“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
“কি কাজ?”
“আমার সাথে একটু শপিংমলে যেতে পারবেন?”
“শপিংমলে আমার কি কাজ?”
“গেলেই তো দেখবেন। আপনার সময় হবে কি না সেটা বলেন।”
“কোন মলে?”
দিশা রিকশায় একপাশে চেপে বসতে বসতে বললো,
“রূপসা টাওয়ারে।”
সাদাফ বিনা সংকোচে, বিনা দ্বিধায় রিকশায় উঠে বসলো। ধনী ঘরের মেয়ের পাশে বসতে তার বিবেক একটুও বাঁকা মোড় নিলো না। শুধু দিশা মেয়েটা বলে নয়, যেকোনো নারী পুরুষের কাছ ঘেঁষতেই যেন তার কোনো সংকোচ নেই। হোক সে ধনী কিংবা গরীব, পুরুষ কিংবা মেয়েলোক। তবে দিশা মেয়েটার একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। হবেই না কেন, অপরিচিত পুরুষলোক তারউপর সাদাফের বেশের যে অবস্থা, দাম্ভিক ধনী লোকেরা হয়তো নাক ছিটকাবে। তাছাড়া কিঞ্চিৎ ভয়ংকর ভাবও ভাসে তার চেহারায়। কিন্তু দিশা মেয়েটা তার বেশের উপর নাক ছিটকাচ্ছে না মোটেও। তার অস্বস্তির কারণ পাশে বসা অপরিচিত পুরুষ ও চেহারায় ফুটে উঠা সামান্য ভয়ংকর রূপ। সাদাফ সিগারেট মুখে তুলে লাইটার জ্বালাতে লাগলে দিশা বললো,
“এখন ওটা জ্বালাবেন না প্লিজ। আমার গন্ধ সহ্য হয় না।”
সাদাফ সিগারেট মুখ থেকে নামিয়ে রেখে দিলো পকেটে। রিকশা বাড়ি থেকে কিছুটা পথ এগিয়ে এলে দিশা বললো,
“বাবা আপনাকে দাওয়াত করেননি?”
“কিসের দাওয়াত?”
দিশা তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো রইলো সামনের দিকে। তার মুখে জবাব ফুটলো মিনিটখানেক পর। সে আবারও সাদাফের মুখপানে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কি একটুও বুঝতে পারেন, আমি যে আপনাকে পছন্দ করি?”
সাদাফ কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে তাকালো তার দিকে। দিশা আবার বলতে লাগলো,
“যখনই আপনি আমাদের বাসায় যান, তখনই আমি আপনাকে দেখি। কখনো সন্দেহের বশে দেখি, কখনো মায়ার জালে আটকে ফেলে দেখি। আপনি কেমন যেন অগোছালো। আপনাকে দেখলে বড্ড মায়া হয়। ইচ্ছে করে নিজ হাতে সবটা গুছিয়ে দেই। আপনি কি জানেন, আপনার সেই ভয়ংকর মুখটাতেও এক টুকরো মায়া কাজ করে? আমি আপনাকে তেমনভাবে পছন্দ করি না, মানে ভালোবাসি না। আপনার সম্পর্কে জানিও না এতোটা। তবে আপনার মায়ায় পড়ে গেছি। আপনাকে দেখলে ভয়ও হয় আবার মায়াও হয়। কেন বলতে পারেন?”
সাদাফ নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে। যেন ভাবছে এর উত্তর কি দেওয়া যায়। তার মনে তো কখনোই বাস করেনি এই মেয়েটা। তাহলে তাকে আর কি উত্তর দিবে সে? দিশা আবার বলতে লাগলো,
“আপনি হয়তো কোনোদিন আমাকে দেখেনওনি ঠিকমতো, ভাবেনও নি কোনোকিছু। তাই এখন ভাবছেন। আমিও কেমন পাগলের প্রলাপন করে যাচ্ছি। আর ভাবতে হবে না। এখন এতো ভেবে কি করবেন। চাইবেন নাকি কখনো আমাকে?”
