“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন” পর্ব- ৭

0
500

“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
সাদাফ খাটের একপাশে বসে আছে। দিশা তার ঠিক সামনেই, রুমের ফাঁকা জায়গাটার মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি ভাবতেও পারিনি আজ আপনি আসবেন। তবে খুশি হয়েছি বেশ। হঠাৎ কি কারণে এসেছেন জানতে পারি? না মানে বাবার কাছেই এসেছেন নাকি আমার বিয়ের উদ্দেশ্যে আসা?”
“আপনার বাবার কাছে এসেছি।”
“ওহ্। আমি কিন্তু আপনাকে দেখে একটু চমকেও গিয়েছিলাম। সত্যি সত্যিই আমাকে নিয়ে পালানোর জন্য এসময়টাতে আসেননি তো আপনি, সেই ভেবে!”
সাদাফ সামান্য বিরক্তি নিয়ে তাকালে দিশা হেসে বললো,
“মজা করলাম। আপনি চাইলেও আমি যাবো না। যাওয়ার হলে আরও আগেই চলে যেতাম, একটু আশ্রয়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতাম আপনার আশ্রয়স্থলে। আর আপনি যে চাইবেনও না তাও জানি। আপনার মাঝে যে কোনো ইন্টারেস্ট নেই, সেটাও আমার বেশ ভালো জানা আছে।”
কাজের মেয়েটা বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে প্রবেশ করলো রুমে। সাদাফ তা দেখেই বললো,
“আমি এখানে খেতে আসিনি। আপনার বাবাকে কোথায় পাওয়া যাবে?”
“এতো ব্যস্ততা কেন? না খায়িয়ে ছাড়বো নাকি! খেয়ে যেতে হবে।”
সাদাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনার বাবা কি নিচতলায়ই আছে?”
দিশা হকচকিয়ে বললো,
“আরে বসুন না। বাবা আসছে তো। আমি কল করছি আবার।”
দিশা ফোন কানে দিতেই সাদাফ বসে পড়লো। অপর প্রান্তে রিসিভ হতেই বললো,
“বাবা, তুমি কোথায়? তোমার কাছে একজন লোক এসেছে। ওইতো, সাদাফ নামের লোকটা। আচ্ছা, তারাতাড়ি এসো। আমার রুমে বসিয়েছি।”
তার কথার ধরনে সাদাফ বুঝে নিলো মেয়েটা তখন কলই করেনি তার বাবাকে। এই মাত্র জানালো সে যে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হায়দার সাহেব মেয়ের রুমে এসে তাকে দেখে যেন একটু বিস্মিতই হলো। তিনি রুমে প্রবেশ করতে করতে বললেন,
“কি ব্যাপার, এখন হঠাৎ?”
“আপনাকে না কাগজপত্রগুলো পাঠিয়ে দিতে বললাম।”
“বাড়িতে একটা কাজ এখন। এসব ঝামেলা একটু পরে করলে হয় না!”
“এই কাজটাও জরুরি। আমি কাজ ছেড়ে দিলে কিন্তু আর ধরবো না।”
“আরে, অনুষ্ঠান শেষ হোক। তারপর ঠান্ডা মাথায় কাজ করি।”
“আমার মাথা ঠান্ডাই আছে। আপনি কাগজপত্র দিয়ে দিলেই আমি কাজটা সেড়ে ফেলতে পারি। আপনার আর বিশেষ কোনো কাজ নেই। অনুষ্ঠান শেষ হতে বহু দেরি। এক কাজ নিয়ে মাসের পর মাস বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি কাগজপত্র দিয়ে দিন এখন।”
“এখনই দিতে হবে?”
