#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৪৩ (শেষ পর্ব)
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
৫২.
এয়ারপোর্টে একগাদা মানুষের ভীড়ে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র আর আয়াশ।চারিদিকে মানুষের তুমুল ব্যস্ততা।কেউ আসছে কেউ যাচ্ছে।আয়াশের ডান হাতটা তার বাবার হাতে ধরা।বাম হাতে একটি ছোট্ট হলুদ রঙের হাসিমুখ আঁকা বল।যাকে আয়াশ বলে স্মাইল বল।এই বলটি তার খুব পছন্দের।বেশিরভাগ সময়ই বলটি তার হাতে থাকে।আজও তাই বলটি হাতে নিয়েই মানুষের ভীড়ে কিছু খুঁজে চলেছে আয়াশ আর অভ্র।পিতা পুত্রকে দেখতে আজ পুরো একরকমই লাগছে।দুজনের পরনেই সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট।দুজনের চোখেও চশমা।ব্যতিক্রম শুধু আয়াশের চশমা গোল আর অভ্র’র চোখের চশমা ছোটোর মধ্যে আয়তাকার।আরেকটি ভিন্নতাও আছে।অভ্র’র শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো আর আয়াশের শার্টের হাতা পুরো হাত পর্যন্ত ঢাকা।এছাড়া দুজনকে আর আলাদা করা যাচ্ছে না।এয়ারপোর্টের ব্যস্ততার মাঝেও দু একজন ঘুরে ঘুরে এই অনেকটা একই রকম দেখতে অসম্ভব সুন্দর ছেলে দুটিকে দেখতে লাগলেন।সেদিকে অভ্র আয়াশের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।হঠাৎ আয়াশের হাত থেকে তার স্মাইল বলটা পড়ে গড়িয়ে যেতে লাগলো।বাবার হাত ছেড়ে সে দ্রুত বলটির পেছনে গেলো।কিন্তু বলটি থামার কোনো নামই নিচ্ছে না।অগত্যা আয়াশও বলের নাগাল পাচ্ছে না।অবশেষে বলটি থেমে গেলো একটি নিল শাড়িতে ঢাকা পায়ের কাছে গিয়ে।আয়াশ দ্রুত নিচে ঝুঁকে বলটি হাতে নিয়েই সামনের মেয়েটির পা থেকে উপরের দিকে আস্তে আস্তে করে মাথা তুলে দেখতে লাগলো।হঠাৎ তার চোখ মেয়েটির মমতাময়ী মুখের দিকে যেতেই সে থমকে গেলো।তার সামনে নিল রঙের সুতি শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবার ওয়ালেটের সেই মায়া ভরা মেয়েটি।খোলা চুলের একাংশ বুকের সামনে এসে রয়েছে।গভীর কালো চোখে তার গাঢ় কাজল দেওয়া।আর সেই চোখে কি অসীম মায়া!যেন সেই মায়া উপচে পড়ে তার পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।এই মেয়েটিই কি আয়াশের মা!আয়াশের হঠাৎ ভীষণ লজ্জা লাগলো।মাথাটাকে মৃদু নিচে নামিয়ে সে আরেকবার আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকালো।
ছেলের সামনে হঠাৎ ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো অরু।তার চোখ যেন হঠাৎ নিষ্পলক হয়ে গেছে।হাত দিয়ে সামনের দেবদূতটিকে ছুঁয়ে দেখতে তীব্র ইচ্ছে করছে।কিন্তু সে পারছে না।তার হাত অসম্ভব কাঁপছে।কি সুন্দর কোমল নিষ্পাপ মুখ!মনে হচ্ছে ছুঁয়ে দিলেই ব্যাথা পেয়ে যাবে,দাগ থেকে যাবে।তবুও আলতো হাতে আয়াশের গালগুলে ছুঁয়ে দিলো সে।এই এতো সুন্দর ছেলেটিই কিনা তার অস্তিত্ব ভাবতেই অরুর পুরো শরীরে এক অন্যরকম অদ্ভুত অনুভূতি খেলে গেলো।আনন্দে চমকে উঠে আয়াশের গাল ছুঁয়ে দেওয়া হাতগুলো নিজের মুখে রাখলো।অরুর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তার নিজের অস্তিত্ব,অভ্র’র অস্তিত্ব,অরু আর অভ্র’র ভালোবাসার অস্তিত্ব।তার বাবু!
