#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৬
#তাশরিন_মোহেরা
টং এ বসে খুব আয়েশ করে চা খাচ্ছি আমি আর রূপক ভাই। সে নিয়েছে এক কাপ রঙ চা আর আমি নিয়েছি দুধ চা। টংয়ের ছাউনির আড়ালে বহু মানুষের গমন দেখছি আর টুকটাক কথা বলছি আমরা দুজন। টং এ চা খাওয়ার অপূর্ব অনুভূতি বোধহয় আর দুটোতে নেই। টং টার পেছনে দোকানদারের ঘর দেখা যাচ্ছে। আমি হালকা উঁকি মেরে দেখলাম মধ্যবয়সী একজন মেয়ে ভেতরে কাজ করছেন। দোকানদারের স্ত্রী হবেন বোধহয়। আমাকে উঁকি দিতে দেখে দোকানদার বেশ বিনয়ের সাথে বললেন,
‘আপনেরা হেইদিকে চাইয়েন না। দরজা নাই তাই ভিত্রে সব দেহা যায়।’
আমার খানিক লজ্জা হলো। এভাবে একটা মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট করে দিলাম আমি। ভেবে খুবই খারাপ লাগলো। আমি এবার রূপক ভাইকে নিয়ে বিপরীতে বসলাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠে আমার। হাতে নিয়ে দেখি আব্বার ফোন। চটজলদি ধরে বললাম,
‘জ্বি আব্বা, আসসালামু আলাইকুম।’
আব্বা সালামের উত্তর দিয়েই বললেন,
‘মা, তুই একটু এখনই বাসায় আসতে পারবি?’
আমি হাতঘড়িটা দেখে বললাম,
‘আব্বা, আমার তো ১২ঃ৩০ এ প্র্যাক্টিক্যাল আছে, জরুরি!’
আব্বা তখন ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বললেন,
‘মা, আমার একদমই ভালো লাগছে না রে!’
আমি খুব ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আব্বার প্রেশারটা খুব সহজেই উঠানামা করে। আর তখন তিনি খুব বেশিই অস্থির হয়ে পড়েন। আমি তাড়া দিয়ে বললাম,
‘সুমি কি পাশে নেই আব্বা?’
‘আছে। কিন্তু আমার তাও কেমন যেন লাগছে রে! তুই একটু আয়, মা!’
‘ঠিক আছে, আব্বা! আমি এখনি আসছি।’
কল কেটেই আমি রূপক ভাইকে বললাম,
‘রূপক ভাই, আমি এখন আসি। আব্বার শরীরটা ভালো লাগছে না। ক্লাসটা আর এটেন্ড করা হলো না।’
রূপক ভাই বললো,
‘দেখিস কিন্তু! আঙ্কেল তো একটুতেই আবার অনেক অস্থির হয়ে পড়েন।’
আমি তাকে বিদায় দিয়ে সরাসরি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি রওনা দিলাম। বাসায় এসে বারকয়েক কলিংবেল বাজালাম। পরপর পাঁচবার বেল বাজার পর সুমি (আব্বার অসুস্থতার জন্য রাখা মেয়েটি) দরজা খুললো। আমি তাকে ধমকে বলে উঠলাম,
‘কি হলো? দরজা খুলতে তোর এতো সময় লাগে?’
সুমি বিরক্ত হয়ে বললো,
‘আপনের বাপের ফায়ফরমাশ খাটতেই দেরি হইয়া গেছে।’
আমি ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম আব্বা আরামে বসে টিভি দেখছেন। সাথে আছে এক বয়াম মুড়ি। আব্বাকে দেখেই কোমড়ে দু’হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাশ থেকে সুমি ফোড়ন কাটলো,
‘আপনের আব্বার ইকটু গরম লাগতাছিলো। হেইল্লাইজ্ঞা টাইনা আপনারে লইয়া আনছে পড়া থাইকা। কেন যে এই মানুষটার কথা হুইনা-ই দৌঁড় দেন, আফা!’
