অটবী সুখ পর্ব ১২

0
130

অটবী সুখ

১২.
একফালি রোদ্দুর চোখে এসে পরছে। সারা মাথায় টনটনে ব্যথা। চোখদুটো মেলতে গিয়ে বুঝতে পারলো, আঁখিপল্লব ভারী হয়ে আছে। সরাসরি তাকাতে পারছে না। আশপাশ ভীষণ অস্পষ্ট। নিজেকে সামলাতে ক্ষীণ সময় নিলো ত্রিস্তান। কালরাতে অনেক দেড়ি করে রুমে এসেছিল। ততক্ষণে তনয়া গভীর ঘুমে মশগুল। সরোজও বাসায় ফিরেনি। ড্রইংরুমের সোফায় এখনো হয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটা অনেক সরল-সোজা। ত্রিস্তান কি করে না করে, সেসব না জেনেই তাকে সাহায্য করছে। অবশ্য, জানলে হয়তো কখনো ত্রিস্তান মুখো হতো না।

“ভাইয়া, তোমার চোখ এত লাল কেন?”

ত্রিস্তান চমকালো। থমকানো দৃষ্টে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো, তনয়া মেঝেতে বসে আছে। দুটো হাত, থুতনি রয়েসয়ে বিছানার ওপর ঠেকানো। মায়াবী একজোড়া নয়ন ড্যাবড্যাবিয়ে ওকে দেখছে। ত্রিস্তান বার কয়েক পলক ফেলে চোখের দূর্বলতা ঢাকতে চাইলো। কপাল কুঁচকে ভরাট গলায় বললো, “তুই এত সকালে আমার রুমে কি করছিস?”
“তুমি কোন দুনিয়ায় আছো? সকাল তো সেই কবেএএ শেষ! আমার ক্ষুধা লেগেছে। পেটের ইঁদুরগুলো একটু পর আমার পেট ফুঁটা করে দিবে। তুমি নাস্তা বানাবা কখন?”

ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। নগ্ন পেটানো শরীরে জড়িয়ে নিলো কালো রঙা টি-শার্ট। কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো, “তোর সরোজ ভাইয়া কোথায়? চলে গেছে?”
“নাহ্। সোফায়। ঘুমায়। অনেক্ষণ ধরে ডাকছি, উঠে না।”
“জগে পানি আছে না? ওর মুখে ঢেলে দে। উঠে যাবে।”
“সত্যি মুখে ঢালবো?” তনয়া অবুজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
মায়ের মতো দেখতে মেয়েটার দিকে তাকালেই বুকের ভেতরটা শীতলতায় মিইয়ে যায় ত্রিস্তানের। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগে সে মৃদু গলায় অনুমতির সুরে বলে, “চাইলে লাথিও মারতে পারিস।”

রান্নাঘরের অবস্থা নাজেহাল। চায়ের কৌটা উদলা হয়ে পরে আছে। চুলার ওপর এঠো কেতলি, চামচ। ঢাকনাটাতেও ময়লা লেগে আছে। ত্রিস্তান তিক্ত নিশ্বাস ফেললো। নিশ্চিৎ সরোজের কাজ এটা। রাতে চা বানাতে গিয়ে এমন অবস্থা করেছে। সে এঠো জিনিসগুলো দক্ষ হাতে ধুঁয়ে নিলো। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে বেশির ভাগ সময় রান্নাঘরের দিকটা বাবা সামলাতেন। ত্রিস্তানও টুকিটাকি সাহায্য করতো। মা অসুস্থ থাকতেন সারাবছর। সে সুবাধে স্কুলে পড়ুয়া অবস্থাতেই রান্নাবান্নায় ভীষণ পটু হয়ে গেছে ত্রিস্তান।

