#৩য়_পর্ব
#আতিয়া_আদিবা
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলমারি থেকে যত্ন করে তুলে রাখা নতুন শাড়িটি বের করলাম। সকালে একবার গোসল করেছি। তবুও দ্বিতীয়বারের মতো গোসলে ঢুকলাম। শাওয়ার ছেড়ে দিলাম। ঝমঝম করে পানি পড়তে লাগলো। কাপড় ছেড়ে ঝর্ণার নিচে দাঁড়ালাম। শীতল পানি গা গড়িয়ে পড়ছে। চোখটা মনের অজান্তেই ভিজে উঠলো। শীতল পানির সাথে তাল মিলিয়ে লোনা জলের স্রোতে ভেসে যেতে লাগলো বাথরুমের মেঝে।
গোসল সেড়ে অনেকদিন পর আয়নার সামনে বসে সাজলাম। চোখে সুন্দর করে কাজল দিলাম। ঠোঁটে হালকা রঙ ছোঁয়ালাম। মুখে দামী ক্রীম মাখলাম। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে বাবার অফিস রুমে আসলাম।
বাবার অফিস রুমটা দোতলায়। প্রবেশদ্বারের সামনে সুন্দর একটি নামফলক রয়েছে। তাতে গোটা অক্ষরে লিখা, ‘শরিফুল ইসলাম’। ঢাকায় বড় বড় যে কয়জন ধনী ব্যবসায়ী আছেন তাদের সাথে তুলনা করলে আমার বাবা সাত নম্বরে রয়েছেন। তবে এর প্রভাব কখনো আমাদের বাড়িতে ছিলো না। বড়লোকদের বাড়িতে সাধারণত চার পাঁচজন কুক থাকলেও আমাদের বাড়িতে নেই। রান্নার কাজটা আমার মায়ের সারতে হয়।
আমার মা অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। শুনেছি, বিয়ের সময় তিনি এক কাপ চা ও বানাতে পারতেন না। বুদ্ধি করে শ্বশুড়বাড়িতে মায়ের সাথে একজন বাবুর্চি পাঠিয়ে দেয় আমার নানা। কিন্তু বাবা সেদিন রাতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, তাদের বাড়িতে কেউ বাবুর্চির হাতের রান্না খায় না। তাই রান্নার পর্বটুকু মায়ের সামলে নিতে হবে।
মায়ের তাতে অসম্মতি ছিলো না। তিনি এক মাস বাবুর্চিকে নিজের সাথে রেখে সকল প্রকার রান্না শিখে ফেলে। এই মানুষটা চাইলেই এখন একশ দেড়শ জনের রান্না কারো সাহায্য ছাড়াই করতে পারে। মায়ের এই গুণটা আমার ভীষণ পচ্ছন্দ।
প্রতিটা মেয়ের মাঝেই ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং তাদের ত্যাগের মহিমা শব্দান্তরে প্রকাশ করা অসম্ভব।
অফিস ঘরে ঢুকলাম। বাবা খুব মনোযোগ দিয়ে ভেপ টানছেন। সম্প্রতি তিনি ভেপ টানা শুরু করেছেন। বাবার প্রচুর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিলো। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে তিনি ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন।
মাকে ডেকে তুললেন। মা ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
কি হয়েছে?
বাবা বললেন,
আমার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। দম নিতে পারছি না। আমি মনে হয় মারা যাচ্ছি। অনা কই? অনাকে ডেকে আনো। মৃত্যুর আগে মেয়েকে কিছু কথা বলা দরকার। নইলে মরেও শান্তি পাবো না। ওকে ডাকো। কুইক!
বাড়িতে কান্নাকাটি বেজে গেলো। মা চাচাদের ফোন করলেন। আমি বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে আমাকে বললেন,
মারে! তোকে এই অবস্থায় রেখে শান্তিতে যে মরতেও পারবো না! ভাই দুটো তো স্বার্থপর। থেকেও নেই! তুই আরেকটা বিয়ে কর।
খুবই সাধারণ চিত্র। স্বামী মারা গেলে বা ডিভোর্স হয়ে গেলে মেয়ের মাতাপিতারা শান্তিতে মৃত্যু স্বাদ তখনই গ্রহণ করতে পারে, যখন মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয়।
তৎক্ষণাৎ বাবাকে শান্ত করতে বলি,
ঠিকাছে বাবা। বিয়ে করবো। তুমি শান্ত হও। আস্তে আস্তে শ্বাস নাও দেখি!
