#অনাদৃতা (৮)
লিখাঃ #আতিয়া_আদিবা
গোধূলি পেরিয়ে এখন চারিদিকে নিকষ কালো। লক্ষাধিক তারকারাজি অথচ চাঁদশূন্য আকাশ। এ আকাশের সৌন্দর্যে কোথায় যেনো ফাঁক আছে। সেই ফাঁকের সাথে আমার জীবনের না মেলা হিসেবগুলির বড্ড মিল।
খন্ডাকারে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমায় কোন রহস্যের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে আমি জানি না। শুধু জানি, এ জীবন মুক্তির স্বাদ চাইতে করছে আকুলিবিকুলি।
রৌদ্র আমায় রেখে চলে গেলো আবার ফিরে এলো। তবে তার ফিরে আসা শুধু আমার জন্য। অন্য কারো জন্য নয়।
গতকাল মাইনুল সাহেবের ছেলে রৌদ্র চলে যাওয়ার পর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলাম মায়ের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
মা, ছেলেটা অবিকল আমার রৌদ্রের মত দেখতে।
মা ভ্রূ কুঁচকে উত্তর দিলো,
কই নাতো! নাম একই আছে, কিন্তু কাটিং তো আলাদা। কোথায় মিল?
মায়ের উত্তরে সন্তুষ্টি মিললো না। দৌঁড়ে গেলাম বাবার কাছে,
বাবা, ও বাবা! এই রৌদ্রর মুখখানা যে আমার রৌদ্রর মত।
বাবার চোখে মুখে প্রথমে বিস্ময়, পরক্ষণেই করুনা। তিনি বললেন,
মারে, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে। এ তোর রৌদ্র নয়। আমি জানি, পুরোনো স্মৃতিগুলো এখনো তোকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু এ থেকে তোর বের হয়ে আসতে হবে। নইলে জমানো কষ্টগুলো থেকে তোর নিস্তার নেই।
চোখের পানি লুকাতে নিজের ঘরে ফিরে আসি। কারো কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। মন বলছিলো, পুরো দুনিয়া আজ তোর বিপরীতে অনা! তারা মিথ্যা। তুই সত্যি। তোর ইন্দ্রিয়জ অনুভূতিগুলো সত্যি।
ফুলি মাসি ততক্ষণে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে গেছে। তাকে আর সেদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। উৎসাহ নিয়ে রাত পার করেছি। যদি মাসি নতুন রৌদ্রর মাঝে আমার হারিয়ে ফেলা রৌদ্রকে খুঁজে পায়! আগামীকাল জিজ্ঞেস করতে হবে। সকাল হলো। নতুন সূর্য উঠলো। কিন্তু আগ্রহটা নতুনের মত রইলো না। ছাইবর্ণ হয়ে গেলো। ফুলি মাসিকে আর জিজ্ঞেস করা হলো না।
আজ সকালে খবরের কাগজ আনতে নিচে যাইনি। কৌশলে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। নাহ! আজ খবরের কাগজের সাথে কোনো নীল খাম ছিলো না।
এ পর্যায়ে, রৌদ্র ফিরে এসেছে তা আমি বিশ্বাস করি। মানুষটা আমার আশেপাশে আছে। আমি বিশ্বাস করি। মনে প্রাণে, বিশ্বাস করি।
রাত তখন দেড়টা কি দুইটা। বাবা মায়ের শোবার ঘর থেকে টিভির আওয়াজ আর আসছে না। রোজ দুইজন গভীর রাত পর্যন্ত টিভি দেখে। এ স্বভাব তাদের আগে ছিলো না। ইদানিং হয়েছে।
মা-বাবার ঘরে টিভি অফ হয়ে যেতেই পুরো বাসায় সুনসান নীরবতায় ছেয়ে যায়। ফ্যানের শব্দে অবশ্য এই নীরবতা কাটা পরে যায়। তবুও এ ফ্যান মোহাম্মদপুরের সেই ফ্যানের মত ঘটঘট শব্দ করে ঘুরে না।
খুব বেশি গভীর ঘুমে ছিলাম না। তার মাঝেই কেনো যেনো মনে হলো কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যে তাকিয়ে আছে তার চেহারা স্পষ্ট নয়। ছায়া। একটি অবয়ব মাত্র। সে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
অনা, আমি ফিরে এসেছি। অচেনায় খুঁজে পাবে আমায়।
ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ মেলে তাকালাম। কিন্তু চারিদিকে অন্ধকার। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। ঘর অন্ধকার কেনো! আমি প্রতিদিন বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাই। গলা শুকিয়ে গেলো। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। বিছানা থেকে নামতে যাবো এমন সময় জানালার দিকে চোখ পরলো। পর্দা গুলো বাতাসে হালকা নড়ছে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। একটি অবয়ব।
গা শিউরে উঠলো। ভয়ার্ত গলায় বললাম,
কে? কে ওখানে?
