#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২২
#তাশরিন_মোহেরা
আজ প্রায় একমাস হতে চললো মুখরের কোনো হদিস নেই। এলাকার আনাচে কানাচে খোঁজা হয়ে গেছে, কিন্তু তার দেখা কোথাও মিললো না। মিলবেই বা কি করে! যারা নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায় তাদের খুঁজে পাওয়াটাও অনিশ্চিত!
একবুক হতাশা নিয়ে দরজা খুলে মুগ্ধের বাসায় প্রবেশ করলাম। ঢুকতেই দেখলাম আন্টি পড়ার রুমটা গুছিয়ে রাখছেন। আমাকে আসতে দেখেই মলিন মুখটায় হালকা হাসি টেনে বললেন,
‘এসেছো মা! বসো, আমি মুগ্ধকে ডেকে দিচ্ছি।’
আমি চুপচাপ বসলাম। মুগ্ধ এ কদিন যাবৎ স্কুলে যায়নি। তার পায়ের ক্ষতটা সেরেছে তবে আন্টি তাকে বাইরে বের হতে দিতে নারাজ। তিনি এখনো বেশ ভয়ে আছেন। আমাকেও কিছুদিন ছুটি দিয়েছিলেন তবে মুগ্ধের জন্য তা আর হলো না। সে আমার কাছে পড়ার অনুরোধ করলো মা’কে। তাই আবারো আগের মতো তাকে পড়াতে আসছি।
পড়ার রুমের ঠিক সামনেই আগে মুখরকে দেখতাম আমি। মুগ্ধকে পড়ানোর ফাঁকে উঁকি মেরে দেখতাম সে তার রুমটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে। কিন্তু এখন সেই রুমটায় মুখর নেই। আন্টি থাকছেন সেখানটায় মুগ্ধকে নিয়ে।
কিছু সময় পর মুগ্ধ এসে বসলো। আজ তাকে অতিরিক্ত শান্ত দেখাচ্ছে। চুপচাপ বসে আছে। গত একমাসে সে প্রতিদিন তার ভাইয়ার জন্য কেঁদেছে। পড়তে বসে কেঁদেছে, স্কুলে গিয়ে কেঁদেছে, খেলতে গিয়ে কেঁদেছে। আমি এলেই সে দৌঁড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলতো,
‘ম্যাম, ভাইয়া আজও আসেনি!’
আর আমি নির্বাক হয়ে তার দুঃখের সঙ্গী হতাম। আন্টিও ভেতরের রুম হতে থেমে থেমে কাঁদতেন।
তবে আজ তার ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমি যা প্রশ্ন করছি তার বাইরে একটা কথাও সে বলছে না। ভাইয়ার কথাও আজ জিজ্ঞেস করছে না! তার এমন শান্ত আচরণ দেখে অদ্ভুত লাগলো। পড়ানো শেষে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি ব্যাপার, মুগ্ধ? আজ সকালবেলা উঠেই কাঁদলে না যে?’
সে আগের মতোই বেশ শান্ত হয়ে বললো,
‘আমি আর কাঁদবো না, ম্যাম!’
আমি অবাক হলাম। তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেন, বাবা?’
‘আমাকে ভাইয়া বলেছে!’
আমি এবার তার কথায় চমকে উঠলাম। মুখর বলেছে মানে? সে কি ফিরে এসেছে? সে ফিরে এলে মুগ্ধ আমায় বলেনি কেন? আর কেনই বা তার মুখখানা মলিন হয়ে আছে?
আমি মুগ্ধকে বললাম,
‘ভাইয়া বলেছে মানে? মুখর সাহেব ফিরে এসেছেন?’
সে দু’দিকে মাথা দুলালো। তার মানে মুখর এখনো ফেরেনি। আমার মনে যে ক্ষীণ আশাটুকুর সঞ্চার হয়েছিলো তা তক্ষুণি নিভে গেল। মুগ্ধ আবারো বললো,
‘ভাইয়া আমার স্বপ্নে এসেছিলো। আমাকে বলেছে, বড় ছেলেরা কাঁদে না। তাই আমাকেও নিষেধ করেছে আর না কাঁদতে। তাই আমি ভেবেছি আর কাঁদবো না কখনো!’
ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগলো তার। বহুকষ্টে কান্না থামাচ্ছে সে। মুগ্ধের পেছনে ঠোঁটে হাত চেপে আন্টিও নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছেন। আমার বুকটা ছিন্নভিন্ন হতে চাইলো যেন।
‘কোথায় গেলেন আপনি, মুখর সাহেব? এতোগুলো মানুষগুলোকে কষ্টে ফেলে কোথায় গেলেন আপনি?’
আমার ছিন্ন মনটা ভেতর থেকে ডেকে উঠলো। মুখরের উপর ঘটা করে আবারো রাগ উঠলো, চরম রাগ! যেন সামনে পেলেই শার্টের কলার চেপে ধরবো! কিন্তু তা হওয়ার নয়। আর কবে মুখরের দেখা মিলবে কেউ জানে না। সে যে আদৌও বেঁচে আছে তা নিয়েও সন্দেহ আছে সবার। নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে ছেলেটা প্রতিপক্ষের সাথে লড়তে গিয়েছে। জিতে গেলে তো কবেই ফিরতো, তাই না? কিন্তু আজ তো পাক্কা একমাস হতে চললো! এখনো তার বাঁচার আশা করাটা যে বড্ড বোকামি হয়ে যাবে।
.