বাবা ক্ষণিককাল বিছানায় অচেতনের মতো শুয়ে থাকলেন। ফযরের আজান দিলে তিনি মাকে বললেন, মনোয়ারা শ্বাসকষ্ট কমেছে। মেয়েকে ঘুমোতে বলো।
মা আমার ঘরে আসলেন। চোখ মুছে হাসিমুখে বললেন,
তোর বাবার শ্বাসকষ্ট কমেছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই। ঘুমিয়ে পড়।
পরেরদিন বাবা মহসিন আংকেলের চেম্বারে গেলেন। মহসিন আংকেল আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। তিনি বাবাকে কঠিন স্বরে বলে দিলেন সিগারেট ত্যাগ করতে।
বাবা মনমরা হয়ে বাসায় ফিরলেন। দুই দিন সিগারেটের প্যাকেট স্পর্শ করলেন না। এসময় তার মেজাজ চরম খিটখিটে হয়ে থাকতো। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতেন।
‘রান্নায় লবণ কেনো কম হয়েছে। রান্নায় লবণের ব্যবহার এখনো শিখলে না মনোয়ারা!’
‘আমার অফিসরুমের জানালার গ্রিলে এত ময়লা কেনো? কাজের মেয়েটা হয়েছে চরম ফাঁকিবাজ। মাসে মাসে টাকা কি ওর চেহারা দেখে দিচ্ছি? ঠিক মতো কাজ কর্ম করে না কিছু না! দুধ কলা দিয়ে অকর্মার ঢেকি পালছি সব’।
তৃতীয় দিন সারা সকাল বাহিরে কাটিয়ে ঝলমলে মুখ নিয়ে তিনি বাসায় ফিরলেন। ঘরে ঢুকেই হৈ হল্লা শুরু করে দিলেন।
‘এই অনা! শীগগির এদিকে আয়। মারাত্বক একটা জিনিস এনেছি। দেখে যা। এই মনোয়ারা কোথায় তুমি?’
বাবার আনা মারাত্বক জিনিস দেখতে আমি আর মা নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাবা ভেপ দেখিয়ে বললেন,
দেখেছো? ইলেক্ট্রনিক সিগারেট। একদমই ক্ষতিকর না। ডাক্তার আমকে সিগারেট খেতে না করেছে। তাই আমি বুদ্ধি করে ভেপ এনেছি। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙ্গবে না’।
অফিসরুমে মিষ্টি সুগন্ধ। বাবা আমাকে দেখে আনন্দিত স্বরে বললেন,
অনা মা এসেছিস? বাহ! শাড়িতে কি সুন্দর দেখাচ্ছে আমার মেয়েকে। বোস। ওই চেয়ারটা টান দিয়ে বোস।
চেয়ার টান দিয়ে বাবার সামনে বসলাম। বাবা ভেপ বন্ধ করে রেখে দিলো। বলল,
দুপুরে খেয়েছিস?