এটুকু বিড়বিড় করতে করতে সুমি রান্নাঘরে চলে গেল। আব্বা আমার দিকে তাকিয়েই মুচকি হেসে বললেন,
‘মা, আজ একটু খিচুড়ি রাঁধিস! তোর খিচুড়ি খেতে আমার ভারী মন চাইছে।’
রাগে আমার মাথার রগ উঠানামা করলো কয়েকবার। আমার আব্বাটা এমনই! তার অতিরিক্ত ভালোবাসা আর আহ্লাদে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। ঠিক এ কারণেই আমাকে একা রেখে ঠিক দশ বছর আগে আম্মা পালিয়ে যায় সুদুরে! সবকিছুতে আব্বার আহ্লাদ আর সন্দেহ আম্মাকে আমার কাছ থেকে দূরে পাঠিয়েছে। ব্যাপারটা তখন না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝি! মানুষটা আমার একটুও কদর করে না। শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবে! আমি হতাশ হয়ে গা এলিয়ে দিলাম সোফায়। মুহূর্তেই কান্না পেয়ে গেল আমার। কান্না পেলেও তা গলাতেই আটকে যায়। এতে অস্বস্তি আরও বেড়ে যায় আমার। আব্বা মানুষটা আমাকে এতো বছর আগলে রেখেছে তাই তার উপর রাগ দেখাতেও আমার সংকোচ হচ্ছে! নিঃশব্দে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম আমি।
জানালার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। বাইরের জনবহুল প্রকৃতিটাও আমায় ক্ষণে অস্থির করে তুললো। তাই বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিয়ে ভাবছি! জীবন কেন আমার সাথেই বারংবার নিষ্ঠুর হয়?
ছোটকাল থেকেই বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বের মাঝে বড় হয়েছি। টানা দশ বছরের একটি দিনও এমন যায়নি যেদিন আমি আব্বা-আম্মার ঝগড়া দেখিনি। আব্বা সবকিছু নিয়েই মাকে সন্দেহ করতেন। মুখে বলতেন তিনি তাকে ভালোবাসেন বলেই নাকি সন্দেহ করতেন। আম্মা তখন বারবার একটা কথা-ই বলতেন, ‘আমি যদি আজ পরিবারের অবাধ্য হয়ে পালিয়ে বিয়েটা করতাম তবে আপনার মতো জঘন্য একটা মানুষের সাথে হয়তো আমার জীবন কাটাতে হতো না। আমি মুক্তি চাই! মুক্তি দিন আমায়।’
কিন্তু আব্বা মাকে মুক্তি দেয়নি। বরং দিন যত যেতে থাকে আব্বা হয়ে উঠে আরও উন্মাদ। আম্মার পালিয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি সর্বদা আম্মাকে আটকে রাখতেন একটা রুমে। বয়স বাড়তে থাকলে তিনি আমাকেও আটকে রাখতে থাকেন। একটা বদ্ধ ঘরে কেঁদেকেটে অস্থির হতাম তখন। আব্বাকে কতো ডেকেছি, ক্ষুধায় কাতরে মরেছি! কিন্তু আব্বা শোনেননি। তার সব ধ্যান ছিলো আম্মাকে নিয়ে! একদিন আব্বার স্বপ্ন সত্যি করে আম্মা ঠিকই চলে যান পালিয়ে। আমার বয়স তখন দশ ছুঁইছুঁই। আম্মা চলে যাওয়াতে আব্বা আমাকে ধরে অঝোরে কেঁদেছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে ফুলে উঠেছিলো। কিন্তু সেদিন একটিবারের জন্যও নিজের চোখ বেয়ে কান্না বের করতে পারিনি আমি। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। কি করবো? আমার অনুভুতিরা যে তখন ক্ষয়ে গিয়েছিলো! বিলীন হয়েছিলো সময়ের গর্ভে।
চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুপাত শেষমেশ করলাম। ফ্যানের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে ভাবছি, এ মুহুর্তে এই ফ্যানে নিজেকে ফাঁস দিয়ে দিলে কেমন হয়? কয়েক সেকেন্ডেই কেল্লাফতে! তবে আচমকা-ই আমার চোখে ভেসে আসে দুটি পরিচিত মুখশ্রী! মুগ্ধ আর মুখর। মনের কোথাও হঠাৎ বলে উঠে, ‘তিথি! এদের জন্য হলেও তুই বেঁচে থাক, আজীবন।’
নিজের ভাবনায় নিজেই চমকে উঠি। খানিক লজ্জাও পেলাম। ক্ষণিকের দেখা সাক্ষাৎে এরা এতো আপন কবে হলো?পরক্ষণেই মুখরের উপর ভীষণ অভিমান হলো আজকের ঘটনা নিয়ে। ছেলেটা তাকে কথায় কথায় অপমান করে! সে কি এতো অপমানের যোগ্য আদৌও?