এই ছেলেকে জন্ম দেওয়ার জন্যই সেদিন অরু কি অসহনীয় কষ্টই না ভোগ করেছিলো!কিন্তু মাতৃত্বের স্বাদের কাছে সেই কষ্ট যেনো আজ কিছুই লাগছে না।এই ফুটফুটে নিষ্পাপ ছেলেটির সামনে দাঁড়িয়ে অরুর মনে হলো এমন কষ্ট সে এই মুখটির জন্য বারবার নিতেও প্রস্তুত।এই ছেলের জন্যই তো অরু সেদিন দিয়েছিলো অনেক বড় ত্যাগ।
সেদিন যখন ডাক্তাররা ভয়ার্ত মুখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলো,বাচ্চার বাঁচার সম্ভাবনা যখন একেবারে না এর বরাবরই ছিলো তখনই অরু যেনো পুরো কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়লো।পানিতে ডুবন্ত মানুষ একটা খড়কুটো ধরে হলেও বাঁচতে চায়।অসম্ভবের মধ্যে খুঁজে বেড়ায় একটু অলৌকিকতার ছোঁয়া,চায় একটু আশার আলো।হুট করে অরুও তখন মনে মনে আল্লাহর কাছে একটি বড় কিছু বলে বসলো।ও মনে মনে বলেছিলো এই বাচ্চা যদি আজ বেঁচে যায় তবে অরু ছয় বছর নিজের বাচ্চার মুখ দেখবে না।তার মুখ থেকে মা ডাক শুনবে না।শুধু বাচ্চার সাথেই নয় পরিবারের কারো সাথেই সে ছয় বছর পর্যন্ত কোনো ধরণের যোগাযোগ রাখবে না।নিজের এতোবড় কষ্টের পরিবর্তে অরু চেয়েছিলো শুধু তার বাচ্চাটারই প্রাণ।সেদিন অরুর ত্যাগের জন্য না অন্য কিছুর জন্য কেউ জানে না তবে একটি মিরাকেল অবশ্যই ঘটেছিলো।অনেক কষ্টের পর,অনেক প্রার্থনার পর অরুর ছেলে জন্ম নিলো।এসেই চিৎকার করে কেঁদে তার সুস্থতার জানান দিলো।অরুও বেঁচে গিয়েছিলো সেদিন।ডাক্তাররা অবাক তবে ভীষণ খুশি।অভ্র ছেলেকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কানে কানে জোরে আযান দিলো।তারপর ছেলেকে দেখানোর জন্য অরুর কাছে নেওয়া হলো কিন্তু অরু দেখলো না।ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো।নিজের বাচ্চাকে যে কিছুতেই দেখতে পারবে না সে।অনেকের কাছে যুক্তিহীন মনে হলেও নিজের ছেলের জীবন নিয়ে আর এক বিন্দুও রিস্ক নেবে না অরু।
তাই সেই ত্যাগের বোঝা বইতেই সুস্থ হওয়ার কিছুদিন পরেই সবার থেকে দূরে ছয় বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়।ছেলের থেকে দূর,অভ্র’র থেকে দূর,পরিবারের সবার থেকেই দূর।
নিজেকে ছয় বছরের জন্য একপ্রকার নির্বাসনেই রেখে দিয়েছিলো অরু।যেই ছেলেকে বাঁচানোর জন্য এতোকিছু করলো সেই ছেলের মুখ থেকেই এক বারো মা ডাক শুনতে পায় নি সে,তার আধো আধো বুলি শুনতে পায় নি,তার বেড়ে উঠা দেখতে পায় নি,কোলে নিয়ে মন ভরে একটু আদরও করতে পারে নি।বুক ভরা হাহাকার নিয়ে একা পড়ে রয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে।এই ছিলো তার সন্তানের জন্য তার ত্যাগ।মস্ত বড় ত্যাগ।কারো সাথেই কারোর কোনো যোগাযোগ ছিলো না।অভ্র শুধু জানতো আয়াশের ষষ্ঠতম জন্মদিনে অরু আসবে।প্রথম ফ্লাইটেই আসবে।অবশ্যই আসবে।
সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই অভ্র আর আয়াশ সকাল সকাল এয়ারপোর্টে এসে দাঁড়িয়েছিল।আর তারা অরুকে পেয়েও গেলো।
