অতঃপর_প্রণয় পর্ব:১৩+১৪

0
960

#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:১৩+১৪

ইত্তি আর মিতু এতক্ষনযাবত ইরিনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কথা ছিলো আয়াজ হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসবে ইরিনকে। কিন্তু সে মত পাল্টে ফেলেছে। ইরিন টুঁ শব্দটিও করলো না। শ্বশুর শাশুড়ি,মা বাবাসহ বাড়ির বড়দের সালাম করে ইত্তিদের সাথে বেরোনো জন্য তৈরী হয়ে নিলো। আয়াজ সোফায় বসে তুতুরী সাথে দুষ্টুমি করছে। ইরিন সদর দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় শুধু বলল,

—“আসি।”

আয়াজ একবার তাকিয়ে আবার তুতুরীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইত্তি টেনশনে পড়ে গেছে। ইরিন রেগে আছে কি না সে বুঝতে পারছে না। মিতুকে ইশারা করলো সে। মিতু যেহেতু একটা মেয়ে এইমুহূর্তে আরেকটা মেয়ের মনের অবস্থা সে নিশ্চই বুঝতে পারবে। মিতু তাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো সে কনফিউজড। ইত্তি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,

—“তুই ঠিক আছিস?”

ইরিন জবাব দিলো না। পূর্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইত্তি আবার জিজ্ঞাসা করলো,

—“ইরিন? ”

ইরিন গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল,

—“আমি ঠিক আছি ইত্তি।

হেলাল সাহেবের গাড়িতে করে ওদের যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। আয়াজের বড় ভাই মহসিন যাচ্ছে তাদের সাথে। তিনি এখনো নামেন নি, তাই ওরা অপেক্ষা করছে।

দশমিনিটের মাথায় মহসিন নেমে এলো। ইরিন দীর্ঘশ্বাস চেপে বিড়বিড় করে বলল,

—আমি আর আসবো না মি.আয়াজ। আপনি আমার পা ধরে মাফ চাইলেও আমি আসবো না।

বস্তুত ইরিনের মনের অবস্থা হচ্ছে আয়াজ যদি এইমুহূর্তেও এসে তাকে বলে হোস্টেলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই সে অতিউৎসাহের সহিত গাড়ি থেমে নেমে যাবে। কিন্তু আয়াজ আসে নি। ইরিন হতাশভাবে হোস্টেলে ফিরে এলো।

বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আয়াজের ঘুম আসছে না। অনেক্ষন যাবত বারান্দায় বসে আছে সে। ইরিন চলে যাওয়ার পর থেকেই ফাঁকা ফাঁকা অনুভূরি হচ্ছে তার। হঠাৎ করে কেন এমন হচ্ছে? অনেকদিন যাবত ইরিনের ওপর রাগ করে ছিলো সে। কিন্তু কখনো এমন অনুভূতি হয় নি। এখন কেন এমন হচ্ছে? ইরিনকে ভীষণ ভাবে মিস করছে সে। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণভাবে।
ইরিনকে কি একটা ফোন করবে সে? ইরিন ধরবে? ধরবে না। নিশ্চই তার ওপর রেগে আছে।
দ্রুত গায়ে শার্ট চড়িয়ে নিলো আয়াজ। এইমুহূর্তে ইরিনকে তার সামনে চাই। কেন চাই? কি কারনে চাই? সে কিচ্ছু জানে না। কিন্তু চাই। গাড়ির চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো সে। তাদের এপার্টমেন্টের দারোয়ান মোতালেব হোসেনকে ঘুম থেকে টেনে তুলে গেট খোলার ব্যবস্থা করলো।

ইরিনের হোস্টেলের সামনে এসে ইরিনের নাম্বারে ডায়াল করলো। ইরিন ফোন সাইলেন্ট করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে এসেছে তার। ফলাফল স্বরূপ ফোন ধরতে পারলো না। আয়াজ গেটের নিচে দাঁড়িয়ে বারবার ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছে, রিং হচ্ছে কিন্তু ইরিন ফোন ধরছে না। ইরিন কি তাহলে ঘুমিয়ে পড়েছে? অস্থির ভাবে এদিক ওদিক পায়চারি করছে সে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ইরিনের সাথে দেখা হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত শান্তি পাবে না সে।

ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইরিনের। বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। কফি তে চুমুক দিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। সে ঠিক করেছে আজকের পরীক্ষাটা সে দেবে না। কফি খেতে খেতে ঠান্ডা বাতাসে নিজেকে সিক্ত করার অনুভূতি নিচ্ছে সে। হোস্টেলের রাস্তায় চোখ পড়তেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভালো করে লক্ষ্য করলো। মানুষটা এদিক ওদিক হাঁটাহাটি করছে। কাছেই গাড়ি পার্ক করা। কপালে হাত রেখে কিছুক্ষন চিন্তা করলো ইরিন। ঘটনার আগাগোড়া কিছুই বুঝত পারছে না। দ্রুত রুমে ঢুকে ফোন চেক করলো সে। সাতটা মিসড কল উঠে আছে। প্রথমটা রাত তিনটায়। তারপরেরটা তিনটা দুই, তারপর তিনটা চার, তিনটা সাত।সবশেষে পৌনে চারটায়। ইরিনের বুক ধড়ফড় করছে। আয়াজের নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে কেটে দিলো। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিচে নেমে এলো। তখনও বাইরে আবছা অন্ধকার। গেটে দারোয়ান ঘুমাচ্ছে। ইরিন গেট খোলার জন্য অনুনয় বিনয় করলো। কিন্তু তিনি গেট খুলতে নারাজ। এত সকালে গেট খোলার পারমিশন নেই। ইরিনের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। মানুষটা নিশ্চই সারারাত এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো। অবশেষে মর্নিং ওয়াকের অযুহাত দিয়ে গেট খুলতে সক্ষম হলো সে। দ্রুত পা চালিয়ে গাড়ির কাছে গেলো সে। আয়াজ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরিনকে দেখে হতবম্ভ হয়ে গেলো। আগুনলাল চোখজোড়ায় ঢুলুঢুলু ভাব। অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো। দুজনের কেউই কোন কথা বলতে পারলো না। তবে এইমুহূর্তে আয়াজের শান্তি লাগছে। আবছা আলোতে ইরিনকে ভীষন সুন্দর লাগছে। আলতো করে তার গালটা টেনে দিতে ইচ্ছে করছে।

