#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৫
#তাশরিন_মোহেরা
‘আর কখনো এ নিয়ে আমায় প্রশ্ন করবেন না। নিজের লিমিটের মধ্যে থাকুন।’
এটুকু বলেই মুখর থমথমে পায়ে ভেতরে চলে যায়। ভেজা শরীরে বসে আছি। আর ভাবছি, ছেলেটার বোধহয় পানি ছোড়ার রোগ আছে। এ নিয়ে দুবার হলো সে আমাকে পানি ছুড়েছে। খুব রাগ হচ্ছে আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি।
পরক্ষণেই ভাবলাম, এতে কি আমার দোষ আছে? আমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেললাম না তো? মুখরকে আমি ১৪ দিনের বেশি জানি না। তাই তাকে হুট করে বুকের ক্ষতটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে সে কি খুব লজ্জা পেয়েছে?
সে যাই হোক, তাই বলে ছেলেটা একটা মেয়েকে এভাবে পানি ছুড়ে মারবে? সে কি মেয়ে, যে কথায় কথায় লজ্জা পাবে? আজব তো! আমার মস্তিষ্ক আমাকে নিজের দোষটা দেখতে বললেও আমার মন আমাকে বলছে যে, ‘তুই দোষী হতে পারিস না, তিথিয়া! কিছুতেই না।’ তাই দিনশেষে মস্তিষ্কের কাছে আমার মনটাই জিতে গেল। সাথে রাগটাও সপ্তমে পৌঁছালো।
হনহনিয়ে ব্যাগ নিয়ে দরজায় চলে এসেছি। জুতো জোড়া পায়ে দিতেই পেছন হতে মুখর ডাকলো,
‘মিস.তিথিয়া, মিস.তিথিয়া?’
মুখরের ডাকে আমার রাগটা কিছুটা নিভলো। মুখর তবে বুঝতে পেরেছে একটা মেয়ের সাথে তার এমন ব্যবহার করাটা মোটেও উচিৎ হয়নি! নিশ্চয়ই আমাকে সরি বলতে এসেছে ঠিক প্রথমদিনের মতো। মনে মনে খুশি উপচে পড়লেও উপরে তা দেখনোটা একদমই ঠিক হবে না। তাই আগের মতোই রাগটা খানিক বজায় রেখে পেছন ফিরলাম। মুখর তখনি সামনে এগিয়ে এলো। এক্ষুণি সে বলে উঠবে,
‘সরি মিস.তিথিয়া। আপনার সাথে এমন ব্যবহার করাটা একদমই ঠিক হয়নি।’
এ অপেক্ষার মাঝপথে মুখর মুখ খুললো,
‘ব্যাগটা দিন!’
আমি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। ছেলেটা কি বলতে গিয়ে কি বলছে? পাগল হলো নাকি? এরপর আবারো বললো,
‘আপনি নিজের ব্যাগের বদলে মুগ্ধের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস! আমি দেখলাম।’
আমি নিজের কাঁধের দিকে তাকাতেই দেখলাম মুগ্ধের স্কুলব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কখন যে তার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম খেয়ালই নেই। ছিঃ কি লজ্জাটাই না পেতে হলো। আমি কাচুমাচু করে ব্যাগটা মুখরের হাতে দিলাম। দেখলাম মুখর ক্ষুব্ধ নয়নে আমার দিকে চেয়ে আছে। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে ফেললাম। আশ্চর্য তো! মনে মনে মুখরকে যাঁতাকলে পিষে ফেললেও সামনে কিছুই বলতে পারছি না। এমনকি একঝাঁক রাগ নিয়েও চেয়ে থাকতে পারছি না। ভেজা বেড়ালের মতো চুপসে আছি বরং! নিজের উপর ক্ষোভ হলো। ব্যাগটা নিয়ে বেরোতে যাবো এমন সময় মুগ্ধ বললো,
‘ভাইয়া, আমি আজকে ম্যামের সাথে স্কুলে যাই?’
আমি তার কথা শুনে ক্ষীণ হাসলাম। মুখরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে মুগ্ধের দিকে বিরক্তিকর চাহনিতে চেয়ে আছে। তার এই চাহনিটা আমার এক বিন্দুও পছন্দ নয়। ছেলেটা কি সারাক্ষণই সবকিছুতে এমন বিরক্ত হয়? আজব তো!
আমি মুখরকে আশ্বস্ত করলাম,
‘মুগ্ধকে আমি স্কুলে দিয়ে আসতে পারবো, মুখর সাহেব। আপনি চিন্তা করবেন না।’
মুখর তার কাঁধে হাত রেখে মুগ্ধকে বললো,
‘ঠিক আছে মিনি ডেভিল! আজ তোর ম্যামের সাথে যা। দুষ্টামি করবি না আর সাবধানে যাস।’
ইশ! এমন একটা ভাব যেন আমি মুগ্ধকে কিডন্যাপ করছি। বলি কি আমি কি তাকে সাবধানে নিয়ে যেতে পারবো না? দেখতে কি এতোটাই অকর্মার ঢেকি মনে হয় আমায়? হাত মুট করে সরু চোখে মুখরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করলাম কিছুটা। মুখর আমার দিকে না তাকিয়েই ভেতরে চলে গেল। এতে আমার মনটা আরও একধাপ বিষণ্নের দিকে এগিয়ে গেল। কি এমন বললাম আমি যে এভাবে উপেক্ষা করতে হবে তার? ভীষণ রূঢ় আপনি, মুখর সাহেব! ভীষণ!
মুগ্ধকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার মাঝে সে বলে উঠলো,
‘ম্যাম, আপনার কার (গাড়ি) কেমন লাগে?’
আমি হেসে তাকে জানালাম,
‘কার তো কমবেশি সবারই পছন্দের। আমিও পছন্দ করি। নিজের একটা কার থাকলে বেশ সাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যায়।’
মুগ্ধও উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বললো,
‘জ্বি ম্যাম। আমার না প্রতিদিন রোদে হেঁটে আসতে একদম ভালো লাগে না। যদি একটা নিজের কার থাকতো তবে তাতে বসে হাওয়া খেয়ে আসতাম খুব আরামে, তাই না? কি মজা হতো!’
‘হুম, ঠিক বলেছো! কিন্তু আমাদের তো নিজের কার কেনার মতো অতো টাকা নেই, তাই না!’
মুগ্ধ এবার বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,
‘ম্যাম, আমি বড় হলে অনেক টাকা কামিয়ে একটা কার কিনবো। আর তাতে বসে আরামে বাইরে যাবো, আসবো। আপনাকেও প্রতিদিন দিয়ে-নিয়ে আসবো। ভাইয়াকেও আর কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে সবখানে ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে না।’
আমি মুগ্ধের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিলাম। দশ বছর বয়সী একটা ছেলের পরিবারের সবাইকে নিয়ে কতো চিন্তা! পরিবারের কথা তো বাদ দিলাম। আমাকে নিয়ে তার এতো চিন্তা হওয়ার তো কথা না!
মুগ্ধের মানসিকতা আমার খুব ভালো লেগেছে। দুষ্টু হলেও তার আচরণ খুব অমায়িক! যা বাকি সবাইকে ভালোবাসতে বাধ্য করে!
মুগ্ধের স্কুলের গেইটে পৌঁছাতেই তার সমবয়সী দুজন ছেলে মুগ্ধের কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘কিরে, মুগ্ধ? কেমন আছিস?’
মুগ্ধ কাচুমাচু হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম আমার সামনে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে সে লজ্জা পাচ্ছে। তাই তড়িৎ তাকে বিদেয় দিয়ে বললাম,
‘আজ তাহলে আমি যাই, মুগ্ধ! ভালো থেকো।’
সেও আমাকে বিদেয় দিয়ে স্কুলে ঢুকে পড়লো। আর আমি চটচটে মেজাজ নিয়ে পাড়ি দিলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
.
‘এই চাশমিশ! আমাকে আরো এক কাপ কফি এনে দাও, এক্ষুণি!’
মেয়েটার কথা শুনে রূপক ভাই তার চশমাটা ঠিক করে চটজলদি ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে গেল। আর এ দেখেই আমার মেজাজটা আরও বেড়ে গেল। রূপন্তী মেয়েটা রূপক ভাইকে পেয়েছে টা কি? যখন যা খুশি তা-ই করাবে?
মেয়েটার দিকে আড়চোখে চেয়ে থাকতেই সে আমাকে ইশারা করলো। আমি তার কাছে গেলাম বিক্ষিপ্ত মনে। এরপর সে তার পা দুটো সামনে অন্য চেয়ারে রেখে আমাকে বললো,
‘এই মেয়ে! নাও, আমার পা দুটো টিপে দাও!’
রূপকা ভাই মেয়েটার কাজ করছে টাকার জন্য। এ মুহুর্তে টাকা তার ভীষণ দরকার। তাই আমিও সায় দিয়েছিলাম রূপক ভাইয়ের প্রস্তাবে। কিন্তু সামান্য ক’টা টাকার জন্য মেয়েটা আমাকে দিয়ে পা টেপাবে, এমন দুর্দিন আমার এখনো আসেনি। নিজের আত্মসম্মানটা বজায় রেখে আমি বললাম,
‘পারবো না।’
মেয়েটা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে ধমকালো,
‘কি? এই মেয়ে কি বললা তুমি?’
আমিও এবার তার চোখে চোখ রেখে দ্বিগুণ ধমকে বললাম,
‘কানে কি ময়লা জমেছে? শুনতে পাননা?বলেছি আমি আপনার পা টিপতে পারবো না।’
মেয়েটা তৎক্ষণাৎ চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বললো,
‘শোনো! কথামতো পা টিপো। আমার কথার অবাধ্য হলে এক টাকাও পাবে না তুমি, বুঝলে?’
আমি তার আঙুলটা নিচে নামিয়ে বললাম,
‘আপনার টাকার আমার দরকার নেই। যদি টাকা দিতে না চান, তবে আপনার একটা এসাইনমেন্টও আর কমপ্লিট হবে না! লসটা কার হবে, আপু? আমার না রূপক ভাইয়ের?’
একথায় মেয়েটাকে কিছুটা অপ্রস্তুত দেখালো। সে এদিক ওদিকে চেয়ে চুপ করে গেল। আমি বাঁকা হাসলাম। হাহ্! আমায় শায়েস্তা করতে এসেছে! সে তো আর জানে না, সে যদি কচি খুকী হয় তবে আমি তার বাপ!
এমন সময় গরম কফি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হয় রূপক ভাই। তাকে বেশ ভীত দেখাচ্ছে। সে কিছুটা তোতলানোর মতো করে বললো,
‘আ-আসলে ক্যান্টিনে অনেক ভীড় থাকায় কফিটা আনতে দেরি হয়ে গেছে, আপু। সরি!’
সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে জড়সড় হয়ে। আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। ছেলে হয়েও সে সামান্য একটা বড়লোকের বখে যাওয়া দুলালিকে ভয় পাচ্ছে! কি অদ্ভুত!
রূপন্তী মেয়েটা রূপক ভাই হতে ছোঁ মেরে কফির কাপটা নিয়ে তাতে চুমুক বসালো। আমি তাকে সরাসরি হুমকি দিলাম,
‘পরেরবার থেকে রূপক ভাইকে দিয়ে আর কোনো কাজ করাবেন না। নয়তো তাকে দেওয়া এসাইনমেন্টগুলোও সময় মতো পাবেন না, বলে দিলাম।’
হুমকিতে বোধহয় কাজ হয়েছে। আমার কথায় মেয়েটা নিঃশব্দে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো চেয়ারে। আমি রূপক ভাইকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। তাচ্ছিল্য করে বললাম,
‘কি গো রূপক ভাই! সিনিয়র হয়ে সবার কাছ থেকে কোথায় তুমি আমাকে বাঁচাবে, তা না উল্টো আমারই তোমাকে বাঁচাতে হলো।’
রূপক ভাই এতে খানিকটা লজ্জা পেয়ে বললো,
‘থ্যাংক ইউ রে!’
আমি এর সুযোগ নিয়ে বললাম,
‘তা হলে আমায় ট্রিট দাও। টং এ গিয়ে চা খাই, চলো। মনটাও ফুরফুরে হবে।’
রূপক ভাই ঠোঁটটা চওড়া করে বললো,
‘ঠিক আছে চল।’
(চলবে)