#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
ব্যাগপত্র গুছিয়ে রামি বিরসমুখে তৈরি হতে গেল। এখনও প্রচুর সময় বাকি। বড়োভাই ঠে*লে*ঠু*লে তাকে সময়ের আগেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। দরজায় নক করে ঘরে ঢুকলো মাহমুদ। রামির মুখের দিকে তাকিয়ে অগোচরে হাসলো। বলল,
“আমার সাথে আয়।”
গম্ভীরমুখে জবাব দিলো রামি।
“তৈরি হতে হবে।”
মাহমুদ আবারও আলতো হাসলো।
“এখনও ঢের সময় বাকি। চল আমার সাথে।” এই বলে রামির হাত চেপে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। রামি বাইক চালাতে জানে। তার কাছ থেকেই মাহমুদ আর সাদাদ ভাইয়ার শেখা। রামি চাকরিতে জয়েন করলেও শখের বাইকটা বিক্রি করা হয়নি। ঘুরেফিরে কিছুদিন পরপর সাদাদ আর মাহমুদ বাইকটা নিয়ে ঘুরেফিরে। রামিও বাসায় আসলে মাঝেমধ্যে বাইক নিয়ে বের হয়। বাসা থেকে কিছু দূরে রামিকে বাইকের সামনে দাঁড় করালো মাহমুদ। রামি কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে মাহমুদের দিকে। মাহমুদ বলল,
“অরুকে পাঠাচ্ছি। সময় দু’ঘন্টা। তোকে আবার ফিরতে হবে।”
রামি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অবাক চোখে মাহমুদকে দেখছে। ওর পিঠে আলতো হাতে চাপড় দিয়ে মাহমুদ বলল,
“সময়টা আমিও পার করেছি। বিয়ের দিনই দুজন দুই বাসায়। তবুও আমাদের দেখা করার সুযোগ ছিল।”
রামি কৃতজ্ঞতা থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের এই বে*হা*য়া*প*না*য় রামি মোটেও লজ্জিত নয়। প্রেমিকই প্রেমিকের মর্ম বুঝে। তার ভাই শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। সে অন্তত কঠিন প্রেমিক না হলে সম্মান থাকবে না।
দেখতে দেখতেই অরু বাসা থেকে বেরিয়ে এদিকওদিক তাকালো। একটা লং কুর্তি, গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বের হলো। মাহমুদ ডেকে পাঠিয়েছে বলে তরী তাকে এদিকে পাঠালো। বাইরে এসেই অরুর চোখ পড়লো রামি আর মাহমুদের উপর। এগিয়ে যেতেই মাহমুদ “বেস্ট অফ লাক” বলে হেসে চলে গেল। রামি বাইকে উঠেই স্টার্ট দিয়ে বলল,
“উঠে বস।”
অরুর কিছুই বোধগম্য হলোনা। মাহমুদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রামি আবারও বলল,
“পেছনে উঠে বস। আমার লেইট হচ্ছে। ”
অরু জিজ্ঞেস করলো,
“উঠবো মানে? কোথায় যাবো?”
“তা তোর জানার প্রয়োজন নেই।” বলে নিজেই অরুর হাত টে*নে বাইকের কাছে নিয়ে আসলো। অরু হাত ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“না বললে যাবো কেন?”
“গেলেই বুঝতে পারবি। ততক্ষণ ধৈর্য ধর।”
উঠে পড়লো অরু। তার মাথায় হাজারও প্রশ্ন কিলবিল করছে। রামি বলল,
“আমাকে ধরে বস।”
অরু রামির কাঁধে হাত রেখে বসতেই রামি মুচকি হাসলো। ইচ্ছে করেই বলল,
“আরও শক্ত করে ধরে বস।”
বলতে না বলতেই কাঁধে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করলো। অরু ঠিকভাবেই বসেছে। শক্ত করে ধরতে বলায় ইচ্ছে করেই নখ ডুবিয়ে দিল রামির কাঁধে। ধমকে উঠলো রামি,
“তোকে বলেছি ধরে বসতে। আমার মাংস তুলতে বলিনি বে*য়া*দ*ব!”
অরু গলায় ধারালো ছু*রি ধরার ভঙ্গিমায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“একদম গলাটা এক*টা*নে আ*লা*দা করে দেব। আমার সাথে কোন ধমকাধমকি চলবে না। আর আজই বিয়ে করার জন্য এত লা*ফি*য়ে*ছে কে?”
