#অদৃশ্য এক সত্ত্বা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫
কেবিনের প্রথম রাতে আমার একদম ঘুম আসতেছিল না। চোখে কিছু না দেখলেও মনে হত চোখে কিছু ভাসছে। কখনও ভয়ংকর অনুভূতি হত আবার কখনও সাবলীল। এ নিয়েই কেবিনের প্রথম দিন আমার। এ জীবনটাও আমার অসহ্য লাগতে শুরু করল। ডিপ্রেশন আমাকে ঘিরে ধরল। যে আমি সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম সে আমি আজকে এভাবে পড়ে আছি। নিজের এ অবস্থা নিজেই মানতে পারছিলাম না। এসব ভাবতে ভাবতেই আমার অসাড় দেহ আরও অসাড় করে ঘুম ঝেঁকে বসলো। চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়তে পড়তে আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
রাতে মনে হলো আমার বুকে আবারও কেউ চেপে বসেছে। আর এদিকে আমার মা হঠাৎ করে কেবিনের দেয়ালে খেয়াল করল একটা হাতের ছায়া। মা হাতের ছায়ার উৎস খুঁজতে খুঁজতেই ছায়াটা মিলিয়ে গেল। হুট করে আমার শ্বাসকষ্ট বাড়তে লাগল। মা হন্নে হয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার এসে আমাকে আবারও চেক আউট করল। টানা আধা ঘন্টা আমার এমন অবস্থা বিদ্যমান রইল। আমার মনে হতো আমি এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলে অনেক ভালো হত।
আধা ঘন্টা পর আমি স্বাভাবিক হলাম। তবে আশানুরূপ কোনো কিছুই অনুধাবন করতে পারল না ডাক্তার রা। এদিকে আমার মায়ের মনে শুধু হাতের ছায়ার বিষয়টা খচখচ করতে লাগল। বাবাকে বিষয়টা বলবে কিনা ভাবতে লাগল। একবার ভাবতে লাগল বাবাকে বলবে আবার ভাবতে লাগল বলবে না। কারণ বাবাকে বললে বাবা এসব বিশ্বাসও করবে না। এটা তার কাছে কেবল মনের ভুল হিসেবেই আখ্যায়িত হবে। তাই মা চুপ রইল।
দিন কাটতে লাগল। আমার শারিরীক অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সারাদিন চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে আমার পিঠে ঘা হতে শুরু করে। সেই ঘা থেকে পুঁজ বের হত। দুর্গন্ধ সৃষ্টি হত। মাঝে মাঝে গলা দিয়ে গন্ধযুক্ত ব্লাড যেত। সব মিলিয়ে আমার কষ্ট যেন আরও বাড়তে লাগল। আমার ওজন কমে ২৭ কেজি হয়ে গেল। শরীরের হাড্ডি ভাসতে লাগল। সামনের দাঁত গুলো শুকিয়ে বের হয়ে গেল। কেমন যেন উদ্ভট লাগত আমাকে। সব মিলিয়ে নরকের মতো জীবন পার করতে লাগলাম। আমার মা কেবল সে সময়টায় কাঁদত। কাঁদতে কাঁদতে একসময় তার চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গেল। আর এদিকে আমি আমার হাহাকার প্রকাশ করতে পারছিলাম না আবার সহ্য করার ক্ষমতাও যেন চলে যেতে লাগল।
নার্স প্রতদিন ঘা গুলো এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যেত। তবে সেগুলো আর শুকাত না। এমন একটা অবস্থা মনে হচ্ছিল আমার সারা শরীরে পচন ধরবে। আর আমি আস্তে আস্তে মরব। এভাবে কাটল আরও এক মাস। এ একমাসে আমার শারীরিক উন্নতি হলো না। শুধু মাত্র চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়া ছাড়া। তবে সেখানেও ঘটে কিছু বিপত্তি। চোখে দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার পর থেকে আমার মনে হত কোনো বিভৎস কিছু আমার সামনে এসে হানা দিচ্ছে। আমার বুকে ব্যথা শুরু হত এমন কিছু অনুভব করলে। তাই কোনোরকম গলার আওয়াজ বের করে মাকে সবটা খুলে বলি। মা বিষয়টা ডাক্তারকে বললে, ডাক্তার ব্যখ্যা দেয় যে আমি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। অনেকদিন এমন পরিস্থিতিতে থেকে আমার মানসিক বিপর্যস্ত হয়েছে। তাই অনেককিছু কল্পনা করি। যার জন্য আমার চোখে এগুলো ভাসে। এটা আস্তে ধীরে কাউন্সিলিং করলে ঠিক হয়ে যাবে। এরপর সব ট্রিটমেন্টের সাথে আমাকে কাউন্সিলিং ও করা হয়। তবে কাউন্সিলিং এ আমার তেমন কোনো উন্নতি হলো না। প্রতদিন হাত পায়ের ব্যায়াম, ম্যাসাজ তো ছিলই।
সবকিছু মিলে একবার উন্নতি হয় আবার অবনতি। নল দিয়ে খাবার খাওয়া, নল দিয়েই পি পটি করানো হত। সব মিলিয়ে আমি জীবিত থেকেও মৃত লাশ হয়ে জীবন পার করছিলাম।
আমার জীবনের সকল আশা এক সময় বিনষ্ট হয়ে যেতে লাগল। এ জীবনের থেকে মৃত্যুই শ্রেয় মনে হতে লাগল।
এদিকে মায়ের মন বারবার অন্য কথা বলছিল। এবার মা সিদ্ধান্ত নেয় যত কিছুই হোক আমাকে রাকি দ্বারাও চিকিৎসা করাবে। আম্মুর ভাবনা প্রবলভাবে দৃঢ় হতে লাগল। তাই টানা তিনমাস পর আম্মু সিদ্ধান্ত নিল রাকি দেখাবে এবং যে করেই হোক।
এবার আম্মুর পাগলামিকে কেউ উপেক্ষা করতে পারল না। তাই আমাকে রাকি দেখানো হলো। পাশাপাশি ডাক্তারি চিকিৎসাও করাতে লাগল। রাকি দেখানোর পর কিছু অদ্ভুত জিনিস সবার চক্ষুগোচর হয়।
চলবে?