আয়াশ চোখ পিটপিট করে বারবার তার মাকে দেখে যাচ্ছে।তার মাকে সে ছবি ছাড়া কখনো সামনাসামনি নিজের চোখে দেখেনি।তবুও তার মনে হচ্ছে এই মেয়েটিকে সে অনেকদিন ধরে চেনে,তার কতো আপন একজন।ছয় বছরের ছোট্ট আয়াশ তার মায়ের ডায়েরির বেশিরভাগ কিছুই বুঝতে না পারলেও এতোটুকু ঠিকই বুঝেছে যে তার জন্যই কোনো এক কারণে তার মা এতোদিন দূরে থেকেছে।আয়াশের চোখ কেমন জ্বলছে।অরুর চোখেও পানি এসে পড়ছে।সে প্রাণপণে তা ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।ছেলের সামনে প্রথম দেখাতেই সে একটুও কাঁদবে না বলে ঠিক করে রেখেছে।আয়াশ ছোট,ঘাবড়ে যেতে পারে।নিজের সন্তানকে আজ অব্দি নিজের চোখে না দেখেও অরু চিনে ফেলেছে।দূরে অভ্রকে দাঁড়িয়ে দেখে আর তার সামনেই তার মতো দেখতে ছোট্ট বাচ্চাকে দেখে অরুর চিনতে অসুবিধা হয়নি যে এই তার ছেলে আয়াশ।
অরু খুশি হয়ে আয়াশের দুই হাত একত্রিত করে একটি চুমু দিয়ে আবারো আয়াশের মুখ হাতরে হাতরে বলতে লাগলো,
‘এমা!এতো দেখছি একদম ছোট্ট অভ্র।আয়াশ তুমি তো দেখছি একদম তোমার বাবার মতন হয়েছো।সেই রকমই গায়ের রং,সেই রকমই ঠোঁট,সেই চোখ,সেই মুখ!’
অরুর কন্ঠ কাঁপতে লাগলো।বারবার তার মমতাময়ী হাতগুলো সে ছেলের মুখে বুলিয়ে দিয়ে এই কথাগুলোই উচ্চারিত করতে থাকলো।তাদের থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে মাতা পুত্র মিলনের সেই সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে লাগলো অভ্র।তার বলতে ইচ্ছে করলো,
‘না অরু,তুমি ভুল বলছো।আয়াশের অনেক কিছুই আমার মতো হলেও চোখগুলো একদম তোমার মতো।সে তাকায়ও ঠিক তোমার মতো করে চোখ পিটপিট করে।সেই একই গভীর কালো চোখ।এই চোখের দিকে তাকিয়েই তো আমি কতো নির্ঘুম রাত পার করেছি।বেঁচে থাকার সহায় খুঁজে পেয়েছি।’
কিন্তু অভ্র কিছুই বললো না।সে পুরো চুপ করে থেকে মুখ ঘুরিয়ে রইলো।যেমনটি সে মুখ ঘুরিয়ে ছিলো অরুর যাওয়ার দিন।একটাবার ফিরেও তাকায় নি।অরু অনেক সময় নিয়ে তার ছেলের কপালে একটা গভীর চুমু দিলো।একবার কেঁদে,একবার হেঁসে আবার স্বাভাবিক হয়ে আয়াশের শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে দিলো।যেমনটি সে আগে অভ্র’র জন্য করতো।
‘বলো তো আমি তোমার কি হই?’
আয়াশ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে আবার আড়চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,
‘মা।’
অরুর কি হলো ও জানে না।ছেলের মুখে মা ডাক শুনে সে হঠাৎ শক্ত করে আয়াশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়িয়ে গেলো।এতোদিনের কষ্ট গুলো যেনো নিমেষেই উধাও হয়ে গিয়ে অরুর বুকটাকে জুড়িয়ে দিলো।আয়াশও খুব শক্ত করে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে অরুর চুলে মুখ লুকালো।অরু টের পেলো আয়াশ খুব নিশ্চুপে বারবার কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে।আয়াশ কি তবে কাঁদছে?