খেয়েছি।
সারাদিন ঘরের কোণায় পরে থাকিস। কখন কি করিস বুঝি না। দুপুর বাবা মায়ের সাথে একসাথে বসে খাবি। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক কথা হবে। এ বাড়িতে কিচ্ছু নিয়মমতো হয় না।
বাবার কথামতো এ বাড়ির নিয়ম ভঙ্গ হতে শুরু হয়েছে যেদিন আমার বড় ভাই অর্ণব অস্ট্রেলিয়া পড়তে চলে গেলো। বাবার ইচ্ছে ছিলো না বড় ভাই দেশের বাইরে পড়তে যাক। ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে। মদ টদ খাবে। সর্বদা তিনি এজাতীয় চিন্তা করতেন। তার চিন্তা অহেতুক ছিলো না।
ভাইয়া অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর আমাদের সাথে ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমিয়ে দিলো। দুই বছরের মাথায় সে ফোন করে জানালো, পাকিস্তানী এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
খবর শুনে মা মূর্ছা গেলো। জ্ঞান ফিরলে নতুন উদ্যোমে কান্নাকাটি শুরু করলেন! এমন ছেলে কিভাবে তিনি পেটে ধরলেন এই নিয়ে অল্প বিস্তর গবেষণাও চললো। বাবা সেসময় গম্ভীর মুখে অফিস রুমে বসে থাকতেন। দুই রাত ঘুমান নি। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে লাগলো।
দ্বিতীয় দফায় এ বাড়ির নিয়ম ভঙ্গ হলো, যখন ছোটভাই আদীব হিন্দু এক মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি আসলো। বাবা দরজার সামনে ক্ষণিককাল স্তম্ভের মতন দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর উচ্চস্বরে ছোটভাইকে বললেন,
বৌ নিয়ে এক্ষুণি বিদায় হ। আমি এবাড়িতে কোনো মূর্তিপূজক রাখবো না।
ভাইয়া বৌ নিয়ে চলে গেলো।
বিশাল বড় বাড়িতে শুধুমাত্র আমি, মা এবং বাবা রইলাম। ভাইদের সাথে আমার তখনো যোগাযোগ ছিলো। এখনো যোগাযোগ আছে। কিন্তু তা আমার বাবা অথবা মা কেউ জানে না।
আমি বললাম,
আগামীকাল থেকে আমরা একসাথে টেবিলে বসে খাবো।
বাবা খুশি হলেন।
অফিস ঘরের জানালা দিয়ে বিশাল পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে। বাবা সেদিকে তাকিয়ে বললেন,
অনা, আমার মন বলে আমার হাতে সময় কম। একদিন হঠাৎ করে মরে যাবো। আমি মারা গেলে তোর ভাইরা যেনো আমার লাশ দেখতে না পারে।
আমি হাই তুলে বললাম,
তুমি চাইলেও তারা লাশ দেখতে পারবে বলে মনে হয় না। ছোট ভাই চেষ্টা করলে হয়তো পারবে। বাস অথবা ট্রেন ধরে চলে আসবে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা আহামরি কোনো ব্যাপার না। কিন্তু বড় ভাই চাইলেও পারবে না।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই দীর্ঘশ্বাসের অর্থ ‘আমি ভুল বলি নি’।
তোকে নিয়েই এখন আমার সব আশা ভরসা। আজ মাইনুল সাহেব বাসায় আসবেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। উনার স্ত্রী আবার অনেক সুন্দর গান করেন। আমি তো বলেছি তুইও অনেক সুন্দর গান করিস। আজ ওদের গান শোনাবি।
উনারা কি ব্যবসায়ীক কাজে আলাপ করতে আসছেন বাবা?
না। একসাথে কাজ করলে মাঝে সাঝে বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াতে হয়। এতে সম্পর্ক ভালো থাকে। আন্তরিকতা বাড়ে।
ও।
উনার একটা ছেলে আছে। বিয়ে থা করেনি এখনো। ভীষণ বাপ ভক্ত ছেলে। বাপ যা বলে ছেলে তাই শোনে। বাপ যদি বলে এক পায়ে বকের মতন দাঁড়িয়ে থাক ছেলে তাই থাকে।
তোমার বিজনেস পার্টনার কি তার ছেলেকে এক পায়ে বকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো?
বলেছিলো। উনার পানিশমেন্টের ধরন ভিন্ন। আমি তো ছেলে মেয়েদের কখনো কোনো পানিশমেন্ট দেই নি। দেওয়া উচিত ছিলো। ভুল হয়েছে আমার। বিশাল বড় ভুল হয়েছে!
চলবে….
এবার বইমেলায় আমার প্রকাশিতব্য উপন্যাস #মেঘের_বিপরীতে
প্রকাশনীঃ অধ্যয়ন (তাম্রলিপি)