অটবী সুখ
২৭.
আজকের সকালটা মোটেও সুন্দর ছিল না। বিকাল হতে হতে তা একেবারে বিদঘুটে হয়ে গেছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঠা ঠা শব্দে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ। একটুখানি শীতলতা শরীরের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে। অথচ এই বৃষ্টির কোথাও একটু ভালো লাগা নেই। নেই একটু শান্তির সন্ধান। ত্রিস্তান আস্তে করে রান্নাঘরের জালানা লাগিয়ে দিলো। ফ্রিজ খুলে সরোজের আনা রক্তের প্যাকেট দুটি রাখতে গিয়ে ‘থ’ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একাধারে ওই থকথকে, লাল তরলটার দিকে কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো, হাতের বুড়ো আঙুলে সূক্ষ্ণ ব্যথা হলো। মনে পরে গেল, পুরো দিনগুলোর কথা। তার নিজের ছেলেবেলার কথা।
ত্রিস্তানের বয়স তখন কতই বা হবে? ত্যারো কি চৌদ্দ? খুব একটা বোঝার বয়স না। হাসি খুশি পরিবারের সে ছিল মধ্যমণি। সারা ঘর টইটই করে বেড়াতো। প্রায়ই দেখতো, তার বাবা অফিস থেকে এসে কি যেন লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজে রাখছেন। সাদা ঝকঝকে কাঁচের বোতলে টকটকে লাল রঙের তরল পানীয়র মতো কিছু। ত্রিস্তানের ছোট বয়স। বুক ভরা হাজারটা আগ্রহ আর কৌতূহল। তার বাবা তাকে না জানিয়ে কি এমন মজার জিনিস তার থেকে লুকিয়ে রাখছেন, সে কিছুতেই তা ঠাওর করতে পারতো না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যেত না। তিনি শুধু বলতেন, “ওগুলো বড়দের জিনিস। ছোটদের দেওয়া যাবে না।”
অথচ ত্রিস্তানের ভেতরকার কৌতূহল তখনো দমবার নয়। এক দানব কণ্ঠ যেন তাকে বারবার বলছিল, “নাহ্! ওটা কি আমাকে জানতেই হবে!”
সেই মনোবল থেকেই একদিন রাত্রিবেলা লুকিয়েচুরিয়ে সেই লাল টকটকে তরল খেয়ে ফেলেছিল ত্রিস্তান। রক্তের স্বাদ…. মানুষের রক্তের কি-না জানা নেই, তবে স্বাদটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে ত্রিস্তানের। একটু নোনতা, প্রচুর পানসে, ভীষণ বিশ্রী খেতে।
আচমকা সরোজের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। সরোজ উদ্বীগ্ন কণ্ঠে ডাকছে। ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে পা রাখার আগেই ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাতেই সরোজ বলে উঠলো, “কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে ত্রিস্তান ভাই।”
রান্নাঘরের চুলার দিকটা অগোছালো। চিনির পট, লবণ-মরিচের পট এলোমেলো করে রাখা। সেগুলো গোছাতে গোছাতেই ত্রিস্তান জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
—“তোমার শ্বাশুড়ি, মানে হইলো গিয়া অটবী আপুর মা… হে তো বিয়ার খবর সব জাইনা গেছে।”
ত্রিস্তানের হাত থমকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরপরই আগের মতোই আবার বললো, “তুই কিভাবে জানিস এতকিছু? তোকে তো আজকে সারাদিন ঘর থেকে বের হতে দেখিনি।”
—“ওইযে? নলীরে কয়েকদিন আগে একখান মোবাইল কিন্না দিলাম না? একটু আগে ফোন কইরাই সব ঘটনা কইলো।”
এরপর একটু থেমে আবার বললো, “এহন কি করবা, ভাই? আন্টি নাকি অটবী আপুরে অনেক বকছে। মারছেও নাকি!”
ত্রিস্তান এবার আর জবাব দিলো না। ভেতরকার ভারী নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইলো। শান্ত রাখতে চাইলো। কিন্তু নাহ্! সবকিছু ঘুরে ফিরে ওই অশান্তি, অস্বাভাবিকের মাঝে গিয়েই ঠেকছে। এত অসহ্য লাগছে সব! এত বিশ্রী ঠেকছে! আর বুঝি সে অটবী নামক দূর্বলতা থেকে ছুটতে পারলো না? একেবারে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধেই গেল?