কোনো উত্তর এলো না।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
জানালার ওপাশে কে?
এবারো কোনো উত্তর এলো না।
ভড়কে গিয়ে বললাম,
কথা বলছেন না কেনো? কথা বলুন। ঘরে কিভাবে ঢুকলেন আপনি?
জানালার ওপাশটা নীরব। ছায়াটা এবার পুরোপুরি পর্দার আড়ালে চলে গেলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো আমার। হঠাৎ মনে হলো, কেউ পেছোন থেকে নাম ধরে ডাকলো ‘অনা’। পরিচিত সে কণ্ঠ। খুব পরিচিত।
অবয়বটা এখন আমার পাশে। তার নিশ্বাসের শব্দ আমি শুনতে পারছি। সে আবার বলল,
‘অনা’।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
কে?
সে বলল,
আমায় চিনতে পারছো না? আমি রৌদ্র।
আমি বললাম,
রৌদ্র! আমার রৌদ্র।
হ্যাঁ। তোমার রৌদ্র। আমি ফিরে এসেছি অনা দেখো।
আমি যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
রৌদ্র? আমার রৌদ্র?
হ্যাঁ। তোমার রৌদ্র।
ছুঁয়ে দেখি তোমায়?
দেখো।
আমি রৌদ্রকে ছুঁয়ে দেখলাম। বরফ শীতল সে হাত বুকে চেপে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলাম। কাঁদতেই থাকলাম। রাত দীর্ঘ হোক। সময় না ফুরাক। আমি কেঁদে যাবো।
রৌদ্রর হাত বুকে চেপে কতক্ষণ কেঁদেছি মনে নেই। দরজার আঘাতের শব্দে আমার কান্না থেমে যায়। দরজার ওপাশ থেকে মা অবিরাম ডেকে চলেছে।
‘অনা, দরজা খুল। কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো? অনা?’
ছায়াটা এখনো আমার পাশে বসে আছে। আমি রৌদ্রকে বললাম। মা এসেছে। আমি দরজা খুলে দেই। রৌদ্র বলল,
না, অনা। আমি আর কারো সামনে যাবো না। আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে দেখা করবার জন্য ফিরে এসেছি। অন্য কারো সাথে নয়।
আমি ক্ষণিককাল চুপ থেকে বললাম,
ঠিকাছে।
বিছানা থেকে উঠে এসে বাতি জ্বালালাম। সুইচ অফ ছিলো। দরজা খুলে দিতেই মা দ্রুত ঘরে ঢুকলো। অবাক হয়ে বলল,
তুই কার সাথে কথা বলছিলি? এভাবে কাঁদছিলি?
রৌদ্র।
মা আরো অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
রৌদ্র মানে!
হুঁ। আমার রৌদ্র ফিরে এসেছে।
কি বলছিস পাগলের মতো?
আমি শক্ত গলায় বললাম,
পাগল মনে হলে পাগল। কিন্তু রৌদ্রর ফিরে আসা নিয়ে আর একটা কথাও নয় মা। তুমি ঘরে ফিরে যাও।
মা বড়বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জানি, তার কাছে পুরো বিষয়টা অবিশ্বাস্য। তবে তাদের বিশ্বাস করা বা না করায় আমার রৌদ্রর ফিরে আসা মিথ্যা হয়ে যাবে না।
রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?
মা আর অপেক্ষা করলো না। চলে গেলো। দরজা লাগিয়ে দিলাম। রাতে ঘর অন্ধকার করে অনেকক্ষণ রৌদ্রর জন্য অপেক্ষা করলাম। সে আর এলো না।
পরদিন সকালে মা বাবা দুজন একসাথে আমার ঘরে এলো। বাবা ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
মা, কেমন আছিস?
ছোট্ট করে উত্তর দিলাম,
ভালো।
শরীর সুস্থ?
হু।
তোর মার কাছে শুনলাম গতকাল রাতে কান্না করেছিস। কেনোরে মা?
এমনি।
বাবা মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর বাবা বললো,
তুই নাকি বলেছিস রৌদ্র ফিরে এসেছে?
হু।
মা, মৃত মানুষ ফিরে আসে কিভাবে?
আমি কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। চুপ করে রইলাম।
কি হলো বল?
এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
বাবা আমার সামনে বসে রইলেন। আরো জেরা করলেন। কিন্তু আশানুরূপ উত্তর পেলেন না। তিনি মার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। বিড়বিড় করে মাকে কিছু বলছেন!
_______________________________
রৌদ্র আমার সামনে বসে আছে। সাইক্রিয়েটিস্ট রৌদ্র। আজ আমাদের জন্য বাগানে বসার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাকে ঘরে পাঠানো হয়েছে। বিছানার সামনে একটা চেয়ার রাখা ছিলো। সে সেখানে বসে আছে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আজ তার চেহারার সাথে আমার রৌদ্রর চেহারার কোনো মিল নেই। দুজন আলাদা মানুষ, আলাদা ব্যক্তিত্ব! শুধু নামটা অভিন্ন।
রৌদ্র জিজ্ঞেস করলো,
আপনি কেমন আছেন?
আমি বললাম,
ভালো।
রৌদ্র হাসলো। বলল,
আপনাকে একটা মজার গল্প শোনাই।
শোনান।
গল্প বলার আগে একটি বিষয় সম্পর্কে আপনার অবগত হওয়া জরুরি।
কি বিষয়ে?
রোগ দুই রকমের হয়। শারীরিক রোগ এবং মানসিক রোগ। বেশিরভাগ শারীরিক রোগ দৃশ্যমান। খালি চোখে না হলেও মেডিকেল চেকাপ এ ধরা পরে যায়। ওষুধ খেলে সেরে যায়। কিন্তু মানসিক রোগ অদৃশ্যমান। শুধুমাত্র রোগীর কাছে দৃশ্যমান।
হু।
মানসিক রোগের ভিত্তি কি জানেন?
না।
বিশ্বাস।
এসব আমাকে কেনো বলছেন?
কারণ আমি জানতে চাই এবিষয়ে আপনার কি মতামত?
আমার কোনো মতামত নেই।
আপনি জানেন আজ আমি কেনো এসেছি?
জানি। আমার মা-বাবা মনে করে আমি পাগল। আর আপনি পাগলের ডাক্তার। তাই অসময়ে আপনার এ বাড়িতে আসার কারণ পরিষ্কার।
রৌদ্র হাসলো। বলল,
বিয়ে করতে এসে ফেসে গেলাম বলুন?
রৌদ্রর কথা শুনে ভীষণ হাসি পেলো। কিন্তু মুখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে রইলাম।
রৌদ্র পুনরায় বলল,
আমি আমার পেশেন্টের মা বাবা থেকে পেশেন্ট কে বেশি বিশ্বাস করি।
বিশ্বাস করলে আর চিকিৎসা করার কি দরকার?
যাতে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। কারণ আমি পেশেন্টের সাথে যা ঘটেছে তা বিশ্বাস করে, বাস্তবে কতটুকু ঘটতে পারে তার সাথে বিষয়টা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলি। তারপর সেখান থেকে জগা আর খিচুড়ি আলাদা করি।
আমি এবার হেসে ফেললাম। রৌদ্রও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
(চলবে…)