অটবী সুখ পর্ব ১৩

0
128

অটবী সুখ

১৩.
“Your Highness, can I buy some of your time until you get tired?”
স্নিগ্ধ একটা পরশ আশপাশে ঘুরঘুর করছে। ত্রিস্তানকে পুরোনো দিনের সুদর্শন, সুশৃঙ্খল ‘ডিউক’ কিংবা ‘নোবেল’ থেকে কম লাগছে না। একহাতে অটবীর হাত ধরে অন্যহাতটা পেছনের দিকে মুড়িয়ে রেখেছে সে। দূর্বাঘাসের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আছে। চোখ বুজে হাতের পিঠে দীর্ঘ চুমুর মুহুর্তটা বোধহয় বর্ণনা করা যাবে না। শুধু অভাব একটা রাজকীয় পোশাকের। তাহলেই হয়তো ত্রিস্তান নামক আজীবন দুঃখী ছেলেটা কোনো এক রাজ্যের সুখী রাজকুমার হয়ে যেত।
অটবী হালকা করে নিশ্বাস ফেললো। ত্রিস্তান থেকে হাতটা টেনে ছাড়িয়ে শান্ত গলায় বললো, “আমার উত্তরটা আপনার জানা, ত্রিস্তান।”
“উত্তরটা কি পাল্টাবে না বলছো?”
“হ্যাঁ।”

ত্রিস্তান আবারও পা ছড়িয়ে বসলো। স্বভাবহীন হাসিটা হাসলো আরও একবার। ঠাট্টার সুরে বললো, “সমস্যা নেই, অটবী। আমি তবুও তোমার শিক্ষক হতে রাজী আছি। আমি বুকভরা আবার দয়ামায়া! সামলে রাখতে পারিনা। অকৃতজ্ঞদের সাথেও ভুলেভালে কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে ফেলি।”

অটবী চোখ-মুখ কঠিন করে বললো, “দরকার নেই এমন শিক্ষকের। আমি আপনার থেকে কিচ্ছু শিখতে চাই না।”
“একটু আগেই না বললে ভালো থাকার উপায় শিখতে চাও?”
“একটু আগে চেয়েছিলাম। এখন চাই না।”

ত্রিস্তান ঘাসের ওপর শুয়ে পরেছে। শুয়ে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে একমনে দেখছে অটবীকে। রুঢ় মেয়েটা ওর দিকে তাকাচ্ছে না। সামনের রাস্তায় কি যেন নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কালো লম্বা চুলে মোটা বেণুনী। গোলগাল হলদেটে চেহারায় মানিয়েছে খুব। ভীষণ সাদামাটা পোশাক। এটাকেই থ্রি-পিস বলে বোধহয়। ত্রিস্তান আকাশ পানে মুখ উচিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো। ঠোঁটের সূক্ষ্ণ হাসিটা ধরে রেখে বললো, “তোমরা কি বলো তো অটবী! আমার কাছে আসতে সময় নাও, অথচ দূরে যেতে একদম সময় নাও না।”

ত্রিস্তান জবাবের অপেক্ষা করলো। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড— এক মিনিট! অটবীর জবাব পাওয়া গেল না। মেয়েটা এত নিষ্ঠুর! অনুভব করতে পারলো, ভেতরটায় একটা বিশ্রী, তেঁতো যন্ত্রণা আন্দোলন করছে। চারিদিকের মৃদুমন্দ বাতাস, হৈ-হুল্লোড়, যানবাহনের হর্ণ— প্রত্যেকটা জিনিস এত বিষাদ ঠেকছে! শরীরের শক্তি যেন নাই হয়ে গেছে। ত্রিস্তান ঘুরেফিরে আবারও অটবীর দিকে তাকালো। দৃষ্টি আবছা, ঘোলা। ঠোঁট নাড়িয়ে হালকা কণ্ঠে পৃথিবীর সবচে’ আশ্চর্যজনক প্রশ্নটা করলো, “অটবী… মৃ’ত্যু কি খুব কষ্টের? সেখানেও কি একা থাকা লাগে?”

প্রশ্নটা বুঝতে অনেক্ষণ সময় লাগলো তার। পরক্ষণেই অর্থ উদ্ধার করতেই চট করে ফিরে তাকালো। লোকটাকে স্বাভাবিক লাগছে না। একটু আগেও ভালো ছিল। অথচ এখন ঘেমেনেয়ে একাকার! কপাল বেয়ে বেয়ে ঝরছে লবণাক্ত জলকণা। বুকের উঠানামা তীব্র। নিশ্বাসের শব্দ কান ঝাঁঝিয়ে দিচ্ছে। হতবাক অটবীর দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে এলো। ত্রিস্তানের দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় আর্তনাদ করলো, “ত্রিস্তান? এমন করছেন কেন? শুনছেন আপনি? কি হয়েছে?”

