অটবী সুখ পর্ব ২০

0
109

অটবী সুখ

২০.
“My lady, If I could, I would hold you so tightly that you would never let go of me.”

ঘুম থেকে উঠে অটবীকে আশেপাশে পায়নি ত্রিস্তান। বাহিরে তখন সন্ধ্যা শেষে আঁধার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এতক্ষণ অবশ্য থাকার কথাও না। শরীরের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। টি-টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিললো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখে সূক্ষ্ণ জ্বালাতন। বুক ভারী। মেয়েটা কি সত্যিই চলে গেছে? ভাবতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস সুরসুর করে বেড়িয়ে এলো। সরোজ তখনো রান্নাঘরে কি যেন করছে। একটু পর পর খুটখাট শব্দে মেতে উঠছে নিস্তব্ধ পরিবেশ। অটবী তার বানানো নুডুলস্ খেয়ে যায়নি। তাই তার একটু মন খারাপ। কাঁচের প্লেটে নিজের বানানো নুডুলস্ নিজেই চামচের আঘাতে টুংটাং শব্দে খাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে মন খারাপ করছে।
সরোজের কাছে যাওয়ার পূর্বে তনয়ার রুমে একবার তাকালো ত্রিস্তান। দরজা ভেড়ানো। বোধহয় ঘুমাচ্ছে। সরোজকে বললো, “অটবী কখন গেছে?”

সরোজ চমকালো, ভড়কালো। হঠাৎ ত্রিস্তানকে দেখে ভয় পেল ক্ষীণ। বুকে লাগাতার কয়েকবার ফুঁ দিয়ে চোখ বড় বড় করে অভিযোগ জানালো, “এমন ভূতের মতো হঠাৎ কথা কও ক্যান? কথা কওনের আগে কাঁশি-টাঁশি দিতে পারো না?”

ত্রিস্তান সে কথার ধার ধারলো না। ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে রান্নাঘরের বামপাশটায় এগোলো। ক্ষুধায় পেটে হরতাল লেগে যাচ্ছে। ছোট একটা বাটিতে নুডুলস্ নিতে নিতে আবারও একই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “অটবী কখন গেছে?”
—“বেশিক্ষণ হয় নাই। এই আযানের একটু আগে।”

কথাটা বলে একটু থামলো সরোজ। আড়চোখে ত্রিস্তানকে একবার দেখে নিলো। গম্ভীর মুর্তে নুডুলস্ গিলছে সে। চাবাচ্ছে কি-না তাতেও সন্দেহ! আমতা আমতা করে সরোজ বলতে চাইলো, “তোমগো মাঝে কি ঝগড়া হইছিল, ভাই? অটবী আপুরে দেখলাম কানতেছিল।”

তৎক্ষণাৎ খাওয়া থামলো। মুখে তখন মাত্র এক চামচ নুডুলস্ পুরেছে ত্রিস্তান। সেটা কোনোমতে গিলে অবাক কণ্ঠে সুধালো, “কাঁদছিল মানে?”
—“ওইতো, যখন এন থেইকা যাইতেছিল গা তখন চোখ মুখ লাল, পানি। কান্নার লাইগা কথাও কইতে পারতেছিল না।”

ত্রিস্তান শুনলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সশব্দে রেখে দিলো বাটি-টা। পেটে ক্ষুধা থাকলেও এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। রুচি চলে গেছে। গলা দিয়ে আর খাবার নামবে না।
—“সরোজ, তোকে যেটা আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?”
—“হ। আনছি।”

বলতে বলতে শেষ নুডুলস্-টুকু ঝটপট চিবিয়ে ফ্রিজ খুললো সরোজ। গোল প্লেট সুদ্ধ একটা লাল প্যাকেট বের করলো। গাঢ় লাল রক্তের প্যাকেট। উদ্ভট গন্ধ। ত্রিস্তানের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো, “আজইকাও কি এক্সপেরিমেন্ট করবা, ভাই?”

