অটবী সুখ
১৪.
আজকাল রেডিও-র অতশত চল নেই। কাশেম আলী সৌখিন মানুষ। টং দোকানে বহু আমলের পুরাতন সামলে রাখা রেডিও ধুঁয়ে-মুছে সাজিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, ভুচুংভাচুং শব্দে গানও বাজে ওটা থেকে। এই যেমন এখন কাশেম আলী কাপে চা ঢালতে ঢালতে রেডিও-র গানের সাথে তাল মেলাচ্ছেন,
“তুমি বন্ধু কালা পাখি,
আমি যেন কি?
বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি।
সাদা সাদা কালা কালা
রঙ জমেছে সাদা কালা।”
শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গানটা গাইছেন তিনি। কণ্ঠস্বর নেহায়েত খারাপ না। শুনতে ভালো লাগছে। আগের দিনের একটা চঞ্চল সুবাসে টগবগ করছে শরীর। ত্রিস্তান চায়ের কাপে চুমুক দিলো। সরোজের দিকে নজর ফেলতেই দেখলো, ছেলেটা কেমন চোখ-নাক কুঁচকে চেয়ে আছে ওর দিকে। কৌতূহলে নিশপিশ করছে সারা মুখ।
ত্রিস্তান ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
সরোজের অভিব্যক্তি পাল্টালো না। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললো, “ভাই, একটা প্রশ্ন ছিল।”
“কি?”
“তোমার হাতে, গালে এরকম আঁচড় ক্যান? ব্যাথা পাইছো কেমনে?”
প্রশ্ন করতে না করতেই কচকচ শব্দে একটা বেলা বিস্কুট অনায়াসে চিবিয়ে ফেললো সরোজ। ভেতরের আগ্রহ কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না। এক্সট্রা এক্সাইটমেন্ট ধরে বেঁধে রেখেছে। কাল রাতে যখন ত্রিস্তানের বাসায় আশ্রয় নিতে গেল, তখন রাত বাজে দু’টা। নিস্তব্ধ পরিবেশে দরজায় খটখট শব্দ তৈরি করার কিছুক্ষণের মাঝেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ত্রিস্তান। টকটকে তাজা ক্ষতগুলো তখন স্পষ্ট, রক্তে ভেঁজা। সরোজ তক্ষুণি আঘাতের কারণ জানতে চেয়েছিল। কিন্তু ত্রিস্তানের ক্লান্ত, রুক্ষ, রুঢ় চাহনিটা তাকে থামিয়ে দেয়।
রয়েসয়ে একটা তিক্ত নিশ্বাস ছাড়লো সরোজ। ত্রিস্তান প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। দিবেও না। কচকচ শব্দে আরেকটা বিস্কুট চিবুতে চিবুতে এক্সাইটমেন্ট নামক বিশ্রী অনুভূতিটা দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালালো সে। চারপাশে নজর বুলালো। টং দোকানের সাত-আঁট হাত দূরে অটবীকে দেখা যাচ্ছে। নলী আর পৃথাকে সম্ভবত স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। তারা একা নয়। জোয়ান, মোটামোটি দেখতে একটা যুবক আর নলীর বয়সী একটা ছেলেও আছে সাথে। অটবী খুব হেসে হেসে কথা বলছে যুবকটির সাথে। সরোজ একবার বাঁকা চোখে ত্রিস্তানকে দেখলো। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিটা এঁটে কিটকিটিয়ে বললো, “আল্লাহ্! ত্রিস্তান ভাই! তুমি এহন কি করবা? ভাবীরে তো অন্য পোলায় নিয়া যাইতেছে গা রে! আহহারে! পুওর সুখনীল ত্রিস্তান! উহু! দেবদাস সুখনীল ত্রিস্তান।”
ত্রিস্তান সাথে সাথে উত্তর দিলো না। একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভাবী কে?”