সাদাফ নির্বোধের মতো উত্তর দিয়ে বসলো,
“না।”
দিশা মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকালো। এটা আসলে সুখের হাসি না দুঃখের হাসি সেটা পর্যন্ত বুঝতে চেষ্টা করলো না সাদাফ। তার কথা হলো সে কেন অযথা চাইতে যাবে তাকে? তাকে তো কোনো প্রয়োজন নেই তার। না কখনো পরেছে সংসারের মায়ায়, আর না কখনো বেঁধেছে সংসার গড়ার স্বপ্ন! মিনিটখানেক নিরব থেকে দিশা আবার বললো,
“আগামী সপ্তাহের সোমবার আমার বিয়ে। আপনি আসবেন আশাকরি। বাবা বলেনি এ ব্যাপারে কিছু, তাই না?”
“না।”
“আমি তো বলে দিলাম। আপনি আসবেন।”
“চেষ্টা করবো। দাওয়াত কি আমার একার?”
“আমার জানামতে আপনার পরিবারের কেউ নেই। থাকলে তাদেরও নিয়ে আসবেন। আপত্তি নেই। সবারই দাওয়াত।”
“পরিবারের কেউ নেই, তবে একটা মেয়ে আছে আমার আশ্রয়স্থলে।”
দিশা ব্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,
“মেয়ে! মেয়ে কেন?”
“থাকার জায়গার অভাব পড়েছে তাই আশ্রয় নিয়েছে। টুকটাক কাজ করে দেয়।”
“ওহ্, সবটা দেয় না। না?”
সাদাফ তার মুখপানে তাকালে সে মুখে সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সবাইকেই আশ্রয় দেন দেখছি। আমি গেলে কি আমাকেও দিতেন?”
সাদাফ এখনও তাকিয়েই আছে। দিশা তাই মুচকি হেসে বললো,
“চিন্তা করবেন না। আমি যাবো না আপনার কাছে আশ্রয় চাইতে। ভালো একটা পরিবার খুঁজে বের করেছে আমার বাবা। মেবি সেখানে সুখেই থাকবো বেশ। ছেলেটাও সবদিক থেকেই বেশ। হয়তোবা খুব বেশি মায়াও জন্মাবে তার জন্য। যতই হোক, স্বামীর স্থানটা নিয়ে যাচ্ছে যে। কিন্তু ক্ষুদ্র হোক কিংবা বৃহৎ, আপনার প্রতি জন্মানো মায়াটা আর কারো পক্ষেই জন্মাবে না নিশ্চিত।”
“আপনি কি বিয়েতে রাজি না?”
“কেন? রাজি না হলে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন বুঝি?”
“আমি কেন পালাবো! আপনি কি পালিয়ে যেতে চান?”
দিশা হেসে বললো,
“নাহ। সে কি আর হয়। এতো সুন্দর জীবনের মুখ থেকে ফিরে আসবো কিসের প্রত্যাশায়, বলুন?”