ত্রিস্তান প্লেট-টা নিলো। সরোজের দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো, “হু।”
—“তোমারে একখান কথা কই, ভাই?”
ত্রিস্তানের আবারও ছোট্ট উত্তর, “হু।”
—“তুমি আমারে যত বোকা ভাবো আমি কিন্তু ততটা বোকা না। কিছু কিছু জিনিস আমিও বুঝি।”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড! দারুণ চমকে সরোজের মুখপানে তাকালো ত্রিস্তান। পরমুহুর্তেই আবারও শান্ত হয়ে ছেলেটার চোখে চোখ রাখলো। নিষ্পাপ চোখদুটোয় তখন হাজারো প্রশ্ন, কৌতূহল ভীড় জমাচ্ছে। সেই ভীড়ের মাঝে হঠাৎ করেই চমৎকার এক দ্যুতি উঁকি দিলো। যেন এতকাল খুঁজতে থাকা প্রশ্নের কিছু উত্তর সরোজ জেনে গেছে, যা জানা তার একদমই উচিত হয়নি।

ঢোক গিলে গলাটা একটু ভিঁজিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালালো ত্রিস্তান। নিস্তেজ কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব কঠোর করে বললো, “আমার রুমে ঢুকতে মানা করেছিলাম, সরোজ। আর ঢুকবি না।”

সরোজ এমন সরাসরি প্রশ্নটা করতে চায়নি। কিন্তু রোজ রাতে ত্রিস্তানের ঘর থেকে আসা নারী কণ্ঠের চিৎকার, কান্নার করুণ সুর সে উপেক্ষা করতে পারছে না। না চাইতেও বিশ্রী সন্দেহ জমাট বাঁধছে। আস্তে আস্তে মাথা তুলে দেখলো, ত্রিস্তান চলে যাচ্ছে। বড় বড় কদম ফেলে। যেন পালাতে চাইছে এখান থেকে। সরোজ এই লোকটাকে বড় ভাই মানে। বড় ভাইয়ের থেকেও বেশি। এলাকার সবাই যখন সরোজকে খারাপ বলে তিরস্কার করতো, একমাত্র ত্রিস্তানই তাকে কাছে টেনে ভালো-মন্দ বুঝিয়েছিল। এই মানুষটা থেকে সে দূরে সরে যায় কেমন করে?

ত্রিস্তান রুমে ঢুকতেই নিচ্ছিল, সরোজ তড়িৎ কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ কেমন প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে, “ভাই, তুমি যা-ই করো, আমি তোমার সাথে আছি। হোক সেটা খারাপ। আমারে সবসময় পাশে পাইবা।”

সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছে ত্রিস্তান। দরজার সঙ্গে গা ঘেঁষে বসে পরেছে মেঝেতে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। এ সত্য সে কতদিন চেপে রাখবে? কতদিন চেপে রাখা যাবে? অটবী! সরোজ! তনয়া! নলী! সবাই ভুল বুঝবে তাকে। ঘৃণা করবে! বাবা-মায়ের মতো কেউ ভালোবাসবে না। কেউ না। শরীরের শিরা-উপশিরায় ভীষণ একটা যন্ত্রণা অনুভব হলো। হাতে থাকা রক্তের থলি, প্লেট ছুঁড়ে ফেললো সুদূর মেঝেতে। রক্তের থলি ছিঁড়লো না ঠিক, কিন্তু কাঁচের প্লেট-টা ভেঙ্গে গেল। ত্রিস্তান সেদিকে চেয়ে চেয়ে দেখলো, কাঁচের টুকরোগুলো তাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে, “ওহে সুখনীল ত্রিস্তান! দুঃখ তোর পিছু ছাড়বে নারে অভাগা!”

নিশ্বাসটা ভারী হলো। কষ্ট দিলো। নিজের ওপর বড্ড করুণা হলো তার। মস্তিষ্ক শুধু এখন একটা নামই জপছে। অটবী! অরবিন্দ অটবীতে বসবাসরত তারই মতো সুখ খোঁজি একটি মেয়ে!

