#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১০
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)
কেটে গেছে তিন মাসেরও বেশি সময়। এই তিন মাসে মোটামুটি অনেককিছুই বদলেছে। এই যেমন সানাত আর অন্তিমের সম্পর্ক এখন আর আগের মতো নেই। যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে তাদের। দুজনেই এখন জীবনে একটা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। এই একমাস হলো সানাত পড়াশোনার পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারে চাকরি নিয়েছে। অন্তিমেরও গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরীর পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। সে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে সুযোগ পেয়েছে। তবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা সে এখন অব্দি জানায়নি। শুধু বলেছে ওটা সারপ্রাইজ। এদিকে ওহীও আজকাল প্রেমে ব্যস্ত। এই মাস দুই হবে সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। আজকে সে ভার্সিটি ফেলে তার প্রেমিক মানুষটির সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে বেরিয়েছে। আর এদিকে সানাতকে রেখে গেছে পাহারাদার হিসেবে। যেনো কোনোকিছু হলে সে সামলে নেয়। অন্তিম আজ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। মূলত অপেক্ষা করছে সানাত আর ওহীর জন্য। তবে এখনও দেখা মেলেনি একজনেরও। অন্তিম হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো। তিনটা পঞ্চাশ বাজে টানা আধা ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে অথচ সানাত ওহীর কারোরই কোনো পাত্তা নেই। অন্তিম বেশ বিরক্ত হয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেলো সানাত আসছে। পরমুহূর্তেই চোখ গেলো সানাতের পাশে হেঁটে আসা ছেলেটির দিকে। বেশ হেসে হেসেই কথা বলছে সানাতের সাথে। সানাতও হাসছে আর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু বলছে। অন্তিমের আচমকাই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে ভেবেই পাচ্ছেনা এই ছেলেটার সাথে এতো হেসে কথা বলার কি আছে! অসহ্য! অন্তিম পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো সানাতের নাম্বারে তারপর ফোন কানের কাছে ধরে গাড়ি থেকে সানাতের দিকে তাকালো। হঠাৎ কথার মাঝে ফোন বেজে উঠতেই সামান্য বিব্রত হলো সানাত। তারপর ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো অন্তিমের কল। সানাত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় অন্তিম বললো,
হ্যালো সানাত তুমি এখন কোথায়?
সানাত যেনো ধাক্কা খেলো। হঠাৎ উনি কোথায় আছি এই কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো? ওহীর কথা কি জেনে গেলো নাকি? সানাত ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললো,
আ..আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো করছেন?
এটা আমার উত্তর নয়। যেটা জানতে চেয়েছি সেটা বলো।
আ..আমি আর কোথায় থাকবো ভার্সিটিতেই আছি।
ভার্সিটির কোথায় আছো?
সানাত ঢোক গিললো। তারপর বললো,
আ..আপনি এসব কেনো জানতে চাইছেন?
আগে বলো।
আমি ভার্সিটির কেন্টিনে আছি।
ওহ। আচ্ছা।
জ্বি।
ওই ছেলেটার সাথে ওখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি করছো?
অন্তিমের কথা শোনা মাত্রই সানাতের বিষম উঠে গেলো। এদিকে তার পাশে দাঁড়ানো আলভী কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে অবলার মতো সানাতের দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত রাখলো। এই দৃশ্য দেখা মাত্রই গাড়ীতে বসে থাকা অন্তিম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তার ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে ওই ছেলের হাত ভেঙ্গে দিতে আর তারপর সানাতের গালে দাবাং মার্কা একটা চর বসাতে। সানাত কাপাকাপা গলায় বললো,
আ..আপনি ক..করে জানলেন?
তোমার ডানে মেইন রোডে তাকাও।
সঙ্গে সঙ্গে সানাত তাকালো। তারপরই চোখে পড়লো অন্তিমের কালো গাড়িটি। অন্তিম বললো,
দেখা হয়ে গেলে চুপচাপ এসে গাড়ীতে এসে ওঠো। বলেই ফোন কেটে দিলো।
কি হয়েছে সানাত? বললো আলভী।
আমাকে যেতে হবে আলভী।
চলো আমি এগিয়ে দিয়ে আসি।
না না তার প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারবো সামনেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
আরেহ আমিও এই রাস্তা দিয়েই যাবো। চলো। বলেই হাঁটতে লাগলো আলভী। সানাতও আর কথা বাড়ালো না। গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই অন্তিম গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিয়ে সানাতের দিকে তাকালো। আলভী গাড়ির ভেতরে বসা ব্লু শার্ট পরা অন্তিমের দিকে তাকালো। অন্তিমের চোখে সানগ্লাস তাই তার দৃষ্টি ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। সানাত আলভীর উদ্দেশ্যে বললো,
তুমি এখন যাও আলভী।
আলভী একবার অন্তিমের দিকে তাকিয়ে তারপর সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
ইনি কে সানাত? কার সাথে যাচ্ছো তুমি?
সানাত পড়লো এক বিপাকে। কি বলবে সে? কি করে বলবে অন্তিম তার স্বামী? আর অন্তিমই বা কেমন রিয়েক্ট করবে? সানাত একবার অন্তিমের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
কা..কাজিন ।
অন্তিমের মাথায় যেনো বাজ পড়লো এমন কথা শুনে। এদিকে আলভী হেসে বললো,
ওহ তা তোমার ভাই কিন্তু খুব হ্যান্ডসাম সানাত। বলেই সে চলে গেলো। আর এদিকে অন্তিম গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে চোয়াল শক্ত করে আছে। সানাত উঠে বসতেই অন্তিম সামনের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
তুমি একা কেনো ওহী কোথায়?
ওহীর কথা মনে পড়তেই সানাতের দম বের হওয়ার পালা। মনে মনে মিথ্যে কথাগুলো সাজিয়ে বললো,
আসলে ওহী রাহার বাসায় গেছে। কিছু ইম্পর্ট্যান্ট নোটস তুলতে। আমিও যেতাম কিন্তু পরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
ওহ। তা ওই ছেলেটা কে ছিলো?
কোন ছেলে?
অন্তিম এবার সানাতের চোখে চোখ রেখে বললো,
যেই ছেলেটার সাথে এতক্ষণ ধরে হেসে হেসে, দাঁত বের করে, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুখের আলাপ করছিলে তার কথা জিজ্ঞাসা করছি? কে সে?
সানাত অন্তিমের এমন ধরনের কথায় বেশ ভরকে গেল। তারপর বললো,
ওহ আপনি আলভীর কথা বলছেন। ও আলভী। আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই। ছেলেটা খুব মজার জানেন। আজও একটা ফানি…
আমি তোমার থেকে ওর সুনাম শুনতে চাইনি। সো প্লিজ স্টপ।
আপনি কি কোনো কারণে রেগে আছেন?
না।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
জাহান্নামে।
এসব কি বলছেন আপনি? আপনি নিশ্চই রেগে আছেন তাই এমন করে কথা বলছেন। কেনো রেগে আছেন? আমি কি কিছু করেছি?
বেয়াদব মেয়ে আমি তোমার কাজিন হই? কোন জন্মের কাজিন আমি তোমার?
সানাত এতক্ষনে বুঝতে পড়লো আসল কাহিনী। সে বললো,
নাহলে আর কি বলতাম?
কিছু বলতে হবে না প্লিজ চুপ থাকো।
আচ্ছা চুপ থাকবো আগে বলুন আমরা কোথায় যাচ্ছি?
টিএসসি।
তাহলে কিন্তু আজকে আপনাকে ট্রিট দিতে হবে। আপনার জব হয়ে গেছে অথচ আপনি এখনো ট্রিট দেননি।
চাকরি তো তোমারও হয়েছে। তুমিও তো ট্রিট দেওনি।
বেশ চলুন আজ আমিও আপনাকে ট্রিট দেবো আপনিও আমাকে ট্রিট দেবেন। একদম ইকুয়াল।
কিছুদূর যেতেই জ্যামে বিরক্ত সানাত অন্তিম দুজনেই। সানাত বিরক্ত হয়ে পাশে তাকাতেই তার আত্মার পানি শুকিয়ে গেলো। তাদের গাড়ির পাশেই ওহী আর তার প্রেমিক বাইকে বসে আছে। সানাতের ঘাম ছুটে গেছে। এখন যদি একবার অন্তিম দেখে ফেলে তাহলে আজ দফা-রফা হয়ে যাবে। সানাত তড়িঘড়ি করে গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে দিলো। অন্তিম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
কি ব্যাপার গ্লাস উঠিয়ে দিলে কেনো?
আ..আমার গরম লাগছে। এসি অন করুন।
তোমার আজ হঠাৎ গরম লাগছে। অন্যান্য দিনতো আমার সাথে বিতর্ক করে জানালা খোলা রাখো আর আজ নিজেই বলছো এসি অন করতে। স্ট্রেঞ্জ!
কি আজব! আজ আমার গরম লাগছে তাই বলেছি তাতে এমন করার কি আছে?