“আর কেডা? অটবী আপু। তোমার প্রেমিকা লাগে না? আমি বুঝি ভাই। সামনে তাকাও, দেখবার পারবা। তোমার পাখিরে তো অন্য ব্যাডায় নিয়া যাইতেছে গা।”
সরোজের ইশারাকৃত স্থানে একবার তাকালো ত্রিস্তান। কিছুই দেখেনি– এমন ভাব করে খালি চায়ের কাপটা বেঞ্চের একপাশে রাখলো। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে জোরেসোরে নিশ্বাস ফেলে বললো, “তোর পাখির দিকে তাকা ব্যাটা। লাল বাতি জ্বলজ্বল করছে।”
“মানে?”
চট করে আবারো অটবীদের পানে দৃষ্টি মেললো সরোজ। এটা কি? তার প্রাণপ্রিয় প্রেমিকা দেখি পুচকে ছেলেপেলের সাথে হাসির ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। আহ্লাদে মাখোমাখো হয়ে একে অন্যের গায়ের ওপর ঢলে পরছে একদম! কি ভাই? প্রতিবন্ধী নাকি? মা-বাবা হাঁটা শেখায়নি? পরকীয়ার সূক্ষ্ণ গন্ধটা নাকে বারি খেতেই তেঁতে উঠলো সরোজ। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো, “এইডা আমি কি দেখতাছি? এইডা দেখবার আগে আমি অন্ধ হইয়া গেলাম না ক্যান? আমার লগে অন্যায় হইতাছে। আমি ঠইকা গেছি। আমারে এহন বাঁচাইবো কেডা?”
পাশ থেকে ত্রিস্তান সবিনয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বিশ লাগবে, ছোটভাই?”
চোখে পানি নেই। তবুও চোখের পানি মোছার ভান করলো সরোজ। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “আমার বুক জ্বলতাছে, ভাই।”
“মরে যা। জ্বলা বন্ধ হয়ে যাবে।”
“আমি সত্যি কইতাছি।”
“ঢং করবি না সরোজ। তাড়াতাড়ি খাবার শেষ কর। তনয়া বাসায় একা।”
সরোজ ঠোঁটের পাতা দুটো চেপে অসহায় চোখে তাকালো নলীর দিকে। নলীও তাকিয়েছে। টং দোকান পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ইশারায় হেসে হেসে কি যেন বলেছেও। হু! ঢং! অন্য ব্যাটাছেলের সাথে হাইসা-টাইসা তাকে দাঁত দেখানো হচ্ছে! ক্ষিপ্ত মেজাজটা হুরহুর করে বেড়ে গেল সরোজের। কিন্তু পরমুহুর্তে কিছু একটা মনে পরতেই শান্ত হয়ে গেল সে। ত্রিস্তানের দিকে চোরা দৃষ্টে তাকালো। আমতা আমতা স্বরে বললো, “ভাই… তুমি কেমনে জানো নীলিমা… মানে নলীর লগে আমার কিছু চলে?”
চা-বিস্কুটের দাম এসেছে ত্রিশ টাকা। ত্রিস্তানের কাছে ভাংটি নেই। এক’শ টাকার একটা নোট দিয়ে তনয়ার জন্য দু’টা চিপস আর কয়েকটা কেক কিনছিল সে। সরোজের কথা শুনে ঠাট্টার সুরে বললো, “যারা সারা বছর পরীক্ষায় ফেল করে চোরের মতো রাস্তায় ঘুর ঘুর করে, তাদের চোখ দেখলেই ভালো-মন্দ জানা যায়।”
সরোজ যেন এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দিবে। আজকের দিনটাই খারাপ! ঘুম থেকে উঠে কার মুখ যে দেখেছিল! নিজের মুখটাই তো! প্রতিদিন তো আয়নায় নিজের মুখটাই সবার আগে দেখে।
–
