অটবী সুখ
২৬.
বাহিরে তখন রাত বেশ। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে বারোটার ঘর পেরিয়েছে। চারপাশে সুনসান নিরবতা। জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায়, সবটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ত্রিস্তান ইচ্ছে করেই বাড়ির পেছনে কোনো বাতি লাগায়নি। কেন যেন এই অন্ধকারটুকু তার ভালো লাগে। মনে হয়, প্রতিনিয়ত এই আঁধারই তাকে তার অস্তিত্বের সাথে বেঁধে রাখছে। তার জীবনের কালো অধ্যায়গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।
বারান্দার একপাশে খাতা, কলম দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো ত্রিস্তান। কারেন্ট থাকা সত্ত্বেও দুটো মোম জ্বালালো দু’পাশে। আধো আলোয় খাতার মাঝখান থেকে একটা পৃষ্ঠা বের করে ইংরেজি অক্ষরে দাগ কাটতে শুরু করলো, “Things are getting more difficult. I messed up everything. I can’t let go and I also can’t hold on. Why the hell this things are so complicated? My intention was to leave that girl after spending some time with her. But why can’t I leave now? Why can’t I step back from my unknown feelings? It seems like everything is out of reach.
I feel bored. I feel like I’m lying in a dark grave, badly waiting for the death. I think, It would be better if I died. Otherwise I will not be able to leave her, whom I guess I give my everything. Maybe my heart also?”
বাকিটুকু আর লিখা হলো না। দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। ত্রিস্তান দরজা না খুলেই বুঝে গেল, এটা সরোজ। নয়তো এত রাতে কেই-ইবা আসবে এখানে?
দরজা খুলে সরোজের দিকে শান্ত চোখে তাকালো ত্রিস্তান। জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
সরোজ ততক্ষণে অন্ধকার ঘরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারছে না। এত বিশ্রী রকমের কালো ভেতরটা! বারান্দা দিয়ে যদিও হলদেটে আলো আসছে! তবুও মাথায় ‘ভূতুড়ে ঘর’ ছাড়া আর কোনো শব্দ এলো না সরোজের। কপাল কুঁচকে বললো, “কারেন্ট তো আছে! তারপরও এমন ভূতের মতোন কইরা রাখছো ক্যান ঘরডা?”
ত্রিস্তান অন্যদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো। বললো, “মাথা ব্যথা করছিল… কি জন্য এসেছিস সেটা বল।”
সরোজ কথা বাড়ালো না। হাতের বাটি-টা ত্রিস্তানের দিকে এগিয়ে দিলো চুপচাপ। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ভাত খাইছিলা?”
—“পরে খাবো।”
সরোজ চলে যাওয়ার পূর্বে আবারও একই ভাবে বললো, “তুমি কিন্তু রাতে ভাত খাইতেছো না ইদানিং। খাওয়া লইও ভাই। ভাতডা খালি ফ্রিজে রাখছি। গরম কইরা লইও।”
সরোজ চলে গেছে অনেক্ষণ। ত্রিস্তান দরজা আটকে নিরব বসে আছে বারান্দায়। জ্বলন্ত মোম দুটো এখন বন্ধ। বাতাস প্রচন্ড রকমের আনাগোনা শুরু করেছে। ওতেই বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ত্রিস্তানের এসবে খেয়াল নেই। রক্তের বাটি-টা ওইযে, ডানপাশের খালি জায়গায় ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে সে। কিছু ভাল্লাগছে না তার। আজকাল পাতালঘরেও যেতে ইচ্ছে করে না। ব্যক্তিটির ঘৃণ্য সৃষ্টি এত পোড়ায়! এত অসহ্য লাগে! অসহ্য দমবন্ধকর অনুভূতি বারংবার করে মনে করিয়ে দেয়, সে একা। খুব, খুব, খুব একা।
আলতো দীর্ঘশ্বাসগুলো যখন মিলেমিশে ক্লান্ত, ঘুমে যখন চোখ অবাধ্য, যখন পুরো শরীরটা দেওয়ালের সঙ্গে ঠেকে একাকার, তখন চোখ বোজা মাত্রই একটা নাম মস্তিষ্কে হানা দিয়ে উঠলো ত্রিস্তানের। ঢিমে যাওয়া কণ্ঠে খুব অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো, “অটবী…”
–
শনিবার। দুপুর তিনটে।
গরমে ঘেমে একাকার হয়ে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরছে অটবী। পা যেন আর চলছে না। কপালের ঘামগুলো গলা ছুঁচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, সে পৃথাকে দেখেছে। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও সন্দেহ মেটাতে একটু আশেপাশে তাকাতেই সন্দেহটা আরও প্রবল হলো তার। একটু এগোতেই বুঝতে পারলো, ওটা আসলে পৃথাই। সকালে এভাবেই সাদা ফিতা দিয়ে দু’বেণী করে দিয়েছিল বোনকে। হাতে সেই একই কালো ব্রেসলেট, স্কুল ড্রেস! অটবীর বুকটা ধুপধাপ করে কাঁপলো। পৃথার সাথে ওই ছেলেটাকে? এত ঘনিষ্ট হয়ে কি করছে ওরা? একে অপরকে চুমু দিচ্ছে? অটবী দ্রুত পা চালালো। বাজারের ব্যাগটা যে তার হাত থেকে পরে গেছে, সে খেয়াল আপাতত নেই। পৃথার কাছাকাছি এসেই সর্বপ্রথমে একটা মারাত্বক চড় লাগালো অটবী। কণ্ঠ চিড়ে ধমকালো, “স্কুল বাদ দিয়ে এখানে কি করছিস পৃথা? এজন্য তোকে স্কুলে পাঠাই আমি।”
বলতে বলতে ছেলেটার দিকে তাকালো অটবী। হাহ! যা ভেবেছিল তাই! এলাকার গুণধর কাদিন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখে মুখে কি ভীষণ বিরক্তি!
অটবী রাগে কাঁপতে লাগলো, “আমার বোনের সাথে এসব করার সাহস পাও কোথায় তুমি? তোমার মাকে আমি এক্ষুণি গিয়ে বলব। অনেক বেড়ে গেছো তুমি!”
কাদিন যেন একটুও পাত্তা দিলো না অটবীকে। দায়সারা ভাবে বললো, “আমার মাকে বলার আগে নিজের বোনকে সামলান। আপনার বোনই আগে এসেছিল আমার কাছে, আমি না।”
অটবী বড় বড় চোখে পৃথার দিকে তাকালো এবার। পৃথা কাঁদছে কম, রাগে ফুঁসছে বেশি। আশেপাশে এত মানুষ! তার বোনের কি একটুও জ্ঞান বুদ্ধি নেই? মানুষ প্রেম করতেই পারে। তাই বলে এত চিল্লাবে?
—“কাদিন কি সত্যি বলছে, পৃথা?”
পৃথা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো যেন, “সত্যি বললে কি? মারবা আমাকে?”
অটবী থমকালো, চমকালো। ভীষণ অবাক হলো পৃথার আচরণে। পৃথা থেকে সে এমন জবাব আশা করেনি। তারচেয়েও বেশি অপমান লাগলো, যখন কাদিন তাকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো! অটবী আর দেড়ি করলো না। পৃথার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো বাসায়। পুরো রাস্তায় পৃথা অনেকবার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অটবী ছাড়েনি। বাসায় আসা মাত্র রেবা বেগমও পৃথাকে এভাবে টানার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। অটবী তারও উত্তর দেয়নি। পৃথাকে টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে।
নলী তখন ঘুমাচ্ছিল। তার গায়ে ১০১ জ্বর। স্কুলে যায়নি আজকে। ভেবেছিল আরাম করে আজকে সারাদিন ঘুমাবে। কিন্তু বিধিবাম! জোড়ে দরজা লাগানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। রাগান্বিত অটবীকে দেখে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালেও, পৃথাকে কাঁদতে দেখে চটজলদি উঠে বসলো সে। অবাক হয়ে সুধালো, “কি হয়েছে, বুবু?”
অটবী এবারও নিরুত্তর। পৃথার দিকে তাকালেই তার রাগটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। স্বাভাবিক হতে চাইলো, “এমন কেন করলি পৃথা? তোকে আমি বুদ্ধীমান ভাবতাম! অথচ… এত অশ্লীলতা! তোকে এসব শিখিয়েছি আমি?”
পৃথা রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো আবার। ভীষণ জোড়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “করেছি তো কি হয়েছে? তুমি করোনা? আর অশ্লীল কাকে বলছো? চুমু খেলেই অশ্লীল হয়ে গেল? তুমি কাও নি যেন? তোমার ত্রিস্তানের সাথে কত কি করেছো আমি জিজ্ঞেস করেছি ক…”
পূর্বেই আরেকটা চড় মারলো অটবী। তবে এবার খানিকটা জোড়ে।
কণ্ঠ রোধ হয়ে আছে তার। মাথার যন্ত্রণায় সবটা আবছা লাগছে। অটবী এই পৃথাকে চেনে না। তার সহজ-সরল, একটুখানি বুদ্ধিমতি বোনটা কোথায়? কোথায় চলে গেল? মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলেই নলী দৌঁড়ে এসে ধরলো বোনকে। বিছানায় বসালো। পৃথা ততক্ষণে দরজা খুলে চলে গেছে। একবারও বোনের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকায়নি। ব্যাপারটায় ভীষণ ধাক্কা খেল অটবী। নলীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে সুধালো, “পৃথা কখন এমন হয়ে গেছে, নলী?”
নলী জবাব দিতে পারলো না। সে কি বলবে? তার নিজেরই পৃথাকে দেখে অবাক লাগছে।
–
পৃথার সঙ্গে বাকবিতর্কতার পরপরই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছিল অটবী। হঠাৎ শক্ত করে কেউ হাত টেনে উঠে বসাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখদুটো আধো আধো করে মেলার আগেই গাল ব্যাথায় টনটন করে উঠলো যেন। কানে কিচ্ছুক্ষণ কিচ্ছু শুনতে পেল না অটবী। এরপর সম্বিৎ ফিরতেই বুঝতে পেল, রেবা বেগম খুব গালাগালি করছেন তাকে। খুবই বিশ্রী গালি। ক্রোধে অন্ধ হয়ে চেঁচাচ্ছেন, “কাকে জিজ্ঞেস করে তুই একা একা বিয়ে করেছিস? এত সাহস কোথায় পেয়েছিস তুই?”
___________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা