অদৃশ্য এক সত্ত্বা অন্তত পর্ব

0
229

#অদৃশ্য এক সত্ত্বা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭/শেষ পর্ব (১ম খন্ড)

আমার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়ার সাথে সাথে সেদিন আমার কান দিয়েও রক্ত বের হতে শুরু হলো। আমার চোখে কেবল ঐ লাশটায় ভাসতে লাগল। পুনরায় আমাকে আই সি ইউতে নেওয়া হলো। একদিন রাখা হলো। আমার অবস্থার উন্নতি আর হলো না। এবার মা আর থেমে থাকতে পারলেন না। উনি রাকিকে কল দিলেন। যেহেতু আমাকে এসে চিকিৎসা করার কোনো উপায় নেই। সেহেতু উনাকে মা সেটা শেয়ার করেন। এবং জানান দূরে থেকে কীভাবে চিকিৎসা করা যায়।

এবার রাকিও বুঝতে পারলেন যা করতে হবে দূর থেকে করতে হবে। কাছে থেকে কোনো চিকিৎসা সম্ভব না। এ যুগে একে তো জিন ভূত কেউ বিশ্বাস করে না, তার উপর রোগীর চিকিৎসার পর কিছু অদ্ভুত বিষয় ঘটার সম্ভবনা থাকে। যার দরুণ ডাক্তারও ভেবে বসবে এতে রোগীর মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই তিনি তার উস্তাদের কাছে আমার বিষয়টা শেয়ার করলেন। এবং আমার জট পাকানো চুল গুলোও দিলেন।

এবার আমার বিষয়টা দেখা শুরু করলেন দ্বিতীয় রাকি। তিনি দূর থেকেই আমার চিকিৎসা শুরু করলেন। যতদূর তিনি বুঝতে পারলেন এবং আমার পরিবারকে ধারণা দিলেন তাতে এটা বুঝা গেল যে আমাকে কেউ কালো জাদু করেছে। এবং বদনজরের একটা কারণ রয়েছে। আর এমনিতে আমার সাথে পাঁচটি আশ্বিক জিনও রয়েছে যারা আমার একদম কাছে এসে ক্ষতি না করলেও দূর থেকে ক্ষতি করছে। এছাড়াও তিনি আরও বলেন আমার অবস্থা শেষ পর্যায়ে। ঠিকমতো রুকাইয়া করলে আমি বাঁচব অন্যথায় বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ। বিষয়টাকে যদি আমার পরিবার এভাবে অবহেলা করে তাহলে এতে ফল আরও খারাপ হতে পারে।

আম্মু বিষয়টা জানার পর একদম ভেঙে পড়ে। আব্বুকে বললে আব্বুও আগের মতোই উত্তর দেয় এগুলো ভুয়া, ভন্ড। এতে কান দিলে আমার চিকিৎসায় আরও সমস্যা হবে। আব্বু সেদিন কান্না করে মাকে এটাও বলে

“মেয়ের হাল ছেড়ে দাও। এতদিন হয়ে গেল এখনও সুস্থতার মুখ দেখেনি। আর মনে হয় না দেখবে। জমানো সব টাকা শেষ। জমি হয়তো বিক্রি করা লাগবে। আমি বিক্রি করে হলেও মেয়ের চিকিৎসা করাব। যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়ে বেঁচে থাকে আমি বাঁচানোর চেষ্টা করব। যদি ভিক্ষা করা লাগে করব। ওর দমটা চলে গেলেই ওকে নিয়ে কবর দিয়ে দিব। সে পর্যন্ত বাবা হয়ে যতটা পারি মেয়ের পাশে থাকব। আমি যেমন মন কে শক্ত করে নিছি তুমিও নাও। এসব হুজুর, রাকি দিয়ে ভালো হবে না। এগুলো জিনের আসর না। যা হবে ভালোর জন্য হবে। হায়াত থাকলে বাঁচবে নাহয় আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে যাবে। তুমি নিজের মনকে শক্ত করো শুধু।”