সারা এলাকা জুড়ে কারেন্টের অভাব। রাস্তায় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোও নিস্তেজ। কোথাও এক রশ্মি আলো নেই। চাঁদের দ্যুতিও দূর্বল চিত্তে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, সে অসুস্থ। পথচারীদের রাস্তা দেখাবার শক্তি তার নেই। সূর্য আড়ি কেটেছে। পর্যাপ্ত আলো তাকে ধার দেয়নি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে অটবী অনেকটা মুখস্ত পরীক্ষার্থীর মতো ফার্মেসীর দিকে হেঁটে চললো। এখন রাত বাজে বারোটা। টিউশন শেষ করে আট’টার দিকে ইলিয়ানা আন্টির বাড়িতে গিয়েছিল সে। কাদিন এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে। ছাত্র ভালো হলেও একটু তদারকির প্রয়োজন। তাই কাদিনকে পড়ানোর দায়িত্ব পরেছে অটবীর ওপর। সে বিষয়ে কথা বলতেই গিয়েছিল অটবী। এই বিষয়, সেই বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত ইলিয়ানা আন্টি তাকে কিছুতেই বাড়ি যেতে দিচ্ছিলেন না। ভাগ্যিস কারেন্ট-টা গিয়েছিল! নয়তো এখনো তাকে ওইসব হাবিজাবি কথা শুনতে হতো। ওদিকে আবার রেবা বেগমের শরীরটাও মন্দ যাচ্ছে। ঔষধও ফুরিয়ে যাবে যাবে ভান ধরেছে। ব্যাগে পাঁচশত টাকার পুরাতন নোট। ঔষধগুলো এক্ষুণি কিনতে হবে। নয়তো কালকে আবার সকালের ঔষধ বাদ পরে যাবে।
ঔষধ কিনতে কিনতে বার্তি দশ মিনিট গেলে যায় অটবীর। অন্ধকার এবার অনেকটা সয়ে গেছে। অল্পসল্প স্পষ্ট আশপাশ। সে এখন জসিমুল্লাহ সাহেবের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে আছে কালো কালো ঝোপঝাড়। হঠাৎ তাকালে মনে হয় পাড়ার কিশোরগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে পণ করলো, বেতনের টাকাটা পেলেই এবার নতুন একটা ফোনের ব্যাটারী কিনবে। তার বর্তমানে যেটা আছে সেটা নষ্ট। ফুলচার্জ করলে এক ঘণ্টাও টিকে না।
আচমকা, কিসের যেন শব্দ শুনলো অটবী। পাতার কচরমচর শব্দ, নড়েচড়ে ওঠার শব্দ, তেজি নিশ্বাসের শব্দ, ক্ষীণ হিসহিস শব্দ! ভয়ে ভেতরটা খিঁচে উঠলেও অটবী ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দমবন্ধকর গলায় আস্তে করে বললো, “কে ওখানে?”
সারাশব্দ নেই। অটবী ঠিক করলো, সে ওদিকে যাবে। উঁকি দিয়ে দেখবে। মারাত্বক বেয়াদব কৌতূহলটাকে শান্ত করবে। আর যদি খারাপ কিছু হয়, ডানে-বামে দেখার কোনো দরকার নেই। এক ছুটে সোজা বাসা! যদিও জায়গাটা অতটা নির্জন না। চিৎকার দিলে নিশ্চই আশেপাশের সবাই ছুটে আসবে? মনে মনে মিথ্যা সান্ত্বনা নিয়ে আলতো পায়ে এগিয়ে গেল অটবী। পাতার কচরমচর শব্দ আবারো হচ্ছে। কেউ নড়ে উঠছে। ঐতো! লম্বা মতো কে যেন বসে আছে গাছের সাথে হেলান দিয়ে। কে এ লোক? আরেকটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো সে।
“অটবী?”
কণ্ঠস্বর ভীষণ পরিচিত। এটা ত্রিস্তান। অটবী শতভাগ নিশ্চিৎ!
ভর-ডর নিমিষেই কোথায় যেন উঁড়ে গেল। অটবী এগোলো দূরন্ত পায়ে। কাছাকাছি হতেই ত্রিস্তান আবার বললো, “তুমি, অটবী?”