নিরবতা ভেঙে আয়াজ বলল,

—“তুই কি আজকে পরীক্ষা দিবি?”

—“হ্যাঁ।”

—“প্রিপারেশন আছে?”

—“না।এখন গিয়ে পড়বো।”

—“না দিলে হয় না?”

আয়াজের আকুতিভরা চাহনি ইরিনের একেবারে কলিজায় গিয়ে লেগেছে। নিজেকে সংযত করে বলল,

—“না হয় না।”

—“আমার ওপর রাগ বলছিস?”

—“না।”

—“তবে?”

—“তবে আর কি? পরীক্ষা যখন দিতেই হবে শুধু শুধু পিছিয়ে লাভ কি?”

আয়াজ নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কেন এতরাতে ইরিনের হোস্টেলে ছুটে এসেছে, কেন সারারাত জেগে হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো এই নিয়ে একটা প্রশ্নও করলো না ইরিন তাকে। বলল,

—“আপনি কি কিছু বলবেন?”

—“কেন?”

—“আমি পড়তে বসবো।”

—“তুই সিউর পরীক্ষা দিবি?”

—“তাই তো বললাম।”

—“ঠিক আছে যা। ”

ইরিনের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এইমানুষটা এমন কেন? সারারাত রাস্তায় জেগে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে অথচ ভালোভাবে দুটো কথা বলতে তার যত অসুবিধে। রাগে গটগট করে হোস্টেলের দিকে ফিরে গেলো সে। আয়াজ মূর্তির মত তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিন অদৃশ্য হতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইরিনের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অশ্রুবিসর্জনটাও অদেখাই থেকে গেলো তার। অথচ সে দিব্যি হাসছে।

পরীক্ষা কি দিয়েছে ইরিন নিজেও জানে না। উইদাউট প্রিপারেশন পরীক্ষা দিয়েছে সে। নির্ঘাত ফেল করবে। পরীক্ষা শেষে, সে আর ইত্তি একসাথে বেরোচ্ছিলো গেটে আয়াজকে দাঁড়ানো দেখে ইত্তি সটকে পড়লো। ইরিন একবার ভাবলো দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাবে। কিন্তু পরোক্ষনেই মত পরিবর্তন করে ফেললো। আয়াজ কেন এসেছে তার জানা দরকার! আয়াজের কাছে এগিয়ে যেতেই আয়াজ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,

—“এক্সাম কেমন হয়েছে?”

—“ভালো না।”

—“জানতাম আমি। শুধুশুধু আমাকে আবার আসতে হলো।”

—“আপনার উদ্দেশ্য কি?”

ইরিনের কড়া জিজ্ঞাসাবাদ। আয়াজ মৃদু হেসে বলল,

—“তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

—“বলুন।”

—“এখানে না বাসায়।”

—“আমি বাসায় যাবো না।”

—“ইরিন প্লিজ! তোকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করার মত শক্তি আমার গায়ে নেই।বিশ্বাস কর, একফোঁটাও নেই। সোনা, বাবু, ময়না, আমি তোকে বিনীত ভাবে অনুরোধ করছি তুই প্লিজ গাড়িতে উঠে বস।”

ইরিন দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। আয়াজ এমন সিরিয়াস মুহূর্তে তার সাথে মশকরা করছে? দরকার নেই ইরিনের! আর কিচ্ছু শোনার দরকার নেই।

আয়াজ দ্রুত সামনে এসে দাঁড়ালো। ইরিনের হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বলল,

—“সত্যি ইরিন বিশ্বাস কর, সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে আমার খুব কষ্ট হয়েছে।”

—“আপনি শুধু শুধু তামাসা করছিলেন কেন?

—“তুই বাসায় যাবি না বললি কেন?”

আয়াজ গাড়ি স্টার্ট দিলো।সারারাস্তায় ইরিন একটা কথাও বলে নি। চুপচাপ বসে ছিলো। বাসায় পৌঁছাতে সোহেলি বেগম আয়াজ আর ইরিনকে দেখে চমকে উঠলেন।ইরিনের হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন,

—“ঘটনা কি?”

ইরিন কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আয়াজ ফ্রেশ হয়ে মায়ের ঘরে এলো। ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—“রুমে আয়। তোর সাথে কথা আছে।”

ইরিন শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকালো।তিনি ইশারায় যেতে বললেন। আয়াজের পিছু পিছু রুমে ঢুকলো সে। আয়াজ আবারও ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিলো। বেরিয়ে এসে দেখলো ইরিন খাটের ওপর বসে পা দোলাচ্ছে। চেয়ার টেনে ইরিনের মুখোমুখি বসলো। সে তাকাতেই ইরিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

—“এই হরিণ তাকা আমার দিকে। তাকা না?

ইরিন আগের মত বসে রইলো।

—“তোকে হরিণ কেন ডাকি জানিস?”