রামি বাইক টা*ন দেওয়ার আগেই তার গলায় ফাঁ*সে*র মতো অরুর হাত আটকে রইলো। দ্রুত নেমে গিয়ে ধমকে বলল,
“এই নাম, তুই আমার বাইক থেকে নাম। একটু হলে আমার জান কেঁ*ড়ে নিচ্ছিলি। তুই তো ডাক্তারি করে জীবন বাঁচাবার পরিবর্তে জলজ্যান্ত মানুষকে ফুঁ*তে ফেলবি। বে*য়া*দ*বে*র পাশাপাশি জ*ল্লা*দ ধরে গলায় ঝুলিয়েছি।”
এই বলে বড়োসড়ো দম নিলো রামি।
অরু ফুঁসে উঠে বলল,
“সবার আগে তোমাকেই ফুঁ*তে ফেলবো।”
“তোকে বলেছি আমার বাইক থেকে নামতে। ছিঃ! কেমন নোং*রা করে ফেলেছিস।”
অরু বাইক থেকে নেমে একদলা থুতু ছুঁড়তে গেলেই রামি ঝট করে বাঁধা দিয়ে বলল,
“এই এই তুই আমার বাইকে থুতু ফেলবি না।”
“তুমি বলেছো না আমি তোমার বাইক নোং*রা করেছি! আজ থুতু ফেলেই ছাড়বো, সরো।”
“তুই শুধু একবার থুতু দিয়ে দেখ। আমি যদি ঠা*টি*য়ে দুটো চ*ড় না মে*রে*ছি, তবে আমার নামও রামি না।”
অরু একদলা থুতু ছিটিয়ে পেছন ফিরে ছুট লাগালো। রামি একবার বাইকের দিকে তাকাচ্ছে, একবার অরুর দিকে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতে হতেই অরু রাস্তা পেরিয়ে গেইটের ভিতর ঢুকে পড়লো।
অরু চলে যেতেই রামির মনে পড়লো অরুকে নিয়ে তার দুই ঘন্টা সময় কাটানোর কথা ছিল। এরপরই সে একমাসের জন্য চলে যাচ্ছে। অথচ কী থেকে কী হয়ে গেল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে রুমাল দিয়ে বাইক মুছে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়েই দেখলো অরু গেইটের আড়ালে লুকিয়ে তাকে দেখছে। দুর্বোধ্য হাসলো রামি। দুই কদম পিছিয়ে অরুদের গেইটে পা রাখলো। না দেখার ভান করে খপ করেই অরুর হাত ধরে টে*নে নিয়ে গেল বাইকের কাছে। সাবধান করে বলল,
“চুপচাপ উঠে বস। নয়তো বাইকের চা*কা*র সাথে বেঁধে টা*ন*তে টা*ন*তে নিয়ে যাবো।”
অরুকে বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে টা*নে*র সাথে অনেকটা পথ চলে এলো। অরুর ঝুঁটি বাঁধা চুল বাতাসে হেলেদুলে উঠছে। মাঝেমাঝে সামনের গ্লাসে অরুর উপর চোখ রাখছে রামি। প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে দুজন এসে পড়লো একটা বড়ো মাঠে। পাশেই একটা লেক, তার পাশে লাল থোকায় কৃষ্ণচূড়ার বাহার। নরম ঘাসের উপর টকটকে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি স্থানটির সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ করলো। অরু মুগ্ধ চোখে চারদিক দেখলো। কৃষ্ণচূড়া তার ভীষণ পছন্দের। প্রকৃতিতে মুগ্ধ অরুরকে বিভোর হয়ে দেখছে আরেক জোড়া মুগ্ধ দৃষ্টি। অরুর পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে ডান হাতটি ছুঁয়ে দিল রামি। ঝট করেই হাত সরিয়ে নিলো অরু। কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রামি আলতো হাসলো। নরম গলায় বলল,
“আমি একটু পরই চলে যাবো। তোর যখন ইচ্ছে হবে, তখন ফোন দিলেই কিন্তু আমাকে পাবিনা। আমি যতক্ষণ না অবসরে আসবো, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমি জানি তুই ফোন করবি না আমায়, তবুও বলে রাখছি। তবে আমি যখন সময় পেয়ে ফোন করবো, তখন অন্তত ফোন তুলিস।”
রামির চোখে ব্যাকুলতা টের পেয়েও অরু চুপ করে রইলো। অনেকটা সময় কাটলো নিরবতায়। রামি সময় দেখলো। এখনই বাড়ি ফিরতে হবে। অথচ কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটাতে পারবে বলে দুজনের এখানে আসা। যদি না রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু’জন গন্ডগোল বাঁধাতো, তবে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যেত। রামি মলিন হেসে বলল,
“বাড়ি ফিরতে হবে, চল।”
অরু মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। বাইক কিছুূদূর আসতেই একটা দোকানের সামনে নেমে পড়লো রামি। দোকানে বসা ছেলেটাকে বলল,
“ঠিকঠাক দিয়েছিস তো?”
“হ্যাঁ, নিশ্চিন্তে যা।”
রামি একটা গিফট বক্স অরুর হাতে দিয়ে বলল,
“বিয়ের দিন না-কি স্ত্রীকে কিছু না কিছু দিতে হয়! এটা তোর জন্যই কিনেছি। আশা করঢ়ি তোর খুব পছন্দ হবে।”
অরুর মাঝে উৎকণ্ঠা। কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে বলল,
“কী আছে এতে?”
