিরেখা।
“বাসা ছেড়ে দিয়েছে মানে?”

“এটার আর কী মানে হতে পারে? বাসা ছেড়ে হয়তো নতুন বাসা নিয়েছে!”

মিঠুর মাঝে উন্মাদনা খেয়াল করলেন ভদ্রলোক। ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“সুহা কোথায় গিয়েছে জানেন? নতুন জায়গার ঠিকানা আপনার কাছে আছে?”

ভদ্রলোক মিঠুকে আবারও আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
“দেখুন বাবা, মেয়েটা বিবাহিত। এভাবে তার পিছু পড়ে থাকাটা আপনাকে শোভা পায় না। তাছাড়া নতুন করে কোথায় উঠেছে, এতটুকু আমি জানিনা। ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে কোথায় উঠবে, এটার খোঁজ রাখার দায়িত্ব আমাদের নয়। আপনার কাছে অনুরোধ, এভাবে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবেন না!”

মিঠু বড়োসড়ো এক মি*থ্যা বলল। ভেবেচিন্তেই মি*থ্যার আশ্রয় নিলো। দৃঢ় গলায় বলল,
“সুহা আমার স্ত্রী। দুই বছর যাবত আমাদের মাঝে দ্ব*ন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। ও আমার কাছ থেকে আলাদা থাকার জন্য মি*থ্যা বলে আপনার বাসায় উঠেছে। আমি চাইছি সবকিছু মিটমাট হয়ে যাক। কিন্তু সে চাচ্ছে না।”

ভদ্রলোক শুধু চমকালেন না, ভীষণ ভাবে চমকালেন। দুটো মেয়ে কীভাবে ঘোল খাইয়ে উনার কাছ থেকে বাসা ভাড়া নিয়েছে! সেসব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে নিন। এভাবে স্ত্রীকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।”

মিঠু বলল,
“দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”

মাথা দুলিয়ে বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক সিঁড়ি ধরে যেভাবে এসেছিলেন, ঠিক সেভাবেই উঠে গেলেন। মিঠু আরও একবার সুহার জানালায় দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে পথ ধরলো বাড়ি আসার।
রিয়াজ এখন সুস্থ। নিত্যদিনের মতো আজও মিঠুর পাশে তাকে দেখা যাচ্ছে। সুহার ঠিকানা জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে মিঠু। অফিস শেষ টাইমেও এখন আর সুহার দেখা পাওয়া যায় না। আজ অবনির দেখা পেল। সে একাই বেরিয়েছে অফিস থেকে। মিঠু নিজ থেকেই এগিয়ে গেল। অবনির বিপরীতে তাকিয়ে সুহাকে দেখতে না পেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“সুহা কোথায়? উনি কোথায় বাসা নিয়েছে?”

অবনি শক্ত গলায় বলল,
“তা দিয়ে আপনি কী করবেন? মানুষের কি ব্যক্তিগত জীবন নেই? সে যেখানেই থাকুক, আপনাকে জানাতে আমি বাধ্য নই।”

অবনি এতটুকু বুঝতে পেরেছে, সুহার ঠিকানা সে জানেনা বললে অন্তত ইবতেসাম বিশ্বাস করবে না। কারণ এই শহরে সুহার একমাত্র কাছের মানুষ হিসেবে সে-ই আছে।
মিঠু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে হাসলো। অবনি ভেতরে ভেতরে আ*ত*ঙ্ক টের পেলেও উপরে বেশ শক্ত রইলো। মিঠু বলল,
“ঠিক আছো, ঠিকানা লাগবে না। আপনি এবার যেতে পারেন।”

অবনি পথ খোলসা পেতেই দ্রুত পাশ কাটিয়ে গেল। মিঠু ওখান থেকে গেল না। আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো রিয়াজকে নিয়ে। অবনি যাওয়ার দশমিনিটের মতো সময় পেরোনোর পরই সুহাকে বের হতে দেখা গেল। মুখে মাস্ক এঁটেছে। মিঠু ঠোঁট টিপে হাসলো। শিকারীর চোখকে ধোঁকা দেওয়া এতটা সহজ নয়। সামান্য মাস্ক কী করে গোটা একজন মানুষকে আড়াল করতে পারে? এতদিনে পুরো মেয়েটাকেই তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। সুহা আশেপাশে নজর বুলিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেল। পিছু নিলো মিঠু। অবনির বাড়ির কাছে আসতেই সেই ট্যাক্সিটা থেমে গেল। সুহা ঝটপট অবনির বাসায় ঢুকে পড়লো। মিঠু তা দেখে শরীর দুলিয়ে হাসলো। মুখের কাছে একটা হাত চেপে আছে। খোঁজ নেওয়া শেষ হতেই সে বাসায় ফিরে গেল। দিনে দুপুরে মিঠু খুব একটা বাসায় আসেনা। আজ তাকে বাসায় আসতে দেখে বাবা অবাক হলেন। বললেন,
“কী ব্যাপার? এ সময়ে বাসায়?”

মিঠু সরাসরি বাবার সামনে বসলো। কোনরূপ সময় না নিয়েই বলল,
“আমি বিয়ে করবো। মেয়ে রেডি। শুধু তুমি হ্যাঁ করলেই হবে।”

★★★

অরু সকালে উঠেই বাসায় চলে এসেছে। রাতে তার ঘুম ভালো হয়নি। নিজের ঘরে শান্তিতে চোখ বুজলো।
ঘন্টা না যেতেই রামি এসে বিরক্ত করা শুরু করলো। ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“এই বে*য়া*দ*ব, এতক্ষণ কীসের ঘুম ঘুমাচ্ছিস? আমাকে একা রেখে এখানে আসতে তোর একটুও বুক কাঁপলো না?”

অরু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে তাকে ঝাড়ি দেওয়া হচ্ছে! চোখ ঘুরিয়ে আবারও শুয়ে পড়তে নিতেই হাত টে*নে আটকে দিল রামি। অরু বিরক্ত হয়ে বলল,
“এমন করছো কেন? কাল আমার ঘুম ভালো হয়নি। এখন বিরক্ত করো না।”

রামির গলার স্বর নিচে নেমে এলো। গতরাতের কথা মনে পড়লে এখনো তার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। গতকাল অরুর গা ঘেঁষে পাশাপাশি শুয়ে টের পেলো তার হাত-পা অসম্ভব কাঁপছে। নিজেকে ধাতস্থ করতেই অরুকে ঝাপটে ধরে মটকা মে*রে শুয়ে রইলো। দু’দন্ড ঘুমাতে পারেনি সে। ভোরের দিকেই চোখ লেগে এসেছিল। মেয়েটা দিব্যি ঘুমিয়ে গিয়েও বলে বেড়াচ্ছে তার না-কি ঘুম হয়নি।
তার আর সময় আছে আজ সহ দু’দিন। মনটা নরম হয়ে এলো। বাইরের দিকে তাকিয়ে খাটো স্বরে বলল,
“আমি কাল চলে যাব অরু।”

অরুর ঘুম উবে গেল। তার নিজেরও খা*রা*প লাগছে। ঘুম ছেড়ে বিছানায় পা ভাঁজ করে বসলো।
“কালই চলে যাবে?”

“হুম। আজ আমার সাথে যাবি?”

“কোথায়?”

“যেখানে নিয়ে যাবো, সেখানে।”

“নিয়ে যাবে টা কোথায়?”

“একটা জায়গায়।”

“জায়গার নাম কী?”

“জানিনা।”

অরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“জায়গায় নিয়ে যাবে, অথচ জায়গার নামই জানেনা। সরো, আমি বিছানা গোছাবো।”

রামি সরলোনা। সটান হয়ে অরুর বিছানায় শুয়ে পড়লো। অরু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মিঠু ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“আমি এখন ঘুমাবো। তুই যা।”

এই বলে বিছানায় কয়েকদফা গড়াগড়ি দেওয়া শেষ। হাল ছেড়ে অরু উঠে গেলো। দশটা পর্যন্ত ঘুমালো রামি। অরু একা একাই ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। বিকেলে দুজনের বের হওয়ার কথা। অরু তৈরি হওয়ার পূর্বেই রামি এসে হাজির।
অরুর মাথায় টোকা মে*রে বলল,
“কীরে ঝ*গ*ড়ু*টে মহিলা, তৈরি হতে এতক্ষণ লাগে?”

অরু মাত্র আইলাইন করতে নিয়েছে। মাথা নড়ে ওঠায় চোখ ভরে গেল কালিতে। আয়নায় নিজের হাল দেখে অগ্নি চোখে তাকালো রামির দিকে। রামি হাসির মাত্রা বাড়িয়ে আগুনে ঘি ঢালার ব্যবস্থা করলো। ব্যস, এতটুকুতেই অরুর মেজাজ বি*গ*ড়ে গেল। বসে থাকা রামির চুলে আ*ক্র*ম*ন চললো। মাথা এদিক-ওদিক নড়ে তো*ল*পা*ড় হচ্ছে রামির। অরুর হাতে কয়েক গাছা চুল উঠে এসেছে। রামি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অরুর হাতে। তার সেট করা চুল আর চুল রইলোনা। এমন অ*ত্যা*চা*র মাসে কয়েকবার হলে অল্পদিনে তাকে ন্যাড়া ট্যাগ নিয়ে চলতে হবে। পাল্টা আ*ক্র*ম*ণ করার উদ্দেশ্যে অরুর চুলে হাত দিতে নিচ্ছিলো রামি। অরু সাবধান করে বলল,
“খবরদার! আমার চুলে হাত দিলে আজ মাটিতে এমন গড়াগড়ি দেব না, বাসাছাড়া হওয়া ছাড়া তোমার কোন উপায় থাকবে না।”

রামি চুপসে গেল। পরাজিত সৈনিকের মতো বলল,
“এবার তৈরি হয়ে নে বোন।”

অরু সূঁচালো চোখে তাকিয়ে বলল,
“নতুন কাউকে পেয়েছো না-কি? বউ ধরে বোন বানাচ্ছো? ব্যাপার কী?”

রামি দু-হাত জোড় করে বলল,
“মাফ কর। ভুল হয়েছে আমার।”

অরু আড়ালে মুখ লুকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। তার তৈরি হওয়ার ফাঁকে রামি একপাশে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে নিলো। অরু তৈরি হয়ে ফোন হাতে নিয়ে পরপর দুটো কাপল পিক ক্যামেরা বন্দী করলো।
বসার ঘর থেকে মিঠুর আওয়াজ আসছে। দুজন বেরিয়ে দেখলো বাবা আর মিঠু কোন জরুরী আলাপে ব্যস্ত। বিয়ে বিষয়ক কিছু কথা অরুর কানে এলো।

#চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here