আমার মায়ের সে সময়টায় মনে কেমন ঝড় বয়েছিল সেটা হয়তো কখনও আমি সন্তানের মা হলে টের পাব। তবে সুস্থ হওয়ার পর মায়ের মুখে ব্যখ্যা শুনার সময় মায়ের গলা ভার হয়ে চোখের পানি বলে দিয়েছিল মায়ের কষ্টটা কতটা প্রখর ছিল। মা তখন বাবার কথায় নির্বাক ছিল। তবে বাবার কথায় মা দমে যায় নি। তিনি পণ করে নিয়েছিল যে মেডিকেল চিকিৎসার পাশাপাশি রাকি দিয়েও চিকিৎসা করাবে। এতে যদি আমি বাঁচি ভালো, না বাঁচলে তো আর কিছু করার থাকে না।

সুতরাং মা মনকে শক্ত করে নিলো। নিজেকে সব অবস্থায় মানিয়ে নেওয়ার মতো প্রস্তুত করে নিলো। এদিকে ডাক্তারও এবার হাল ছেড়ে দিলেন। আমার জন্য বার কয়েক বোর্ড বসানো হলো। তবে এতে কোনো লাভ হলো না। সঠিক রোগ ধরা না পড়লে রোগ নিরাময় সম্বভ নয়। এদিকে বাংলাদেশের চিকিৎসায় ভালো কোনো ফল না পেয়ে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে।

আমার অবস্থার আর উন্নতি ঘটছে না। হাই পাওয়ারের ঔষধ দেওয়ার পর আমার ব্লাড যাওয়া কমেছে। তবে মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এবার আমার মনে হতে লাগল আমার মরে যাওয়ায় ভালো। তাই নতুন নতুন পাগলামি শুরু করলাম। আমি যখনেই সুযোগ পেতাম সে সময়টায় সুইসাইডের চেষ্টা করতাম। কখনও হাত নাড়াতে পারলে স্যালাইন খুলে ফেলতাম। আবার কখনও খাবার দেওয়ার নলটা টেনে ধরতাম। আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারব না। তাই এরকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম। বাবা মায়ের টাকার উপর টাকা যাচ্ছে। সে সাথে শারিরীক কষ্ট এবং মানসিক যন্ত্রণা । সব মিলিয়ে আমার এ পাগলামি টা করার প্রবণতা আরও বেড়ে গেল। আমি যতই নিজেকে সামলে নিতে চায়তাম ততই যেন কেউ আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে বলত আমার এভাবে বেঁচে থাকা ঠিক হবে না। তাই একের পর এক সুইসাইড এটেম্প নিতে শুরু করলাম। আমার এরকম পরিস্থিতি দেখে ডাক্তাররাও ভয় পেয়ে যায়। ডাক্তাররাও বুঝতে পারছে আমার বাঁচার ইচ্ছাটা মরে গেছে। তাই আবার যেন আমি মানসিক শক্তি অর্জন করতে পারি সেজন্য আমাকে নেওয়া হয় কাউন্সিলিং করতে। প্রথম দিন আমাকে টানা ২ ঘন্টা কাউন্সিলিং করা হয়। আমার কথা শুনতে চায়। কেন এমন করছি। আমি চুপ করে থাকতাম। কোনো জবাব দিতাম না। তবে সেদিন ডাক্তারের কাছে হালকা গলায় বলেছিলাম,

“আঙ্কেল আমি একটু আমার চেহারাটা দেখতে চাই।”

ডাক্তার সেদিন একটা আয়না নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে। আমি আমাকে দেখে ভয় পেয়ে যাই। দাঁত ভেসে গেছে আমার। চোখ গর্তে চলে গেছে। শরীরে ফ্যাকাশে রঙ। সব মিলিয়ে আমাকে এত বিদঘুটে দেখা যাচ্ছিল যে, আমি আমাকেই দেখে চিল্লায়ে উঠি। সেদিনের মতো ডাক্তার শান্ত করে,আমাকে আরও কিছুক্ষণ কাউন্সিলিং করে, কেবিনে দেয়।

কাউন্সিলিং এর পর আমার সুইসাইডের প্রবণতা পুরোপুরি না কমলেও একটু কমে। এদিকে মা আমার অবস্থা দেখে পাথরের মতো হয়ে যায়। রাকি মাকে কিছু আমল শিখিয়ে দেয়। একটু তেল পড়ে দেয়,আমার শরীরে মালিশ করে দেওয়ার জন্য। সম্ভব হলে বরই পাতা দিয়ে গোসল করাতে বলে। কিছু আয়াত শিখিয়ে দেয় আমার সামনে সবসময় পড়ার জন্য। তিন কূল পড়ে ফু দেওয়ার জন্য। প্রতিদিনের আমলগুলো তিনি মাকে বুঝিয়ে দিতেন। আর মা সবকিছুর আড়ালে গিয়ে সেগুলো পড়তেন। তেল মালিশ করে দিতেন।

সুতরাং আমার মেডিকেল চিকিৎসাও চলছে আবার রাকি দিয়েও রুকাইয়াও চলছে। দুটো চিকিৎসায় সমানতালে চলছে। এদিকে এবার আমার উন্নতি হওয়া শুরু করল। যেটা বিগত কয়েক মাস ধরে হচ্ছিল না। আমার জন্য পুনরায় মেডিকেল বোর্ড বসানো হলো এবং চিকিৎসার ধরণ চেন্জ করা হলো। এদিকে মা ও রাকির কথায় প্রতিদিনের রুকাইয়া করতে লাগল। আমার অবস্থার উন্নতি কোনো চিকিৎসায় হয়েছিল বলতে পারব না। হতে পারে আমার সাথে কোনো প্যারানরমাল কিছু ছিল। অথবা আমার এগুলো মনের ভুল ছিল। কারণ সে সময়টায় এতই মানসিক বিপর্যয় ঘটেছিল যে এরকম মনের ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে মায়ের ঘটনার বর্ণণা, আমার সাথে হয়ে যাওয়া কাহিনি এটাই জানান দেয় রাকির কথা মিথ্যা নয়। আমাকে কালো জাদু করা হয়েছিল এবং আমার সাথে জিনও ছিল। আর সেটার প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম । সে কাহিনিও বলব।

যাইহোক ডাক্তার এবার আমার রোগের কারণও খুঁজে পায়। তাদের ভাষ্যমতে আমার মাথার নার্ভে সমস্যা হয়ে এমনটা হয়েছে। এর আগে যেহেতু সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারে নি তাই আমার ক্ষেত্রে কিছু ভুল চিকিৎসা হয়েছে। যার দরুণ আমার অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হওয়া শুরু করে। ভুল চিকিৎসায় আমার শারিরীক অনেক কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা সাড়তে অনেক সময় লাগে। এবং ভুল ওষধের ডোজে আমার মানসিক অনেক বিপর্যয় ও ঘটে। সে সাথে মস্তিষ্কেও চাপ পড়ে ভীষণ। সুতরাং সব মিলিয়ে আমার দুটো চিকিৎসা অগ্রসর হচ্ছিল নতুন করে।

সেদিনের পর থেকে আমার জীবনে আবার নতুন মোড় নেওয়া শুরু করল। আর সে সাথে কিছু প্যারানরমাল ঘটনাও ঘটল।

#অদৃশ্য এক সত্ত্বা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৭ /শেষ পর্ব (শেষাংশ)

আমার অবস্থার উন্নতি হওয়া শুরু করল। আমার রোগ নির্ণয়ের পর আমার সঠিক চিকিৎসা চলতে লাগল। আস্তে আস্তে আমি একটু স্বাভাবিক হতে লাগলাম। নিয়মিত কাউন্সিলিং করায় সুইসাইডের প্রবণতাও চলে গেছে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। পিঠের ক্ষতটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে ব্যথাও কমে গেল। মাথাটা মাঝে মাঝে টন টন করে ব্যথা করলেও ইনজেকশন দিলে সেটা একটু কমে যায়।