হঠাৎ! সূক্ষ্ণ একটা চিৎকার এসে বারি খেল দেওয়ালে। সরোজের চিৎকার। ত্রিস্তানের নাস্তা বানানো ততক্ষণে শেষ। কাপে চা ঢেলে আস্তে ধীরে ডাইনিংটেবিলের ওপর খাবার রাখলো সে। চেয়ার টেনে বসলো। সরোজ ভিঁজে একাকার হয়ে আছে। পরনে ভেঁজা প্যান্ট আর গায়ে পাতলা গামছা জড়িয়ে কাতর দৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকেই। ত্রিস্তান তাকাতেই প্রায় কেঁদে ফেলার মতো করে বললো, “ভাই! ও ভাই! সক্কাল সক্কাল তোমার বোন কামডা কি করছে দেখছো? ঘুমাইতে ছিলাম, মুখের উপর পানি ঢাইলা দিলো! তুমি এর একটা বিচার করো।”

ত্রিস্তান প্রথমেই কিছু বললো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। অনেকদিন চুল কাটা হয়না। মাথার একগুচ্ছ চুল বারবার চোখ ঢেকে ফেলছে।

“আমি তো তনয়াকে আরও একঘণ্টা আগে পানি ঢালতে বলেছিলাম। তোর ভাগ্য ভালো, ও আরেকটু ঘুমাতে দিয়েছে তোকে।”

“ভাই! তুমি এমনটা করতে পারলা?”
“পারছি। এখন বেশি কথা না বলে খেতে আয়।” সরোজ চেহারা কুঁচকে ত্রিস্তানের মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। আবহাওয়া অতটা ঠান্ডা না। কিন্তু তবুও তার শীত শীত লাগছে। ঝটপট গরম গরম চায়ের কাপে হামলে পরতে পারলেই বাঁচে!
ত্রিস্তান সময় নিয়ে প্রশ্ন করে, “তনয়া কই? ওকে দেখছি না কেন?”

সরোজ হাভাতের মতো পরোটা দিয়ে চা খাচ্ছে। অনেকটা সেভাবেই বললো, “তোমার বোন যে বিটকেল! পানি ছুঁইড়াই দৌঁড়! বকারও সুযোগ দে নাই।”

অর্ধেক পরোটা রয়ে গেছে। আর খেতে ইচ্ছে করছে না। ত্রিস্তান তনয়ার জন্য দুটো পরোটা প্লেটে আলাদা করে রাখলো। থমথমে গলায় বললো, “খাওয়া শেষে চলে যাবি। আঙ্কেল ফোন করেছিল। তোর নাকি দুপুরে কোচিং আছে?”
“তোমার মনে হয় আমি কোচিং-এ যামু?”
“তুই কয়বার ম্যাট্রিক ফেল করেছিস যেন?”

সরোজ মিনমিনিয়ে বললো, “একবারই তো ফেল করছি। এমন করো ক্যান?”
“এবারও ফেল করবি। তোর কপালে লেখা আছে।”

সরোজ সে কথায় কান দিলো না। আয়েশ করে পরোটার টুকরা চায়ে ভিঁজিয়ে মুখে পুরে নিলো। সুধালো, “ভাই, তুমি রক্ত দিয়া কি করো?”
ত্রিস্তান চমকে তাকালো ঠিক কিন্তু পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। হিম শীতল গলায় বললো, “খাই।”
অথচ সত্যটা সরোজ একেবারেই বিশ্বাস করলো না, “ধুর! রক্ত আবার খাওয়া যায় নাকি? কি করো আসলে কও তো। ওই দোকানের ব্যাটাও দেখলাম তোমার কথা শুইনা কেমন ভয় পাইয়া গেল।”

দোকানি ত্রিস্তানকে দু’কারণে ভয় পায়। এক. ইভটিজিং করায় একবার রাস্তায় পিটিয়েছিল বলে। আর দ্বিতীয় কারণটা অবচেতন মনের ভয়।
ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “বিশেষ কিছু না। এক্সপেরিমেন্ট করি।”
“কি এক্সপেরিমেন্ট?”
“আরেকটু বড় হ, তারপর বলবো।”

