অটবী সুখ পর্ব ২৪

0
103

অটবী সুখ

২৪.
রাত ঠিক কত হবে? অটবীর জানা নেই। ঘড়ি দেখা হয়নি। বাসায় এতক্ষণে নিশিরাতের গভীর ঘুমে সবাই। তার বড়োলোকি আত্নীয়দের কেউই তাদের এই ভাঙ্গা বাসায় থাকতে আগ্রহী নয়। বিয়ে ভাঙ্গা পরপরই একরাশ উত্তাপে ভরা সমালোচনার পর যার যার বাসায় চলে গেছে। পরিবেশটা তখন থেকেই গুমোট, নিস্তব্ধ। অটবী পায়ে পায়ে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মুখস্ত শিক্ষার্থীর মতো চলে গেল নিজ রুমে। নলী আর পৃথা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘোর তন্দ্রায় বিভোর হয়ে আছে। ঘুমানোর ধরনটা এলোমেলো। নিশ্চিৎ এতক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করছিল! ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে গেল অটবী। সুন্দর করে শুইয়ে দিয়ে কাথা টেনে দিলো। এ মেয়ে দুটোর ঘুম আবার ভীষণ ভালো। একবার ঘুমালে প্রচন্ড শব্দেও সহজে ঘুম ছেড়ে উঠে না।

ফোনে তখন অত চার্জ নেই। কোনোমতে লম্বালম্বি বক্সে একদাগ অবশিষ্ট আছে। নষ্ট ফোনে এইটুকু চার্জ পাঁচ মিনিটও ঠিকবে না। কিন্তু ত্রিস্তান বলেছিল, বাসায় ফিরে একটা মেসেজ দিতে। দিবে কি? লোকটা যদি অপেক্ষায় থাকে?
নলীদের পাশের অল্প জায়গায় রয়েসয়ে গা এলালো অটবী। ফোনের কন্টাক্ট লিস্টের টি(T) অক্ষরের ত্রিস্তান নামটি খুঁজে বের করলো চটজলদি। বার্তা পাঠালো, “বাসায় পৌঁছেছেন?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো না। সময় নিলো। অটবীর অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোনে জ্বলজ্বল করলো তিনটি অক্ষরের শব্দ, “এসেছি।”
তারপর আবার টুং করে শব্দ হলো, “এখন কি করছো? বাসার কেউ কিছু বলেছে?”

অটবী দ্রুত টাইপ করলো, “না। সবাই ঘুম।”
—“আচ্ছা।”

এরপর আর কোনো বার্তা এলো না। অটবী অক্লান্ত চোখে পিটপিট করে চেয়ে দেখলো আলো আঁধারিয়া আকাশটাকে। চোখে ঘুম নেই। ফোনটাও ততক্ষণে চার্জের অভাবে প্রাণহীন হয়ে পরে আছে, বদ্ধ হাতের মুঠোয়। অথচ মস্তিষ্কে এক নিদারুণ অলসতা অনুভব করছে সে। কিছু ভাববার অলসতা। ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনার অলসতা। সে কি সত্যি ত্রিস্তানের হয়ে গেছে? ত্রিস্তান কি এখন তার? সব এত জলদি জলদি হয়ে গেছে যে অটবীর মনে হচ্ছে, সে বুঝি কোনো কাল্পনিক গল্পের সুখী চরিত্র! চরিত্রটা যদিও খারাপ নয়। অটবী বোধহয় ছোট থেকে এমনই এক সুখ সুখ চরিত্রের সন্ধানে ছিল। সন্ধ্যান পেয়ে যেতেই নিজেকে এখন কেমন নির্ভার, চিন্তামুক্ত লাগছে!

সকাল থেকে রেবা বেগম খুব কম কথা বলছেন। প্রয়োজন ছাড়া তার কণ্ঠনালি গলিয়ে একটা টু শব্দও বেরুচ্ছে না। অটবীর তাই অল্পসল্প মন খারাপ। সকালে সে মুশফিক ছেলেটাকে কল করার চেষ্টা করেছিল। প্রত্যেকবারই ফোন বন্ধ বলছে। মুশফিকের কাছে অটবী যেমন কৃতজ্ঞ, তেমনি ছেলেটার জন্য একটা সুক্ষ্ণ অপরাধবোধও ভেতরে ভেতরে কাজ করছে। পাশাপাশি এ-ও জানতে ইচ্ছে করছে, শেষ মুহুর্তে ছেলেটা এমন বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেল কেন? ঠিক কি কারণে? অটবীর ওপর প্রবল ঘৃণায়? হতে পারে। অটবী কাজটাই করেছে এমন।

নলী আর পৃথাকে বিদ্যালয়ে দিয়ে আসার পথে ত্রিস্তানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অটবীর। লোকটা মাত্রই জঙ্গলের পথ শেষ করে মেইনরাস্তায় পা দিয়েছে। ভ্রু দুটো কুঁচকানো। খুব বিরক্ত হয়ে ফোনে কি যেন টাইপ করছে। তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কেঁদেছো?”

