অনাদৃতা – #পর্ব_৬
লেখকঃ #আতিয়া_আদিবা
অন্যদিন মাকে সকালের নাস্তা তৈরিতে টুকটাক সাহায্য করি। আজ আর ঘরের বাইরে গেলাম না। অদৃশ্য কোনো টানে চিঠিটা হাতে নিয়ে ঘরে বসে রইলাম। এক প্রকার আগ্রহ জন্মালো। প্রবল আকাঙ্খা জেগে উঠলো মনে। আগামীকাল সকালে পুনরায় খবরের কাগজ আনতে গেলে আরেকটি নীল খাম পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
দুপুরে গোসল করে ঘর থেকে বের হলাম। মা আর ফুলি মাসি ডায়নিং এ খাবার সাজাচ্ছে। ফুলি মাসি ছুটা কাজের বুয়া। দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। তাকে এখন পর মানুষ বলে মনে হয় না। দীর্ঘদিন কারো সংস্পর্শে থাকলে তাকেও আপন বলে মনে হয়। পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আমায় দেখে ফুলি মাসি কেমন যেনো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো।
আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
কি হয়েছে ফুলি মাসি?
উনি নিচু স্বরে বলল,
কিছু না আম্মাজান। খাইবা? ক্ষুধা লাগছে?
আমি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম,
হুঁ। লেগেছে।
মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো এবং আমায় দেখে বেশ অবাক হলো। হওয়ারই কথা। আমি সচরাচর ডায়নিং এ বসে খাই না। খাওয়া দাওয়ায় বড্ড অনিয়ম। কিন্তু গতকাল বাবাকে কথা দিয়েছি এখন থেকে একসাথে খাবো। সেই কথা রাখবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাতে ক্ষতি কি?
মা এখনো বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।
বলল,
কিরে! তুই ডায়নিং এ, এসময়?
মধাহ্নভোজের আয়োজন দেখতে এলাম। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।
মা কিছু বলার আগেই বাবা ডায়নিং এ প্রবেশ করলো এবং আমাকে দেখামাত্র উল্লাসে মেতে উঠলেন।
‘অনা মা দেখি!’
হেসে উত্তর দিলাম,
গতকাল বলেছিলাম না? এখন থেকে একসাথে বসে খাবো। তোমাদের সাথে গল্প করবো।
বাবা ক্ষণিককাল চুপ করে রইলেন। মনে হয় কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি সফল হলেন। কুঁচকানো ভ্রূ মুহুর্তেই প্রশস্ত হয়ে গেলো। বললেন,
হ্যাঁ বলেছিলি। ভালো করেছিস মা। সবসময় নিজেকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখিস যা মোটেও উচিত না। শোন মা, পরিবারের চেয়ে এ দুনিয়ায় আপন কেউ নাই। দুঃখ, কষ্ট, সুখ। সবই পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে হয়।
আমি অস্ফুটে বলে উঠলাম,
সুখটা ভাগ করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও মানুষকে কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা দেন নি।
বাবা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল,
তোর সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে, মা।
কি কথা?
তোর বিয়ে নিয়ে।
আমি চুপ করে মুচকি হাসলাম মাত্র। বাবা বলল,
তোর মা আসুক। একসাথে বসে খেতে খেতে এ বিষয়ে আলোচনা করবো।
আমি এবারো কোনো কথা বললাম না।
টেবিল সাজানো শেষ হলো। মা খেতে বসলেন। নারিকেল দিয়ে চিংড়ি মাছের মালাইকারি রান্না করা হয়েছে। রৌদ্রর ভীষণ পছন্দ ছিলো চিংড়ি মাছ। সাথে আমারো পছন্দ। আমাদের বাসায় শেষ কবে মালাইকারি রান্না করা হয়েছিলো মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে করতে পারলাম না।
পাতে এক টুকরো চিংড়ি নিয়ে ভাতে মেখে খেতে শুরু করলাম। মনের অজান্তেই চোখের কোণে পানি চলে এলো। মাথা যতটুকু সম্ভব নিচু করে ফেললাম। যদি অশ্রুজল আড়াল করা যায়!