“বারবার তো আসবো না।”
“বসো, আসছি।”
দিশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো সাদাফের কথার কত জোর যেটা তার বাবার মতো মানুষও ঝামেলা মনে করলো না। অথচ সামান্য কাজের ব্যাঘাতেই তিনি কতই না রেগে উঠেন! সে সাদাফের উদ্দেশ্যে বললো,
“বাবা কাগজপত্র নিয়ে ফিরতে ফিরতে আপনি খাওয়া শেষ করুন। বাথরুমে হাত ধুয়ে আসুন।”
সাদাফ কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করলো না। দুহাত মুঠিবদ্ধ করে দরজার বাইরে তাকিয়ে রইলো নিশ্চুপ। কতই না বিরক্তি খেলামেলা করছে তার চেহারায়! দিশাও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। হায়দার সাহেব ফিরতেই সাদাফ দাঁড়িয়ে কাগজপত্র হাতে নিয়ে একবার দেখে নিলো। দিশা আবারও বললো,
“এবার তো খেয়ে নিন।”
“আসছি আমি।”
হায়দারের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে সাদাফ বেরিয়ে যাচ্ছে। হায়দার সাহেবও বললেন,
“সে কি! খাওয়াদাওয়া করে যাও।”
“খেতে আসিনি।”
যেতেই যেতেই কথা বলে চলে গেলো সে। একবার ভাবলো না পর্যন্ত এতোক্ষণ যাবত খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিশার কতটা কষ্ট হতে পারে খাবারকে এভাবে ইগনোর করার কারণে! বিয়ের কনে হয়ে সে নিজে এসে দাঁড়িয়েছিলো, তা-ও সুযোগটাই পেলো না মেহমানদারি করার!
সাদাফ বিয়েতে আর যায়নি। তার কাজ পড়ে আছে, বিয়ের প্রোগ্রাম তার জরুরি না। তার কাছে আপাতত জরুরি বিষয় হলো যেই কাজ হাতে নিয়েছে তা সম্পন্ন করা। একবেলা খাওয়ার জন্য সেখানে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই তার মাঝে। টাকা হলে এমন কত বেলাই খাওয়া যায়। আর আতিথেয়তা রক্ষা করা? সে তো মূল্যহীন বিষয়বস্তু এই উদাসীন লোকটার কাছে।
তিন সপ্তাহের ভেতরে সাদাফ এই কাজ সেড়ে উঠেছে। হায়দারের কাছ থেকে টাকাও পেয়েছে হাজার দশেক। কিন্তু রাজীব সরকার একটু চালাকি করতে চেয়েছে তার সাথে। জমি বিক্রির টাকা নিয়ে সে উধাও প্রায়। দোকানপাটেও দেখা যায় না, তার ঠিকানা খুঁজে বাড়িতে খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায় না। পরিবারের সদস্য জানায় সে কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেছে। অথচ পথে একজনের কাছে জেনেছে সে ঢাকাতেই আছে। তবে টাকার জন্য সাদাফ বারবার যায়নি তার দুয়ারে। সপ্তাহখানেক পর হঠাৎ এক রাতে তার বাড়ি এসে হাজির হয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ। সে দরজায় টোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কে তা জানতে ভেতর থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো কেউ। সাদাফ জবাব দিলো না। দরজায় টোকা দিয়েই যাচ্ছে। রাজীব সরকার দরজা খুলে তাকে দেখে হতবাক হয়ে গেছে! সাদাফ পকেট থেকে সিগারেট নিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বললো,
“ঢাকায় ফিরলেন কবে?”
রাজীব সরকার দাঁতের পাটি বের করে হেসে বললো,
“এইতো, আজকেই তো ফিরলাম।”
“কিন্তু পরশুও যে আপনাকে ঢাকার পথে দেখা গেছে! সে যাক, আমার টাকা দিবেন কখন?”
বলতে বলতে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নিলো। রাজীব সরকার ইতস্তত বোধ করে বললেন,
“টাকা তো দিমুই। বাড়ির কাজ ধরমু, কয়দিন পরে দিলে হয় না?”
“কাজ শেষ করার সময় এতো তাড়া, টাকার বেলায় কয়দিন পরে কেন?”
“একটু সমস্যায় আছি, বুঝোই তো!”
“টাকা হাতে নিয়েও সমস্যায় আছেন বলছেন, কদিন পর কি কলিজা খুড়ে এনে দিবেন? এখন কি আপনি দিবেন, না আমি নিজ হাতে নিয়ে যাবো?”
সাদাফের এই কঠিন দৃষ্টিকে উপেক্ষা করার সাহস হয়নি রাজীব সরকারের। বরং ভয় পেয়ে গেছে তাই তাকে দাঁড়াতে বলে ঝটপট টাকা আনতে ভেতরে চলে গেলো। আবার দরজার সামনে এসে টাকা এগিয়ে ধরতেই সাদাফ জিজ্ঞেস করলো,
“কত?”