হকচকিয়ে অটবী উত্তর দিলো, “কই, নাতো!”
—“চোখ ফোলা তোমার।”
—“রাতে ঘুমাইনি। এজন্যই বোধহয়।” বলতে বলতে দু’চোখে একবার হাত ছোঁয়ালো অটবী। আসলেই চোখদুটো ফুলে আছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে মনে হচ্ছে, সে কোনো পানির বল ধরছে। এত ফুললো কখন?

ফোনটা প্যান্টের পকেটে পুরে ত্রিস্তান আবার বললো, “আর কোনো কাজ আছে তোমার? টিউশন বা অন্য কিছু?”
—“মায়ের কথায় টিউশন ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওদের সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি।”
—“অন্য কোনো কাজ নেই বলছো?”
—“নেই।”

ত্রিস্তান এবার কাছাকাছি হলো। নির্বিকার ভঙ্গিতে অটবীর হাত ধরে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “তোমার কিছু গলার, হাতের কিসব রেখে গেছো বাসায়। নূপুরও দেখলাম। কালকে কি আমাকে বিয়ে করতে এসেছিলে নাকি যুদ্ধ করতে? ওগুলো খুলে রাখলে কখন? খুললে যখন আবার নিয়ে গেলে না কেন?”

অটবী সরু চোখে তাকালো। লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? গতকাল কান্নাকাটির এক পর্যায়ে সে ত্রিস্তানের গায়ে তার চুড়ি খুলে ছুড়ে মেরেছিল। গলার গহনা আর নুপুর তো লোকটার সামনেই খুলেছিল কাজী অফিস যাওয়ার পূর্বে। তাহলে? ‘কখন খুললো’– এসব জিজ্ঞেস করার মানে কি?
অটবী সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো, “আপনার সামনেই তো খুলেছিলাম ওগুলো। চোখ কি তখন আকাশে রেখে এসেছিলেন?”

ত্রিস্তান ততক্ষণে অটবীর হাতে হাত রেখে জঙ্গলের পথে পারি জমিয়েছে। এবারও তার নির্লিপ্ত জবাব, “নাওনি কেন আর?”
—“নেওয়ার সুযোগ ছিল? বিয়ের পর তো বাসাতেই চলে গিয়েছিলাম।”

ত্রিস্তান অটবীর দিকে না তাকিয়েই ভারী নিশ্বাস ফেললো, “ওহ! তাইতো!”

অটবী আশ্চর্য হলো। চূড়ান্ত পর্যায়ের আশ্চর্য, হতবাক, বিমূঢ়! লোকটার আসলে সমস্যা কি? কি চায়? অটবীকে বিরক্ত করতে এত মজা লাগে কেন তার? অটবীর তো মোটেও মজা লাগে না। বরং ত্রিস্তানের জায়গা অন্য কেউ এমন না বুঝে ঝগড়া করলে সে নিশ্চিৎ ওই ব্যক্তিকে দু’গালে দুটো চড় লাগিয়ে দিতো। একেবারে শক্ত হাতের কড়া চড়! ত্রিস্তান বলে বেঁচে গেছে।

সরোজ কিংবা তনয়া কাউকেই পাওয়া গেল না। তারা নাকি ঘুরতে বের হয়েছে। ত্রিস্তান অটবীকে সোফায় বসতে বলে রান্নাঘরে এগোতে এগোতে সুধালো, “কি খাবে?”

অটবী বসলো না। ত্রিস্তানের পিছু পিছু রান্নাঘরে ঢুকলো। পরিপাটি রান্নাঘর। এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে উত্তর দিলো, “কিছু খাবো না। খেয়ে বের হয়েছি।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “আপনি সরোজকে আর কতদিন এখানে এভাবে রাখবেন? ওকে ওর বাসায় পাঠাচ্ছেন না কেন?”

ত্রিস্তান চপারবোর্ড আর ছুড়ি নিয়ে কি যেন খুটখাট করে কাটছে। উত্তরে আস্তে করে বললো, “ও যেতে না চাইলে আমি কি করতে পারি?”
—“ওর যে পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছেন? এমনিতেই পড়তে চায় না।”
—“আমি পড়াচ্ছি ওকে।”

অটবী অবাক হলো খুব।
—“বই-খাতা, এসব কোথায় পেয়েছেন?”
—“চাচা দিয়ে গেছে কয়েকদিন আগে।”
এপর্যায়ে ধীর অথচ বিশাল বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। চাচাকেও এরা হাত করে নিয়েছে। এখন তো তার আর কিছু বলার নেই। সরোজ যদি এখানে থেকে হলেও একটু পড়ালেখা করে, তাও-বা কম কিসের?

ত্রিস্তান এক এক করে পেয়াজ, ধনেপাতা, আলু, চপারবোর্ডে চপচপ করে কাটছে। খুবই দক্ষ হাতে। তার পুরুষালী হাতগুলো এত দ্রুত নড়ছে যে অটবী মনোযোগ সহকারে তাকিয়েও কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ প্রত্যেকটার সাইজ এত পার্ফেক্ট! এত নিঁখুত!

ভাবনার অকূল পাথারেই ত্রিস্তান বললো, “অটবী? আমাকে একটু ওখান থেকে দুটো ডিম দাও তো।”

অটবী সাথে সাথে বাম পাশে তাকালো। মাঝারি আকারের একটা ফ্রিজ রাখা। আলতো পায়ে এগিয়ে সে ফ্রিজটা খুলতেই নিচ্ছিল, হঠাৎ তড়িৎ গতিতে আধখোলা ফ্রিজটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান।
অটবী ভয় পেল। চমকিত হয়ে দূরে সরে গেল কয়েক কদম। বিস্মিত নয়নে ত্রিস্তানের দিকে তাকাতেই দেখলো, লোকটা ভীষণ ঠান্ডা চাহনিতে চেয়ে আছে ওরদিকে। শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “ফ্রিজ খুলছিলে কেন?”

অটবী দু’বার চোখের পলক ফেললো, “আপনি… ডিম দিতে বলেছিলেন।”
—“ফ্রিজে ডিম নেই।”
বলতে বলতে ফ্রিজের পাশের ঝুড়ি থেকে দুটো ডিম নিজেই নিলো ত্রিস্তান। অটবী কেমন দৃঢ় চোখে তাকিয়ে বললো, “ফ্রিজে এমন কি আছে? এমন কেন করলেন আপনি?”

ত্রিস্তান সরে এলো ওখান থেকে। একহাতে পরপর দুটো ডিম ভাঙ্গলো চুলার গরম পাত্রে।
—“কিছু নেই।”
—“আপনি ঘামছেন কেন?”
—“কই ঘামছি?”

অজান্তেই নিজের কপালে হাত ছোয়ালো ত্রিস্তান। নাহ্। লবণাক্ততার ছিঁটেফোঁটাও নেই। অটবী তখন দূর থেকে ত্রিস্তানকে পরখ করছিল। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন, ত্রিস্তান সবসময় তার মুখটাকে এত নির্লিপ্ত করে রাখে! এবারও করে রেখেছিল। কিন্তু ইদানিং কেন যেন ওই অতি স্বাভাবিক মুখটার ভীষণ গভীরে লুকিয়ে থাকা আতঙ্কগুলো অটবী ধরতে পারে। ওই রহস্যময় প্রাচীন গন্ধটা নাকে বার বার বারি খায়। মস্তিষ্কে জট পাকায়। অথচ…. ত্রিস্তান বলেছিল অরণ্যর ভেতর নাকি বেশি রহস্য থাকে? কই? সে তো কষ্টকে দেখছে, হাজারটা রহস্যে মোড়ানো, আষ্টেপৃষ্টে বন্ধী।

—“আমি একটু পর নাস্তা নিয়ে আসছি, অটবী। তুমি ড্রইংরুমে গিয়ে বসো। এখানে গরম।”
—“আমি কিছু খাবো না বলেছি।”
—“তোমার কথা শুনছে কে?”

আবারও! অটবীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও সেই শান্ত দৃষ্টিটা ছুঁড়ে দিচ্ছে ত্রিস্তান। দৃষ্টিটা অটবীর পছন্দ নয়। এই দৃষ্টির কারণেই ত্রিস্তানকে অচেনা লাগে। সমুদ্র সমতুল্য রহস্যময় মনে হয়।

কাল রাত্রির নির্ঘুম, ক্লান্ত, অবসর প্রিয় চোখদুটো ত্রিস্তানের অপেক্ষায় অপেক্ষায় কখন যে সোফাতেই নিস্তেজ হয়ে গেল! অটবীর খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙ্গলো এর ঘন্টাখানেক পরই। চোখে মেলে নিজেকে আর সোফাতে পেল না সে। নরম বিছানায় কারো বাহুবন্ধনে আবিষ্কার করলো। তার গলায় লোকটা মাথা গুঁজে আছে। অটবীর নিজের হাত দুটোও লোকটার গলা জড়িয়ে, চুলের গভীরে। চুলগুলো এত ঘনকালো! পরনের কুঁচকানো শার্ট, পুরুষালী গঠন দেখে যদিও বোঝা যায়, এটা ত্রিস্তান। কিন্তু অটবী জানে, ত্রিস্তান ছাড়া তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবে কে?

অটবী আস্তে করে ডাকলো, “ত্রিস্তান? আপনি কি ঘুমাচ্ছেন? ছাড়ুন আমাকে!”

ওপাশ থেকে জবাব নেই। অটবী মাথা উঁচিয়ে একবার ত্রিস্তানকে দেখে নিলো। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! সে আবার ডাকলো, “ত্রিস্তান! উঠুন!”

ত্রিস্তান নড়লো ক্ষীণ। অস্পষ্ট কণ্ঠে আওড়ালো, “জ্বালাচ্ছো কেন?”
—“আমি জ্বালাচ্ছি?”
—“জ্বালাচ্ছোওই তো, অরণ্য। জ্বালিয়ে আমার বুক ব্যথা করে দিচ্ছো।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here