অপরদিকে এতদিন হাতে পায়ে ক্যালুনা দিতে দিতে হাত পা ও যেন ক্যালুনা নিতে পারছিল না। ক্যালুনা দিলেই কিছুক্ষণ পরেই তা আউট হয়ে যেত আর তীব্র ব্যথার সঞ্চার হত। তাই বেশিরভাগ সময় সরাসরিই ইনজেকশন দেওয়া হত। মাথার চুল পড়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। মাথায় যখনই হাত দিতাম তখন অজোরে চোখ দিয়ে পানি পড়ত। হাঁটু সমান লম্বা চুলগুলো কেটে ঘাড় অবধি করেছে। চুল ও দশ ভাগের নয় ভাগ পড়ে একভাগ আছে। সবমিলিয়ে আমাকে ন্যাড়া করে দেওয়া হলো। এমনিতেও চুলের যত্ন হয় না তাই চুলগুলো একেবারে ফেলে দিল।

কঙ্কাল সাড় দেহ আমার সারাদিন লেপ্টাইয়া বিছানায় পড়ে থাকত। শারীরিক অবস্থা পূর্বের থেকে উন্নতি হলেও কেমন যেন অবসাদ অবসাদ লাগত। মাঝে মাঝে মনে হত কেউ আমাকে এসে ধুমরে মুচরে দিচ্ছে। দূর থেকে কেউ এসে গলা চেপে ধরতে চাচ্ছে এমন মনে হত। মাঝে মাঝে হালকা কান্নার সুর শুনতে পারতাম। রাকি অবশ্য মাকে বলে দিয়েছিল এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আর সে সময় টায় আমি সেন্সে থাকলে আমি যেন আমল করি আর আমার অবস্থা ভালো না হলে মা যেন সেগুলো আমল করে। তাই যখনই আমার এমন মনে হত আমি আমল করতে থাকতাম। আমল করতে করতে লক্ষ্য করতাম সব ধরণের আজগুবি ঘটনা গুলো হুট করেই বন্ধ হয়ে যেত। যা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর মনে হত।

আমার চিকিৎসার ও উন্নতি হতে লাগল। আস্তে আস্তে আমি সুস্থ হতে লাগলাম। টানা তিন মাস হাসপাতালের বেডে কুকড়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে যেন আমি সজীব হতে লাগলাম। আমি সে সময় চিবিয়ে কিছু খেতে না পারলেও মুখ দিয়ে খেতে পারাতাম। তাই সব খাবার বেটে চটকে স্যুপের মতো করে দিত। আস্তে আস্তে আমার স্বাস্থ্য ঠিক হতে লাগল। আমি উঠে দাঁড়াতে পারলাম। যেদিন আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল এক মুঠো খুশি আমার জীবনটাকে রঙিন করে দিয়েছে। সেদিন দাঁড়াতে পারলেও পায়ে তেমন ভর না পাওয়ায় দুই তিন পা হাঁটতেই থুবরে পড়েছিলাম। রাত তখন একটা বাজে। নীচের পড়তেই যখন সামনের দিকে তাকালাম তখন মনে হলো এক বিভৎস নারী আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি সে সময়টায় ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম না। বরং রাকির বলে দেওয়া আমলগুলো করতে লাগলাম। সাথে সাথে বিভৎস মুখটা বিলীন হয়ে গেল। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।

সেদিনের পর থেকে যতবারেই আমার মনে হত কোনো অশুভ কিছু আমাকে হানা দিচ্ছে ততবারেই আমি আমলগুলো করতাম। এতে করে সাথে সাথেই আমি একটা স্বস্তি অনুভব করতাম। এদিকে আমার শারিরীক বেশ উন্নতি হলো। সঠিক চিকিৎসা হওয়ায় আমার চিকিৎসার উন্নতিও হলো এবং আমি সুস্থ হতে লাগলাম ধাপে ধাপে।

