#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৮
#তাশরিন_মোহেরা
কাল ভালো ঘুম হয়নি। হাই তুলতে তুলতে রাস্তায় বেরোলাম। মুখর কি এক দোটানায় ফেলে দিলো আমায়! কাল রাতে জরিমানাটা কি তা বলে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? সারারাত ধরে ভেবেছি জরিমানা কি হতে পারে? সে আমায় পানি ছুঁড়ে মারবে না তো? কিংবা তাকে আঘাত করার জন্য যদি চাকরি অর্থাৎ টিউশনি থেকে বরখাস্ত করে দেয়? সেকি! আমার যে টিউশনিটা এখন খুব দরকার!
দরজাটা খুলতেই দেখলাম মুখর ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। তার ঠোঁটের ডান কোণে সামান্য ক্ষত দেখা যাচ্ছে। কাল আসলেই তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি। ঢোক গিলে তড়িৎ তার কাছে গিয়ে বললাম,
‘মুখর সাহেব, জরিমানাটা কি তাড়াতাড়ি বলুন। আমার আর তর সইছে না!’
মুখর না বোঝার ভান করে বললো,
‘কিসের জরিমানা?’
আমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম,
‘আরে কাল আপনাকে আঘাত করার জরিমানা!’
মুখর দু’হাত ভাজ করে বললো,
‘ওহ! সে জরিমানা!’
‘জ্বি হ্যাঁ, বলুন তাড়াতাড়ি বলুন!’
মুখর আমার দিকে ঝুঁকে বললো,
‘জানতে চান জরিমানাটা কি? জরিমানাটা হলো…’
এই বলে মুখর থেমে গেল। আমি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছি। সে হঠাৎ আমার কপালে টোকা মেরে বললো,
‘আগে মুগ্ধকে পড়ানো শেষ করুন। তারপর বলছি!’
এই বলে কুটি কুটি করে হাসতে হাসতেই সে চলে গেল। মেজাজ আমার সত্যিই বিগড়েছে। ছেলেটা ভাবে কি আমায়? সামান্য এক জরিমানার জন্য এতো অস্থির হয়ে পড়ছি বলেই তার এতো ভাব? নাহ! আর অস্থির হওয়া যাবে না। আপনি বললে বলুন আর না বললে আমার কিছুই এসে যাবে না, মুখর সাহেব। চুলোয় যাক আপনার জরিমানা!
কিন্তু এতোকিছুর পরও আমার অস্থিরতা বিন্দুমাত্র কমলো না। উল্টো তরতর করে বেড়েছে। মনে মনে দোয়া করছি সময়গুলো যাতে তাড়াতাড়ি যায়। অবশেষে মুগ্ধকে পড়ানো শেষ হলো। আমি এক লাফে উঠে গিয়ে মুগ্ধকে বললাম,
‘যাও মুগ্ধ, তোমার ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে এসো, এক্ষুণি!’
মুগ্ধ মুখরকে ডেকে আনলে আমি বললাম,
‘এবার তো বলুন জরিমানাটা কি? এমন করছেন কেন মুখর সাহেব?’
মুখর হালকা হেসে বললো,
‘আসুন, ডাইনিং এ এসে বসুন।’
আমিও তার কথামতো বসলাম। কিছুক্ষণ পরই মুখর একবাটি পায়েশ এনে আমার সম্মুখে রাখলো। আমি অবাক হয়ে তার দিকে ফিরলাম। সে আমায় আশ্বস্ত করে বললো,
‘এটাই আপনার জরিমানা!’
আমি বিভ্রান্ত হলাম। তাকে প্রশ্ন ছুড়লাম,
‘মানে?’
সে আমার পাশে চেয়ার টেনে বসে বললো,
‘আপনারাই তো বলেন আমার রান্না নাকি খুব খারাপ। তাই ভাবলাম পায়েশ রেঁধে আপনাকে খাওয়াই। এর চাইতে বড় জরিমানা আপনার জন্য কি হতে পারে, মিস.তিথিয়া?’
