#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৮
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সানাতকে খুঁজে চলেছে অন্তিম। এজাজদের বাড়ির আশেপাশেও খোঁজ নিয়েছে কিন্তু কোথাও সানাতকে পায়নি। এই মুহূর্তে সে সানাতের আরেক স্টুডেন্টের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেও সানাতকে পায়নি। অন্তিম কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এতো রাতে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে সানাত কোথায় যেতে পারে মাথায় আসছেনা তার। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই অন্তিম ভেজা চুলে একবার হাত চালিয়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো।
বাসস্ট্যান্ডের সামনে বাইক থামালো অন্তিম। সানাতকে সে এর আগে প্রায়ই এখান থেকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছে। তাই বাস স্ট্যান্ডের কথা মাথায় আসতেই যেনো আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল। তবে এখানে এসে সে হতাশ হলো। কারণ এখানে কোথাও সানাতকে তার চোখে পড়লো না। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ মানুষের ভীড় নিতান্তই খুব কম, নেই বললেই চলে। অন্তিম বাইকের কাছে গিয়ে বাইক স্টার্ট দিতে নিলেই হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো অন্তিম। বৃষ্টিতে খুব একটা স্পষ্ট না দেখতে পেলেও দূর থেকে সানাতের পরনে আকাশী রঙের শাড়িটা দেখে সে চিনতে ভুল করেনি ওটা সানাত। অন্তিম বাইক থেকে নেমে দৌঁড়ে গিয়ে সানাতের সামনে দাঁড়াতেই দেখলো সানাত ফুটপাতে মাথা নিচু করে বসে আছে। অন্তিম হাঁটু ভাঁজ করে সানাতের সামনে বসে পড়লো। তারপর ডেকে উঠলো,
“সানাত!”
অন্তিমের গলার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই সানাত মাথা তুলে তাকালো। সানাতের মুখের দিকে তাকাতেই যেনো অন্তিমের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। সানাতের চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেঁদেছে। এই ভাঙ্গাচোরা,বিধ্বস্ত সানাতকে এর আগে কখনো দেখেনি সে।অন্তিমকে দেখে সে ভাঙ্গা গলায় বললো,
“আপনি? আপনি এখানে কেনো?”
“সানাত তোমার কোনো সেন্স আছে আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি। ক’টা বাজে তোমার খেয়াল আছে! আমি চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর তুমি এখানে ফুটপাতে বৃষ্টির মধ্যে বসে আছো! আমার কতোটা টেনশন হচ্ছিলো জানো তুমি? বারবার মনে হচ্ছিলো ওইসব কথা শুনে অভিমানের বশে তুমি হয়তো সুইসাইড…”
এইটুকু বলেই থেমে গেল অন্তিম আর বলতে পারলোনা। সানাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
“চিন্তা করবেন না আমি আর যাই করি আত্মহত্যা করবো না। এতকিছুর পরও যখন বেঁচে আছি তখন এতো সহজে মরবো না। আমি মরতে খুব ভয় পাই। খুব। তারজন্যই তো এতকিছুর পরও মরার কথা ভাবছিনা উল্টো বাঁচার জন্য লড়াই করছি প্রতিনিয়ত। আর আমি মরলে কি করে চলবে বলুন? আমি মরলে ঠিক তার পরের সেকেন্ডেই আমার বাবার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে, আমার ভাই-বোনের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, আমাদের সংসারটা অচল হয়ে পড়বে। তাই চাইলেও আত্মহত্যা করতে পারবোনা এখনো যে অনেক পিছুটান রয়েছে। কিন্তু আপনি এখানে কেনো এসেছেন?”
“তোমাকে নিতে এসেছি। বাসায় চলো।”
“আমি কোথাও যাবো না। আপনি ফিরে যান।”
“যাবেনা মানে? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
“যার জীবনটাই ঠিক নেই তার আবার কিসের মাথা ঠিক-বেঠিক। আপনি ফিরে যান। আমি কোথাও যাবনা।”
“সানাত পাগলামি করো না। তুমি জানো ওহী তোমার জন্য কতোটা টেনশন করছে?”
“আপনি আমাকে পাগল বলেছেন অথচ আপনার বোন আমার থেকেও বড় পাগল। পাগল না হলে আমার মতো একটা ফেলনা মেয়েকে নিয়ে কেউ এতোটা ভাবে বলুন? ও নিজেও জানেনা ও কতোটা বোকা আমার একটা নোংরা-খারাপ মেয়েকে এতটা ভালবাসছে?”