আয়াশের হাত ধরে অরু ছয় বছর পর তার আপন বাড়িতে ঢুকতেই সবাই অশ্রু চোখে এগিয়ে এলো।অরুর বাবা,মা,বোন,শ্বশুর,শ্বাশুড়ি,আরিশা আপু,দুলাভাই,তুতুল সবাই সেখানে উপস্থিত।সবাই যে জানতো আজ তাদের অরু আসছে ছেলের জন্য ছয় বছরের নির্বাসন শেষে।অরুর মা এসে মেয়েকে ধরে কাঁদতে লাগলেন।সবাই কাঁদছে।আজ কথার চাইতে যেনো অনুভূতিরা বেশি প্রকাশ পাচ্ছে।অভ্র’র মা রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার করে শুয়ে ছিলেন।তার মাইগ্রেইনের ব্যাথাটা আবার চেঁপে বসেছে।অরু এসেছে শুনে তিনি তৎক্ষনাৎ দৌঁড়ে এলেন।তার মাথায় একটি লাল গামছা বাঁধা।অরু হেঁসে বললো,
‘মা আস্তে।আপনার শরীর অসুস্থ।’
এই কথায় অভ্র’র মা মাথা থেকে গামছাটা এক টানে খুলে ফেলে বললেন,
‘কিসের অসুস্থ!আমার মেয়ে ফিরে এসেছে সব ব্যাথা চলে গেছে।হ্যাঁ রে মা!আমাদের বাসায় একটা চাঁদ পাঠিয়ে দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলি বল তো।এতোদিনে আজ এই ঘরটা পরিপূর্ণ হলো।’
কথাগুলো বলতে বলতে অভ্র’র মা অরুকে ধরে কেঁদেই দিলেন।চম্পা এসে ছলছল নয়নে অরুর পাশে দাঁড়ালো।অরু হেঁসে বললো,
‘কেমন আছো চম্পা?’
‘আফা মনি আপনেরে ছাড়া কোনো দিন ভালা থাকতে পারি।আপনি আইয়া পড়ছেন এহন হইলো গিয়া ভালা থাকুম।’
‘তোমার কোনো বাচ্চা কাচ্চা হয়েছে?’
‘কি কন আফা মনি!আমারে যে বিয়া করাইলো হেরেই যদি প্রথম আমার বাচ্চায় না দেহে হেলে কেমনে হইবো!আপনে আইছেন এহন আপনেগো দোয়ায় যদি আমারো একটা বেইবি হয়!’
অনেকদিন পর চম্পার সেই আঁচলে মুখ চেঁপে হাসি দেখতে অরুর ভীষণ ভালো লাগলো।সেই চেনা মানুষগুলোর চেনা ভঙ্গিগুলো দেখতে কতই না ভালো লাগছে।সবাই একে একে অরুকে ঘিরে রইলো।আজ যেনো সবাই অরু নামের উৎসব পালিত করছে এই বাড়িতে।আয়াশকে আজ পায় কে! সে আজ গুটিশুটি মেরে সোফায় সেই তখন থেকে মায়ের কোলেই বসে আছে।অরু আয়াশকে কোল থেকে নামাচ্ছেই না।আয়াশের ইদানিং কোলে উঠতে ভীষণ লজ্জা লাগে।সে তো বড় হচ্ছে নাকি!আজ তার ছয় বছর হয়ে গেছে!কিন্তু আজ আয়াশের মায়ের কোলে থাকতে প্রথম প্রথম লজ্জা লাগলেও এখন একদমই লাগছে না।বরং ভালো লাগছে,ভীষণ ভালো লাগছে।আয়াশকে কোলে নিয়ে অরু একটি অ্যালবাম খুলে বসেছে।পাশে আরো কতকটি অ্যালবামের স্তুপ পড়ে আছে।এতোটুকু বাচ্চার ছবিতেই ভরপুর তিন চারটে মোটা মোটা অ্যালবাম।অভ্র আয়াশের একটু একটু পরিবর্তনের ছবিগুলোও সব তুলে রেখেছে।হয়তো অরুর জন্যই।সবার থেকেই শুনতে পেলো অরু, কিভাবে অভ্র একা হাতে আয়াশকে বড় করেছে।অফিস আর ছেলে একা হাতে সামলিয়ে সন্তানের জন্য মা আর বাবা দুটোর দায়িত্বই পালন করেছে।আয়াশ বলে উঠলো,
‘মা,তুমি যে বাইরে একটা দোলনা টানিয়েছিলে সেটা এখনও আছে।আমি আর তুতুল ভাইয়া মাঝে মাঝেই গিয়ে উঠি।কিন্তু বাবার সামনে উঠি না।বাবা দেখলেই কেমন উদাস হয়ে পড়ে।তুমি ঐ দোলনাটা খুব পছন্দ করতে যে তাই।’
তুতুল অরুর পাশ থেকে হেঁসে বললো,
‘মামানি জানো,আমি তো আয়াশকে একবার ছোটো থাকতে মেয়েদের মতো ফ্রক পড়িয়ে দোলনায় উঠিয়ে ছিলাম।’
অরু বললো,
‘ফ্রক পড়িয়েছিলে কেনো?’