“আমি চলে যাওয়ার পর দেখিস।”
অরু বক্স হাতে নিয়ে বসে রইলো। তাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে রামি ওদের বাড়ি ঢুকতেই সাদাদের মুখোমুখি হলো। ধারালো নজরে তাকিয়ে মুহূর্তেই রামিকে ফা*লা*ফা*লা করে ফেললো সাদাদ। রামি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই সাদাদ খ্যাঁক করে উঠলো,
“তোর এতবড়ো সাহস! তুই আমার কথা অমান্য করে বউ নিয়ে ঢং করতে বেরিয়েছিস।”
রামি বলল,
“তো তুমিও যাও তোমার বউ নিয়ে। আমি কী বাঁধা দিয়েছি না-কি? অবশ্য এক বাচ্চার বাপ তুমি। এই বুড়ো বয়সে রংঢং তোমায় মানায় না।”
ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠলো সাদাদ। গলা উঁচিয়ে বলল,
“তুলে যাস না রামি, অরু আমার এককালের বউ ছিল। আমি না চাইলে তুই ওঁকে বিয়ে কেন, ওর ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারতি না। কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।”
রামি উল্টো গর্জন করে উঠলো,
“কোন কালে তোমার বউ ছিল? আমাকে প্রমাণ দেখাও। বুড়ো বয়সে অরুর পেছনে ঘুরে যখন পাত্তা পাওনি, তখন কৃতজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয়েছো।”
“তুই এখন আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিস? ভুলে যাস না….”
সাদাদকে আর বাকি কথা সম্পন্ন করতে দিলোনা রামি। হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল। বলল,
“হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি আজ থেকে আমাকে এই ডায়ালগ শুনতে শুনতে বুড়ো হতে হবে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাই, আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ চাই।”
লম্বা কদম ফেলে বাড়ির ভেতর চলে গেল রামি। পেছন পেছন সাদাদও গেল। একেবারে তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে অরুর বাবার সাথে দেখা করতে গেল। তবে অরুর সাথে দেখা হলোনা। সে দরজায় খিল দিয়ে বসে রইলো। উদাস মনে অরুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিঠুকে কল দিয়ে জানালো আমি যাচ্ছি।
গাড়িতে উঠে অর্ধেক পথ যেতেই মুঠোফোন তীব্র শব্দ করে উঠলো৷ রামির ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। অরু এখনই একটা বো*ম ফা*টা*বে। ঠিক হলোও তাই। রামি কল রিসিভ করতেই চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“কী দিয়েছো তুমি আমায়? এটা গিফট?”
রামি শব্দহীন শরীর দুলিয়ে হাসলো। অরুর একটা ছোটোবেলার ছবি বাঁধাই করে দিয়েছে। যেটাতে স্পষ্ট অরুর নাক দিয়ে পানি পড়ছে।
খট করেই লাইন কেটে দিল অরু। ছুটে রামির বাসায় গিয়ে ওঁর ঘরে ঢুকলো। আলমারি থেকে দুটো শার্ট বের করে পায়ের তলায় রাখলো। মুহূর্তেই ভিডিও কল দিল রামিকে।
অরুর কাছ থেকে ভিডিও কল পেয়ে রিসিভ করতেই রামির চোখ চড়কগাছ। মনে পড়ে গেল মিঠু তাকে সাবধান করে নিজের জিনিস সামলে রাখতে বলেছিল। অরু পায়ের তলায় দুটো শার্ট রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করছে।
★★★
এমদাদুল হকের সাথে বুঝাপড়ায় বসলো মিঠু। এমদাদুল হকের শরীরে বেশ কিছু ক্ষ*ত চিহ্ন স্পষ্ট। মিঠু ক্ষ*ত*গু*লো টার্গেট করে বিদ্রুপ করে বলল,
“ব্যথা পেলেন কীভাবে? রাস্তায় চলার পথে হোঁচট খেলেন না-কি?”
অগুন চোখে তাকালো এমদাদুল হক। ওই নজরে উত্তপ্ত দাবানল। হিসহিসিয়ে বলল,
“এর উচিত জবাব তুই পাবি। আমাকে এভাবে হেনস্তা করার পরিণাম খুব ভ*য়া*ব*হ।”
মিঠু ঠোঁট টিপে হাসলো। মজবুত কন্ঠে বলল,
“ইবতেসাম হাত গুটিয়ে বসে থাকার জন্য মাঠে নামেনি। এনিওয়ে ট্রিটমেন্ট খরচ দেব না-কি?”
এমদাদুল হক তেতে উঠলেন। বাজখাঁই গলায় বললেন,
“তুই আমাকে টাকার গরম দেখাস? তোর মতো দশটা ইবতেসামকে কিনে পায়ের তলায় রাখি আমি।”
মিঠু ফের হাসলো। নজর তীক্ষ্ণ করে মাথা ঝুঁকিয়ে নিলো। বলল,
“ইবতেসাম একটাই তৈরি হয়েছে। তাকে কেনার যোগ্যতা কোন অমা*নুষের হয়নি, আর না কোনদিন হবে।”
#চলবে……