দীর্ঘ এক ব্যস্ত দিন পার করে বাসায় পৌঁছালাম। এসে জিরোবারও ফুরসত নেই। রান্নাঘরে ঢুকে আব্বার জন্য সহ দু’কাপ চা বসিয়ে দিলাম চুলোয়। চা বানাতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো এক সকালে আমি মুগ্ধ আর মুখরের জন্য কেক বানিয়ে এনেছিলাম আমার জন্মদিন উপলক্ষে। সেদিন মুখর আমাকে বলেছিলো,
‘চলুন, মিস.তিথিয়া! আপনাকে আমার স্পেশাল চা খাওয়াই!’
আমিও খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,
‘ঠিক আছে, মুখর সাহেব!’
সেদিন দেখলাম মুখর সাহেব সম্পূর্ণ উল্টো পদ্ধতিতে চা বানাচ্ছেন। আমি সচরাচর নিজের জন্য চা বানাতে গেলে প্রথমেই একটা লিকার তৈরি করে তাতে পরিমাণমতো তরল দুধ ঢেলে দেই। চা হয়ে গেলে এক কাপে চিনি নিয়ে চা’টা তাতে ঢেলে দেই। কিন্তু মুখর প্রথমেই একটা কড়া লিকার তৈরি করে তা আলাদা করে রাখলেন। একটা কাপে তরল দুধ নিয়ে তাতে আধা চামচ চিনি আর দু’চামচ পাউডারের দুধ দিলেন। কড়া লিকারটা ছাকনি দিয়ে ঐ দুধ-চিনির মিশ্রণটাতে ঢেলে দিলেন। গরম গরম চা’টুকু থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণ পেলাম আমি। চায়ে চুমুক দিতেই মনে হলো স্বর্গে চলে এসেছি। এরপর আমিও কয়েকবার বাসায় এমন করে চা বানানোর চেষ্টা চালিয়েছি। মুখরের মতো অতুলনীয় না হলেও ভালো হয়েছে!
পুরোনো এই স্মৃতিতে ডুব দিয়েই মনটা আরও চূর্ণবিচূর্ণ হলো। চোখ বেয়ে অশ্রুধারা পড়ার আগেই নাক টেনে তা থামিয়ে ফেললাম। চা’টা বানিয়ে আব্বার সামনে এক কাপ রাখলাম। কিন্তু তিনি তাতে চুমুক দিতেই থু মেরে সবটা ফেলে দিলেন। বললেন,
‘এসব কি বানিয়েছিস, তিথি? চায়ের বদলে লবণ দিয়ে দিয়েছিস এতে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘কই আব্বা! আমি তো চিনিই দিয়েছিলাম।’
নিজে চুমুক দিয়ে বুঝলাম আব্বা আসলে ঠিকই ধরেছে। আমি চিনির বদলে একগাদা লবণ দিয়ে ফেলেছি। আব্বাকে বললাম,
‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি আরেক কাপ বানিয়ে আনছি!’
আব্বা আমাকে পিছু ডাকলেন। ইশারা করে পাশে বসতে বললেন। আমিও গুটিশুটি মেরে বসলাম। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘তোর কি হয়েছে বল তো! সারাক্ষণ মুখটা মলিন হয়ে থাকে। চোখের নিচেও কালি জমেছে।’
আমি নিচে তাকিয়ে বললাম,
‘পরীক্ষার জন্য পড়ার চাপ বেড়েছে, আব্বা। তাই এমন লাগছে দেখতে!’
‘আমাকে বোকা বানাতে যাস না। পড়ার যত চাপই হোক তোর চোখের নিচে কখনো কালি পড়েনা। কেননা তোর রাত জেগে পড়ার অভ্যাস নেই। কোনো সমস্যা হলে আমাকে খুলে বলতে পারিস, মা!’
ক্ষীণ স্বরে বিড়বিড় করলাম,
‘আব্বা, আমি আপনাকে কেমনে বলি একটা ছেলে আমায় এমন অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে?’
আব্বা আমাকে আবারো বললেন,
‘আমি জানি আমার পাগলামো তুই পছন্দ করিস না। তাই কখনো কিছু খুলেও বলিসনি আমায়। নিজের মধ্যে রেখেই সবসময় ফাইট করে গেছিস। কিন্তু আমারো যে আমার মেয়ের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। আমিও যে চাই তুই এসে আমাকে এটা ওটা বলিস।’
আমার মনটা আরো ছোট হয়ে গেল। আব্বা নিজের দুর্নাম করছে ঠিক, তবে আমার মনে হচ্ছে আমিই বোধহয় আব্বার মনের মতো একটা মেয়ে হয়ে উঠতে পারিনি। আব্বার অপছন্দের সবকিছুতেই আমি জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে। তন্মধ্যে সবচে’ বড় অপছন্দের ব্যাপার হলো আমি ভালোবেসেছি। মুখর নামের নিখোঁজ এক পথিকের কাছে মন দিয়ে এসেছি নিজের। যা ফেরত দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
ভাবনার মাঝে আব্বা বললেন,
‘মানুষ অনেক সময়ই মনের দ্বন্দ্বে পড়ে পথ হারিয়ে বসে। বুঝে উঠতে পারে না তার ঠিক কি করা উচিৎ! তুই যদি এমন দ্বন্দ্বে পড়ে থাকিস তবে অবশ্যই আমায় বলবি! আমি তোকে সাহায্য করতে না পারি অন্তত আমাকে বলে তোর মনটা হালকা হবে।’
আমার বুকটা দুরুদুরু করছে। আব্বাকে কি সবটা খুলে বলবো? কিন্তু এতে করে আব্বা যদি আমাকে মায়ের মতো বন্দী করে রাখে? কিন্তু এতো কিছু বলার পরও কি তিনি আমার উপর রুষ্ট হবেন? শেষমেশ কিছু না ভেবেই আব্বাকে বলে ফেললাম,
‘আব্বা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি!’
(চলবে)