‘বারে!আমি তো বোন চেয়েছিলাম।ও ভুল করে ভাই হয়ে গেছে না।তাই আমি মাঝে মাঝে ওকে ফ্রক পড়িয়ে বোন বানাই।’
তুতুল ফোকলা দাঁতে হাসতে লাগলো।তার মুখের বাম সাইডে একটি দাঁত নেই,পড়ে গেছে।সামনের দাঁতগুলোও হয়তো পড়েছিলো আবার নতুন গজিয়েছে।হালকা আঁকাবাকা।এতে তাকে দেখতে আরো মিষ্টি লাগছে।অরু এক হাতে আয়াশকে সামলিয়ে আরেক হাতে তুতুলকে কাছে টেনে নিলো।কতো বড় হয়ে গেছে তুতুল!
‘তুতুল তোমরা দুজন কি একই স্কুলে পড়ো সোনা?’
‘হুম।তুমি চিন্তা করো না মামানি,আমি তুতুলকে দেখে রাখি তো।ও তো একটু ভ্যাবলা টাইপের,কেউ ক্ষ্যাপালেও কিছু বলে না।কিন্তু আমি গিয়ে দমাদম মাইর দেই।তুতুলের ভাইকে ক্ষ্যাপাবে এতো বড় সাহস!’
তুতুলের কথায় অরু হেঁসে ফেললো।আয়াশ লজ্জা পেয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকালো।এই তুতুল ভাইয়াটাও না!মায়ের সামনে আয়াশের নামে কি বলা শুরু করেছে।আয়াশের বুঝি লজ্জা লাগে না!’
অরু আলতো হাতে আয়াশের মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলো,
‘আয়াশ,বাবা তুমি কিভাবে জানলে আমি কৃষ্ণচূড়া গাছের সাথে বাঁধা ঐ দোলনাটা পছন্দ করি?তোমাকে কে বলেছে?’
আয়াশ উৎফুল্ল হয়ে বললো,
‘কে আবার!বাবা বলেছে।বাবা আমাকে তোমার অনেক অনেক গল্প শুনিয়েছে।আমরা প্রতিরাতেই তোমাকে নিয়ে গল্প করে ঘুমাতে যাই।জানো মা,আমাদের যখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে তখন বাবা আলমারি থেকে তোমার শাড়ি নামিয়ে আমার আর নিজের গায়ে বিছানায় চাদরের মতো জড়িয়ে দেয়।তারপর আমরা তোমার শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রেখে দুজন দুজনকে ধরে ঘুমিয়ে থাকি।সেখানে তোমার গন্ধ পাওয়া যায়।আর কেউ পায় না তবে আমি আর বাবা পাই।বাবা মাঝে মাঝে তোমাকে অনেক মিস করে জানো তো!আমার থেকেও বেশি।তখন বাবা চুপিচুপি ঘুম থেকে উঠে তোমার ছবি বুকে ধরে কাঁদতে থাকে।বাবা ভাবে আমি ঘুমিয়ে গেছি কিন্তু আমি তো সবই দেখে ফেলি।’
কথাটা বলে আয়াশ মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে ফেললো।অরুও একটু ফ্যাকাসে ভাবে হেঁসে উপরে অভ্র’র রুমের দিকে তাকালো।এখানে সবাই থাকলেও অভ্র নেই।গাড়িতেও অভ্র অরুর সাথে কোনো কথা বলে নি।তার দিকে একবার তাকিয়েও দেখে নি।
বুকে দু হাত গুঁজে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে নিজের রুমে খোলা জানালার সামনে।তার চোখগুলো আজ গভীর অভিমানে সিক্ত।অরু আস্তে করে রুমে এসে দরজার কাছে দাঁড়ালো।পেছন থেকে অভ্রকে অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো কিন্তু অভ্র কোনো সাড়া দিলো না।কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবারো অরু ডেকে উঠতেই অভ্র শুধু বললো,