বাকা হাসলো মুখর। আমি একবার তার দিকে, একবার পরিবেশন করা পায়েশের দিকে দেখলাম। পায়েশটা দেখতে ভালো হয়েছে তবে খেতে ঠিক কতটা ভালো হবে তা আমার জানা নেই। কেননা মুখর সাহেবের খাবার ঠিক মাকাল ফলের মতো। উপরে সুন্দর হলেও খেতে ভীষণ খারাপ! আমি শুষ্ক ঢোক গিললাম। এই জরিমানার চাইতে অন্য সবকিছুই যেন ফিকে পড়ে গেছে। মুখর মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। দুষ্টু হাসি হেসে সে বললো,
‘কি হলো, পায়েশটুকু খান।’
আমি এক চামচ নিয়ে মুখের উপর তুলে ধরলাম। খাবো কি খাবো না এই দোটানায় পড়ে শেষমেশ চোখ খিঁচে খেলাম পায়েশটা। আমার মুখটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। অবাক হয়ে মুখরের দিকে চেয়ে আছি। পায়েশটা সত্যি খুব ভালো হয়েছে। আমি মুখরকে বললাম,
‘পায়েশটা মজা হয়েছে খুব।’
সে মুচকি হেসে বললো,
‘অনেকদিন ধরেই প্র্যাক্টিস করছিলাম। শেষমেশ তবে ভালো হলো।’
আমি আরও দু’চামচ মুখে দিয়ে বললাম,
‘প্র্যাক্টিস মেক্স আ ম্যান পারফেক্ট, মুখর সাহেব।’
সেও এর বিপরীতে হাসলো। আমি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। খানিক বাদে মুখর বললো,
‘মিস.তিথিয়া!’
আমি চোখ তুলে তার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে দেখলাম। আমি সবসময়ই সাথে রুমাল নিয়ে বের হই। আজও খাওয়ার সময় রুমালটা পাশে রেখেছিলাম। মুখর আমাকে বললো,
‘আপনার রুমালটা কি একটু নিতে পারি?’
আমি ভ্রু কুঁচকে সেকেন্ড খানেক ভেবেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালাম। সে রুমালটা নিয়ে হুট করেই আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি সাথে সাথেই পিছিয়ে গেলাম কিছুটা। তবে খুব বেশি পেছাতে পারলাম না। মাথাটা আমার চেয়ারে ঠেকলো। সে এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটের এক কোণে রুমাল দিয়ে মুছলো। ক্ষীণ হেসে বললো,
‘পায়েশ লেগেছিলো মুখে!’
আমার ঠোঁট দুটো আপনাআপনি হা হয়ে গেল। এ আমি কি দেখছি? বুকটা ঢিপঢিপ করে আওয়াজ দিচ্ছে আমার। ভয়ের সাথে সাথে আমার শরীর জুড়ে একটা উত্তেজনা কাজ করলো। ভাবছি এই কোন মুখরকে সামনে দেখছি আমি? এই তো কিছুদিন আগেই আমি স্বেচ্ছায় মুখে চকলেট ক্রিম লাগিয়ে মুখরের সাহায্য চেয়েছিলাম, কিন্তু সে কোনো সাহায্যই করেনি। তবে এখন? এখন কি হলো মুখরের?
আমি স্বাভাবিক হয়ে মুখরকে বললাম,
‘আপনি আজেবাজে কিছু খাননি তো, মুখর সাহেব?’
মুখর আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
‘কেন? আমি আবার আজেবাজে কি খেতে যাবো?’
‘আপনি ক’দিন ধরে অদ্ভুত আচরণ করছেন।’
মনে মনে বিড়বিড় করলাম আমি। কারণ এটুকু বলার সাহস নেই আমার! মুখরকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম,
‘না, কিছু না!’
সেও আর কথা বাড়ালো না। মুগ্ধকে তাড়া দিয়ে উঠে পড়লো। পায়েশটুকু প্রায় শেষ পর্যায়ে, এমন সময় আমার পাশে রাখা মুখরের ফোনে ভাইব্রেট হলো। ভাইব্রেট হওয়াতে আমি ফোনের স্ক্রিনে তাকাই। একটা অজানা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। তাতে লিখা,
‘নিজের বাবাকে নিজেই মা’র’লে, মুখর। এর জন্য তোমায় প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। জটিল এক প্রায়শ্চিত্ত!’
(চলবে)