“সানাত ওহী জানে কে ওর কাছের আর কে নয়। তুমি প্লিজ বাড়ি চলো।”
“আপনি বেকার জেদ করছেন কেনো বুঝতে পারছেন না আমার মতো মেয়ে আপনার জীবনে থাকলে আপনার জীবনটা, আপনাদের পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে। আমি যে অপয়া, অলক্ষ্মী! আমি এতটাই খারাপ যে নিজের মায়ের মতো খালার চোখেও আমি বেঈমান। হ্যাঁ মায়ের মতো! কিন্তু মা নয়। দিনশেষে মায়ের মতই থেকে যায় কিন্তু মা হয়ে ওঠে না। তাইতো আমিও মেয়ের মতোই রয়ে গেছি কিন্তু মেয়ে হয়ে উঠতে পারিনি। তাই আপনাকে বলছি এই জোরপূর্বক বিয়েটাকে বয়ে বেড়াবেন না। যেটা হয়েছে সেটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যান। আর নতুন করে জীবনটাকে গুছিয়ে নিন।”
“আমি আমার জীবনে কি করবো না করবো সেটা তোমার থেকে শুনে করবো না সানাত। তোমাকে আমি সেচ্ছায় বিয়ে করেছি সানাত সেটা হোক মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিংবা জেদের বশে কিন্তু করেছি। তাই তোমাকে ছাড়তে হলেও আমি সেচ্ছায় ছাড়বো তোমার বা কারো কথায় নয়। তোমার আর আমার মধ্যে একটা বিষয়ে খুব মিল আছে জানো সানাত। আমরা দুজনেই ঠকে গেছি। তুমি বন্ধুত্বে আর আমি ভালোবাসায়। আমার এখন কি মনে হয় জানো সানাত এই পুরো বিষয়টা শুধুমাত্র পরিস্থিতির জন্য ছিলোনা কোথাও না কোথাও ডেস্টিনিতে ছিলো তাই হয়েছে। তোমার আর আমার গন্তব্যটা হয়তো আলাদা কিন্তু আমাদের রাস্তাটা এক। তাই আমি তোমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি সানাত। ভেবোনা আমি দয়া-মায়া করছি আমি আমার আত্মগ্লানি কমাতে হাত বাড়াচ্ছি। কারণ আমি জানি তোমার আজকের এই অপমানের জন্য আমি দায়ী। আমি যদি সেদিন একবারের জন্য হলেও জানতাম তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো তাহলে বিশ্বাস করো আমি আর যাই হোক না কেনো জেদের বশে তোমার লাইফ নিয়ে খেলতামনা। তাই বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছি সানাত তুমি কি আকড়ে ধরবে এই হাতটা? আই প্রমিজ আমি বিশ্বাস ভাংবোনা।”
সানাত কোনো কথা বলছেনা শুধু নিস্পলকভাবে তাকিয়ে আছে। অন্তিম আবারও বললো,
“ধরবে না সানাত?”
সানাত আকড়ে ধরেই কেঁদে ফেললো। অন্তিম আলতো করে সানাতের গালে হাত রেখে বললো,
“সানাত প্লিজ কান্না থামাও। এখন অনেক রাত হয়ে গেছে বাড়ি ফিরতে হবে। আর তুমিতো ভিজে একাকার হয়ে গেছো সাথে আমিও। এবারে নির্ঘাত জ্বর আসবে। তাড়াতাড়ি চলো।”
সানাত উঠে দাঁড়ালো। শীতে চোখে ঝাপসা দেখছে সে। তারপর অন্তিমের পেছনে গিয়ে বাইকে উঠে বসলো। অন্তিম একটা হেলমেট দিয়ে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে বললো,
“অস্বস্তি বোধ করো না। শক্ত করে ধরে বসো। তোমার গা গরম জ্বর আসবে বোধয়। আর দুর্বল আছো যেকোনো সময় সেন্সলেস হয়ে যেতে পারো। তাই শক্ত করে ধরে বসো।”
সানাত আলতো করে অন্তিমের কাধে হাত রাখলো। সানাতের ভেতরটা আজ অদ্ভুত ভালোলাগায় ছেয়ে যাচ্ছে। ইশ এতো সুখ কেনো লাগছে তার। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সে মোটেও অভাগী নয় বরং বড্ডো ভাগ্যবতী। কেনো মন বলছে তাদের অগোছালো সম্পর্কটা ধীরে ধীরে রং পাচ্ছে।
বাইক বাসার সামনে এসে থামাতেই অন্তিম আচমকা খেয়াল করলো সানাত তার পিঠে ঢলে পড়েছে। বেশ কয়েকবার ডাক দেওয়ার পরও কোনো সাড়া দেয়নি। অন্তিম বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে। কোনো রকমে দাড়োয়ান চাচার হেল্প নিয়ে হ্যান্ডেল করে বাইক থেকে নেমে সানাতকে কোলে তুলে নিয়ে বাসার ভেতরে গেলো।
এদিকে সানাতকে নিয়ে বাসায় ঢোকার পর ওহী সানাতের এই হাল দেখে কেঁদে কেটে এক। তার প্রাণের প্রিয় বান্ধবীর এই অবস্থা দেখে তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সে যে সানাতকে বড্ড ভালোবাসে। অন্তিম একটু বিরক্ত হলেও প্রকাশ করছেনা। সে ওহীকে বললো,
“ওহী ওর ভেজা শাড়িটা চেঞ্জ করে দে। আর জ্বর এসেছে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দে। আজকে রাতটা তুই ওর সাথে থাক। কোনো প্রয়োজন পড়লে আমাকে ডাক দিস আমি ওই রুমেই আছি।”
বলেই বেরিয়ে গেলো অন্তিম।
#চলবে