সরোজের আগ্রহী মন দমলো না। খেতে খেতে সে জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। সে অপেক্ষা করবে। সামনে বসে থাকা ত্রিস্তান দমবন্ধ করে চেয়ে রইলো শুধু। মনে মনে হাসলো খুব। সরোজের ওপর না। নিজের ওপর। ভাবলো, বোকা মানুষগুলো তার পাল্লাতেই পরে কেন? সে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতক, খারাপ, মিথ্যুক। ভাবুক হওয়ার ভান ধরে থাকে। এসব মানুষগুলো যখন তার আসল সত্য জানবে, তখন কি করবে এরা? ত্রিস্তান চায় না ওরা কিছু জানুক। একদমই চায় না। যাদের চোখে সে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে পায়, তাদের চোখের ঘৃণা কিভাবে সহ্য করবে? আদৌ পারবে সহ্য করতে? ত্রিস্তান জানে, সে পারবে না।

গুটিকয়েক চড়ুই তারে বসে আছে। বাতাসে উত্তাপ নেই। তবুও হাঁসফাঁস লাগছে। কাঁধের ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সময়টা দেখে নিলো অটবী। পাঁচটা দশ বাজছে। আজকে একটা টিউশন করাতে পারেনি। ছাত্র বেড়াতে গেছে। অথচ অটবীকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধও করেনি। অতদূর হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দেখে দরজায় তালা ঝুলানো।
অটবীর বুকের ভেতরটা গুমট অনুভূতিতে চুপসে আছে। ক্লান্ত শরীর ঘেমে একাকার। ওইতো, রাস্তার একপাশে ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। ভাবলেশহীন লোকটা এখনো নির্লিপ্ত। অনায়াসে হাত পা ছড়িয়ে ফুটপাতের দূর্বাঘসে শুয়ে আছে। অটবী কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলো। শক্ত হাতে কাঁধের ব্যাগ সামলে গটগট পায়ে এগলো। নিঃশব্দে বসলো ত্রিস্তানের পাশে। ত্রিস্তান ওকে দেখে হাসলো অল্প। একদম ক্ষীণ। উঠে বসতে বসতে বললো, “অভাগার দুয়ারে এসেছ যে? তোমাকে দেওয়ার মতো কিছু আমার কাছে নেই।”
“আমি আপনার কাছে এসেছি, কে বললো?”

মেয়েটার চোখের তীক্ষ্ণটা সরাসরি বুকে বিঁধছে। ত্রিস্তান অকারণেই আবার হাসলো। বললো, “তাহলে আমার পাশে বসেছ কেন?”
অটবী আনমনা হলো। সুবজ ঘাসের মাঝে একদুটা হলুদ ঘাসেরা উঁকি দিচ্ছে। একটা একটা করে হলুদ ঘাসগুলো ছিঁড়ে সে মৃদু স্বরে বললো, “দেখছিলাম, এত দায়িত্বের ভারেও আপনি কেন নুইয়ে পরছেন না। হাসছেন, ঘুরছেন, ফুর্তি করছেন। হয়তো লোকদেখানো। কিন্তু তবুও… আমি কেন পারি না?”

ত্রিস্তান আজ বড্ড বেশিই হাসছে। সচরাচর তাকে হাসতে দেখা যায় না। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে সর্বদাই শীতলতা লুকোচুরি খেলে। বাদামী চোখদুটো কালো অধ্যায় যেন। অঘোষিত আইনের এলোমেলো চুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে থাকা নোনতা পানিগুলো ক্লান্তির সূক্ষ্ণ প্রকাশ। ত্রিস্তান চোখেচোখ রাখলো। অন্যরকম দৃষ্টি। চঞ্চল। প্রশ্ন করলো, “শিখতে চাও?”

অটবী চোখ সরালো না। ত্রিস্তানের মতো করে জানতে চাইলো, “কি?”
“কিভাবে ভালো থাকতে হয়।”
অটবীও হাসলো এবার, “চাই।”
“কিন্তু তার বিনিময়ে আমাকে কিছু দিতে হবে।”
“কি দিতে হবে?”

অটবীর চাহনি পাল্টালো। কঠোরতায় ডুবুডুবু হতেই ওর দিকে ঝুকলো ত্রিস্তান। চট করে একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো পিঠে। ফিসফিসিয়ে বললো, “Your Highness, can I buy some of your time until you get tired?”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here