অটবী সুখ
২৮.
শেষ রাতের বৃষ্টির রেশ এখনো রয়ে গেছে। মাথার ওপর চলন্ত বৈদ্যুতিক পাখার গতি তীব্র। শীত লাগছে। কিন্তু ফ্যান কমানোর কিংবা বন্ধ করার বিন্দু মাত্র প্রয়াস নেই। ওড়নাটা শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে অটবী শুধু ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্ত প্রান্ত পায়চারি করছে। চিন্তায় মনে হচ্ছে, মাথায় হাজারটা পাথরের বোঝা। ঠোঁটের পাতাগুলো রুক্ষ হয়ে আছে। জিভ দিয়ে তা ভিঁজিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো অটবী। এগারোটা বেজে বারো মিনিট। ত্রিস্তান এসেছে দশটায়, হুট করেই। কাল সন্ধ্যায় লোকটা বলেছিল, সে অটবীকে আজকে নিতে আসবে। অটবী বিশ্বাস করেনি। একদম পাত্তাই দেয়নি। ভেবেছিল, লোকটা মিথ্যে বলছে, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সত্যি সত্যি হয়তো আসবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ত্রিস্তান এসেছে। বসার ঘরে বসে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। এক ঘন্টা হয়ে গেল, তাদের কথা শেষই হচ্ছে না!
এমনিতেও রেবা বেগম রহিমদের কাউকে পছন্দ করেন না। সে হিসেবে ত্রিস্তানকেও তার পছন্দ হবার কথা নয়। তারওপর বিয়ের মতো বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। ত্রিস্তানকে দেখা মাত্রই উনার উচিত ছিল চিৎকার-চেঁচামেচি করে পুরো এলাকা উল্টে ফেলা। পুলিশ-টলিশ ডেকে এলাহি কান্ড ঘটানো। কিন্তু তা না করে এরা দুজন এত শান্ত, স্থবির পরিবেশে এতক্ষণ কি কথা বলছে তা কিছুতেই ঠাওর করতে পারছে না অটবী। ওপাশ থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি তো দূর, কথার আওয়াজও ভেসে আসছে না। তার মনের হাঁসফাঁস বাড়ছে। ভয় বাড়ছে। বিছানায় একটু শান্তিতে বসতেও পারছে না সে। এই নলীটাও যে কোথায় গেল! কাজের সময় একদম পাওয়া যায় না।
ভাবনা অকূল পাথারেই খট করে খুলে গেল দরজা। নলী এলো হাঁপাতে হাঁপাতে। তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বললো, “কাহিনী তো ঘটে গেছে আপা।”
অটবীর ভয় সীমা ছাড়ালো যেন, “ক-কি হয়েছে? আম্মা কিছু বলেছে ত্রিস্তানকে? গালিটালি দেয়নি তো?”
ঝুঁকে থাকা নলী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পানির তেষ্টা পাচ্ছে। ঢোক গিলে বললো, “সেটাই তো সমস্যা! গালিটালি কিচ্ছু দেয় নাই। বকেও নাই। চুপ ছিল।”
অটবী ভ্রু বাঁকালো। প্রশ্ন করলো, “তাহলে?”
—“ত্রিস্তান ভাইয়া জম্বেশ একটা ভাষণ দিছে। ওমনি আম্মা শান্ত! কি ভাষণ দিছে, শুনবা?”