ইরিনের কোন নড়চড় নেই। আয়াজ নিজে নিজেই বলল,

—“তোর চোখদুটো হরিণের চোখের মত মায়াবী তাই।”

ইরিনের হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে,তীব্রগতিতে লাফাচ্ছে। তবুও জবাব দিলো না সে। আয়াজ ওর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

—“আমি তোকে সেই ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি।”

ইরিন অবাক চোখে আয়াজের দিকে তাকালো। আয়াজ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

—“তোর মনে আছে প্রথমবার সবাই মিলে যখন আমাদের দুজনের বিয়ে ঠিক করেছিলো? তখন আমি টুয়েলভ এ ছিলাম। সারাদিন তোর সাথে ঝগড়া? বড়আপু যখন আমাকে ফিসফিস করে জানালো মা আমাদের বিয়ে দিতে চাইছেন তখন আমি কিন্তু মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম তুই না করে দিবি। তাই আমিও না করে দিয়েছিলাম। ”

ইরিন অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে। আয়াজ বলল,

—” তারপর তোর এইচ এসসি পরীক্ষার আগে বাবা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি আছে কি না তখন কিন্তু আমি আর না করি নি। তবে আমার ইচ্ছে ছিলো তোর পড়ালেখা যখন মোটামুটি শেষের পর্যায়ে আসবে তখন বিয়েটা হবে। কিন্তু তোর পাগলামির জন্য হুট করে আমাকে ডিসিশন চেইঞ্জ করতে হলো। এবার আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিবি তুই?”

—“কী?”

—“তুই আমাকে ভালোবাসিস?”

ইরিন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,

—“কখনো না। ”

আয়াজ হাসলো। ইরিনের খোঁপা করা চুল গুলো টেনে দিয়ে বলল,

—“ইশস!কখনো না! বললেই হলো? কালতে রাতে তুই মায়ের সামনে কি বলেছিলি মনে আছে?”

—“ভুল বলেছি। একদম ভুল।”

—-“হুম। আর?”

—“আর মানে?”

—“আচ্ছা যা, বিশ্বাস করে নিলাম। তুই রাগিস না।”

—“আপনি আর কিছু বলবেন?”

—-“হুম। আমি বুঝতে পেরেছি বিয়ের পর সত্যি মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে থাকা উচিৎ। স্বামীর সেবা করা উচিৎ। সেই হিসেবে তোরও তোর শ্বশুর বাড়িতে থাকার অধিকার আছে।”

ইরিনের মাথায় আসছে না আয়াজ হঠাৎ মত পরিবর্তন করলো কেন? গতকাল রাতে সে নিজেই ইরিনের থাকা নিয়ে তুলকালাম বাধিয়েছে অথচ আজকেই মত পরিবর্তন করে ফেলেছে? রহস্যটা কি?

আয়াজ বলল,

—“তবে আমার একটা শর্ত আছে। তুই যদি আমাকে কথা দিস, পড়াশোনা ঠিকমত করবি তাহলে হোস্টেলে থাকার দরকার নেই। বাসায় থাকতে পারবি। কারণ আমি আন্টিকে কথা দিয়েছি তোর পড়াশোনা শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেবো না। এবার তুই বল, তোর কি মতামত? বাসায় যদি থাকতে চাস তাহলে পড়াশোনায় কোন ফাঁকিবাজি করা যাবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। যতদিন আমি আছি সকালে দিয়ে আসবো। ছুটির সময় নিয়ে আসবো।”

—“ঠিক আছে।”

—“তবে নেক্সট উইক থেকে আমি কিন্তু ঢাকায় থাকছি না।”

আজকে সকালেই খবরটা পেয়েছে আয়াজ। সরকারি হাসপাতালে চাকরী হয়ে গেছে তার। তবে পোস্টিং হয়েছে ঢাকার বাইরে।

—“কোথায় যাবেন আপনি?”

—“আমার পোস্টিং ঢাকার বাইরে পড়েছে। যশোরে। তোর সমস্যা হবে না। তুই বাবার সাথে কলেজে আসা যাওয়া করবি।”

ইরিন জবাব দিলো না। মৌনমুখে বসে রইলো। আয়াজ মুচকি হেসে বলল,

—“ভালো হয়েছে না? আমি চলে গেলে শান্তিতে থাকতে পারবি।”

—“কবে যাবেন?”

–“নেক্সট উইক।”

—“ভালো।”

আয়াজ হঠাৎ লম্বা হয়ে ইরিনের পাশে খাটে শুয়ে পড়লো। ইরিনের হাতটা টেনে বুকের ওপর রেখে বলল,

—“অনেক ভালোবাসার কথা বলে ফেলেছি। এবার তুই একটু ভালোবাসা দেখা। স্বামীর সেবা কর। সারারাত তোর জন্য মশার কামড় খেয়েছি। মহিলা হোস্টেলের মশাগুলো কম করে হলেও আমার লিটার খানেক রক্ত খেয়েছে। দুর্বল হয়ে গেছি আমি।এবার তুই সেবা করে সুস্থ কর।”

আয়াজ চোখ বন্ধ করে ইরিনের কোমর জড়িয়ে ধরলো। ইরিনের আবার বুক ধড়ফড় করছে।সারা শরীরঝিমঝিম করছে। আয়াজ চোখ বন্ধ করেই বলল,

—“হরিণ? কি ভাবছিস তুই?

ইরিনের হঠাৎ রেশমার কথা মনে পড়ে গেলো। কৌতুহল বশতই জিজ্ঞেস করলো,

—“রেশমার সাথে আপনার কি সম্পর্ক? আপনি যদি আমাকেই ভালোবাসেন তাহলে রেশমাকে বিয়ে করবেন বলেছেন কেন?”