–
তখন মাত্র সন্ধ্যা নামো নামো ভাব। বৃষ্টি শেষে পশ্চিম আকাশে মনোমুগ্ধকর কমলাটে রঙ। সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। ওদিকে আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাঁদমামা উঁকিঝুঁকি মারছে। কখন সূর্য পুরোপুরি উবে যাবে! কখন সে দৃশ্যমান হবে!
অটবী তখন জানালার ধারে বসে চাঁদ-সূর্যের লুকোচুরি দেখছিল। মুখ তার মলিন, চোখের শিরা-উপশিরা কান্নার দরুণ ক্ষীণ লাল। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর লম্বাটে দাগ স্পষ্ট গালে গেঁথে আছে। বাহ্যিক দিক থেকে তাকে শান্ত দেখালেও ভেতরটা তার অস্থির। বুকটা ভীষণ যন্ত্রণায় কেমন কেমন যে করছে! ফেঁটে যাচ্ছে একদম! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দরজার দিকে আরেকবার তাকালো অটবী। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। একটু একা থাকতে চাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে একা থাকতে দিচ্ছে না। কোলাহলে, কলরবে মনে হচ্ছে, যেন সে একটা বিস্তর যানজটপূর্ণ রোডে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালা গলিয়ে একজন ড্রাইভার একজন রিকশাচালককে খুব গালাগাল করছে। ঠিক যেমনটা রেবা বেগম এখন করছেন অটবীকে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, দরজার ওপাশ থেকে অবিরাম বকাবকি করছেন তিনি। দু’চারটে হৃদয়বিদারক কথার বাণী ছুঁড়ে দিচ্ছেন অনায়াসে! অথচ এদিকে যে অটবীর প্রাণটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এর খেয়াল আছে কারো? নেই… অটবী একবার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। আসলেই কেউ নেই।
অটবী সবে মাত্র জানালার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। সরব, কপালে উষ্ণ এক ছোঁয়া পেতেই চট করে চোখ মেললো। নজর সামনে তুলতেই দেখলো, ত্রিস্তান! তার সামনে ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে…
অটবীর ঘরের অবস্থান বাড়ির দক্ষিণ দিকে। এদিকটা সচরাচর নির্জন, নিস্তব্ধ। মানুষের আনাগোনা নেই। খানিকটা জঙ্গলের মতো। ত্রিস্তানের এদিকে আসতে পারার কথা না। সে আসলো কিভাবে?
কণ্ঠে বিহ্বলতা নিয়ে অল্পসল্প ভাঙ্গা স্বরে অটবী সুধালো, “আপনি এখানে কিভাবে? কিভাবে এসেছেন?”
—“নলী হেল্প করেছে।”
—“নলীকে কোথায় পেলেন?”
—“কোথায় পাবো?”
বলতে বলতে ত্রিস্তানের শক্ত বাম হাতটা অটবীর নরম গালে কোমলভাবে স্পর্শ করলো।
—“কেন এসেছেন, ত্রিস্তান? কেউ দেখে ফেললে?”
—“কেউ দেখেনি।” ত্রিস্তান অদ্ভুত আচরণ করছে। তার বুড়ো আঙুল অপরিচিত ভাবে স্পর্শ করছে তাকে। গালের রক্তজমাট বাঁধা জায়গা থেকে শুরু করে চোখের পাতার নিচ অব্দি যত্নের সঙ্গে আঙুল বোলাচ্ছে ত্রিস্তান। চোখদুটোর দৃষ্টি অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম। এমন ত্রিস্তানকে অটবী আগে কখনো দেখেনি। এত গভীর নয়নে ত্রিস্তান কখনো অটবীকে পরখ করেনি।
—“অটবী… এত কেঁদেছ কেন?”