মাথার ওপর কড়া উত্তাপ। ঝলমলে রোদ্দুর। তীব্র তাপে শরীর ঘেমে একাকার। স্কুল শেষে হাতে হাত ধরে বাসায় ফিরছিল দু’বোন, নলী আর পৃথা। হাতে দশ টাকার বাদামের ঠোঙা। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নিজেদের ব্যস্ত করে রেখেছে ওরা। আশেপাশের খেয়াল নেই। আলোচনার মূল বিষয় এই, আজকে অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। রেবা বেগম তাই মেয়েকে ঘর থেকে বের হতে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। পাত্রপক্ষ দেখতে আসায় কেন ঘর থেকে বেরোনো যাবে না- তা তাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে ঢুকছে না। পাশাপাশি তারা এ নিয়েও চিন্তিত, তাদের ভবিষ্যৎ বোনজামাই ঠিক কেমন হবে? ভালো হবে তো? দেখতে শুনতে ভালো না হলে বাদ। চরিত্রও ভালো হতে হবে। নয়তো তাদের ফুলের মতো বোনকে তারা কিছুতেই বিয়ে দিবে না। একদমই না।

রাস্তার মোড়ে রহিম, কাদিন সঙ্গে আরও কিছু ছেলেপেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কথার মাঝে কাদিনের দিকে দৃষ্টি চলে যায় পৃথার। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চেয়ে থেকে আফসোসের সুরে বলে, “কাদিন ছেলেটাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম।”

নলীও একবার কাদিনের দিকে তাকালো। অতঃপর চোখ-মুখ বিকৃত করে বললো, “কি দেখে ভালো মনে হইছিল? আমার তো প্রথম থেকেই ভাল্লাগে না। বান্দরের মতো চেহারা। শরীর একটা কাঠি। ফুঁক মারলেই বাতাসে ভাসাভাসি শুরু করে…”

কথাটা শেষ হতে পারলো না। পৃথা চোখ রাঙিয়ে চেয়ে আছে। নির্ঘাত নলীকে মেরে কুচিকুচি করার পরিকল্পনা আঁটছে মনে মনে। নলী কাদিনের বদনাম আর গাইলো না। অভিযোগের সুরে বললো, “তোরা যে সরোজকে নিয়ে বলতিস? আমার খারাপ লাগতো না? এবার বুঝ! পছন্দের মানুষকে গালাগাল করলে কেমন লাগে!”
—“সরোজ ভালো ছেলে না।”

পৃথার গম্ভীর কণ্ঠ। নলী ঢং করে বললো, “কাদিন যেন অনেক ভালো?”
—“কাদিনও ভালো না।”

ততক্ষণে ওরা রহিমের কাছাকাছি চলে এসেছে। রহিমের বাজে হাসিটা তখন টাটকা, তাজা। দাঁত কেলিয়ে ওদের উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি ময়না পাখিরা? স্কুল শেষ? বাসায় যাচ্ছো?”

নলী সাথে সাথে বিরক্তি প্রকাশ করলো। পৃথার হাত টেনে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড়ালো, “তো আর কোথায় যাবো রে লুচ্চা?”

অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার সংবাদটা ত্রিস্তান পেল রাত্রিবেলা। ঘড়িতে তখন ন’টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। ত্রিস্তান টং দোকানে বসে চা-সিগারেট ফুঁকছিল। কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে সংবাদটা জানালো সরোজ। সরোজের সাথে যদিও ইদানিং তার কথাবার্তা হচ্ছে অল্পসল্প। দূরত্বটা ত্রিস্তানই তৈরি করেছে। কিন্তু সরোজ তার দিক থেকে সচল, চঞ্চল। ত্রিস্তান না জানতে চাইলেও অটবীর প্রত্যেকটা পদক্ষেপ সম্পর্কে মিনিটে মিনিটে অবগত করছে। ত্রিস্তান সব কিছু পাত্তা দেয় না। না শোনার ভান ধরে রয়। এই যে! এখনো ধরছে। ধরার চেষ্টা করে নিজেকে বলছে, সে শোনেনি। কিচ্ছু শোনেনি।
কিন্তু ভেতরকার হৃদযন্ত্র সেকথা মানতে নারাজ। তাকে ভুল প্রমাণ করতে উঠেপরে লাগছে। অধৈর্য করছে। এরপর… এরপর দশমিনিটের মাথায় ত্রিস্তান অটবীদের বাসার সামনে! ঠিক রান্নাঘরটার সম্মুখে, যেখানে আপাতত অটবী চুলায় খাবার গরম করতে ব্যস্ত।