—“এত ঘটনা ঘটে গেলো তুই এখন রেশমাআপুকে নিয়ে পড়ে রইলি?”

—“কথা ঘোরাচ্ছেন কেন? রেশমা আবার আপনার আপু হলো কবে থেকে?”

—“উনি আমার সিনিয়র। আমার রাগ উঠে গিয়েছিলো তোর ওপর। তাই রাগ করে বলেছিলাম। ”

—“রেশমার কথাই কেন বলেছিলেন?

—“কারণ রেশমা আপুর একটা ছেলে আছে। আমি জানি তুই পরে আমাকে প্রশ্নটা করবি। তাই ভেবেচিন্তা উনার নামই বলেছি। তুই তো আবার ঝগড়ুটে!”

—“মিথ্যে বলার আর জায়গা পান না তাইনা? ঐ মেয়েকে দেখলে কেউ বলবে না তার ছেলে আছে।”

আয়াজ তাল মিলিয়ে বলল,

—“ঠিক বলেছিস। হট না?”

ইরিন সরু চোখে আয়াজের দিকে তাকালো।আয়াজ চোখ বন্ধ রেখেই হাসছে। দুম করে আয়াজের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো সে। রাগে চোখমুখ লাল করে ফেললো। তাকে কষ্ট দিয়ে কি শান্তি পায় আয়াজ? আয়াজের চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে ইচ্ছেমত টানলো। আয়াজ তখনো হাসছে।

—“এত জোরে টানছিস কেন? ব্যথা পাই তো।”

ইরিন চুল টানাটানির পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে আবারও কৈফিয়ত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

—” আমি কি আরাম পাওয়ার জন্য টানছি?” কি বলেছেন আপনি? রেশমা, হট না? খুব হট? ”

—“ইরিন লাগছে। টাক বানিয়ে ফেলবি নাকি?”

—“হ্যাঁ ফেলবো।”

—“এই যে তুই বউদের মত আচরণ শুরু করে দিলি। বিয়ে হয়ে গেছে বলে ভাবিস না আমি তোর সাথে মারামারি করবো না? ছাড় বলছি! আমি ধরলে কিন্তু রেহাই নেই। পরে আমার দোষ দিতে পারবি না।”

ইরিন আয়াজের গায়ের ওপর উঠে গেছে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,

—“কি বললেন আপনি? নিজে দোষ করে আবার আমাকে মারবেন বলছেন? মারবেন আমাকে? ”

—“না। চুমু খাবো। আয় চুমু খাই! যদিও সকালে ব্রাশ করি নি ব্যাপার না। আমি নিশ্চিত এলাচির সুঘ্রাণ পাবি।”

টেনে নিজের চুল থেকে ইরিনের হাত দুটো সরিয়ে নিলো আয়াজ। দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,

—“লেট’স স্টার্ট?”

ইরিন নাকমুখ বিকৃত করে বলল,

—“আপনি একটা খাটাস।আমার বোধশক্তি থাকতে এই জীবনেও কোনদিন আমি আপনাকে চুমু খাবো না।”

—“খাবি না?”

—“জীবনেও না।”

—“ঠিক আছে, আমি আয়াজ রহমান শপথ করে বলছি তোকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বানিয়ে হলেও আমি চুমু খাবোই খাবো। ব্রাশ না করেই খাবো। আহা! কি সুন্দর এলাচির সুঘ্রাণ! তুই একবার চুমু খেয়েই দেখ না।”

ইরিনের বমি আসছে। আয়াজের রুচিবোধ এত জঘন্য কেন? ওয়াক!থু!

আয়াজ আবারও ভিলেনটাইপ হাসি দিয়ে বলল,

—“ইরিন? জাস্ট একটা।”

আয়াজের রীতিমত তার হাতদুটো নিজের হাতের বাধনে আটকে ফেলেছে। ইরিন অবস্থা কাঁদোকাঁদো। তার এমন অবস্থা দেখে আয়াজের দম ফেটে হাসি আসছে। ইরিন পা দুটো এলোমেলো ছুঁড়ে সতর্ক করে বলল,

—“আমি কিন্তু সবাইকে বলে দেবো? খবরদার না। আঁআঁআঁআঁ!”

আয়াজ তাকে আধশোয়া করে ফেলেছে। ইরিন কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,

—“আপনি প্লিজ ব্রাশ করে আসুন।”

—“তুই কোন দেশের হেলথ মিনিস্টার, তোকে চুমু খেতে আমার ব্রাশ করা লাগবে?”

আয়াজ আলগোছে একটা চুমু খেয়েই নিলো ইরিনের ঠোঁটে। তারপর মুচকি হেসে ইরিনের ইরিনের হাতদুটো ছেড়ে দিলো। সাথে সাথেই ইরিন হামলে পড়লো তার ওপর।এলোপাথাড়ি কিল দিয়ে বলল,

—“খবিশ লোক! আমি এখন আপনার গায়ে বমি করবো। করবই করবো। ”

সোহেলি এসেছিলেন নাস্তার জন্য ডাকতে। রুমে ঢুকে এদের দুজনের অবস্থা দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেলো। এসব কি হচ্ছে? বিছানার বালিশ নিচে পড়ে আছে। চাদরের অবস্থা এলোমেলো। এদের কি বিয়ের পরেও কোন কান্ডজ্ঞান হয় নি? এসব ছেলেমানুষি করছে কেন? তাঁকে দেখে দুজনেই ভদ্র হয়ে বসেছে। সোহেলি ধমকে উঠে বললেন,

—“এসব কি আয়াজ?”

আয়াজ সুবোধ বালকের মত বলল,

—“আমি কিছু জানি না মা। হরিণকে জিজ্ঞেস করো।”

ইরিন রাগে ফেটে যাচ্ছে।ইচ্ছে করছে সোহেলি বেগমের সামনেই থাবড়া মেরে আয়াজের নাক ফাটিয়ে দিতে। বদ লোক! কি সুন্দর তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে।সোহেলি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওদের দুজনকে ডাইনিং টেবিলে যাওয়ার কথা বলে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যেতেই শুরু হলো পুনরায় মারামারি, কাটাকাটি।
#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:১৪

আয়াজের জয়েনিং এর বাকি আর মাত্র চারদিন আছে। পরশু যশোর যাবে সে। এদিকে আজকে তাদের ব্যাচ থেকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।সবগুলো জুনিয়র ব্যাচকে ইন্টার্ন ডাক্তাররা সবাই ট্রিট দেবে। গ্র‍্যান্ড ফিস্ট!পুরো ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছে,কনসার্টও হবে,নামীদামী শিল্পিদের নিয়ে আসা হয়েছে,চারদিকে হৈচৈ পরিবেশ!

ইরিন জাম কালারের একটা শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে এসেছে,মাথায় ফুলের ক্রাউন!টুকটুকে সুন্দর লাগছে ওকে!
এসেই আয়াজকে খুঁজছে,কিন্তু তার দেখাই নেই!..উনি যেখানেই যান হাওয়া হয়ে যান। তবে আয়াজ অবশ্য ইরিনের অলক্ষে চুপিচুপি এসে কয়েকবার ইরিনকে দেখে গেছে।

ইরিন সেল্ফি তুলছে,কোথা থেকে ইত্তি এসে হাজির।উঁচু হয়ে ইরিনের মাথার ওপর দিয়ে সেল্ফি পোজ দিলো।তারপর নিজের ফোন বের করে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে বলল,

—“তোর এত দেরী হলো কেন?”

—“বলবো না।”

ইরিন পার্লারে থেকে সেজে এসেছে। তাই তার দেরী হয়েছে। ইত্তি হাসলো,বেশ সুন্দরভাবে হাসলো।তারপর মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করলো,

—“তুই কি রেগে আছিস?”

—“ছাগলের মত প্রশ্ন করছিস কেন?”

—“ওকে মানুষের মত প্রশ্ন করছি,…মিস তাসনিয়া ইরিন আপনি কি রেগে আছেন ?”

—-“মিস নয় মিসেস!”

—“ওকে মিসেস তাসনিয়া ইরিন এবার বলুন আপনি রেগে আছেন কেন?”

—“তুই আমার সেল্ফি গুলো সব নষ্ট করে দিয়েছিস!..আমি একটা ছবিও আপলোড দিতে পারবো না এখন!”

—“ওমা কেন?”

—“তুই বুঝবি না।যা সর,..খাম্বার মত সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস না।

—“আমার সাথে দাঁড়ালে তোকে বাইট্টা দেখায় সেইজন্য?”

—“ইত্তি আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”

—“কুল,কুল,কুল!..এত হাইপার হচ্ছিস কেন?..আয় আরো কয়েকটা সেল্ফি তুলি?..তোকে নিয়ে সেল্ফি তুললে আমি সেলিব্রেটি হয়ে যাবো, আফটার অল তুই ক্যাম্পাসের চার্মিং হিরোর বউ!”

—“তোর গার্লফ্রেন্ড কই?”

—“আমাকে তো বলল পাঁচমিনিটের ভেতর আসছে।…তারপর থেকে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে,এখনো আসার নামগন্ধ নেই,তোরা মেয়েরা কি যে এত সাজগোজ করিস আল্লাহই জানে!”

—“কেন সাজলে কি সমস্যা? তোর হিংসে হয়? তুই সাজবি? ”

ইত্তি আবারও হাসলো, ইরিন চোখ সরিয়ে নিলো।

—“তুই আমাকে নিয়ে পড়েছিস কেন?”

—“পড়বো! একশোবার পড়বো,আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই পড়বো, তুই একটা বলদ।”

—“আমি বলদের মত কি করলাম?”

—“বলদের মত কি করলি মানে?…তুই তো বলদই!..একেবারে অস্ট্রেলিয়ান বলদ!.শুধু বলদ না তুই একটা ছাগল!রাম ছাগল,..ব্লাক বেঙ্গল ছাগল!”

ইত্তি অনবরত হেসে যাচ্ছে,ইরিনের মুখ বন্ধ নেই,এত পরিমান কথা বলে যাচ্ছে। তার পেছনে আয়াজের এর উপস্থিতিটুকুও টের পায় নি। আয়াজ ইত্তিকে ইশারায় চুপ থাকতে নির্দেশ দিয়ে নিজে ইরিনের পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইত্তির হাসি ক্রমাগত বাঁড়ছে।

—“ইত্তি আমি কিন্তু টেনে তোর চুল সব ছিঁড়ে ফেলবো বলে দিলাম।….তুই জানিস না তোর চেহারা বান্দরের মত!..তুই যে এমন বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসছিস তুই জানিস তোর মুখ থেকে কি পরিমাণ বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে. তুই জানিস? একেবারে পঁচা মাছের বিশ্রী গন্ধ!আমার বমি আসছে!..ওয়াক!”

সে বমি করার জন্য পেছনে ফিরতেই স্ট্যাচু হয়ে গেলো। আয়াজ লাফ দিয়ে দূরে সরে গেছে,ইত্তি অট্টহাসি ঠেকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

—“আমি আসি আয়াজ ভাই!”