এতদিন আমার শরীর শুধু মুছিয়ে দেওয়া হত। আজকে প্রায় তিনমাস পর আমাকে গোসল করানো হবে। মা রাকির কথা মতো কোথায় থেকে যেন বরই পাতা জোগার করে এনেছে এবং একটা বালতিতে গরম পানি নিয়ে তাতে বরই পাতা দিল। তারপর একটা মগে করে পানি এনে বেডে বসে কিছু আমল করল। তারপর মগের পানিতে ফু দিয়ে বালতির পানিতে মিশালো। এরপর আমাকে সে পানি দিয়ে মা গোসল করালো।

এতদিন পর গোসল করতে পেরে আমার ভেতরটাও বেশ প্রশান্তিময় হতে লাগল। মনে হচ্ছিল আমার শরীরে কিছু ভর করে ছিল আর সেটা এখন দূর হয়েছে। এরপর টানা সাতদিন হাসপাতালেই আমাকে এভাবে মা গোসল করাত। এবার আমি দ্রূত সুস্থ হতে লাগলাম। এবং আমার শারিরীক উন্নতি এতই দ্রূত হলো যে ডাক্তারাও বেশ অবাক হচ্ছিল। যে জায়গায় ডাক্তাররা একটা সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল সে জায়গায় আমি বেঁচে ফিরছি তার উপর এত দ্রূত সুস্থ হচ্ছি এটা সত্যিই অকল্পনীয় ছিল।

অনেক ঝড় ঝাপটার পর আমাকে রিলিজ দেওয়া হলো টানা তিনমাস পর। অনেকটা সুস্থ। স্বাভাবিক ভাবে চলতে ফিরতে পারছি। যেদিন আমি বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিনের দৃশ্যটা এখনও আমার চোখে ভাসে। সারা বাড়িতে মানুষের সমাগম। সবাই আমাকে দেখতে এসেছে। সবার মধ্যে একটায় উত্তেজনা এর জন্য যে যার মৃত্যুর খবর শুনেছিল আজ সে মানুষটায় জ্যান্ত ফিরেছে। এত মানুষ দেখতে আসলেও আমার বাসার ভেতর পর্যন্ত কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। কারণ ডাক্তারের কড়া নিষেধ ছিল। ডাক্তার বলেছিল আমাকে নিরিবিলি রাখতে।

বাসায় আসার পরও আমার চিকিৎসা চলতেছিল। শারিরীক ভাবে অনেক সুস্থ হলেও কিছু কিছু দিকে আমি বেশ অসুস্থ ছিলাম। যেমন আমার হুটহাট হাত, পা কাঁপত বুক ধরফর করত। আর এ সমস্যাটা আমার এখনও রয়ে গেছে। এরপর টানা নয়মাস ডাক্তারের ফলোআপে এবং রাকির চিকিৎসা নেওয়ার পর আমি পুরোপুরি সুস্থ হই।

ডাক্তারের ভাষ্যমতে আমি হুট করে এভাবে এত দ্রূত সুস্থ হয়ে যাব উনারা ভাবতেও পারেনি। এমনকি শেষ ফলোআপের রিপোর্ট দেখে ডাক্তারও অবাক হয়েছিল। কারণ আমার রিপোর্ট এতই ভালো এসেছিল যে পূর্বে আমি কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলাম। অথবা আমার এত সূচণীয় অবস্থা হয়েছিল এটা বুঝায় যাচ্ছিল না। ডাক্তাররা সে সময় টায় আমাকে সাহসী যোদ্ধা বলতে লাগল। আমি সে সময়টায় প্রতিটা ডাক্তারের ভালোবাসা পেয়েছিলাম। আমাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে সবাই অনেক উৎসাহ দিয়েছে। সে সময়টা কোনো কোনো ডাক্তার ভিজিটের মোটা অঙ্কের টাকায় তারা নেয় নি। সে হিসাব করলে ২০১২ সালের মতো সময়ে হাসপাতালে আড়াই লাখ টাকার বিল তারা নেয় নি। আর এ বিলগুলো ছিল ডাক্তারদের ভিজিট। তারা তাদের ভিজিটও নেয় নি এবং অনেক চিকিৎসায় ডিসকাউন্ট ও দিয়েছে। সব মিলে বাবা মায়ের দোয়া, সকলের ভালোবাসা এবং আল্লাহ অশেষ রহমতে আমি সুস্থ হই আলহামদুলিল্লাহ।

বিষয়টা প্যারানরমাল কি’না জানি না। তবে হুট করে সুস্থ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা সবাইকে একটু হলেও ভাবিয়ে তুলেছিল। তবে বিষয়টা যে কিছুটা প্যারানরমাল ছিল তা টের পেয়েছি ২০২২ সালে। ২০১২ সালের পর আমার তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। জীবনে অনেক উত্থান পতন গিয়েছে তবে সেটা সংগ্রাম করে পার ও করে ফেলেছি। তবে ২০২২ সালে এসে আমার কেবল মনে হত আমার সাথে কেউ আছে। কেউ দূর থেকে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে তবে পারছে না। অকারণে রাগ উঠে যেত। কারণে অকারণে কাঁদতাম। সুইসাইড করার ভীষণ ইচ্ছা করত। অযথায় ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। হুট করে অসুস্থ হয়ে যেতাম। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে লক্ষ্য করত সব ঠিক আছে। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা এই ভালো এ খারাপের মধ্যে যাচ্ছিল। আবারও স্বাস্থ্য নষ্ট হতে শুরু করল। চুল পড়তে শুরু হলো।

অনেক চিকিৎসা করার পরও আমার তেমন রোগ ধরা পরছে না। বিয়ের কথা শুনলেই আমার রাগ উঠত। বিষয়টা আবার ২০১২ সালের দিকে মোড় নিতে নিল। এবার আমার মায়ের মনে খচখচ করতে লাগল। মা আবার আমাকে রাকি দেখাল। রাকি যখন তিলাওয়াত করত আমার দম বন্ধ হয়ে যেত,বমি আসত, মাথা ব্যথা করত, চোখ দিয়ে এমনেই পানি পড়ত। সব মিলিয়ে রাকি জানাল আমার সাথে বদজিন আছে যারা দূর থেকে ক্ষতি করার ট্রাই করতেছে। আমার যেন বিয়ে নাহয় তার জন্য বান মারা হয়েছে। আরও কিছু বিষয় যেগুলো সবার সামনে উপস্থাপন সম্ভব না। এরপর আমি ২০২২ এর আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত রাকি যেভাবে বলেছে সেভাবে আমল করে আসছি। এবং আস্তে আস্তে আমার সমস্যা গুলো কাটতে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ বিয়ে নিয়ে সমস্যা ছিল সেটাও এ গল্প লিখতে লিখতে হয়ে গেল। যার দরুণ গল্পটা দিতে এত দেরি হলো।

আমার কাছে বিষয়টা ২০২২ এর আগে মনে হত আমার মনের ভুল ছিল তাই এরকম প্যারানরমাল বিষয় ঘটেছে। তবে ২০২২ এর পর থেকে আমার মনে হয় বিষয়টা প্যারানরমালেই ছিল।

জানি না বিষয়টা কী ছিল হতে পারে আমার মানসিক বিপর্যয়ের জন্য এমনটা হয়েছে নাহয় পুরোটাই প্যারানরমাল ছিল। বিষয়টা যাইহোক তবে সে সময়ের যন্ত্রণাটা আমি কখনও ভুলব না। আমার জন্য দোয়া করবেন। এরকম পরিস্থিতিতে কখনও যেন কাউকে না পরতে হয় সে দোয়া করি।

আর হ্যাঁ এটাই আপনাদের লেখিকা শারমিন আঁচল নিপার সাথে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here