নাহ্ কিছুনা আমার একটু অদ্ভুত লেগেছিল তাই আর কি!
🌻
বর্তমানে এখন তারা আছে টিএসসির সামনে। সানাত বসে মন ভরে ফুচকা খাচ্ছে। আর এদিকে অন্তিম নাক কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তারপর বলে উঠলো,
ইয়াক সানাত। এসব আনহেলদি খাবার কি করে এতো মজা করে খাও তুমি? হেজিটেড ফিল করো না? আমার তো দেখেই কেমন যেনো লাগছে?
এতো আয়েস করে খাওয়ার মাঝে বিঘ্ন ঘটায় সানাত বেশ বিরক্ত। সে বিরক্তি নিয়েই বললো,
না আমার কোনো হেজিটেড ফিল হয়না। আপনাদের মতো বড়লোকদের কাছে হেজিটেড হবেই।
সানাত বিষয়টা বড়লোক বা গরীবের নয়। বিষয়টা হেলথের। তুমি এই নিয়ে তিন প্লেট খাচ্ছো। এবার প্লিজ স্টপ করো নইলে সত্যিই প্রবলেম হবে।
সানাত শেষ ফুচকাটা খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো,
চলুন এবার নেক্সট ট্রিটটা দেবেন। বলেই অন্তিমের হাত ধরে টেনে নিয়ে দাঁড় করালো আইসক্রিমের গাড়ির সামনে। তারপর বললো,
এবার আইসক্রিম খাবো। এবার কিন্তু আপনিও খাবেন আমার সাথে।
মোটেও না। তুমি খাচ্ছো খাও আমাকে এসবে টানবেনা। আর এমনিতেও আই ডোন্ট লাইক আইসক্রিম।
কিইই! আপনি আদেও মানুষ?
মানে? তোমার আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি ভাল্লুক নাকি এলিয়েন?
ভাল্লুক না তবে আপনি ভিন গ্রহের মানুষ নিশ্চিত। নাহলে আইসক্রিম আবার কারো ভালো লাগেনা? আমি তো জন্মেও শুনিনি।
বয়স কতো তোমার যে শুনবে! বাচ্চা মানুষ!
কিহহ আপনার আমাকে বাচ্চা মনে হয়? শুণুন আমার বয়স বাইশ বছর বুঝলেন। আমি মোটেও বাচ্চা নই।
আমাকে কিছু বোঝাতে আসবেনা। তোমার থেকে গুনে গুনে ছয় বছরের বড় আমি।
সানাত আর পাত্তা না দিয়ে দুটো আইসক্রিম নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। অন্তিম দাড়িয়ে দাড়িয়ে সানাতের আইসক্রিম খাওয়া দেখছে তারপর একটুপর টিসু দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে। এই যে অন্তিমের এই ছোট ছোট কেয়ারগুলো কতোটা সুখ দেয় সানাতকে তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেনা। আইসক্রিম খাওয়া শেষে সানাত বললো,
এবার আমার ট্রিট দেওয়ার পালা। চলুন।
কি খাওয়াবে শুনি? কোনো আনহেলদি খাবার কিন্তু না?
আপনি চলুন তো।
সানাত আর অন্তিম হাঁটছিলো। আচমকাই অন্তিমের চোখ গেলো পাশের ফুলের দোকানে। কি মনে করে যেনো অন্তিম একটা গাজরা কিনে নিলো। তারপর সানাতকে থামিয়ে বললো,
সানাত তোমার হাতটা দেও তো।
কেনো?
দেও।
হাত বাড়িয়ে দিতেই গাজরাটা হাতে খুব যত্নের সাথে পরিয়ে দিলো। এদিকে সানাতের মনের খাচায় বন্দী সুপ্ত প্রজাপতি গুলো অনুভূতির তুমুল জোয়ারে উড়ে বেড়াচ্ছে।
সানাত আর অন্তিম একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই সানাত গিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে এসে হাজির হয়ে বললো,
নিন ধরুন। নাক ছিটকাবেন না। একবার খেয়ে দেখুন রাস্তার ধারের সস্তার মাটির ভারের চায়ের স্বাদই আলাদা।
অন্তিম হাজার দ্বিধা শর্তেও সানাতের কথা ফেলতে পারলোনা । সে চুমুক দিতেই দেখলো সত্যিই অসাধারণ। সানাত চুমুক দিয়ে অন্তিমের দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে উঠলো,
“তোমার সাথে টিএসসি, মাটির ভাড়ে গরম চা
তোমার সাথে হঠাৎ দেখায়, থমকে গেছে শহরটা।”
#চলবে