‘তোমার ছেলে নিচে আছে।’
অরু হঠাৎ দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে অভ্রকে শক্ত করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।অভ্র নিজের বুক থেকে অরুর হাত ছাড়াতে চাইলো।তার চোখেও পানি এসে পড়েছে।কিন্তু অরু ছাড়ছে না।খুব শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছে।অভ্র বারবার দাঁতে দাঁত চেঁপে বললো,
‘অরু,ছাড়ো।’
অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘না ছাড়বো না।’
অনেক চেষ্টা করে অরুর হাতটা অভ্র নিজের বুক থেকে ছাড়িয়ে পেছনে ঘুরতেই আবার অরু সামনে থেকে জড়িয়ে ধরলো।নিজের থেকে অরুকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো অভ্র।বারবার বলতে লাগলো,’অরু,ছাড়ো বলছি’ কিন্তু অরুও নাছোড়বান্দা।অভ্রকে আজ কিছুতেই ছাড়বে না সে।কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলতে লাগলো,
‘না ছাড়বো না।কিছুতেই ছাড়বো না।’
দুজনের চোখেই পানি।দুজনেই চেষ্টায় আছে।একজন ধরে রাখার আরেকজন ছাড়িয়ে নেবার।
অভ্র অশ্রু চোখে শক্ত মুখে বললো,
‘একটা জিনিসই শুধু চেয়েছিলাম তোমার থেকে। যেমনই হোক,যেভাবেই হোক আমার কাছে থাকবে।সেটাও আমাকে দাও নি।কথা দিয়ে কথা রাখো নি।বলেছিলে আমার মত ছাড়া কখনো ছেড়ে যাবে না।তুমি একটা মিথ্যুক।ছাড়ো আমাকে!’
অরু চুপ করে রইলো,ছাড়লো না।অভ্র’র কথার প্রতিউত্তরে শুধু কাঁদলো কিছু বললো না।হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে দিলো।আজ অভ্র’র সব অভিমান অরু শুষে নিবে কিন্তু কিছুতেই ছাড়বে না।
এই ছাড়িয়ে নেওয়া,ধরে রাখার প্রচেষ্টায় একপ্রকার ধস্তাধস্তিই শুরু হয়ে গেলো সেখানে।একসময় দুজনেই হাঁটু গেড়ে পড়ে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো।অভ্র’র চোখ থেকে চশমা পড়ে গেছে।তবুও অরু ছাড়ছে না খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে।আর থাকতে না পেরে অভ্র হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে উঠে নিজেও অরুকে জড়িয়ে ধরলো।কতোটা কষ্ট হয়েছে এতোদিন তার!আজ অবশেষে অরুকে সে নিজের বুকে পেলো।দু হাতে অরুর মুখ ধরে অভ্র অনেক সময় নিয়ে কপালে তার ঠোঁট ছুঁয়ে রাখার পর পাগলের মতো অরুর গালে,চোখে,মুখে চুমু দিতে লাগলো।কতোদিন সে এই মায়া ভরা মুখটাকে দেখতে পারে নি।তাই আজ অসংখ্য ভালোবাসায় ছয় বছরের তৃষ্ণা সে একসাথেই মিটিয়ে নিচ্ছে।
৫৩.
রাত প্রায় অনেক।ঘড়ির কাটা দশ সংখ্যাটিতে পৌঁছে গেছে।অভ্র অস্থির হয়ে বারবার দরজার দিকে দেখছে।দশটা বেজে গেছে এখনও অরুর রুমে আসার কোনো নামগন্ধ নেই।আজ অরু নিচ থেকে কিছুতেই ছাড়া পাচ্ছে না।সারাদিন ভর সবাই অরুকে নিয়ে হৈচৈ করেছে।অরুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে অভ্র বিরক্তমুখে সোফায় পা উঠিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে মুখের সামনে একটা মোটা বই খুলে ধরেছে।ছটফট করতে থাকা অভ্র’র মন বইয়ে কি লেখা আছে কিছুই বুঝতে পারছে না।এই সময় অরু রুমে আসলো।অভ্রকে দেখেই অরুর মধ্যকার সুপ্ত বাচ্চাটা এতোদিন পর আবারো জেগে উঠলো।সে পা টিপে টিপে পূর্বের ন্যায় অভ্র’র বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো।অভ্র চমকে উঠে বললো,
‘কি করছো!দরজা খোলা,আয়াশ এসে পড়ে যদি।’
‘ভেরি ফানি!এই ডায়লগ গুলা আমার দেওয়ার কথা আপনার না।’
অভ্র মুচকি হেঁসে বললো,
‘তাহলে সেই ডায়লগ না দিয়ে উল্টোটা করছেন কেনো?’
অরু মুখে একটা হাই তুলে বললো,
‘কি করবো বলুন।আমার অতিরিক্ত নিরামিষকতা সম্পন্ন বরের জন্য আমাকে মাঝে মাঝে ডায়লগ এক্সচেঞ্জ করে ফেলতে হয়।’
‘আহারে! ম্যাম,আপনার তো দেখছি খুবই কষ্ট।’
অরু মুখটা করুণ করার ভাণ ধরে সোফায় বসে বললো,
‘হুম।আরেকটা কষ্টের ব্যাপার কি জানেন তো,আমার কষ্টটা আমার বর একদমই বোঝে না।সবসময় পিচ্চি পিচ্চি বলেই মজা করে উড়িয়ে দেয়।’
‘সো সেড!এতো আক্ষেপ আপনি মেটান কিভাবে?’
‘যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে দেখে মেটাতাম এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।’
অভ্র হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বসে বললো,
‘তুমি ওখানে হ্যান্ডসাম ছেলেদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে?’
অরু করণ মুখে আবারো মাথাটা উপর নিচে দুলাতে লাগলো।তারপর একসময় ফিক করে হেঁসে দিলো।অভ্র হঠাৎ ঝট করে অরুকে কোলে তুলে বিছানায় ফেলে ইচ্ছেমতো পায়ের পাতাদুটো ধরে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো।আর বললো,
‘এতো হ্যান্ডসাম বর থাকতে হ্যান্ডসাম ছেলে দেখতে হয়!দেখাচ্ছি তোমায় হ্যান্ডসাম ছেলে!’
অরুর তখন সুরসুরিতে হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাবার মতো অবস্থা।কোনো মতে হাসতে হাসতে বললো,
‘মিথ্যা বলেছি।প্লিজ ছেড়ে দিন আর বলবো না।প্রমিজ!’
অভ্র ছেড়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে হেঁসে অরুর পাশে শুয়ে পড়লো।এক হাত মাথার নিচে দিয়ে অরুর দিকে ফিরে বললো,
‘এক বাচ্চার মা হয়ে গেছো!এখনো মাথা থেকে দুষ্টুমি যায় নি।সেই বাচ্চাই রয়ে গেলে।’
অরু উঠে বসে বললো,
‘হ্যাঁ তো!আমি দশ বাচ্চার মা হলেও আপনার কাছে এমন দুষ্টুমিই করবো।আর আপনাকে তা সহ্য করতে হবে বুঝলেন মশাই?’
‘আপনার সকল দুষ্টুমিই তো সেই কবে থেকে আমি গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে আছি মহা রাণী।’
কথাটা শুনে অরু খিলখিল করে হাসতে লাগলো।অনেকদিন পর অভ্র সেই হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখলো।
অনেক রাতে আয়াশ চুপিচুপি অভ্র’র রুমে চলে
এলো।আজ দাদী তাকে নিজের কাছে শুতে নিয়েছিলো।আয়াশ অবাক!প্রতিদিন সে বাবার কাছে ঘুমায় আর আজ যেখানে তার মা এসেছে আর আজই কিনা আয়াশ এই রুমে ঘুমাবে না।এটা কোনো কথা?