ত্রিস্তান কিছু একটা বললো। অস্পষ্ট। বোঝার জন্য তার দিকে বেশ খানিকটা ঝুঁকলো অটবী।
“বাম দিকে ফোন… সরোজকে কল দাও।”

সঙ্গে সঙ্গে বাম দিকে তাকালো অটবী। এক প্যাকেট সিগারেট, লাইটার, মোবাইল ফোন, ওয়ালেট! বড্ড অবহেলায় পরে আছে সেগুলো। অটবী ঝটপট মোবাইল হাতে নিলো। কোনো ধরণের লক নেই বিধায় সহজেই ডায়াল লিস্টে গিয়ে কল লাগালো সরোজকে। সরোজ আশেপাশেই আছে। এখান থেকে সাত-আট মিনিটের রাস্তা।

“কল করেছি। এক্ষুণি চলে আসবে।”
“তুমি চলে যাও অটবী।”
“জি?” চমকিত হয়ে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো সে। লোকটার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। শুধু অস্থিরতা কমে নির্জীব হয়ে গেছে। ব্যাপারটা পূর্বের থেকেও বেশি ভয়াবহ।

“আমাকে কি অমানুষ বলে মনে হয় আপনার? আপনাকে একা রেখে কেন যাবো?”
“আমি অমানুষ, অটবী।”

ত্রিস্তান অসুস্থ! ত্রিস্তান পাগল! ত্রিস্তান আবোলতাবোল বকছে! এ তিনটা বাক্য ছাড়া আর কোনো কিছু মাথায় ঢুকছে না অটবীর। সে শক্ত হয়ে বসে আছে। যাবে না এখান থেকে। কিছুতেই না। অথচ ত্রিস্তানও নাছোড়বান্দা। পাষাণের মতো এত জোড়ে ধমকে উঠল তার ওপর! অটবীর রাগ করার কথা। নিস্তেজ ত্রিস্তানকে সেখানে একা ফেলে আসার পর সারা রাস্তা সে রেগে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। এটা কি ধরণের যন্ত্রণা? এত অসহ্য!

বাসা থেকে তুমুল ঝগড়া করে এসেছে সরোজ। আজকে কোচিংয়ে পরীক্ষা ছিল। সে যায়নি। ফলসরূপ জসিম আখতার ভীষণ রেগে ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। থাপ্পড়ও মেরেছেন বোধহয়। বাম গালটা টকটকে লাল হয়ে আছে। নলী সরোজের গোমড়া মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। বাদাম খেতে খেতে বললো, “আঙ্কেল ঠিকই করেছে। আরও মারা উচিত ছিল।”

সরোজ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “তিনটা থাপ্পড় মারছে! তোর কাছে কি কম লাগে? কই একটু আদর-টাদর করবি! আইছোস শ্বশুড়ের পিছ ধরতে!”
“বাজে কথা বলবেন নাতো। পড়ালেখা করতে হবে। ভালো চাকরি না পেলে বুবু জীবনেও আপনাকে মেনে নিবে না।”

সরোজ পাত্তা দিলো না। ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে। এসব নিয়ে এখন প্যারা নিয়ে লাভ নেই। পৃথা আজকে স্কুলে আসেনি। ধরা পরার তাই ভয় নেই। নলীকে জোড় করে অনেক কষ্টে নদীর পাড়ে নিয়ে এসেছে। টিফিন টাইম শেষ হতে দেড়ি নেই। এই অল্পটুকু সময়ে প্রেমালাপ না করে এসব ফালতু আলোচনার কোনো মানে হয়?
তৎক্ষণাৎ মুখে জ্বলজ্বলে হাসি ফুঁটালো সরোজ। নলীর বাহুতে আলতো গুটা মেরে বললো, “এইসব বাদ দে নীলিমা। ভালা কথা ক। কত্তদিন পর এমন সুন্দর জায়গায় প্রেম করার সুযোগ পাইছি! বড় রোমান্টিক রোমান্টিক ফিল আসতাছে রে!”