প্রারম্ভে সবাই নিশব্দে খেয়ে যাচ্ছিলো। ডায়নিং এ ছেয়ে গেছিলো নিরবতা। সেই নিরবতা ভেঙ্গে বাবা শুরু করলেন আমার দ্বিতীয় বিয়ের কথা।
তিনি হাসিমুখে বলল,
মাইনুল সাহেব আমাকে গতকাল রাতে ফোন করেছিলো। আমাদের মেয়েকে খুবই পছন্দ করেছেন। ব্যবসায়িক সম্পর্কটা আত্মীয়তার সম্পর্কে রুপান্তরিত করতে চান।
মা উৎসাহিত কণ্ঠে বলল,
এতো খুশির খবর। আমাদের মেয়ের বয়সও তো কম। সবে মাত্র ত্রিশে পা রাখলো। এই যুগের মেয়ে ছেলেরা পড়াশোনা শেষ করে, চাকরি বাকরি খুঁজে বিয়ে করতে করতে আটাশ উনত্রিশ ত্রিশ বছর বয়সের দ্বারে পৌঁছে যায়।
বাবা বলল,
তা তো বটেই। মাইনুল সাহেবের ছেলে পেশায় পাগলের ডাক্তার।
মা খানিকটা ভড়কে গেলেন,
পাগলের ডাক্তার মানে?
মায়ের এহেন প্রতিক্রিয়ায় বাবা বেশ মজা পেলো। চোখে পানি নিয়েও আমার গালে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন,
মানে হলো পেশায় সাইক্রিয়েটিস্ট। দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। অল্প বয়সেই বিস্তর নাম ডাক কুড়িয়েছে।
ছেলের নামটা যেনো কি?
রৌদ্র।
নামটা শুনে বুকের গহীনে কুট করে কামুড় দিয়ে উঠলো। আমি অস্পষ্টস্বরে বলে উঠলাম,
রৌদ্র!
জানিনা মা-বাবা আমার এই অস্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে পেলো কিনা। তারা মাইনুল সাহেবের ছেলেকে নিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত।
বাবা বললেন,
ছেলের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। তারা দেরি করতে চাচ্ছে না। যত দ্রুত সম্ভব ছেলের বিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে চাইছে। আমার নিজের শরীরটাও বড্ড নড়বড়ে। কবে কি হয়ে যায়! আমিও চাইছি অনার শুভ পরিণতি দেখে যেতে। নয়তো মরেও শান্তি পাবো না।
তুই কি বলিস অনা মা?
এতক্ষণ বাবা যা বলেছেন তা ভীষণ ভাসা ভাসা শুনেছি আমি। ‘রৌদ্র’ নামটা শুনে হারিয়ে ফেলেছি বাকশক্তি। কি ঘটছে আমার সাথে? সকালে খবরের কাগজের সাথে পাওয়া চিঠি। রৌদ্রর ফিরে আসার কথা। মাইনুল সাহেবের ছেলের নাম কাকতালীয় ভাবে আমার মৃত স্বামীর সাথে মিলে যাওয়া!
মস্তিষ্ক কাজ করছে না। মাথায় অনবরত কেউ যেনো সুঁই ফুটিয়ে চলছে। তবুও স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলাম,
তোমরা যা ভালো মনে করো। আমার কোনো আপত্তি নেই।
ফুলি মাসি রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। তিনি আমার দিকে তাঁকিয়ে আছেন। এখনো তার মুখ থেকে ভয়ের ছাপ পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় নি। আমি মাসিকে বললাম,
মাসি, এক কাপ চা করে খাওয়াবে?
ফুলি মাসি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
বাবা বলল,
এই অবেলায় চা খাবি?
প্রচন্ড মাথা ধরেছে। তাই চা খাবো।
এটুকু বলে আমি ঘরে ফিরে আসছিলাম। বাবা নিচু স্বরে ডাক দিলেন,
অনা?