এবার ফোলা চোখের পাতায় আঙুল চালালো ত্রিস্তান। আলতো স্পর্শে কাহিল করে দিলো অটবীকে। অটবীর বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ করে তার একলা সময়ে কাউকে কাছে পেয়ে চোখ বেয়ে অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু গড়ালো। সাথে সাথে সেই জল মুছে নিলো ত্রিস্তান। ঢিমে স্বরে বললো, “এত কাঁদছো কেন? বেশি ব্যথা পেয়েছ?”
কথাটা গালের লাল অংশে আঙুল বুলিয়ে বললো ত্রিস্তান। এর অর্থ হয়তো এটাই, চড়টা বেশি জোড়ে লেগেছে কি-না। কিন্তু অটবীর তো শুধু গালে ব্যথা লাগেনি। তার মনটাও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মায়ের রুঢ় আচরণ, বোনের হঠাৎ পরিবর্তন— সব কিছু তার হৃদয়ে আঁচড় কেটেছে। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে তাকে।
ত্রিস্তানের প্রশ্নের উত্তরে অটবী জোড়েজোড়ে মাথা দুলালো। হ্যাঁ, তার ব্যথা লেগেছে। অনেক! অনেক! অনেক!
ত্রিস্তান আলতো তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। লবণ পানিতে প্রেয়সীর গাল আবারও ভিঁজে আসতেই কাছাকাছি হলো সে। চুমু খেল দু’গালে, দু’চোখে, নাকে আর কপালে! এরপর একটু থামলো ত্রিস্তান। যত্ন করে অটবীর কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। আরেকদফা তপ্ত নিশ্বাস নস্যি করে উঁড়িয়ে দিলো বুকের মধ্যখান থেকে। অল্পক্ষণ অটবীর রক্তিম ঠোঁটটাকে দেখে হঠাৎ করেই অধরে-অধর মেলালো সে। এত আদুরে ভাবে! এত অধৈর্য হয়ে! অটবী ভয়ানক অনুভূতিতে পিসে যাচ্ছিল। তার দু’হাত কখন যে ত্রিস্তানের কলার জড়িয়ে ধরেছে, খেয়াল নেই। ত্রিস্তান সাবধানে অটবীর গালের দু’পাশ ধরে আছে। ওভাবেই কাছে টানলো ওকে। অটবী স্পষ্ট টের পেল, একটা মিষ্টি সুবাস তার ঘ্রাণশক্তি রোধ করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা করে তুলছে। কিসের সুবাসটা ওটা? তাদের একটু দূরে থাকা বেলী গাছগুলোর? হতে পারে!
–
তারা ওভাবে কতক্ষণ ছিল, অটবীর জানা নেই। তবে আকাশের কমলাটে রঙ এখন একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিপাশ। ঘরের বাতি জালানো নেই বিধায় অটবী ত্রিস্তানকে তেমন করে দেখতে পারছে না। শুধু অনুভব করতে পারছে, লোকটা ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান থেকে জানালার উচ্চতা বেশি নয়। বরং ত্রিস্তানকেই লম্বা লাগছে। জানালাটা তার বুক অব্দি আসে।
—“কোথায় যাচ্ছো?” ত্রিস্তান বললো, শীতল কণ্ঠস্বরে।
অটবী ঘরের বাতি জ্বালাতে উঠতে গিয়েও উঠলো না। “লাইট জ্বালাতে চেয়েছিলাম।”
—“প্রয়োজন নেই।”
ত্রিস্তানের অদ্ভুত আচরণের পালা তখনো শেষ হয়নি। তার হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে তখনো অটবীর একেকটা হাতের আঙুল।
—“তোমার চোখে আমি কতটুকু ভালো, অটবী? কতটুকু ভালো মনে করো আমায়?”
—“হু?” অটবী যেন বুঝলো না, “আপনি হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করছেন কেন?”
ত্রিস্তান সে কথার উত্তর দিলো না। আস্তে করে বললো, “আমি যদি কালকে তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাই, সমস্যা হবে অটবী?”
অটবী বার কয়েক পলক ফেললো, “ক-কোথায় নিয়ে যাবেন?”
—“আমার কাছে। একেবারের জন্য।”
কথাটা শোনা মাত্রই ত্রিস্তানের হাতদুটো শক্ত করে ধরলো অটবী।
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা