অটবী সুখ পর্ব ২১

0
118

অটবী সুখ

২১.
পাতাল ঘরটায় ডুবো ডুবো অন্ধকার। বাজে, বিশ্রী গন্ধে এক তেঁতো ঝাঁঝ গলায় এসে উপচে আসতে চাইছে। বাতাসে ভ্যাপসা গরম, দমবন্ধ অনুভূতি। বাতি জ্বালাতেই দেখা গেল, নোংরা কাপড়ে ব্যক্তিটি দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে। পাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়গুলি রাখা। ছুঁয়েও দেখেনি হয়তো।
ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিঃশব্দে ম্যালামাইনের সাদা বাটি-টা মেঝেতে রাখলো। এরপর ক্লান্ত গলায় বললো, “বলেছিলাম কাপড় চেঞ্জ করে নিতে। করোনি কেন?”

সাদা বাটিতে টকটকে গোলাপের মতো রক্তগুলো দেখে মনে আলতো আনন্দের বাতাস দোলা দিয়ে উঠলো ব্যক্তিটির। তবে তা তক্ষুণি প্রকাশ করলো না। ভীষণ অভিযোগের সুরে বললো, “আমার এখানে ভালো লাগে না। আর কতদিন আমাকে বন্দী করে রাখবি? আমি বাহিরে যাবো।”

বাহিরে? এ অবস্থায়? মোটেও সম্ভব না। তাছাড়া বাসায় সরোজ আছে। তনয়া ড্রইংরুমে খেলছে।
—“পরে নিয়ে যাবো। এখন এটা খেয়ে নাও।”
—“সত্যি নিয়ে যাবি?”

ত্রিস্তান জবাব দিলো না। মেঝেতে পা মুড়িয়ে বসলো। তার তুখোড় দৃষ্টি ব্যক্তিটির পানে বিদ্যমান। সে একবার ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বাটি-টির দিকে এগিয়ে গেল। লোভাতুর নয়নে প্রাণভরে রক্তগুলো পরখ করে ঝাপিয়ে পরলো খেতে। ঢকঢক শব্দে রক্ত পানের সময় ঠোঁট বেয়ে এক সূক্ষ্ণ রেখা গড়িয়ে পরলো একটু একটু করে। ত্রিস্তান সবটা দেখলো। নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগলো ওর। আর কত? আর কতদিন? ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে বললো, “কালকে থেকে আর প্রতিদিন রক্ত পাবে না। ভাত খেতে হবে।”

সঙ্গে সঙ্গে চট করে তাকালো ব্যক্তিটি। খাওয়া থামালো। আশ্চর্য রকমের বিরক্তি নিয়ে বললো, “ভাত কেন খাবো? আমি ভাত খেতে পারবো না।”
ব্যক্তিটি রেগে গেছে। বিকৃত মুখশ্রীতে হাজারো অসন্তোষের ভীড়। তবে সেই অসন্তোষে পূর্ণ রাগ তাকে দমাতে পারলো না। শান্ত সুরে বললো, “তোমার মতো মানুষেরা খাবার খেতে পারে। তুমিও খেয়েছো, ভবিষ্যতেও খেতে পারবে।”
—“আমার ভাত ভালো লাগে না। আমার রক্ত ছাড়া কিচ্ছু ভালো লাগে না।”
—“শুধু রক্ত খেতে থাকলে একদিন মরে যাবে।”
—“আমি মরতেই চাই।”

ঘাড় ব্যথা করছে। হাত-পায়ে চিনচিনে যন্ত্রণা। আজকে জঙ্গল দিয়ে আসার সময় পায়ে কিসের যেন কাঁটা বিঁধে গেছে। বিরাট আঁচড়। একটু কেটেও গেছে। ঔষধ লাগানো হয়নি। রক্ত শুকিয়ে লেপ্টানো। ত্রিস্তান পায়ের ক্ষতটা একবার দেখে নিলো। তেমন বিশেষ না। এরচেয়েও বড় আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে সে। তবুও এই সামান্য কাঁটাছেঁড়ায় এত কষ্ট হচ্ছে কেন? সে কোথায় যেন শুনেছিল, “ক্ষুদ্র ব্যথায় বেদনা বেশি।”
আসলেই কি তাই?

তিক্ত মেজাজটা মাথার ডান পাশে তিক করে উঠলো। বুড়ো আঙুল আর শাহাদাত আঙুলের সাহায্যে কপাল বার কয়েক ঘঁষে নিলো ত্রিস্তান। বললো, “তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করো। আমার কাজ আছে।”
—“কিসের কাজ? করিস তো চুরি। অবশ্য তোর দ্বারা এর চেয়ে বেশি কিছু হবেও না।”

স্পষ্ট অপমানটা ত্রিস্তান গিলে নিলো। কিছু বললো না। কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটি তখনো থেমে নেই।
—“তনয়াকে আমার কাছে আর আনিস না কেন? কত দিন দেখা হয় না!”
—“কেন আনবো? আগের বার মেরে ফেলতে পারো নি বলে এবার যেন মেরে ফেলতে পারো, তার জন্য?”

না চাইতেও সেদিনের ঘটনা মনে পরে গেল ত্রিস্তানের। রক্ত খেতে না দেওয়ায় এই যে, সামনে বসে থাকা তার ভীষণ আপন মানুষটা উম্মাদ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ত্রিস্তানেরও যে কি হয়েছিল! পাতাল ঘরের দরজাটা আটকাতে মনে নেই। সেই সুযোগে রান্নাঘর থেকে ছুঁড়ি নিয়ে ঘুমন্ত তনয়াকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ব্যক্তিটি। ত্রিস্তানের ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, সে যদি সেদিন সময়মতো না আসতো! তাহলে হয়তো ভীষণ বাজে রকমের অঘটন ঘটে যেত। ভীষণ বিশ্রী অঘটন!

অথচ সামনের মানুষটির চেহারায় অপরাধ বোধের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সে খুব আরামে বাটির অবশিষ্ট তরল বিন্দুটুকু শেষ করলো। যেন এমন অমৃত সে কখনো খায়নি। রয়েসয়ে উত্তর দিলো, “তুই না খাইয়ে রেখেছিলি কেন? তাছাড়া ওই পাগল মরে গেলেই ভালো।”

চোয়াল শক্ত হলো। কপালের রগ সূক্ষ্ণ ভাবে ফুঁটে উঠলো। বলতে ইচ্ছে করলো, “তুমিও তো পাগল। তনয়ার চেয়েও বড় পাগল।”
কিন্তু তা আর ভেতর গলিয়ে বাহির হলো না। গম্ভীরমুখে উঠে দাঁড়িয়ে, সে কঠিন গলায় বললো, “কালকে থেকে তোমার এসব খাওয়া বন্ধ। ভাত পাবে শুধু। খেতে পারলে খাবে, নয়তো না খেয়ে থাকবে।”
চোখে মুখে আতঙ্ক বাসা বাঁধলো। কেঁপে কেঁপে, থেমে থেমে বলতে চাইলো, “সুখনীল! তুই জানিস… রক্ত খেতে না পেলে আমার কষ্ট হয়।”
—“আমারও হয়। যখন সময়ের কাটা প্রত্যেকটা সেকেন্ড মনে করিয়ে দেয়, আমার কেউ নেই।”

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় ত্রিস্তান শুনলো, পেছন থেকে অবিরাম ব্যক্তিটি চিৎকার করছে। চিৎকার করে বলা কথাগুলো কানে বিঁধছে খুব। অশান্তি লাগছে। দূর থেকে দীর্ঘশ্বাসেরা একপলক আকাশ দেখে করুণ সুরে অভিযোগ করছে, “আর কত? এবার থামো!”

_

অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল ঠিক রবিবার বিকেলে। সোমবার বিকেল হতে না হতেই সেই বিয়ের গুঞ্জন ধামাচাপা হয়ে যায়। পাত্রের পরিবার রাজী থাকলেও অটবী মানা করে দিয়েছে। তার অসুস্থ মা আছে। ছোট দুটো বোন আছে। সে বিয়ে করে চলে গেলে তাদের দেখবে কে? এই যুক্তি দিয়ে পাত্রপক্ষকে মানা করা গেলেও রেবা বেগম বেঁকে বসলেন। এত ভালো সম্বন্ধ! অথচ মেয়েটা কি না কি নিয়ে বসে আছে। তাদের দেখাশোনা করতে হবে বলে আজীবন বিয়ে না করে থাকবে? এ কেমন যুক্তি? এমন সম্বন্ধ কি বারবার আসে? রেগেমেগে অটবীর সঙ্গে কথা বলছেন না পুরো একদিন। অটবী প্রথম প্রথম যদিও রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছিল। এখন থেমে গেছে। তার মা অভিমানীর সঙ্গে জেদিও। তার এই অভিমান বিয়েতে রাজী না হওয়া অব্দি শান্ত হবে না। আর অটবী এই বিয়ে করবে না।

