#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_০৪
#তাশরিন_মোহেরা
স্নিগ্ধ সকালের এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। পরিষ্কার নীল আকাশে সাদা মেঘ উড়ছে। ঠান্ডা মনোরম বাতাস বইছে। তবে এই স্নিগ্ধ, মনোরম দিনের শুরুটা আমার মোটেও ভালো হয়নি। অনিবার্য কারণে আজ মুখর আমায় মুগ্ধকে পড়াতে আসতে না করেছে। তাই ভেবেছি সকালে আজ একটু দেরিতে উঠবো। কিন্তু তা আর হলো কই? সকাল আটটা থেকে ফোনটা আমার বেজেই যাচ্ছিলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে কেউ বলছে,
‘তিথু, জলদি রেডি হয়ে ভার্সিটি চলে আয়।’
কে কল দিয়েছে তা আর দেখার প্রয়োজন পড়লো না আমার। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,
‘এই সাতসকালে আমি ভার্সিটি গিয়ে কি করবো, রূপক ভাই?’
রূপক ভাই পুনরায় ফিসফিস করে বলছে,
‘একটু কাজ আছে। আয় না, আমার বোন!’
আমি তাকে আর না করতে পারলাম না। এই মানুষটা হলো ভার্সিটির এক বড় ভাই। নাম রূপক খন্দকার। নিত্যদিনই তার কিছু না কিছু কাজ পড়ে যায়। আর সেই কাজে সাহায্য করার একমাত্র ব্যক্তি হলাম আমি। দিন নেই, ক্ষণ নেই তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসতে হয় আমার। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না! খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
ভার্সিটি ঢুকতেই দেখলাম একগাদা পেইজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপক ভাই। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আবার কি হলো, বলো তো! কে তোমায় আবার কাজ দিলো?’
রূপক ভাই আহ্লাদের সুরে বললো,
‘তুই ছাড়া এই ভার্সিটিতে আমার আর কে আছে বল? দেখতে একটু হাবাগোবা বলে কেউই আমার সাথে মিশতে চায় না। তাই তোকেই বারবার বিরক্ত করি কাজ দিয়ে।’
আমি তাকে থামিয়ে বললাম,
‘আর মাখন ঢলতে হবে না, রূপক ভাই। কি কাজ আছে তা-ই বলো!’
রূপক ভাই আমাকে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম এক মেয়ে বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে। রূপক ভাই আমাকে বললো,
‘ইনি হলেন আমার এক বছরের সিনিয়র আপু, রূপন্তী।’
এটুকু বলেই রূপক ভাই আমাকে ইশারায় বললো,
‘সালাম দে!’
আমিও সৌজন্যতার সহিত মেয়েটাকে সালাম দিলাম। কিন্তু, আশ্চর্য! সালামের উত্তর দেওয়া তো দূর, মেয়েটা আমার দিকে ফিরেও দেখলো না। ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। রূপক ভাই এবার বললো,
‘আপুর সামান্য কিছু এসাইনমেন্ট আমাদের করে দিতে হবে। সেজন্যই তোকে ডাকলাম। আমি অর্ধেক করবো আর তুই বাকি অর্ধেক।’
কিন্তু এসাইনমেন্টের বাহার দেখে মনে হলো না ‘সামান্য কিছু’। হয়তো সারা বছরের সবটাই আমাদের দিয়ে করাতে চাইছে এই মেয়ে। আমি রূপক ভাইকে ফিসফিসিয়ে বললাম,
‘এই মেয়ে আমাদের ব্যবহার করছে, রূপক ভাই।’
রূপক ভাইও আমাকে ফিসফিস করে বললো,
‘আরেহ! মেয়ে মেলা বড়লোক। এই কাজটা করে দিলে আমাদের লাভই হবে, তিথু। তুই ভাবিস না।’
মেয়ের হাবভাব আমার বিন্দুমাত্র পছন্দ হলো না। বড়লোক বলে ভার্সিটিতে দাপট দেখাচ্ছে। তার চোখ দেখেই বোঝা যায় মনটা অহংকারে ঢেকে পড়েছে সম্পূর্ণ। কিন্তু রূপক ভাইকে না করার ইচ্ছে আমার নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই এসাইনমেন্টগুলো নিতে হলো।
.