ইরিনের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না।আয়াজ এগিয়ে গিয়ে ইত্তিকে একটা লিস্ট বুঝিয়ে দিলো।স্টুডেন্ট দের লিস্ট,কেউ বাদ পড়েছে কি না চেক করার জন্য!

ইত্তি চলে যেতেই আয়াজ ভ্রু কুঁচকে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন ভ্রূজোড়া নাচিয়ে বলল,

—” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? নজর লেগে যাবে তো।”

—“হাউ ফানি!”

—“বুঝি বুঝি হিংসে হচ্ছে না?”

—“থাক আমি কিছু বলবো না। কিছু বললে তো তুই আবার ইত্তির মত আমাকেও একগাদা কথা শুনিয়ে দিবি।”

—“লাগবে না আপনার বলা। আমি জানি আমাকে সুন্দর লাগছে।”

—“সেজেছিস তো আমার টাকা দিয়ে।”

—“আপনি আবার আমাকে টাকার খোঁটা দিচ্ছেন?”

—“হ্যাঁ দিলাম।”

—” আমার চাইতে আপনার টাকা বেশি হয়ে গেলো?”

—” অবশ্যই হলো না। আগে আমার টাকা তারপর তুই।”

—“ঠিক আছে আমি বাসায় গিয়ে আপনার টাকা আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো।”

—“থাক। আগে যখন মাফ করে দিয়েছি এবারের টাকাও মাফ করে দিলাম।”

ইরিম ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে ঢুকে গেলো ।

আয়াজ মুচকি হেসে গুনগুন করে গাইলো,

— “যখনই পড়েছে নজর, আমি তো হয়ে গেছি তোর!”

রাগে ইরিনের মাথানষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আয়াজ তাকে আবারও টাকার খোঁটা দিয়েছে। এদিকে খোঁচা লেগে তার শাড়িও ছিঁড়ে গেছে। রাগে হল থেকে বেরিয়ে সোজা হোস্টেলের দিকে হাঁটা ধরলো সে। হোস্টেলে এসে ইরিন শাড়ি খুলে থ্রিপিস পরে নিলো।মেকাপ তুলে মুখ ধুয়ে নিলো। প্রোগ্রামে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। হোস্টেল প্রায় ফাঁকাই, কেবল থার্ড ফ্লোরে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েরা আছে। খাওয়া শেষ করে তারা চলে এসেছে। তাদের কালকে পরীক্ষা আছে তাই। বাকিরা সবাই প্রোগ্রামে এটেন্ড করতে চলে গেছে।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ হতে চলেছে,আয়াজ পুরো অডিটোরিয়াম ঘুরেও ইরিনের দেখা পেলো না। ইরিন কি চলে গেছে নাকি?.খুঁজে পাক শুধু একবার,চড়িয়ে বেহুঁশ করে দেবে !আস্ত বেয়াদব একটা!যেখানেই যাবে তাকে পেরেশান করে ছাড়বে!

গেট দিয়ে বেরোতেই ইত্তিহাদের সাথে দেখা।সাথে মিতু। আয়াজকে দেখে লজ্জায় কাঁচুমাচু করছে। আয়াজ নিজেও অস্বস্তি নিয়ে ওর কাছে গেলো।

—“এই ইত্তিহাদ?”

—“জ্বী ভাই?…কিছু বলবেন?”

—“না মানে তোদের মেয়েরা সবাই খেয়েছে?”

—“জ্বী ভাই!…আমরা সবাই তো একসাথেই বসলাম।”

—“লিস্টের সবাই?..তুই সিউর?..কেউ বাদ পড়ে নি তো?”

—“না ভাই,আমার জানামতে তো কেউ বাদ পড়ে নি।”

—“আচ্ছা ঠিক আছে,…যা ভেতরে যা!”

আয়াজ গেট থেকে বেরিয়ে হোস্টেলের দিকে গেলো। আয়াজের ভেবে নিয়েছে ইরিন বোধহয় তার ওপর রাগ করে একা একা হোস্টেলে চলে গেছে। ইরিনের হোস্টেলের দিকে যাওয়ার পথে একটা ইটের টুকরার সাথে ধাক্কা খেয়ে নখ উলটে গেছে তার। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে নখ বেধে নিলো সে।

হোস্টেলের নিচে এসে আয়াজ অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ইরিন ধরছে না।এবার মেসেজ টোন বেজে উঠতেই সে মেসেজ বক্সে গেলো।

—“তাড়াতাড়ি নিচে আয়!আমি অপেক্ষা করছি।”

—“আমি আসবো না। আপনি চলে যান।”

আয়াজ কোন রিপ্লাই দিলো না।মিনিট পাঁচেক ওয়েট করে অবশেষে ইরিন নিচে নামলো আয়াজ আলো থেকে সরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে!
ইরিন কাছে গিয়ে ডাক দিলো,

—“কই আপনি?”

আয়াজ ফোন বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।এবার আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।এদিকে পুরো নিস্তব্দ!কেউ নেই!অন্ধজারে গা ছমছম করছে ইরিনের।হাতড়ে আয়াজের হাত ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না! আয়াজ ওর কাছ থেকে সরে দূরে দাঁড়িয়েছে।

বজ্রকন্ঠে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—“তুই চলে এলি কেন?..হোস্টেলে একা একা কি করছিলি?”