তখন ঘড়িতে দুপুর তিনটে। মাথার ওপর উত্তপ্ত সূর্য। তেজটা আগের চেয়ে একটু বেশিই বোধহয়। সূর্যিমামা কি তবে আজ রেগে আছেন? রেগে আছেন হয়তো। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করতে গিয়ে অটবী খেয়াল করলো, ফোনের নোটিফিকেশনে অপরিচিত নম্বর থেকে পাঁচটা মিসড্ কল দেখাচ্ছে। অটবী জানে নম্বরটা কার। ওইযে? তাকে যারা পরশুর আগেরদিন দেখতে এলো? সেই ছেলে। তার নাকি অটবীকে খুব পছন্দ হয়েছে। বিয়েতে মানা করার পরও অটবীর পিছু ছাড়ছে না। কল করে বিরক্ত করছে খুব। ফোন সাইলেন্ট করেও শান্তি নেই। সে কল ধরছে না, তবুও বেহায়ার মতো করেই যাচ্ছে!

অটবী বিরক্ত প্রকাশের অবকাশ পেল না। ষষ্ঠবারের মতো আবারও ছেলেটা কল করছে। হাহ! এমন মানুষও পৃথিবীতে হয়? অটবীর মাঝে কি এমন পেল এই ছেলে?
মোবাইলটা ঠেলেঠুলে ব্যাগের ভেতর আরও গুঁজে রাখলো অটবী। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলো। গরমে গলা শুকিয়ে গেছে। তৃষ্ণায় মন আকুপাকু করছে। ব্যাগ হতে পানির বোতল বের করবে, ওমনি কে যেন পাশে এসে হাঁটতে লাগলো, “আপনি আমার কল ধরছেন না কেন?”

অটবী চমকালো, থমকালো। চট করে পাশ ফিরে তাকালো। সেই দেখতে আসা ছেলেটা! এই ছেলে ভূতের মতো হঠাৎ এলো কোত্থেকে? তাকে ফলো করছে নাকি? কপাল কুঁচকে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললো, “আপনি এখানে কিভাবে?”

ছেলেটা লাজুক হাসলো। নিশ্চিন্ত হয়ে বললো, “চিনেছেন তাহলে!” এরপর আবার বললো, “একটু কাজে এসেছিলাম আসলে। যাওয়ার সময় আপনাকে দেখে কথা বলতে এলাম।”

মিথ্যে কথা। এই ছেলে বিদেশে থাকে। তিন বছর ধরে সেখানেই ছোটখাটো কাজ করছে। কয়েকদিন হলো বিয়ের জন্য দেশে এসেছে। এর বাসাও অটবীদের চার এলাকা পরে। এই ছেলের কস্মিনকালেও এখানে কোনো কাজ থাকতে পারে না। থাকলেও সেটা অটবী জড়িত। অটবীর পিছু পিছু হ্যাংলার মতো দৌঁড়ানো।
অটবী যথাসম্ভব মিথ্যেটা হজম করে নিলো। পাশ থেকে ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করলো, “উত্তর দিলেন না যে? আপনি আমার কল ধরছিলেন না কেন?”

বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। অল্পসল্প দমাতে চেষ্টা করে বললো, “ফোন সাইলেন্ট ছিল। দেখিনি।”
—“আমার তো মনে হচ্ছে আপনি মিথ্যে বলছেন। একটু আগেও দেখলাম আপনি ফোন হাতে নিয়েছেন।”

অটবী নিত্যান্তই ভদ্র, শান্ত মেজাজি। এমন ছেলেদের পাত্তা না দিলেও সোজা-সাপটা কিছু বলতে পারে না। তবুও একটু তাচ্ছিল্য করে হেসেই প্রশ্ন করলো, “জানেন যেহেতু জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
কিঞ্চিৎ থতমত খেলো ছেলেটা। তবে দমলো না। সময় নিলো। ধাতস্ত হতেই ট্রেনের গতিতে ছুটলো, “আমার নাম মুসফিক। জানেন নিশ্চই? আপনার নাম অটবী, তাই না? অনেক সুন্দর একটা নাম। আপনার মতো।”
অটবী এবার কথা বাড়ানোর অবশিষ্ট আগ্রহটুকুও হারিয়ে ফেললো। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। জঘন্য রকমের অসহ্য। তার জীবনে কি কষ্টের অভাব ছিল? এই বার্তি ঝামেলার উড়ে এসে জুড়ে বসবার প্রয়োজন কি ছিল?

দুপুর হলেও রহিমের দল ঠিকই মোড়ের টং দোকানে আয়েশ করে চা খাচ্ছে। সাথে ত্রিস্তান, সরোজও আছে। ত্রিস্তান সবসময়কার মতোই এক হাত দিয়ে সিগারেটে একটু পরপর টান দিয়ে অন্য হাতে চা ধরে আছে। পাশের এলাকায় বিদেশ ফেরত এক লোক এসেছে। টাকা পয়সার অভাব নেই। পাঁচ ভোরিস্বর্ণ, গয়না, গোটা পঞ্চাশ হাজার টাকা! তাজা খবরটা রাকিব এক্ষুণি এনেছে। নিজের চোখে সবকিছু দেখে এসেছে সে। এই নিয়েই আজকের মূল আলোচনা। টং দোকানাদার যেন তাদের আলোচনার আগাগোড়া কিচ্ছু শুনতে না পায়, তাই তারা বেশ ফিসফিসিয়েই কথা চালিয়ে যাচ্ছে। দোকানদারও কান খাঁড়া করে আছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। এত আস্তে কেউ কথা বলে? এই ব্যাটাছেলেগুলো কি একটু মজাও নিতে দিবে না?

ত্রিস্তান এসবের ভেতর কখনোই থাকে না। সবকিছু ঠিক হওয়ার পর সে শুধু প্লেন বানিয়ে দেয়। তার আপাতত এখানে কোনো কাজ নেই। ওদের থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে একেকটা সুখটান বাতাসে মিলিয়ে দিচ্ছে সে। আর যেখানে ত্রিস্তান, সেখানেই সরোজ। পাশে দাঁড়িয়ে সরোজও ড্যাবড্যাব করে আশপাশ দেখছে। হঠাৎ অটবীকে চোখে পরলো ওর। তৎক্ষণাৎ ত্রিস্তানের বাহু গুঁতিয়ে জোরেসোরে বললো, “ভাই? ওইডা অটবী আপু না? লগে ওই ব্যাডা কে?”

ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে বামদিকের রাস্তায় তাকালো। অটবী তাড়াহুড়োয় কোথায় যেন যাচ্ছে। পাশে মোটামোটি ধাঁচের একটা ছেলে। হেসে হেসে কথা বলছে। অজান্তেই ঈগল চোখদুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। দৃঢ়, গাঢ় নয়নে ওদেরকে সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলো ত্রিস্তান। বুক ভারী হওয়ার পূর্বে সরোজকে বলতে শুনলো, “এই ব্যাডা তো মনে হয় ওই বিয়ের ছেলে। অটবী আপু না বিয়ে ভাইঙ্গা দিসে? এ ব্যাডা এনে কি করে?”

হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। দূরের দূর্বাঘাসে সেটি ছুঁড়ে ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরালো ত্রিস্তান। অটবী সেই ছেলেটার সাথে এতই ব্যস্ত যে, পেছনে ফেলে আসা ত্রিস্তানকে সে একবারও খেয়াল করেনি। ভালো! সে তো এটাই চেয়েছিল। প্রথম থেকে। কিন্তু তবুও বুকটা এমন নীল নীল ব্যথায় কাতরে উঠছে কেন? নীলেরা এত নিষ্ঠুর হয় কেন? মুক্ত বাতাসের অভাবে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে।

প্রাণের অরণ্য,
আমি দুটো তুমি দেখেছি। চোখ বুজে রাখলে আমার একদম কাছের তোমাকে আর চোখ মেললেই বহুদূর হারিয়ে যাওয়া তুমিকে।

আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। মেঘের তড়িৎ গর্জনে ভেতরটা নড়ে উঠছে। সেই দু’ঘণ্টা আগ থেকে বৃষ্টি আসবে আসবে বলেও আসছে না। ভয় লাগাচ্ছে শুধু। তনয়া বায়না ধরেছে, সে বৃষ্টি দেখে ভাত খাবে। কিন্তু কই? এত অপেক্ষা করেও তো বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেষ অনেকটা জোড় করেই তনয়াকে ভাত খাইয়ে দিতে লাগলো ত্রিস্তান। তনয়া গাল, নাক ফুলিয়ে রেখেছে। বৃষ্টির ওপর তার ভীষণ রাগ। পঁচা, দুষ্টু বৃষ্টি।
ভাতে আজ বিশেষ কিছু নেই। আলু ভর্তা, ডাল। তনয়ার আবার এইসব ভর্তা বেশ পছন্দ। ভাতের একেকটা লোকমা সে প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে চিবুচ্ছে। খেতে খেতে কেঁশে উঠতেই পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো ত্রিস্তান। নরম কণ্ঠে বললো, “আস্তে খা।”

বলতে বলতে পাশের চেয়ারে শোকের ছায়া এঁটে রাখা সরোজকে একবার আড়নয়নে দেখলো সে। এক লোকমা ভাত তনয়ার মুখে পুরে দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে? মুখ অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?”

সরোজ বেজায় মন খারাপ নিয়ে বললো, “তুমি খবর শুনো নাই?”
—“কেমন খবর?”
সরোজ আগের মতোই ম্লান কণ্ঠে বললো, “অটবী আপু বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবার বিয়ে।”

তারপর মুহুর্তেই ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বললো, “তুমি কিছু করবা না ভাই? আপুরে এমনে এমনে বিয়ে করতে দিবা?”

ততক্ষণে চঞ্চল হাতজোড়া থেমে গেছে। স্তব্ধ হয়েছে শরীর, ফাঁকা হয়েছে মস্তিষ্ক! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিশ্বাসগুলো এমন আটকে আটকে আসছে কেন? তনয়া ভাতের জন্য তাগাদা দিতেই সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। আস্তে করে উত্তর দিলো, “আমি কি করবো?”
—“কি করবা মানে? বিয়ে আটকাবা না? তুমি না আপুরে ভালোবাসো?”

‘তুমি না আপুরে ভালোবাসো?’— কথাটা যেন কেমন। মাথায় পাহাড়সম চাপ সৃষ্টি করে। মনে হয়, তার মতো অসহায় আর দুটো নেই। সে কিছু পারে না। কাউকে আগলে রাখার নূন্যতম ক্ষমতাও তার নেই।
পুরোটা সময় সরোজ ত্রিস্তানের উত্তরের অপেক্ষায় বসে ছিল। ত্রিস্তান উত্তর দেয় নি। তনয়াকে ভাত খাইয়ে চুপচাপ চলে গেছে নিজ রুমে। বিছানার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলের দ্বিতীয় ড্রয়ারে কয়েকটা ঘুমের ঔষধ গুছিয়ে রাখা আছে। সেখান থেকে তিনটে ঔষধ নিয়ে ত্রিস্তান পানি দিয়ে গিললো তা। বিছানায় গা এলালো। ফোনের গ্যালারির প্রথর সারির একটা ভিডিও ওপেন করবো। এটা তার মায়ের ভিডিও। তার মা গান গাইতে খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় তাকে কোলে নিয়ে এভাবেই গান গেয়ে ভিডিও করে রাখতেন তিনি। ওইযে? ভিডিও-তে দেখা যাচ্ছে তার মাকে। শাড়ি পরে, বাঙালিয়ানা সাজ সেজে ছোট্ট ত্রিস্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। বাংলা গান তো আর তেমন ভালো পারেন না। ইংরেজি কি যেন একটা গান গাইছেন। ভিডিও করছেন তার বাবা। যে কেউ দেখলে বলবে, “অ্যা ফরএভার হ্যাপি ফ্যামিলি!”

ভিডিওটা ত্রিস্তান বারবার টেনে দেখলো, শুনলো। দেখতে-দেখতে শুনতে-শুনতে তন্দ্রায় দূর্বল হয়ে পরলো সে। চোখের তীব্র জ্বালায় কপাল কুঁচকালো। হাহ! তার না পাওয়ার ঝুলিতে আরেকটা না পাওয়া যোগ হয়ে গেল। তার এত না পাওয়া!

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here