মেয়েটার মুখশ্রী মলিন। চোখ ফোলা। সে কি কেঁদেছে? তিক্ত নিশ্বাস ফেলে ত্রিস্তান আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ভেবেছিল, অটবীকে একটু দেখেই চলে যাবে। তবে তা আর হলো না। চলে যাওয়ার পূর্বেই অটবীর নজরে পরে গেল সে। এখন কি করবে? সে কি একটু হাসবে? কিছু বলা উচিত কি?
ভাবনার অকূল পাথারে অটবীই সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করলো, “কেন এসেছেন?”

দূরত্ব বেশি নয়। তিন-চার হাত। একটু জোরে কথা বললেই সব শোনা যায়। কিন্তু অটবী আস্তে কথা বলছে। কথাটা শুনতে ক্ষীণ বেগ পেতে হলো ত্রিস্তানের। এরপর সে নিজেও ওভাবে উত্তর দিলো, “তোমার নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? তাই দেখতে এলাম।”

অটবী মনে মনে হাসলো। লোকটার কাছে দেখি তার সব খোঁজখবরই আছে! তাহলে এই মিছে অভিনয়, দূরে সরে যাওয়া কেন? অটবীর খুব বলতে ইচ্ছে হলো, “দেখেছেন ত্রিস্তান? এবারও আপনি আমার কাছে এসেছেন। আমাকে দূর্বল করতে। অথচ আপনি নাকি আমাকে নিজের করে চান না!”
কিন্তু মুখে বললো, “বিয়ে এখন হচ্ছে না। যখন হবে, তখন আসবেন। সবার সাথে।”

ত্রিস্তান মুচকি হাসলো। আরও কিছুক্ষণ অটবীকে মন ভরে দেখে, সুপ্ত বেদনাটা লুকিয়ে রাখলো। কেমন করে যেন বললো, “বিয়ে করে নিও অটবী। ছেলে শুনলাম… ভালো?”
—“এখন কি আপনার কথা মতো চলতে হবে?”

ত্রিস্তানের হাসির আওয়াজ বৃদ্ধি পেল। কৃত্রিম, দীর্ঘ হাসি। সেই হাসি অটবীকে তৃপ্ত করতে পারলো না। বিষিয়ে দিলো। চাপা বিশ্রী রাগটাকে হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দিলো সুরসুর করে। পাষাণ লোকটার চোখে চোখ রেখে মারাত্বক ঘৃণা নিয়ে বললো, “আপনার মতো জঘণ্য লোক আর কেউ হতে পারে না, ত্রিস্তান।”

পরপরই তাদের মধ্যিখানে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ালো বন্ধ বিস্তর জানালা! ত্রিস্তান দৃষ্টি সরালো না। বন্ধ জানালাটার দিকে চেয়েই থাকলো। যেন সে এখনো দেখছে, অটবী দাঁড়িয়ে আছে ওই তো, অদূরে। রাগী নয়নে ভস্ম করে দিচ্ছে তাকে। মেয়েটা এত রাগতে পারে! ত্রিস্তান আরও একবার মলিন হাসলো। কে বলে সে হাসে না? এইযে, ক্ষণে ক্ষণে হাসছে!
চোখ দুটো বুজে, আকাশ পানে মুখ করে, ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “আমার প্রাণ। প্রাণের অটবী। তোমাকে পাওয়ার যদি একটা সুযোগ পাওয়া যেত।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here