অটবী উৎসুক জনগণের ন্যায় তাকালো। তাতে যেন আরও উৎসাহ পেল নলী। কণ্ঠকে জোড়পূর্বক পুরুষালি করে ত্রিস্তানের মতো গম্ভীরমুখো হয়ে বললো, “আমি জানি আপনি কষ্ট পেয়েছেন। কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা না। আমাদের অবশ্যই উচিত ছিল আপনার মত নিয়ে বিয়ে করা। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। আপনাদের আর্থিক অবস্থা, হঠাৎ বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া– সব মিলিয়ে অটবী আপনাকে আর দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায়নি। এখন আপনি বলতে পারেন, আমরাই হয়তো বিয়ে ভেঙ্গেছি বা এমন কিছু। কিন্তু আমরা আমাদের অনেক আগে থেকে পছন্দ করলেও আমাদের মাঝে সম্পর্কের উৎপত্তি ঘটেছে ওর বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর। একমাস আগে।”
নলী থামলো। বোঝা গেল, ত্রিস্তানের মতো কথা বলতে তার খুব বেগ পেতে হচ্ছে। বারবার তাল হারিয়ে ফেলছে। জোড়ে জোড়ে দুটো নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “অটবী আপনাকে খুব সম্মান করে, ভালোবাসে। আপনি ওর মা। ওকে মারতেই পারেন। কিন্তু যে নিজেই ভুল পথে হাঁটছে, তার কথা বিশ্বাস করে; পুরোটা না জেনেই ওকে মারা উচিত হয়নি। একটু নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে বসুন। ওর পুরো কথা শুনুন। আগে আমি কেমন তা জানুন। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনার নিশ্চই আপনার মেয়ের ওপর বিশ্বাস আছে? ও আপনার মতামতের বিরুদ্ধে একপাও আগাবে না। আর না আমি ওর মতের বিরুদ্ধে যাবো।”
সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বিশাল বক্তব্য। তবে মিথ্যের চেয়ে সত্যই বেশি বলেছে লোকটা। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আম্মা আর কিছু বলে নি?”
—“নাহ্, বলে নাই।”
বলতে বলতে পড়ার টেবিল থেকে প্লাস্টিকের বড় বোতল উঠালো নলী। কয়েক ঢোক পানি গিলে গলা ভেঁজালো। এরপর আবার বললো, “তোমাকে ত্রিস্তান ভাইয়া বলছিল উঠানে যাইতে। কি যেন বলবে বললো।”
—“উঠানে? উনি এখনো যাননি?”
প্রশ্ন ছুড়ে, এবড়োথেবড়ো ওড়নাটা সুন্দর করে মাথায় জড়ালো অটবী। বসার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে সাবধানী গলায় শুধালো, “আম্মা কোথায়? বাইরে যেতে পারবো?”
—“রুমে আছে। পৃথাও মনে হয় রুমে। আল্লাহ জানে আম্মার কানে কি আকাম-কুকাম ঢালতাছে! তুমি আপা তাড়াতাড়ি যাও তো!”
অটবী আর দেড়ি করলো না। ছুটন্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। ত্রিস্তান কি এখনো অপেক্ষা করছে? নাকি চলে গেছে? অস্থির লাগছে তার। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে।
–
উঠানের দিকটায় ত্রিস্তানকে পাওয়া গেল না। আড়ষ্ট অটবীকে আরও অশান্তিতে ফেলে সে বিন্দাস গেটের বাহিরে সিগারেট ফুঁকছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। উলটো দিক ফিরে আছে। ঝাকড়া চুলের মাথার ওপর দিয়ে অবিরাম ধোঁয়ার সারি উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন ভেতরকার সব গ্লানি নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে আকাশ! ত্রিস্তানও-বা কম কিসের? চোখের লুকোচুরিতে আকাশের সঙ্গে গোপন আলাপনে মত্ত হয়েছে সে। কেমন একটা রাজকীয় ভাবসাব! কিন্তু কোথাকার রাজা সুখনীল ত্রিস্তান? অটবীর বক্ষে লুকানো ওই গোপন যন্ত্রের? নাকি এই বিশাল আকাশের? যাকে সে তার মনের সব কথা বলে।
ক্যাচক্যাচ শব্দে গেট খোলার আওয়াজ হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ত্রিস্তান। অটবীকে দেখে অল্প হাসলো। স্নিগ্ধ হাসি! মনোমুগ্ধকর! অটবীর রাগ-টাগ চট করে উবে গেল। কি মুশকিল! সে কি আদৌ কখনো এ লোকের ওপর রাগ করতে পারবে না?