‘ভাইয়া রুটি বানাতে দক্ষ হতে চায় তাই আজ থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত আপনার এই রুটি আর আলুভাজিই খেতে হবে, ম্যাম!’
মুগ্ধ টেবিলে নাস্তা রাখতে রাখতে কথাটুকু বললো। তার কথা শুনে রীতিমতো একটা বড় আঘাত পেলাম। নিজের কপালটা দেয়ালে ঠু’কে ম’রে যেতে ইচ্ছে হলো আমার। এই কোন পা’পে’র শাস্তি দিচ্ছে লোকটা আমায়। মুগ্ধের কাছে জানতে চাইলাম,
‘হ্যাঁ গো, মুগ্ধ! রোজ রোজ এসব খেতে তোমার ভালো লাগে?’
মুগ্ধের মুখশ্রী দ্বিগুণ মলিন হয়ে গেল। সে দুদিকে দুবার মাথা দুলিয়ে বললো,
‘উহু! একদমই না।’
আমি দু’হাত মুট করে ভাবলাম এ নিয়ে কি করা যায়! মুখরকে কি সরাসরি বলবো, ‘আপনার রান্না খুব খারাপ, মুখর সাহেব।’ না না! একথা বলার সাধ্যি আমার নেই। তবে উপায়? কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম মনে মনে। সিনেমার নায়কদের মতোই থ্রিপিসের হাতাটা গুটিয়ে নিলাম। বেশ ভাবের সাথে হিজাবটাও ঠিক করলাম। এ দেখে মুগ্ধ অবাক হয়ে বললো,
‘ম্যাম? কি হয়েছে?’
আমি তার পিঠ চাপড়ে বললাম,
‘রান্নাটা আজ আমিই করি, কি বলো মুগ্ধ?’
মুগ্ধের নয়ন খুশিতে নেচে উঠলো। লাফিয়ে সে সম্মতি জানালো। আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেল রান্নাঘরে। সেখানে পো’ড়া পো’ড়া রুটি সেঁ’ক’ছে মুখর। পুরো রান্নাঘরটাই ধোঁয়ায় ছেঁয়ে গেছে। তা উপেক্ষা করেই আপনমনে রুটি সেঁ’কে যাচ্ছেন মুখর সাহেব। অতরিক্ত ধোঁয়ায় আমি আর মুগ্ধ কাঁশতে শুরু করলাম। এ দেখে মুখর পেছন ফেরে। ঠিক তখনি আমার চোখ যায় তার শ্যা’ম কপালে ছড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ চুল যা ময়দা লেগে কিছুটা সাদা হয়ে গেছে। এতেও দেখতে ভারী অ’মা’য়ি’ক লাগছে মুখরকে। পরক্ষণেই নিজের কান্ডে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই বে’হা’য়া’র মতো তাকিয়ে ছিলাম মুখরের দিকে। তড়িৎ দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম আমি। মুগ্ধ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে তার গায়ের এপ্রোনটা খুলে আমার হাতে তুলে দিলো। উৎফুল্ল চিত্তে মুখরকে বললো,
‘ভাইয়া, আজ নাকি ম্যাম আমাদের জন্য নাস্তা বানাবেন।’
মুখর মুখটা কুঁচকে আমার দিকে একবার তাকালো। পরপরই মুগ্ধের দিকে চেয়ে বললো,
‘মানে? নাস্তা তো আমি বানিয়েছিই!’
মুগ্ধ অভিযোগের সুরে মুখরকে বললো,
‘তোমার নাস্তা খেয়ে প্রতিদিন স্কুলে আমার বা’থ’রু’মে যেতে হয়। সবাই হাসাহাসি করে আমায় নিয়ে।’
কথাটা শুনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম আমি। মুখর আবারো সেই বিরক্তির চাহনি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছে। হাসি থামলো আমার সাথে সাথেই। মুখর আমার কাছ থেকে এপ্রোন নিয়ে বললো,
‘আমার বাড়িতে পড়াতে এসে কেউ নাস্তা বানাক, এ আমি হতে দেবো না। অযথা ব্যস্ত হবেন না, মিস.তিথিয়া। আমি আবারো ভালো করে নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।’
কিন্তু মুগ্ধের জেদের কাছে মুখরের ভাবটা আর টিকলো না। অতঃপর শুধুমাত্র আজকের জন্য এ ঘরের রাঁধুনি হয়ে গেলাম আমি। গরম রুটি আর আলুভাজি দিয়ে বেশ ভরপেট ভোজন হলো মুগ্ধ আর মুখরের। মুগ্ধ খাওয়া শেষ করে বললো,
‘উম্ম! ম্যাম আপনি খুব ভালো রাঁধেন। আমার তো আরও খেতে ইচ্ছে করছে।’
তখনি দেখলাম মুখর চোখ পা’কি’য়ে মুগ্ধকে ইশারা করলো। সে মাথা নিচু করে স্কুলের জন্য তৈরি হতে চলে গেল। আমি মুচকি হেসে চায়ে চুমুক দিলাম। এমন সময় মুখরের সংক্ষিপ্ত জবাব,
‘খাবার ভালো হয়েছে।’
আমি মুখরের প্রত্যুত্তরে ক্ষীণ হাসলাম। পরপরই পিনপতন নিরবতা। পরিবেশটা খুব বি’চ্ছি’রি রকমের চুপচাপ হয়ে আছে দেখে আমার ভালো লাগলো না। আবার কি বলবো তাও খুঁজে পেলাম না। এ মুহুর্তে ডাইনিং টেবিলে আমি আর মুখর ছাড়া আর কেউ নেই। তাই কিছু না বলতে পেরে কেন যেন অ’স্ব’স্তি হতে লাগলো। হঠাৎ আমার মাথায় খেলে গেল একটা দৃশ্য। প্রথম যেদিন মুখরকে দেখেছিলাম, খেয়াল করেছি মুখরের বু’কে’র কিছুটা নিচের দিকে একটা কালচে হয়ে আসা ক্ষ’ত। যা দেখেই বোঝা যায় বেশ গুরুতর আ’হ’ত হওয়ার ফল এটি। তাই কৌতুহল চাপাতে না পেরে বলে ফেললাম,
‘আচ্ছা মুখর সাহেব, আপনার বু’কে’র নিচের দিকে দাগটা কিসের?’
মুখর গ্লাসে পানি নিয়ে তাতে চুমুক দিতে যাবে, এমন সময় আমার প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল। আমি তার দিকে বোকার মতো চেয়ে আছি। আর সাথে সাথেই মুখর হাতের পানিটুকু ছু’ড়ে মারলো আমার দিকে। হঠাৎ এমন হওয়ায় আ’তঁ’কে উঠলাম আমি। রা’গে শরীর কেঁ’পে উঠলো খানিক। তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই দেখলাম তার চোখেও আমার জন্য স্ফু’লি’ঙ্গ ঝরছে। র’ক্ত’চ’ক্ষু নিয়ে আমায় বললো,
‘আর কখনো এ নিয়ে আমায় প্রশ্ন করবেন না। নিজের লিমিটের মধ্যে থাকুন।’
(চলবে)
(অনেক তো হলো ‘নেক্সট, নাইস’ এসব কমেন্ট! এবার গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি পাঠকমহল থেকে। ধন্যবাদ!)