#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৪
#তাশরিন_মোহেরা
অতিরিক্ত মন খারাপ দেখে রূপক ভাই আমাকে আর ভার্সিটি আটকে রাখলেন না। একটা ট্যাক্সি ডেকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাসায় এসে দেখলাম আব্বা সোফায় বসে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর খবরের কাগজ পাঠ করছেন। রান্নাঘর থেকে সুমির আওয়াজ ভেসে আসছে। সে ড্রয়িংরুমে আসতে আসতেই বলছে,
‘খালুজান, আফনে আর কিছু খাইবেন নি?’
দরজার কাছে আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এবার আমার দিকে ফিরে বললো,
‘আফা! আইজ তাড়াতাড়ি আইয়া পড়লেন যে?’
আমি বিরসতা নিয়ে বললাম,
‘এমনি! ভালো লাগছে না।’
মুখরের বিরহে এতোটাই কাবু হয়ে গেছি যে কারো সাথে কথাও বলতে ইচ্ছে হলো না। শারীরিক খারাপ লাগাটা মানুষ সইতে পারে কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা বোধহয় সবার থাকে না। হৃদয়ের অনলে দগ্ধ হয়ে প্রতিনিয়ত বাঁচার ইচ্ছেটাও লোপ পাচ্ছে! রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। কিছুই ভালো লাগছে না আমার! জানালার পাশে গিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়লাম। পরিষ্কার আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। শূন্য মস্তিষ্ক ঠিক কি ভাবছে তা আমি জানি না! হঠাৎ ঐ আকাশে মুখরের কঠিন চাহনি ভেসে উঠলো। সাথে সাথে চোখটা বন্ধ করে ফেললাম আমি। আর তার সাথেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আরো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। নিজের উপরই কেমন বিরক্ত লাগছে আমার! কথায় কথায় ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদার অভ্যাস তো আমার ছিল না! তবে এই কিছুদিন ধরে কেন নিজের কান্নাগুলো আটকে রাখতে পারছি না আমি? বয়স তো কম হলো না আমার! এই বয়সে এসে এমন বাচ্চাদের মতো কাঁদাটা কি আমায় মানায়?
দরজায় কড়াঘাত পড়লো। আব্বা ডাকছেন আমায়। নিশ্চয়ই মন খারাপটা খেয়াল করেছেন! এই মন খারাপটাও যেন আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না! সকালবেলা রূপক ভাইয়ের কাছে আর এখন আব্বার কাছে ধরা পড়ে গেলাম। তবে আব্বার উপর অভিমান হয়েছে আমার ভীষণ! কেনই বা এতো অভিমান তা বুঝে উঠছি না। আব্বা তো রোজই আমায় কটুকথা শোনায়! ছোট থেকেই আব্বার কাছে শুধু ‘না’ ই শুনে এসেছি। বাইরে খেলতে যাওয়া, আব্বার সাথে শপিং করতে যাওয়া কিংবা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আবদার কখনো করতে পারিনি আমি! যতবারই আব্বার কাছ থেকে এসবের অনুমতি চেয়েছি ঠিক ততোবারই আব্বা আমায় কড়া কথা শুনিয়েছেন। শক্ত হাতে আটকে রেখেছেন আমার হাত দুটো! কোথাও যেতে দেননি! কিন্তু তাতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। কখনো আব্বার মুখের উপর কিছু বলিনি! মুখ বুজে সবটা সহ্য করেছি শুধুমাত্র এই ভেবে, আব্বা আমার ভীষণ একা! আমায় ছাড়া তার কোনো ভরসা নেই, আপনজন নেই!
কিন্তু আজ এই অভিমানের কারণ বোধহয় তার অমত দেওয়া নয়! ভালোবাসার কথা আব্বাকে জানিয়েছি নামমাত্র! এসবে তিনি মত দেবেন এটা আশা করাটাও বোকামি! কিন্তু আমার খারাপ লাগার বিষয়টা মুখর! আব্বা মুখরকে নিয়ে যা তা ভাবছেন, এটাই আমার অভিমানের মূল উদ্দেশ্য।
দরজাটায় ইতোমধ্যেই অনেকবার ধাক্কা দিয়ে ফেলেছেন আব্বা! জেদ করেই এসব করছেন তিনি। যতক্ষণ আমি দরজা খুলবো না এভাবেই ধাক্কাতে থাকবেন। বিরক্ত হয়ে শেষমেশ দরজাটা খুলে দিলাম। ক্ষণেই সুরটা কোমল করে আব্বা বললেন,
‘আয়, নাস্তা খেতে আয় মা! অনেকদিন হলো তোর সাথে বসে নাস্তা করা হয়না।’
তার এই নিঃসংকোচ আবেদনকে আমি আর না করতে পারিনি। কোমল মুখশ্রীটা দেখেই আমার মনটা বরফের মতো গলে গেছে।
সোফায় আব্বার সাথে বসে নাস্তা করছিলাম। এমন সময় খবরের কাগজে চোখ গেল। শিরোনামে বড় করে লেখা,
‘কে ও মিলস এন্ড ফ্যাক্টরিজ এর বিভিন্ন শাখায় আগুন।’
শিরোনামটা দেখেই মনটা আরও ছোট হয়ে গেল। এদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়ত কত মানুষ তাদের প্রাণ হারায়! সংবাদের পাতা খুলতেই এসব চোখে পড়ে প্রতিটা দিন। তাই অনেক আগেই আমি খবর পড়া ছেড়ে দিয়েছি। এসব পড়ে নিজেকে ভীষণ অনিরাপদ মনে হয়! বাইরে বের হওয়াটাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
.
ভার্সিটির রোড ধরে আগাচ্ছি, ঠিক তখনি সেদিনের ছেলেটাকে চোখে পড়লো। যে কিনা মুখরের মতো একই পারফিউম লাগিয়ে রাস্তায় ঘুরছিলো। আজ সে চোরের ন্যায় এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এরপরই হঠাৎ একটা সরু গলির মাঝে ঢুকে পড়লো। এদিকটায় কেউ খুব বেশি যায় না। গলিটা ভীষণ গা ছমছমে! তাই নিঃশব্দ সেই গলিটা ধরে ছেলেটার যাওয়াটা আমার সন্দেহজনক মনে হলো। কিছু না ভেবেই আমি তার পিছু নিলাম। গলির সামনে আসতেই আমি থমকে গেলাম। বুকটা দুরুদুরু করছে। ছেলেটার পিছু নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? কেনই বা আমি তার পিছু নিচ্ছি?
আচ্ছা? তার মাধ্যমে যদি মুখরের খোঁজ পাওয়া যায়? না! এ কি করে সম্ভব? মুখরের খোঁজ কেন আমি এই অজানা ছেলেটার কাছ থেকে পাবো? উল্টো আমিই যদি বিপদে পড়ি? বিপদে পড়লে তো ফোন আছেই! সাথে সাথে রূপক ভাইকে ফোন দিলেই তো সে ছুটে চলে আসবে।
এটুকু ভেবেই আমি একবুক সাহস নিয়ে গলিটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। ক্ষীণ আশা এখনো আমার হৃদয়ে বিদ্যমান। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে ধীরপায়ে গলিটার মাঝে হাঁটছি। ভয়ে বুকটা হাতের মুঠোয় চলে আসতে চাইছে! হাত পা সবই অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে!
গলিটার পথ ধরে সোজা আসতেই একটা পুরোনো বিল্ডিং দেখতে পেলাম। যা অসম্পূর্ণ রেখেই ফেলে দেওয়া হয়েছে। বিল্ডিংটার ভেতরে জায়গায় জায়গায় বালি, সিমেন্ট পড়ে আছে। তার পাশেই খালি একটা মাঠ। এদিকটায় মানুষ খুব কমই বলা যায়। হঠাৎ বিকট শব্দে দুটো গুলির আওয়াজ হলো। সাথে সাথে চমকে উঠলাম আমি। শরীর বেয়ে অনবরত ঘাম ছুটছে আমার! হাত দুটো ভয়ে ঠান্ডা হয়ে এসেছে। আশেপাশে ভয়ার্ত চোখে দেখলাম একবার। দেখি ছেলেটা বিল্ডিংটার পেছন দিক হতে আসছে। তার পায়ের দিকটায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বেরিয়েই সে আমার দিকে ফিরলো। তার সাথে চোখাচোখি হলো আমার। ছেলেটার চোখ দুটো অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে। আর সে রক্তচক্ষু নিয়ে ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে!
তাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমার শরীর হঠাৎ অচল হয়ে পড়লো। বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম আমি। চিৎকার করতে গিয়েও করতে পারলাম না। এদিকে মস্তিষ্ক বলছে, ‘দৌঁড়া তিথি! জানটা নিয়ে দৌঁড়া!’
কিন্তু পা চলছে না কিছুতেই! ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। কিছুক্ষণ আগে যাকে গুলি করে মেরেছে, ঠিক তেমনি ভাবে আমাকেও নিশ্চয়ই মারবে! অকালেই তবে আমার প্রাণটা যাবে? মুখর সাহেব, আপনাকে দেখার আগেই আমার প্রাণটা হারাতে হলো তবে? আব্বা! আমায় ক্ষমা করবেন আপনি। আমার মৃত্যুর পর আপনি একা হয়ে যাবেন, জানি! কিন্তু কি করার? আমার আয়ু যে এটুকুই!
ছেলেটা আমার কিছুটা কাছে আসতেই হঠাৎ বাঁচার তীব্র আশা জেগে উঠলো আমার মনে। তাই চিৎকার করে আকাশের দিকে আঙুল তাক করে বললাম,
‘আয় হায়! পারমাণবিক বোমা!’
ছেলেটা চমকে পেছনে আকাশের দিকে তাকায়। আমি এ সুযোগে দিগবিদিক না দেখেই সামনে দিলাম এক ভো দৌঁড়। ছেলেটা আমার মিথ্যা অভিনয়টা বুঝতে পেরে আমার পিছু দৌঁড় দেয়। কিন্তু আমি দৌঁড়াতে গিয়ে সরু গলিটার মাঝে না ঢুকে সামনে নিস্তব্ধ রাস্তাটা ধরে আগালাম। ভুল হয়েছে ভেবে নিজেকে ধিক্কার জানালাম কয়েকবার। এদিকের কিছুই তো আমি চিনি না! তবে এখন? এখন কোথায় যাবো আমি? পেছন ফিরে দেখলাম ছেলেটা এখনো আমার পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে! আমি এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়াচ্ছি। অন্ধের মতো দৌঁড়ানো যাকে বলে! মাঝে একবার হোঁচটও খেয়েছি! যা ভীষণ পীড়া দিচ্ছে এ মুহুর্তে। কিন্তু এসব ভাবার এখন উপায় নেই। চোখ বুজে প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছি তো দৌঁড়াচ্ছি। হঠাৎ কারো পিঠের সাথে জোরে ধাক্কা খেলাম। যার সাথে ধাক্কা খেয়েছি সে মানুষটা টাল সামলাতে পেরে আমাকে নিয়েই রাস্তায় পড়ে গেল। ছেলেটার মাথা পুরোটাই মাটির সাথে মিশে গেছে। আর আমি তার পিঠের উপর বসে আছি। ছেলেটাকে খেয়াল করারও সময় নেই এখন। নিজের জীবনটা আগে! তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়েই দৌঁড় দেওয়ার জন্য পুনরায় প্রস্তুত হলাম এমন সময় আগন্তুক আমার হাত আঁকড়ে ধরলো। চিরচেন সেই কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘মিস.তিথিয়া?’
আমি পেছন ফিরে তার মুখটা দেখার আগেই ভারসাম্য হারালাম। সবকিছু অন্ধকার দেখেই একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়তে নিলাম। কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই চোখ বন্ধ করেই অনুভব করলাম চিরচেনা সে হাত আমায় আগলে নিয়েছে তার বাহুডোরে। এরপর আর কিছুই আমার মনে নেই!
(চলবে)