বলো বাবা।
মাইনুল সাহেবের ছেলেকে আগামীকাল আসতে বলি? তোরা কথা বার্তা বল। হুট করে তো বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায় না। নিজেরা নিজেদের জানবি, বুঝবি।
ছোট্ট করে উত্তর দিলাম, আসতে বলো।
বাবা খুশি হলেন। মার মুখ ঝলমল করে উঠলো।
আমি রুমএ ফিরে এলাম। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে পারলাম না। পূর্ব দিকের জানালা লাগিয়ে দিতে যাব, আচমকা প্রচন্ড বাতাস শুরু হলো। গরম বাতাস। দক্ষিণে চোখ যেতেই দেখলাম কালো মেঘ জমছে। বৃষ্টি হবে। ঝড়ও হতে পারে।
জানালা লাগিয়ে দিয়ে ভারী পর্দা টেনে দিলাম। ফ্যান চলছে। পর্দা হালকা হালকা নড়ছে। ঘরে এক অদ্ভুত আলো ছায়ার নৃত্য।
প্রায় ঘুমিয়ে পরেছিলাম। এমন সময় ফুলি মাসি চা নিয়ে ঘরে আসলো।
আম্মাজান, আফনের চা।
চোখ মেললাম। বেশ কষ্ট করে উঠে বসলাম। আমার হাতে চা দিয়ে ফুলি মাসি দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ সূচালো করলো। কিন্তু টু শব্দটি বের হলো না। মাসির জড়তা ভাঙ্গাতে জিজ্ঞেস করলাম,
মাসি কিছু বলবে?
হ।
কি বলবে বলো।
মাসি আমতা আমতা করতে লাগলো।
আমি তাকে আশ্বাস দিলাম।
কি হয়েছে মাসি বলো?
কিছুটা ইতস্তত করে মাসি বলল,
আজকে এবাড়ি আসনের সময় দেখলাম রাস্তার ওইপাশে একটা পাগল দাঁড়াইয়া আছে। এ বাড়ির দিকেই তাকায়া আছে। আমি তারে জিগাইলাম এ বাড়িতে কি দেখে? পাগল কইলো…
এটুকু বলে মাসি থেমে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
পাগল কি বলল?
কইলো যে, এ বাড়িতে সে এমন কিছু দেখে যা অন্য কেউ দেখতে পারেনা। যে থাকে সে এ বাড়ির মালিকের মেয়ের সাথে থাকে।
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,
পাগল পাগলের মত কথাই বলেছে। এ বাড়িতে আমার সাথে কেউ থাকলে তোমরা দেখতে না?
ফুলি মাসি বলল,
না, আম্মাজান। অনেক পাগলের অন্তরে চক্ষু আছে। সেই চক্ষু দিয়া তারা ওইডা দেখে যা অন্য কেউ দেখে না। এইডা অনেক পাগলের বিশেষ ক্ষমতা।
আমি আবারো হেসে ফেললাম। বললাম,
আচ্ছা ঠিকাছে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া পাগল তো বলেছে যে আছে আমার সাথে আছে। তোমাদের ভয় পাওয়ার কারণ কি?
মাসি বলল,
একটা কথা কমু আম্মাজান?
বলো।
আফনার স্বামী মানে রোদ্দো বাবার মরন তো গাড়ি চাপা পরে হইছে। পাগলকি সেদিকে ইংগিত দিলো?
কিসের ইংগিত?
রোদ্দ বাবা মইরাও আপনার সাথে আছে।
ফুলি মাসি। মৃত মানুষ কিভাবে আমার সাথে থাকবে? বাজে কথা বলছো। এমন কিছুই না। তুমি যাও কাজ করো গিয়ে।
ফুলি মাসি অপেক্ষা করলো না। চলে গেলো। চায়ের ওপর পাতলা সর পরে গেছে। এক চুমুক দিয়ে দেয়ালে হেলান দিলাম। আজ সারাদিন আমার সাথে একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে। বিষয়গুলো কাকতালীয় হিসেবে মেনে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু জানি না, ভাগ্য আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
কাকতালীয় ঘটনাগুলো এত রহস্যে ঘেরা হয় কেনো?
(চলবে…)