ইরিন জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুললো কিন্তু কিছু বলার আগেই মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে ‘আহ!’ শব্দ হলো। আয়াজ ঠাটিয়ে চড় মেরেছে তাকে।অন্ধকারে এতটা নির্ভুলভাবে কিভাবে কেউ টার্গেট করতে পারে? ইরিনের মাথা ভনভন করছে। সে আবারও কিছু বলতে নিলে আয়াজ খপ করে তার হাত টেনে ধরলো। শক্তভাবেই চেপে ধরেছে।

—“এত তেজ কেন তোর?..নিজেকে কি ভাবিস? একা একা হোস্টেলে আসলি কোন সাহসে? তোর কোন ভয় নেই?…দুনিয়াসুদ্ধ লোক ওইদিকে! তুই একা বের হয়েছিস কাকে জিজ্ঞেস করে?”

ইরিন মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে আছে। থার্ড ফ্লোরে যে মেয়েরা আছে সেই কথা রাগে আয়াজকে বললো না সে। কি দরকার বলার? কোন কথাবার্তা ছাড়াই আয়াজ তাকে চড় মেরেছে। এবার মেরে ফেললেও ইরিন কিচ্ছু বলবে না। আয়াজ রাগে দাঁতমুখ খিঁচে বলল,”এই তুই চুপ করে আছিস কেন?..যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে!দে বলছি..একা হোস্টেলে বসে ছিলি কেন তুই?”

ইরিন ব্যাথায় কেঁদে দিলো। আয়াজ এবার হাতের চাপ কমিয়ে দিলো। ধমক দিয়ে বলল, “এই চুপ!একদম কাঁদবি না। কিছু হলেই চোখের পানি। একদম নাটক করবি না!”

ইরিন কান্না থামিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কিছুটা শান্ত হতেই আয়াজ তার হাত ছেড়ে দিলো। একটু পরে আলতো করে ইরিনের ডানহাত ধরে জোরপূর্বক অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলো, কিন্তু যাওয়ার পথে অসাবধানতা বশত আবার হোঁচট খেলো সে। রাগে সজোরে লাথি মারলো পাথর বরাবর। তাতে তার উলটে যাওয়া নখ দিয়ে রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে। তবু রাগে থামলো না। ইরিনের হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্যান্ডেলের এর দিকে হাঁটছে। দ্রুত হাঁটার কারনে খুঁড়িয়ে হাটার ধরনটা বোঝা যাচ্ছে না। সারা রাস্তায় তার জুতো চুইতে রক্ত ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়েছে। লাইটের আলোতে আসতেই ইরিনের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

—“সোজা ভিতরে যা। আমি আসছি।”

ইরিন তখনও আয়াজের পায়ের অবস্থা খেয়াল করে নি। তার কথার প্রতি উত্তরে আগুনলাল চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।
হস্পটালে ঢুকে পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলো আয়াজ। তারা আসার আগেই খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হয়ে গেছে। একটু পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্লেটে করে খাবার নিয়ে ইরিনের কাছে এলো । তাকে দেখে ইরিনের বান্ধবীরা সরে দূরে গিয়ে বসেছে। ইরিনও উঠে যেতে নিলো। আয়াজ তার হাত চেপে ধরে বলল,

—“যাচ্ছিস কেন?”

—“আমি প্রোগ্রাম দেখবো।”

—“খাবার?”

—“কেন নিয়ে এসেছেন? আমি খাবো না!”

—“তোর জন্য কে এনেছে?আমি তো আমার জন্য এনেছি।”

—“তাহলে এখানে নিয়ে এলেন কেন?”

—“তুই খাইয়ে দিবি।”

ইরিন ঝাড়ি মেরে উঠে চলে যাচ্ছিলো। আয়াজের সাথে পেরে উঠলো না। আয়াজ তার হাত ধরে রেখেছে।

—“খাওয়া শেষ হলে তার পর যাবি।”

ইরিন চোখমুখ লাল করে বলল,

—” আপনি আমাকে আর একটা কথা বললে এখানে একটা সিন ক্রিয়েট হয়ে যাবে।”

—“হ্যাঁ। এই সিন ক্রিয়েট করা ছাড়া আর পারিস কি তুই?”

—“আপনি গায়ে পড়ে ঝগড়া কেন করতে চাইছেন? আমি আপনার সাথে কোন কথা বলতে চাইছি না আপনি বুঝতে পারছেন না?”

—“হ্যাঁ পারছি। কিন্তু গায়েপড়া তো তাই তুই না চাইলেও তোকে কথা বলতে হবে।”

ইরিনের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিনা দোষে তাকে চড় মেরেছে আয়াজ। আয়াজের সাথে বিন্দুমাত্র কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। আয়াজ নিজেই ভাত মাখিয়ে তার মুখের সামনে ধরলো। ইরিনের বান্ধবীরা দূর থেকে মুখ টিপে হাসছে। ইত্তি এসেছিল আয়াজের পায়ের ব্যথার ওষুধ দিয়ে যেতে। ওষুধ আনতে তাকেই পাঠিয়েছে আয়াজ। ভেতরে ঢুকে থতমত খেয়ে আবার বেরিয়ে গেলো । ইরিন ঠেলে আয়াজের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

—“দরদ দেখানো লাগবে না। মেরে আমার হাড় মাংস গুঁড়া করে দিয়ে এখন এসেছেন দরদ দেখাতে?”

—“বাসায় গিয়ে তুইও আমাকে ইচ্ছেমত মারিস। এখন খেয়ে নে প্লিজ। ”

—“বললাম তো আমি খাবো না।”

—“লক্ষ্মী মেয়ে না তুই?”