অন্ধকারে ত্রিস্তানকে ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে না। অটবী শুধু এটুকুই বুঝলো, লোকটা হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দূরত্ব রেখে সেও বসলো পাশে। ঝটপট জিজ্ঞেস করলো, “ভূতের মতো একা একা আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আবারও অসুস্থ হয়ে পরেছেন? আপনার ফোনে লাইট নেই? দেখি, জ্বালান তো একটু।”
ত্রিস্তান শীতল নয়নে অটবীর দিকে চেয়ে আছে। আবছা চোখেও অটবীকে অপরূপ লাগছে। মেয়েটা সুন্দর– এ কথা সে অস্বীকার করতে পারবে না। এক দেখায় যে কারো পছন্দ হয়ে যাবে।
ত্রিস্তান ক্ষীণ স্বরে বললো, “আস্তে কথা বলো, অটবী। তুমি পুরো এলাকাকে আমার এখানে থাকার কথা জানিয়ে দিচ্ছো।”
অটবী গুটিকয়েক ছোট ছোট নিশ্বাস ফেললো। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বললো, “আপনি এখানে কি করছেন? তনয়া কোথায়?”
—“সরোজ আছে তনয়ার সাথে।”
অটবী ভ্রু কুঁচকালো, “মানে? ও তনয়ার সাথে কি করছে?”
“চাচা ওকে বের করে দেওয়ার পর আমার বাসায় থাকছে এখন।”
অটবী হতাশ হলো। এক রহিম কি কম ছিল? এখন ত্রিস্তানও জুটেছে ছেলেটার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে। কাঁধের ব্যাগটা মাটি থেকে উঠিয়ে সে চলে যেতে চাইলো। তাকে থামিয়ে দিলো ত্রিস্তান, “আরেকটু বসবে, অটবী?”
নিঃসঙ্কোচ আবদার। অটবীর কেন যেন মানা করতে ইচ্ছে করলো না। ব্যাগটা আবারও মাটিতে রেখে বসে পরলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখনো উত্তর দেননি, ত্রিস্তান। এত জায়গা থাকতে এই ঝোপঝাড়ের ভেতর কি করছেন?”
“এটা আমার প্রিয় জায়গা।”
“এই ঝোপঝাড়?”
ত্রিস্তান মৃদু হাসলো। হাতের সিগারেট-টা সেই অনেক আগে ফেলে দিয়েছে। চোখ বুজে, ঢিমানো কণ্ঠে বললো, “ঝোপঝাড় দেখেই পছন্দ। একেবারে নির্জন! কেউ দেখার নেই, শোনার নেই। কাউকে মেরে ফেললেও কেউ কিচ্ছু জানবে না।”
ত্রিস্তানের ঠোঁটের কোণের ওই সুন্দর হাসিটা অস্বাভাবিক। অটবী বিমূঢ় নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। হালকা স্বরে বললো, “আপনাকে অসুস্থ লাগছে। আপনার এখন বাসায় চলে যাওয়া উচিত।”
“ওই বাসাটায় ভয় লাগে অটবী৷ ওখানে যেতে ইচ্ছে করে না।”
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ক্লান্ত ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। আবার আলো নিভে যেতেই বাজে রকমের আঁধার। একটু আগের চাঁদের দ্যুতিটুকুও নেই। অটবী সেই অল্প আলোতেই অবাক হয়ে দেখলো, ত্রিস্তান ভয়ংকর মানুষের মতো হাসছে। চোখের গভীরে অদ্ভুত উদাসীনতা, দুঃখ, যন্ত্রণা একই সাথে ক্ষুধার্ত বাঘের হিংস্রতা। অটবী ভয় পেল। কিন্তু অতটা না, যতটা পেলে মানুষ দৌঁড়ে পালায়। সে খুব শান্ত হয়ে বসে আছে। এই ত্রিস্তানকে সে চেনে না। কিন্তু চিনতে চাইছে। আস্তে করে ডাকলো, “ত্রিস্তান?”
সাথে সাথে একটু ঝুঁকে আসলো ত্রিস্তান। চোখে চোখ রাখলো। অটবী নড়লো না। স্থির চেয়ে রইলো।
“তোমার চোখে আমি নিজেকে এত ওপরে দেখতে পাই কেন, অটবী? আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়।”
ঝড় বইছে। বৃষ্টি পরবে। ত্রিস্তান উঠে দাঁড়ালো। বড় বড় পায়ে চলে যাচ্ছে সে। একবারও অটবীর দিকে তাকায়নি।
_______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা