অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৪

0
587

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৪
#তাশরিন_মোহেরা

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই শুনছি রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। কিছুটা সন্দেহ হলো আমার। এই সকালবেলা সুমির তো আসার কথা না! আর আব্বা ঘুম থেকে উঠেনই বেশ বেলা করে। তবে? এই সকালবেলা কে এমন টুংটাং ধ্বনি তুলছে? হাত-মুখ না ধুয়েই দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে দৌঁড় দিলাম। রান্নাঘরে পা রাখতেই দেখি আব্বা চুলোর ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। বেসিনে হাত ধুচ্ছেন, তাও চোখ মুখ খিঁচে। আমি তড়িৎ এগিয়ে দেখি তিনি হাতটা পুড়ে ফেলেছেন চায়ের পাত্র ধরতে গিয়ে। ধমকে আব্বাকে বললাম,

‘কি করছেন আপনি, আব্বা?’

আমি ব্যস্ত পায়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে এক টুকরো বরফ এনে হাতে লাগিয়ে দেই। এমন সময় আব্বা গদগদ হয়ে বললেন,

‘তোর জন্য সকালবেলা উঠে নাস্তা বানাচ্ছিলাম। অনেকদিন তো বানাই না, তাই হাত পুড়ে ফেললাম।’

আমি রাগ নিয়ে বললাম,

‘কেন আব্বা? আমি কি বলেছি আপনাকে নাস্তা বানাতে? আমি নিজে উঠেই বানিয়ে খেয়ে যেতাম।’

আব্বা মুখটা তৎক্ষণাৎ মলিন করে বললেন,

‘রাগটা একদম মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিস। তাই তো সবসময় ভয় পাই কখন আমাকে একা ফেলে চলে যাস!’

আমার ঈষৎ রাগ লাগলেও কিছু বললাম না। মানুষটার কষ্টও বুঝি আমি। মা চলে যাওয়ার পর অনেকটা বছর আমরা দুজন একা কাটিয়েছি। তারপরও একাকিত্বটাকে আপন করে নিতে পারিনি আমি কিংবা আব্বা কেউই। উল্টো একাকিত্বের ভয়ে দিনের পর দিন আরো চুপসে গিয়েছিলাম। অন্ধকার আর একাকিত্বে একপ্রকার ভীতি জন্মে গিয়েছে আমাদের। তাই তো আব্বা স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আর কাউকেই হারাতে চান না। আমি এসব ভেবে কিছুটা নরম হলাম। আব্বাকে বললাম,

‘আমি আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না, আব্বা। কাল রাগের মাথায় ওসব বলে দিয়েছি। ভয় পাবেন না।’

আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম আদরে। মানুষটা ঈষৎ পাগল হলেও মনটা ভীষণ ভালো তার। যাকে ভালোবাসেন তাকে শক্ত হাতে শেষ অবধি আগলে রাখতে চান। কিন্তু এই ঢালটাই তাকে সবার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেন।
আমি চুলগুলো হাত খোপা করে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে দিলাম। আব্বাকে আসতে বলে আমিও চেয়ার টেনে বসলাম। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরতে যাবো এমন সময় আব্বা আমার হাতটা ধরে থামিয়ে বললেন,

‘আজ আমি খাইয়ে দেই, মা?’

আব্বার এই ছোট্ট অনুরোধটা আমি না করতে পারলাম না। হাসিমুখে সম্মতি জানালাম। আব্বা রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে আবারো গম্ভীর হয়ে যান। আমার দিকে রুটিটা এগিয়ে দিয়ে বলেন,

‘ভালোবাসা বড্ড ভয়ংকর রে। মাঝে মাঝে এটি দানবাকৃতির রূপ ধারণ করে মানুষকে গিলে খায়। অন্ধকার সাগরে চুবিয়ে মারে।’

আমি এবার বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘তো এসব আপনি এখন আমাকে কেন বলছেন?’

আব্বা আমার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

‘আমি বুঝতে পেরেছি তুই রূপক ছেলেটাকে পছন্দ করিস। কিন্তু তাই বলে আমার চাঁদের টুকরো মেয়েটাকে তো আমি পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারি না। ছেলেটা তোর যোগ্য নয় রে, তিথি। এ পৃথিবীতে কোনো ছেলে-ই তোর যোগ্য নয়। ছেলেটাকে তুই ছেড়ে দে।’

রাগে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়ালো। আব্বার হাতটা ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম। অতিরিক্ত রাগে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা-ই বেরুলো না। থমথমে পায়ে মুখে কিছু না দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। আব্বা পেছনে অনেকবারই আমাকে ডেকেছেন, কিন্তু আমি শুনিনি! লোকটা একটা বদ্ধ পাগল। হাতের উল্টোপিঠে চোখ জোড়া মুছে মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

‘এই পাগল লোকটাকে ছেড়ে তুমি মুক্ত, মা! সাথে কি আমাকেও নিয়ে যেতে পারলে না? তখন তোমার হাত ধরে চলে গেলে আজ এই দিন আমার দেখা লাগতো না, তাই না?’

.

আব্বার উপর রাগ দেখিয়ে কাল রাতেও ভালো মতো ঘুম হলো না। আর এদিকে সকালেও লোকটা আমায় রাগিয়ে দিয়েছে। তার এমন কান্ডে মুগ্ধকে পড়াতে আসতেও তাই দেরি হয়ে গেল। মুখে কিছু দিয়ে না আসায় ক্ষিধেটাও পেয়েছে বড্ড। ঘুমঘুম চোখে বসে আছি। মুগ্ধ সকালের নাস্তা বানাতে ভাইকে সাহায্য করছে। মুখরের রান্নার হাত আগে থেকে বেশ উন্নত হয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু না পারলেই দৌঁড়ে আমার কাছে ছুটে আসে। রান্নাবান্নায় বেশ আগ্রহ তার! ভাবছি, বিয়ের পর বেশ মজা হবে। আমি দুপুরের খাবার রাঁধলে, মুখর রাঁধবে রাতের খাবার। আবার কোনো সময় এ নিয়মের বাইরে গেলে যে দু’বেলা রেঁধে খাইয়েছে তাকে অপরজন স্পেশাল কিছু বানিয়ে সারপ্রাইজ দেবে। বাহ! জম্পেশ এক সংসার হবে আমাদের।

‘ছিঃ এসব কি ভাবছিস, মুখপুড়ি! তোর আব্বা না তোকে এতো কিছু শুনিয়েছে? তারপরও শিক্ষা হলো না তোর?’
‘প্রেম তো এ জীবনে একবারই এলো। আর প্রথম প্রেমকে কি এতো সহজে ভোলা যায়? যায় না গো!’
‘আবেগের বশে নিজের প্রিয়জন হারালে তো আজীবন দুঃখই কপালে জুটবে। এমন অনেকেই বাবা-মা’র মনে পাথর মেরে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে পালিয়ে যায়, একটু ভালো থাকার আশায়। কিন্তু তাদের ভালো থাকাটা কি আদৌও হয় এরপর?’

মনটা আমার এবার চুপসে গেল। মুখরের প্রেমে পড়েছি অবধি আমার মন আর মস্তিষ্কের প্রায় সময়ই দাঙ্গা লাগতে শুরু হয়েছে। বেপরোয়া মনটা সবকিছুতেই মুখরকে ধরে টেনে আনে। এদিকে সজাগ মস্তিষ্ক বারবার ঠেলে দূরে পাঠিয়ে দিতে চায় মুখরকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় কার হবে তা-ই ভাববার বিষয়!

ঘাড়টা এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে মাথাটা রাখলাম টেবিলের উপর। যেন এখনি আমার চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নামবে। তবে এ অবস্থাটা আমার জন্য ভীষণ অস্বস্তির হওয়ায় ঘুম এলো না। তবে চোখের তন্দ্রাটাও এখনো যায়নি। মাথাটা তুলে ঘাড়টা আবারো ম্যাসেজ করলাম কিছুক্ষণ। বেশ ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা! ভালো ঘুম না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে।

মুগ্ধকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়িয়েছি আজ। সারাটাক্ষণ আমি ঘাড়টা এদিক ওদিক করেছি। একদিন ঘুম না হওয়ায় শরীরটাও কেমন ভেঙে পড়েছে। ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছি, তখনি দেখলাম মুখর পাশে এসে আমায় বললো,

‘কাল আপনাকে তিনবার কল দিয়েছি, ধরেননি যে?’

গতকাল মুখরের ফোন পেয়ে আমি যে পরিমাণ ভয় পেয়েছি তা এ মুহুর্তে মুখরকে বলা সম্ভব নয়। আমি খানিক ইতস্তত করে বললাম,

‘ইয়ে, আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।’

অপ্রস্তুত হেসে বিষয়টা উড়িয়ে দিলাম। মুখরও এ বিষয় নিয়ে তেমন প্রশ্ন করলো না আর। মুখর এবার কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললো,

‘পরশু মুগ্ধের জন্মদিন। কিছু কেনাকাটাও বাকি ছিলো তাই কল দিয়েছিলাম আপনাকে। আপনি কি আজ ফ্রি আছেন?’

আমি মুখরের কথা শুনেছি, তবে কিছু বলতে পারছি না। ভীষণ দূর্বল লাগছে আমার। ভাঙা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়েই ঢুলছি আমি। এমন সময় কিছু না ভেবেই মুখরের বাহুতে আমার মাথাটা কাত করে রাখলাম। এতে মুখর কিছুটা কেঁপে উঠে বললো,

‘মিস.তিথিয়া?’

আমি ক্ষীণ স্বরে অনুরোধ করে বললাম,

‘প্লিজ মুখর সাহেব। কিছুক্ষণ এভাবেই থাকুন।’

মুখর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

‘আপনি ঠিক আছেন, মিস.তিথিয়া?’

আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছি মুখরের বাহুতে মাথা রেখেই। অন্য সময় হলে বোধহয় এ মুহুর্তটা আমি বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে উপভোগ করতাম! কিন্তু এখন মাথাটা ভীষণ ধরেছে। তাই কিছুই ভালো লাগলো না।

সে মুহূর্তেই মুগ্ধ চিৎকার করতে করতে আসে,

‘ভাইয়া, আমার টিফিনটা দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!’

চিৎকার করতে করতে সে ড্রয়িংরুমের দিকেই আসছে। আর মুখরের বাহুতে আমার মাথা রাখার দৃশ্যটা মুগ্ধের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে মুখর ছটফট করতে থাকে হঠাৎ। এরপর চট করে মুখর তার বাহু দিয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দূরে দাঁড়ায়। তবে তার ধাক্কায় আমি টাল সামলাতে পারলাম না। শরীরের সবটুকু ভর নিয়েই নিচে পড়ে যাই। মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে সিলিংফ্যানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এরপর গুনগুন করে বললাম,

‘এমনটা না করলেও পারতেন, মুখর সাহেব! আমার ভাগ্যটাই আসলে পোড়া।’

এই বলে আমি চোখ বুজলাম। আর কানে ভাসছে মুগ্ধ-মুখরের চিৎকার,

‘মিস.তিথিয়া? মিস.তিথিয়া, ঠিক আছেন? ম্যাম! ম্যাম!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here