.
মুগ্ধের পড়ার রুমে ঢুকতেই দেখলাম মুখর পাশের রুমে মুগ্ধকে কিছু একটা নিয়ে ভীষণ কথা শোনাচ্ছে! আমি চুপচাপ মুখরের কথা শুনছি। সে মুগ্ধকে ধমকে বললো,
‘কি সমস্যা তোর? স্কুলে এতো কি করিস যে ডেইলি তোর স্কুলের জামাটা এতো ময়লা হয়? সাথে তো ব্যাগটারও নাজেহাল অবস্থা! প্রতিদিন তুই আমাকে তোর স্কুলড্রেস ধোয়াবি, মুগ্ধ?’
মুখর অনবরত প্রায় এক মিনিট বকবক করেছে। তার উত্তরে মুগ্ধ কিচ্ছু বলেনি। কিছুক্ষণ পর মলিন মুখে মুগ্ধ ফিরে আসে পড়ার রুমে। আমার সামনে বসতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি ব্যাপার, মুগ্ধ সাহেব? সাতসকালে বকা খেলেন যে?’
মুগ্ধ আগের মতোই বিরসমুখে বসে আছে। আমি বললাম,
‘বলবেন না?’
সে দুদিকে মাথা দুলিয়ে বোঝালো সে বলবে না। মুখরের বকা খেয়ে তার এতো পেট ভরেছে যে কথা-ই বের করতে পারছে না সে আর। আমি হালকা কেঁশে তাকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম,
‘আজ বোধহয় তোমার দিনটা-ই খারাপ যাবে, মুগ্ধ!’
সে বিড়বিড় করে ক্ষীণস্বরে বললো,
‘প্রতিদিনই খারাপ যায়।’
আমি কথাটা শুনেও তাকে কিছু বললাম না। কিছুটা খটকা লাগলো আমার। আজ বেশ চুপচাপ ভাবেই পড়েছে মুগ্ধ। বাড়তি কোনো কথা-ই সে মুখ থেকে বের করেনি। তার মন খারাপ দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। সে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে যাবে, আমি তাকে খুশি করার জন্য বললাম,
‘আজও আমি তোমায় স্কুলে নিয়ে যাবো, মুগ্ধ! মজা হবে, তাই না?’
কিন্তু মুগ্ধের মুখের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে আগের মতোই মনমরা হয়ে বললো,
‘আচ্ছা!’
সে তৈরি হতে গেলে আমি তাকে মনে মনে বললাম,
‘তোমাকে মোটেও তোমার ভাইয়ের মতো চুপচাপ থাকাটা মানায় না, মুগ্ধ! তোমার ভাই তো একটা বোরিং মানুষ!’
তখনই রুমে ঢুকলো মুখর। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়াতেই মনে মনে তওবা খেলাম। সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একবার দেখলো। মনে হলো যেন আমার মনের কথাটা তার কর্ণগোচর হলো। আমি ঘাবড়ে নড়চড়ে বসলাম। ছেলেটার চাহনিতে মাঝে মাঝে আমি খুব শিউরে উঠি! আজও তাই! যেন আস্ত গিলে খেয়ে ফেলবে কুমিরের মতো। আমি তাকে আরেকবার তীক্ষ্ণ চোখে দেখে মন মধ্যে বললাম,
‘নাহ! আপনি কুমির নন, আপনি হলেন পেঁচা।’
(চলবে)
(সুখবর! পর্বটা পোস্ট করেই দিলাম। পাশে থাকবেন সবাই! আর মুখর-তিথিয়া জুটি কেমন লাগছে জানাবেন।❤️)