কৃত্রিম গম্ভীরতা নিয়ে অটবী মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন? আমি আপনাকে খুঁজছিলাম।”
ত্রিস্তান উত্তর দিলো না। হাতের সিগারেট-টা ফেলে পা দিয়ে পিঁষে ফেললো। আচমকা ঝুঁকে বললো, “দেখো তো, সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছো?”
লোকটা কাছে চলে এসেছে। একটু বেশিই কাছে। কানের জায়গাটুকু গরম নিশ্বাসেরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি! অটবী ভড়কে এক কদম পেছালো। কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে ত্রিস্তানকে দূরে সরিয়ে দিলো। অন্যদিকে চেয়ে বললো, “কিজন্য ডেকেছেন?”
—“ঘুরতে যাবো।”
—“হু? কি?”
অটবীর আশ্চর্য দৃষ্টি। পরনে মোটামোটি ধরণের সালোয়ার। চুলগুলো কাকের বাসা হয়ে আছে। এ অবস্থায় ঘুরতে যাওয়া? তারওপর রেবা বেগমের হাবভাবও সুবিধার নয়। কাল রাত্রির রাগ নিশ্চই এত তাড়াতাড়ি কমে যায়নি?
অটবী দিরুক্তি জানালো, “মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? এমতাবস্থায় আপনি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেন কিভাবে?”
ত্রিস্তান আগের মতোই উত্তর দিলো, “কিছু হবে না, চলো।”
অটবীর হাত ধরে ক্ষীণ টানলো সে। অথচ অটবী শক্ত হয়ে আছে। নড়ছে না।
—“আপনি বাচ্চামো করছেন, ত্রিস্তান! এমনিতেও আম্মা রেগে আছেন। তাকে আর রাগানো ঠিক হবে না।”
—“তিনি রেগে নেই।” ত্রিস্তানের নির্লিপ্ত কণ্ঠ। অটবী ভ্রু কুঁচকালো, “মানে?”
—“তোমার আম্মা মনে মনে রাজিই আছেন। শুধু প্রকাশ করছেন না।”
—“আমাকে কাল থাপ্পড় মেরে আম্মা এখন রাজি আছেন? আপনি আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে বলছেন?”
—“কাল হয়তো ছিলেন না, এখন আছেন। তুমি উনাকে পটাতে পারোনি। এটা তোমার দোষ।”
হাহ! এখন সব দোষ তার? দিরুক্তি করে কিছু বলবে, তার পূর্বেই অটবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো ত্রিস্তান। কোত্থেকে হাজারটা গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, “আর কথা বলো না তো, অটবী। তুমি আমাকে খুব বিরক্ত করছো।”
কথাটা কি ত্রিস্তান তাকে ভয় পাওয়াতে বললো? কিন্তু অটবী তো মোটেও ভয় পায়নি। উলটো চরম বাধ্য হয়ে বললো, “সবাই দেখবে, ত্রিস্তান! আপনি এমন বাচ্চামো কেন করছেন? অনতত হাতটা তো ছাড়ুন!”
তৎক্ষণাৎ ত্রিস্তানের একরোখা উত্তর, “তো? দেখলে দেখুক। তুমি আমার প্রেমিকা নও।”
তবে সে কে? অটবীর খুব ইচ্ছে হলো, প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু সে জানে, জিজ্ঞেস করলেও ত্রিস্তান উত্তর দেবে না। চুপ থাকবে।
জঙ্গলের কাঁদায় মাখো মাখো রাস্তা পেরিয়ে ত্রিস্তানের বড়োসড়ো বাড়িটায় পৌঁছাতেই ত্রিস্তান হাত ছেড়ে দিলো। দরজা খুললো। ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে বললো, “তোমাকে একেবারে নিয়ে আসবো বলেছিলাম। কথা রাখতে পারছি না বলে দুঃখীত, অটবী। তবে এখন, এই মুহুর্তে আরেকটা কথা দিচ্ছি। এখন থেকে বিকাল অব্দি এটা তোমার। এখানের সবকিছু তোমার। যা ইচ্ছা করো, যত ইচ্ছা জ্বালাও। কেউ কিছু বলবে না।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
পরের বার থেকে বড় দিবো, প্রমিস!