#৫ম_পর্ব
লেখকঃ #আতিয়া_আদিবা
সারারাত আমার ঘুম হয় নি। রৌদ্রর স্মৃতিগুলো মনের দরজায় কড়া নেড়ে গেছে বার বার। পূর্বাভিমুখে লালচে আভার দেখা মিলতেই জানালা খুলে দেই। একরাশ শীতল বাতাস সাথে সাথে ঘরময় ছড়িয়ে গেলো। রোদ উঠে গেলে, এই শীতল বাতাস কোথায় যেনো হারিয়ে যায়!
রান্নাঘরে গেলাম চা বানাতে। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা আর ছোট বাটিতে করে কিছু মুড়ি নিয়ে ফিরে আসলাম। চায়ের সাথে মুড়ি খাওয়াটা আমার পুরোনো অভ্যাস। দূর থেকে নাম না জানা পাখির ডাক ভেসে আসছে ক্ষীণস্বরে।
রোজ দেখি নিয়ম করে সূর্য ওঠে। নিয়ম করে সূর্য ডুবে। রাত হয় আবার রাত পেরিয়ে হয় ফুটফুটে ভোর। সময়, দিন, মাস, বছর । সব নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। সাথে নিয়ে যায় মানুষের সুখ। দিয়ে যায় দুঃখ, বিষাদ। বিপরীত চিত্রও চোখে পরে। যত হাহাকার, যত কষ্ট সব যেনো এই সময়, দিন, মাস, বছর সাথে করে নিয়ে যায় দূরে, বহুদূরে! দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পাওয়া যায় সুখের সন্ধান। কিন্তু হারানো মানুষগুলো চিরতরে হারিয়েই যায়। তারা আর কখনো ফিরে আসে না। জানিয়ে যায় চিরবিদায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে মনোনিবেশ করলাম। আগোছালো বিছানা। বালিশের পাশে অযত্নে অবহেলায় পরে আছে মোবাইল ফোন। বড় গোছানো স্বভাবের মেয়ে ছিলাম আমি। বিছানার চাদর একটুখানি কুচকে থাকলেও আমার পক্ষে সহ্য করা ছিলো দুরূহ। সেই আমার কাছে আগোছালো বিছানা আজ আরামপ্রিয়!
চা শেষ করে পুনরায় ঘরের বাহিরে বেরিয়ে এলাম। পেপার আনতে নিচতলায় গেলাম। রোজ পেপার ওয়ালা কেচিগেটের শিকের ফাঁকে খবরের কাগজ গলিয়ে যায়। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে কাগজ আনার কাজটা আমিই সেরে ফেলি। আজও আনতে গেলাম। কালো কেচিগেটের শিকের ফাঁকে ওইতো খবরের কাগজ! কিন্তু তার নিচে ওটা কি পরে আছে? কৌতূহলী মনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম একটি নীল খাম। হাতে নিতে উলটে পালটে দেখলাম। প্রাপক, অনাদৃতা। আমার নামই তো লিখা! চিঠি চালাচালির সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগে। বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোনটাই যেনো যোগাযোগ রক্ষার প্রাণকেন্দ্র। এসময়, আমায় কে চিঠি লিখলো? তাছাড়া এই মুহূর্তে চিঠি পাঠাতে পারে এমন কোনো মানুষের নামও মনে পরছে না। আশ্চর্যজনক!