“পুরো বিশ হাজার।”
“পুরো পঁচিশ হাজার চাই আমার।”
“কিন্তু…”
“এক পয়সাও নামবে না কিন্তুতে।”
অবশেষে পঁচিশ হাজার হাতে তুলে দিতেই সাদাফ চলে এসেছে তার বাড়ির সীমানা ছেড়ে। কোনোই লাভ হলো না ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। এদিকে শ্রাবণ অপেক্ষায় বসে আছে তার বাড়ি ফেরার। ক্ষুধা লেগেছে তা-ও খায়নি সে। লোকটাকে আগে খাবার দিয়ে তারপরই খাবে সে। দিনে দিনে লোকটার প্রতি টান টান অনুভব হতে শুরু করেছে তার। মায়াটা বেড়ে যাচ্ছে বেশ। সাদাফ নিম্নতম তিন বেলা বাড়ি না এলেই একটু দুশ্চিন্তা চেপে যায় মাথার মধ্যে। কখনো বাইরে খেয়ে নিলে তার মনটা খারাপ হয় কিছুটা। মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরলে ভয়ের চেয়ে কষ্টই হয় বেশি। ভাবে, লোকটা মাদক সেবন করে কেন? তার মনে কি খুব দুঃখ নাকি স্বভাবের কারণেই এসব? মাঝে মাঝে রাতে তারাতাড়ি ফিরলে খুশি হয় সে। মধ্যরাতে ফিরলে অপেক্ষায় বসে থাকে। তাকে খাবার দিয়ে পরেই খায়। আজও অপেক্ষায় বসে আছে। বারোটার পরপরই সাদাফ বাড়ি এলে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হাতমুখ ধুয়ে নিতেই সে খাবার নিয়ে সাদাফের রুমে গেলো। সাদাফ একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা নিয়ে এসেছি। দেখো তো, ভালো হয়েছে কি না?”
শ্রাবণ উৎফুল্ল নিয়ে শপিং ব্যাগ খুলতে খুলতে বললো,
“কি এটা?”
সাদাফের আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হলো না। সে স্বচক্ষেই দেখে নিলো বেড কভার নিয়ে এসেছে সাদাফ সাথে দুইটা বালিশের কভার। সাদাফ বললো,
“ডিজাইনটা আর রঙটা কেমন?”
“ভালো। কিন্তু আপনার বালিশ তো একটা তা-ও কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেছে। সেই বালিশে কি কভারগুলো শোভা পাবে!”
“পাবে না? তাহলে বালিশও কিনে আনবো।”
“তোমার জন্য একটা ছোট তোশকের অর্ডার করে দিবো। মাদুরের উপর বিছিয়ে নিবে।”
শ্রাবণ খুশি হয়ে বললো,
“তাহলে সাথে একটা বালিশও।”
“আমি নতুন বালিশ আনলে তুমি এইটা নিয়ে যেয়ো।”
মুহুর্তেই শ্রাবণের খুশিটা মলিনতায় মিলিয়ে গেলো। যে একটা বালিশ এইটা, এটাকে বালিশের কাতারে ফেলাও মুর্খতা হবে। সাদাফ তার মুখের দিকে তাকিয়ে নেই। খাবারে মনযোগ দিয়ে বললো,
“তোমার বেতনটা কাল দিয়ে দিবো।”
শ্রাবণ নিশ্চুপ বেরিয়ে গেলো। মনে মনে সাদাফকে খচ্চর লোক বললো এই পুরাতন বালিশটা দেওয়ার কথা বলায়। মনে মনে স্থির করলো, লাগবে না তার বালিশ। বেতন পেলে একটা নতুন বালিশই কিনে নিবে সে। পরক্ষণে আবার হেসেও উঠলো নিজের প্রতি। সাদাফ যখন শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়েছিলো, সে ভেবে নিয়েছে তার জন্য বুঝি পোশাক এনেছে। কিন্তু পোশাকের পরিবর্তে সেখানে বেড কভার দেখে হেসে মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো তার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here