“সে-ই ভালো। সুখে থাকুন।”
সাদাফের আবেগহীন কথায় দিশা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বললো,
“আপনি তো এদিকেই থাকেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, ভেতরের রাস্তায়।”
“আচ্ছা, তাহলে আপনি যান। আপনাকে দিয়ে কোনো কাজ করানোর জন্য না, বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার জন্যই এসেছিলাম। আসবেন কিন্তু বিয়েতে। বাবাকে বলবো তিনি যেনো আবার দাওয়াত করেন। আর শুনুন, নারী জাতকে সম্মান দিতে জানলে মেয়েটাকে নিয়ে এভাবে না থেকে বিয়ে করে নিন। আশ্রয় চেয়েছে, কলঙ্ক তো চায় নি।”
সাদাফ রিকশা থেকে নামতেই রিকশাওয়ালাকে বাড়ির দিকে যেতে নির্দেশ করলো সে। দিশা কি বুঝে কি বলে গেলো, তার কিছুই বুঝতে পারলো না সাদাফ। এমনকি বুঝতেও চায় না এতোসব। সে সিগারেট জ্বালিয়ে ভাবনাহীন হাটতে লাগলো নিজের গন্তব্যের দিকে। বাড়ি যাওয়ার আগে সে বাজারে যাবে। কি কি কিনবে সেগুলোরই লিস্ট করছে মনে মনে। সন্ধ্যার পর সে রিকশা নিয়ে বাড়ির সামনে এলো। কথাবার্তা শুনে শ্রাবণ দরজা খুলে দেখলো রিকশাওয়ালা মাথায় চালের বস্তা নিয়ে ঢুকছে গেইট দিয়ে। পিছু পিছু সাদাফ এসে রিকশাওয়ালাকে শ্রাবণের রুমটা দেখিয়ে দিলো। কারণ এই রুমটায় কোনো আসবাব নেই বিধায় যথেষ্ট জায়গা আছে। শ্রাবণ একপাশে সরে দাঁড়ালো। সাদাফ এগিয়ে এসে আরও দুইটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলো হাতে। ব্যাগে দুইটা মেলামাইনের প্লেটসহ তেল মশলা কাঁচাবাজার সবই আছে। সাদাফ রিকশাওয়ালাকে বিদায় করে নিজের রুমে এলো। শার্ট খুলে হাতমুখ ধুয়ে আবার নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়েও শ্রাবণের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“শ্রাবণ, আরও কিছু বাকি পড়ে আছে?”
শ্রাবণ ব্যাগ দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপাতত নেই।”
“ও, তাহলে লাইনে আছে। না? কত টাকা খরচ হয়েছে ভাবতে পারছো? একজনের পিছুই যদি এতো কিছু লাগে তবে বউ বাচ্চা নিয়ে মানুষ চলে কি করে!”
কথার পরপরই সাদাফ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। এদিকে শ্রাবণ বিড়বিড় করতে লাগলো,
“একজন আর দশজন কি? মানুষের প্রয়োজনের কি শেষ আছে! একজনের জন্যও রান্না করতে হয়, দশ জনের জন্যও করতেই হয়। শুধু পরিমাণে না কমবেশি।”
পরবর্তীতে সে সাদাফের রুমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসতেই দেখলো সাদাফ আবার দেহে শার্ট চাপিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“এখন ভাত খাবেন?”
“না। একটু পরে।”
কথার সাথে সাথে সে গেইটের বাইরে চলে গেলো। দরজায় তালাও দেয়নি। শ্রাবণ ভেবেছে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবে। কিন্তু সময় যাচ্ছে, রাতের গভীরতা বাড়ছে। অথচ লোকটার খবর নেই। অনেক্ক্ষণ ক্ষুধা নিয়ে বসে থেকে সে আর সহ্য করতে না পেরে সাদাফের খাবার আলাদা করে রেখে নিজে খেয়ে নিয়েছে। খাওয়ার পর সাদাফের খাবার তার রুমে এসে রেখে গেছে। হাতের কাছে ঘড়ি নেই তবে অনুমান করতে পারছে সময় বারোটার কম হবে না। লোকটা এতো রাত পর্যন্ত বাইরে কেন থাকে? এদিকে ঘরবাড়ি তুলে নিয়ে গেলেও তো তার খোঁজ থাকবে না! রুমে তালাও ঝুলায়নি যে সে একটু নিশ্চিন্তে বসে থাকবে নিজের রুমে। বারবার মনভরা ভয় নিয়ে দরজা খুলে দেখছে সাদাফ এসেছে কি-না। একটু আধটু শব্দ পেলেই বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠে চোর ডাকাত এসেছে কি না! মনে সাহস জুগিয়ে আবার উঁকি দিয়ে দেখে দ্রুত দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে আসে। গতরাতের মতো আজও মধ্যরাতে এসেছে সে। আজ আর ঘুমাতে পারেনি শ্রাবণ। কেননা আজ সে জানতো সাদাফ ঘরে নেই৷ এই ঘর পাহাড়া দেওয়ার জন্যই তার ঘুমের বারোটা বাজাতে হলো! দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নিজের রুমের দরজা খুলে যে একটু উঁকি দিবে, এখন সেই সাহসটুকুও হচ্ছে না! বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়েই চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে? কে এখানে?”