ইরিন মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। আয়াজ হাতের প্লেট রেখে ইরিনের বাম হাত দিয়ে ইরিনের ডানহাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। ইরিন আবারও ঝাড়া মেরে
ফেলে দিলো। বললো,

—“আমি খাবো না।”

—“না খেলে এখাম থেকে উঠতে পারবি ন।”

ইরিন জবাব দিলো না। আয়াজ ভাত মাখিয়ে বলল,

—“হাঁ কর?”

—“এবার আমি ছুঁড়ে ফেলে দেবো সব।”

বলতে দেরী ইরিনের ছুঁড়ে মারতে দেরী হয় নি। আয়াজ হতবম্ভ হয়ে নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। আর অনেকগুলো চোখ তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ইরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“খুশি?”

ইরিন মৌনমুখে বসে রইলো। আয়াজ আয়াকে খাবার গুলো পরিষ্কার করতে বলে আরেক প্লেট খাবার নিয়ে এলো। নতুন করে খাবার মাখিয়ে ইরিনের মুখের কাছে ধরে বলল,

—“হাঁ কর।”

ইরিন জেদ বজায় রেখে বসে রইলো। আয়াজ প্লেট নামিয়ে কিছুক্ষন স্থির ভাবে ইরিনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। ইরিনের চোখে পানি।আবারও ইরিনের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে অনুরোধের সুরে বলল,

—“দয়া করে হাঁ কর ইরিন।”

ইরিন হাঁ করলো না তো করলো না। আয়াজ সবার অলক্ষে তার গালে একটা চুমু খেয়ে পুনরায় অনুরোধের সুরে বলল,

—“কি করতে হবে বল? তোর পা ধরে মাফ চাইতে হবে? ”

ইরিন চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকালো। এবার হাঁ করে লোকমাটা মুখে নিলো সে। আয়াজ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে সে চুপচাপ খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে আয়াজ তার মুখ মুছিয়ে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের দিকে নিয়ে গেলো। ওদেরকে বেরোতে দেখে ইত্তি হাতে ওষুধের প্যাকেট নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে দিলো। ওষুধ দেখে ইরিন জিজ্ঞেস করলো,

—“কি হয়েছে ইত্তি? ওষুধ কার জন্য?”

—“তুই জানিস না?”

ইত্তি অবাক হয়ে একবার আয়াজের দিকে একবার ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন অবাক হয়ে বলল,

—“কি?”

আয়াজ বলল,

—“কিছু না। তুই ইত্তির সাথে প্যান্ডেল গিয়ে বয়। আমি আসছি।”

ইরিন নড়লো না। গোঁ ধরে বলল,

—“ওষুধ কার জন্য?”

—“আমার জন্য। হোঁচট খেয়ে পা কেটে গেছে।”

ইরিন আয়াজের পায়ের দিকে তাকালো। পায়ের ব্যান্ডেজের ওপর দিয়েও খানিকটা রক্ত লেগে আছে। এই জন্যই আয়াজ তাকে নিয়ে বেরোনোর সময় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছিলো। ইত্তি চলে যাচ্ছিলো ইরিন পুনরায় তাকে ডাক দিয়ে বলল,

—“তুই একটা রিক্সা জোগাড় করে নিয়ে আয় তো।আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। ”

আয়াজ বলল,” কেন?”

—“কেন আবার? বাসায় যাবো।”

—“অনুষ্ঠান?”

—” এই পা নিয়েও আপনার অনুষ্ঠান দেখার এত শখ?”

—“আমি আমার কথা বলছি না। তুই থাকবি না?”

ইরিন জবাব না দিয়ে ইত্তিকে রিক্সা আনতে পাঠিয়ে দিলো। ইত্তি রিক্সা নিয়ে আসতেই দুজনে রিক্সায় উঠে পড়লো। রিক্সায় উঠেই পায়ের ব্যথায় আয়াজের জ্বর চলে এসেছে। ইরিনের কাধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইলো সে। ইরিন প্রথমে সরিয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু জ্বর এসেছে বুঝতে পেরে চুপ করে গেলো। আয়াজ আবারও ইরিনের গালে চুমু খেয়ে বললো,

—“হরিণ আমার। তুই আমাকে ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দে কিন্তু এমন রাগ করে থাকিস না প্লিজ।”

ইরিন বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—“আবোলতাবোল না বকে চুপচাপ আমাকে ধরে বসে থাকুন। ”

আয়াজ কিছুক্ষন নিরব থেকে হঠাৎ ইরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“তুই কি নিষ্ঠুর রে ইরিন? একা একাই খেয়ে নিলি? আমি যে খেলাম না একবারও তো জিজ্ঞেস করিস নি!”

আয়াজ জ্বরের ঘোরে ছোট বাচ্চাদের মত ঢং করে কথা বলছে। ইরিন প্রথমে বুঝলো না। মুখ বাকিয়ে বলল,

—“খান নি কেন? আমি আপনাকে নিষেধ করেছি?”

—“তুই আমাকে জিজ্ঞেস করলি না কেন? আমি কতবার তোর মুখের দিকে তাকিয়েছি তুই জানিস? তুই একবারও আমাকে খেতে বললি না। ”

—“ঢং।”

আয়াজ তার কাধ থেকে মাথা সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। ইরিনের মায়া হচ্ছে। অসুস্থ মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,

—“এদিকে ফিরুন।”

—“না।”

—“না ফিরলে আমি আপনার সাথে আর কথা বলবো না।”

আয়াজ মুখ ফিরালো। ইরিন তার কপালের আউলাঝাউলা চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল,

—“বাসায় গিয়ে আমি নিজ হাতে আপনাকে খাইয়ে দেবো। ঠিক আছে?”

—“দিবি তো?”

—“দিবো। এবার চুপ করে বসে থাকুন।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here