নলী কোণা চোখে তাকালো একবার। কটমট গলায় বললো, “আপনি ভালো হবেন না, তাই না? আপনার বাবা আপনাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। মনে হয় না দুইতিন দিনে ঢুকতে দিবে। একয়দিন কোথায় থাকবেন, কি খাবেন! এসব চিন্তায় আমারই তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আপনাকে দেখুন! কোথাকার কোন নবাবজাদা! যেন পাঁচ-ছয়টা বাড়ির মালিক। একটা থেকে বের করে দিলে অন্যটায় গিয়ে উঠবে।”

সরোজ দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
“ঠিক বলছিস। নিজের বাড়ি না থাকলেও থাকার অভাব নাই। ত্রিস্তান ভাইয়ের বাসায় বিন্দাস থাকমু। কার বাপের কি?”
“ত্রিস্তান ভাইয়া না হাসপাতালে? এখন কেমন আছেন ভাইয়া?”
“হাসপাতালে আর থাকছে কই? জ্ঞান ফিরার পরই বাসায় যাওনের লাইগা যে কি অবস্থা করছে! তয়, করা স্বাভাবিক। তনয়া বাসায় একা না?”
“কি হইছিল ভাইয়ার?”
“জানি না। ডাক্তাররে কইতে শুনছিলাম প্রেসার লো।”

নদীর পাড়ে পা ভিঁজিয়ে বসে ছিল ওরা দুজন। নলী উঠে দাঁড়ালো। হাতের অবশিষ্ট বাদামগুলো সরোজকে দিয়ে বললো, “বাকিটা আপনি খান। আমি যাই। টিফিন টাইম শেষ হতে বেশি দেড়ি নেই।”

সরোজ মন খারাপ করলো খুব। মুখে এখনো বাদাম রয়ে গেছে। সেগুলো চিবুতে চিবুতে অসম্ভব করুণ গলায় বললো, “এখনই চইলা যাবি? প্রেম তো শুরুই করলাম না।”

নলী পেছনে ফিরে বললো, “এখন প্রেম করতে হবে না। বিয়ের পরে কইরেন।”

রাত ক’টা বাজে জানা নেই। হাতে খাবারের মস্ত বড় প্লেট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে ত্রিস্তান। নিচ থেকে আওয়াজ আসছে। ধাপধুপ ধুপধাপ! বাতি জ্বালাতেই অন্ধকার রুমটা স্পষ্ট হয়ে এলো। রুক্ষ-সূক্ষ্ম, জীর্ণ শরীরের ব্যক্তিটি মাঝ বরাবর বসে হাত পায়ের শিকল খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ত্রিস্তানকে দেখা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠলো, “খাবার আনতে এত সময় লাগে? আমারে মেরে ফেলতে চাইছিস তুই? এত সহজ আমাকে মা’রা?”

ত্রিস্তান ক্লান্ত গলায় উত্তর দিলো, “ঘুমিয়ে পরেছিলাম।”

বলতে বলতে খাবারের প্লেট-টা সামনে রাখলো সে। প্লেটে বড় বড় দুটো মাছ ভাঁজা, ভাত, আলু তরকারি।
খাবারগুলো দেখা মাত্রই ঘৃণায় নজর সরিয়ে ফেললো ব্যক্তিটি। দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “এইগুলা কি আনছিস? রক্ত কই? রক্ত খাবো।”
“রক্ত নেই।”
“রক্ত নেই মানে? তুই ইচ্ছা করে দিচ্ছিস না। আমি জানি না মনে করেছিস? খাবো না এগুলা। নিয়ে যা এখান থেকে।”
“এগুলোই খেতে হবে।” ত্রিস্তানের চোয়াল শক্ত। চোখে মুখে দারুণ কাঠিন্যতা। বোঝা গেল, আজকে সে কিছুতেই রক্ত খেতে দিবে না। মুহুর্তেই ব্যক্তিটি অধৈর্য হয়ে গেল। মেঝে থেকে খাবারের প্লেট উঠিয়ে ছুঁড়ে মারলো ত্রিস্তানের বুকে। কিন্তু এতেও যেন তৃপ্তি মেলেনি। তেঁড়ে এসে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে লাগলো ত্রিস্তানের গাল, হাতের চামড়া। অনবরত পাগলের ন্যায় চিৎকার করতে লাগলো, “তুই ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছি। তুইও আমাকে মেরে ফেলতে চাস। আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবি না তোরা। অভিশাপ তুই! আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ!”

নখের ধারালো আঁচড়ে বিষাক্ত যন্ত্রণা অনুভব করলেও মনের ব্যথা থেকে এই ক্ষত যেন খুবই নগণ্য। ত্রিস্তান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। টু শব্দটিও করলো না। নিশ্চল চোখজোড়া স্থির চেয়ে রইলো সামনের মানুষটার পানে।

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here