আয়াশ তাই দাদীর চোখকে ধোঁকা দিয়ে এখানে চলে এসেছে।অভ্র আর অরু বালিশের সাথে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে একে অপরের হাতে হাত রেখে তাদের এতোদিনের জমে থাকা কথা বলছিলো।আয়াশ হঠাৎ টুপ করে বাবা মায়ের মাঝখানে ঢুকে গেলো।একদম অরুর কোল ঘেঁষে বসে রইলো।অভ্র অবাক হয়ে হেঁসে দিলো।এই ছেলে কখনোই এমন কান্ড করে না।বড্ড লাজুক ছেলে যে।ছেলেকে হাত দিয়ে আরেকটু নিজের কাছে টেনে নিয়ে অরু বললো,
‘আমার আয়াশ সোনা এতক্ষণ কোথায় ছিলো?আম্মু কতক্ষণ ধরে তাকে খুঁজে চলেছে!’
আয়াশের হঠাৎ দাদীর প্রতি বড্ড অভিমানে মন ভরে উঠলো।দেখেছো আয়াশের মাও আয়াশকে খুঁজে বেড়িয়েছে আর আয়াশ কিনা এতক্ষণ ধরে আসতে পারে নি।কতগুলো সময় সে মিস করলো!
আয়াশ মুখ ফুলিয়ে বললো,
‘দাদী আসতে দেয় নি।আমাকে বলল আজকে তার সাথে ঘুমাতে।তাই আমি লুকিয়ে চলে এসেছি।আমি আমার মায়ের কাছে ঘুমাবো না বলো!’
আয়াশের কথা শুনে অভ্র অরু একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেললো।অরু বললো,
‘তাই তো!আয়াশ তো তার বাবা মার সাথেই ঘুমাবে।দাদী একদমই বুঝে নি।আয়াশকে ছাড়া কি আর আয়াশের বাবা মায়ের ঘুম আসবে!’
অভ্র ঈষৎ মুখ ফুলানোর ভাণ করে বলল,
‘মাকে পেয়ে আয়াশ দেখছি একদিনেই মায়ের ন্যাওটা হয়ে গেলো।আর বাবাকে বুঝি ভুলে গেছে না!’
বাবার কথায় আয়াশ ভীষণ মজা পেলো।মিষ্টি করে একগাল হেঁসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘উহুম!আমার বুকে অনেক ভালোবাসার জায়গা আছে।সেখানে বাবা আর মা দুজনেই থাকতে পারবে।অর্ধেক ভালোবাসা বাবার জন্য আর অর্ধেক ভালোবাসা মায়ের জন্য।’
নিজের ছোটো ছোটো দু হাত দিয়ে আয়াশ মা আর বাবার গলা নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো।ছেলের কান্ডে অভ্র আর অরু দুজনেই হাসতে লাগলো।আয়াশের গালে দু প্রান্ত থেকে দুজনে স্নেহময়ী ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে ছেলের ছোট্ট বুকে দুই হাত একত্রে শক্ত করে মিলিত করে রেখে অভ্র আর অরু বহুদিন পর বুক ভরা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমের রাজ্যে পারি জমালো।জীবন মানেই তো সুখ দুঃখের সমষ্টি।সুখের পর দুঃখ,দুঃখের পর সুখ এই চক্রাকারেই তো চলে আসছে জীবন।শুধু এই চক্রাকারে চলার সময় কাম্য থাকে অবশিষ্টে থাকে যেন সবার জীবনে এক টুকরো সুখ।সব কষ্ট,জঞ্জাল,ক্লান্তির পর অতঃপরে থাকে যেনো একজন পরম কাছের মানুষ।যার কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকবে আমাদের জন্য এক আকাশ ভালোবাসা।অভ্র আর অরুর জীবনও তো আর এই চক্রের নিয়মের উর্ধ্বে নয়।তবুও এতোকিছুর পরও অভ্র আজ খুশি।কারণ সে অবশেষে পেয়েছে তার সত্যিকারের মনের মানুষ।আর অরুর কাছে তো আছেই ভালোবাসার নিল অভ্র।
★★★সমাপ্ত।★★★