খুঁতখুঁতে মনে খবরের কাগজ হাতে নিলাম। সাথে নীল খামটাও নিলাম। খামটা স্পর্শ করার সাথে সাথে শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে আবার স্থির হয়ে গেলো। কিন্তু পঞ্চইন্দ্রিয় এখনো সচল। বার বার মনে হতে লাগলো কোথা থেকে দুটো চোখ আমায় গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। চোখ দুটো আমার অপরিচিত নয়। সে আমার বহুদিনের চেনা মুখ। এই আলো মাখা সকালেও গা ছমছম করে উঠলো।
আমি আর দেরী করলাম না। খবরের কাগজ আর নীল খামটা নিয়ে ফিরে এলাম।
ঘরে এসে নীল খামটা হাতে নিয়ে ক্ষণিককাল বসে রইলাম। খুব যত্ন করে আঠা লাগানো হয়েছে। সাবধানে খামটা খুললাম। তৎক্ষনাৎ ভীষণ পরিচিত একটি পারফিউমের গন্ধ পুরো ঘরে ছড়িয়ে গেলো। ম ম করতে লাগলো চারিদিক। পারফিউমের গন্ধটাও আমার পরিচিত। ভীষণ পরিচিত। কিন্তু কে ব্যবহার করতো ঠিক এই মুহূর্তে মনে পরছে না।
ধবধবে সাদা একটি কাগজ ভাঁজ করে রাখা খামের ভেতর। কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখলাম পুরো পৃষ্ঠায় শুধুমাত্র একটি বাক্য লিখা। বাক্যটি পড়ে যতটা না অবাক হয়েছি। তার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে প্রেরকের নাম পড়ে। গায়ে সামান্য কাঁটা দিয়ে উঠেছে!
নীল খামে পাঠানো চিঠিতে লিখা,
‘অনা, আমি ফিরে এসেছি’
ইতি,
তোমার রৌদ্র
কেউ কি মজা করছে আমার সাথে? কিছু কিছু মানুষ অন্যের দুর্বলতা নিয়ে তামাশা করতে পছন্দ করে। এটি তাদের কাছে মজার একটি খেলা। মানুষটি যখন হতাশায় দুমড়ে মুচড়ে যায়, তখন তারা এগিয়ে আসে। সাহায্যের হাত বাড়াতে নয়। যেটুকু আশা তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, সেটুকু কেড়ে নিতে!
যদি পারফিউমের গন্ধটা অপরিচিতই থেকে যেতো তাহলে হয়তো আমার চিন্তা চেতনা এটুকু গন্ডির মাঝেই আবদ্ধ থাকতো।
কিন্তু! আচমকা আমার মনে পরে গেলো, এই পারফিউমটা রৌদ্র ব্যবহার করতো। আমি চিঠিটা নাকের কাছে নিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলাম। নাহ! আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না। এই পারফিউমটা রৌদ্রই ব্যবহার করতো।
কেউ একজন উপহার দিয়েছিলো তাকে। পারফিউমের গন্ধটা আমার বেশ ভালো লাগতো। অফিস থেকে ফিরে এসে যখন স্বেদে ভরা শার্ট বিছানায় ফেলে গোছলে যেতো রৌদ্র, আমি যত্ন করে তার শার্টটি নিয়ে বারান্দায় মেলে দিতাম। মাঝে মধ্যে শার্ট বুকে জড়িয়ে বুকভরে ঘ্রাণ নেওয়া ছিলো আমার স্বভাব। স্বেদ আর পারফিউমের গন্ধ মিলে এক অদ্ভুত মাতাল ঘ্রাণ তৈরি হতো। সে ঘ্রাণে মুখ ডুবিয়ে বহুসময় পার করেছি।
সে পারফিউমের ঘ্রাণ চিনতে খুব বেশি সময় আমার লাগলো না।
আমি প্রতিদিন নিচে খবরের কাগজ আনতে যাই না। আমার আজকে নিচে যাওয়া, নীল খাম পাওয়া, খামের চিঠিতে পরিচিত সুবাস, প্রেরকের স্থানে রৌদ্রর নাম – এসব কি নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার? নাকি অন্য কিছু বিরাজমান যা আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না?
সূর্য পুরোপুরি উঠে গেছে। চিঠিটা যত্ন করে বিছানার তোষকের নিচে রেখে দিলাম। চিঠিটা পড়ার পর থেকে মাথায় সূক্ষ্ম ব্যাথা। তখনকার ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে। সত্যি মনে হচ্ছিলো, যেনো দুটো চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মায়াভরা দৃষ্টি মেলে!
মা ঘরে এলো। চোখের দিকে ক্ষণিককাল তাকিয়ে থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
রাতে ঘুমাস নি?
সহজ গলায় উত্তর দিলাম,
চেষ্টা করেছি। ঘুম আসে নি।
চোখের নিজে যে দিন দিন কালি পরে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে?
আমি হাসলাম কোনো উত্তর দিলাম না।
মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,
চেহারাটা দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এত অনিয়ম, এত অবহেলা! নিজের প্রতি কোনো যত্ন নেই। কেমন জীবন কাটাচ্ছিস তুই? এভাবে বেঁচে থাকা যায়?
বেঁচে থাকা যায় বলেই হয়তো বেঁচে আছি মা। নয়তো কবেই মরে যেতাম।
মা আমার পাশে এসে বসলো। তার চোখে মুখে পরম মমতার ছাপ। সে আমার মাথায় হাত রাখলো। জানি, এখন ভীষণ অপ্রিয় একটি বিষয়ে আমায় চালিয়ে যেতে হবে আলাপন। ইচ্ছের বিরুদ্ধে।
মা তৃপ্তি নিয়ে বললেন,
মাইনুল সাহেব রাতে বাড়ি গিয়েই ফোন করেছিলো।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম,
তারপর?
মার মুখ ঝলমল করে উঠলো। সে প্রফুল্লচিত্তে বলল,
তোকে মাইনুল সাহেব এবং তার স্ত্রী দুজনেই ভীষণ পছন্দ করেছেন।
বাহ! তা কয় কেজি মিষ্টি আনছো আজকে?
মা অবাক হয়ে বলল,
মিষ্টি আনবো কেন?
আমি হেসে বললাম,
বারে! এত বড় খুশির সংবাদ। মিষ্টি এনে খাওয়াবে না?
একটুকরো মেঘ কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিশাল সূর্যটাকে আড়াল করে ফেলেছিলো। সেই গুমোট মেঘ যেনো মুহুর্তেই আমার মায়ের মুখে জায়গা করে নিলো। তার ঝলমলে মুখে নেমে এলো অন্ধকার। সে আমার হাত ধরে বলল,
তোর বাবা মাইনুল সাহেবের ছেলেকে অনেক পছন্দ করেন।
হু।
ছেলেটা ভালো। দেখতে সুন্দর। তাছাড়া অবিবাহিত। এমন সুযোগ বারবার আসে না অনা।
কথা ঘুরিয়ে বললাম, মা নাস্তা বানাবে না?
মা বুঝলেন এই বিষয়ে কথা বলার প্রতি আমার আগ্রহ নেই। তিনি বেশ রাগ দেখিয়ে, বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন। আমি জানি না, কেনো এই সমাজে একজন মেয়ে পতিহীনা নারী হিসেবে থাকবে পারবে না! কেনো তাদের বয়স অল্প হলেই পুনরায় বিয়ে করতে হবে। কেনো এত জোর জবরদস্তি!
মা বেরিয়ে যাওয়ার পর পুনরায় চিঠিটার প্রতি প্রবল টান অনুভব করলাম। আরো একবার বিছানার নিচ থেকে চিঠিটা বের করলাম। দ্বিতীয়বারের মত পড়লাম। আবার পড়লাম। বার বার পড়লাম।
হঠাৎ মনে হলো কেউ কানের কাছে নরম গলায় আমার নাম ধরে বলল,
‘অনা, আমি ফিরে এসেছি!’
(চলবে…)
পর্ব ৬ – https://www.facebook.com/549603828864534/posts/1074982986326613/
আগের পর্বের লিংকঃ (পর্ব ৪) https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1030459904112255&id=549603828864534