“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নাস্তা করে বের হয়ে দাবা ঘরের দিকে যাচ্ছিলো সাদাফ। পথে চায়ের দোকান থেকে ডাকলো রাজীব সরকার। তার গ্রামের বাড়ির একটা মামলার কথা জানিয়েছিলো দু’সপ্তাহ আগে। শহুরে কোনো পার্টির কাছে ভালো দামে বিক্রি করতে চান তিনি। সাদাফকে বলেছে একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কাজের প্রতি অনিহা থাকায় সে অগ্রসর হয়নি সেদিকে৷ আজ আবার নিশ্চয়ই তাগাদা দেওয়ার জন্য ডাকছে। সাদাফ এগিয়ে এলো দোকানের পাশে। রাজীব সরকার তাকে ডাকার জন্য বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলো। এখন আবার বসে দোকানদার ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললো,
“দুই কাপ চা দে তো।”
সাদাফ বললো,
“চা খাবো না। কি দরকার, বলুন?”
“আরে, বহো মিয়া। দরকার বলার জন্যই তো ডাকলাম।”
সাদাফ বসতেই তিনি আবার বললেন,
“যাও কই?”
“এদিকেই।”
“জরুরি তাড়া?”
“কাজের কথায় আসেন।”
“আচ্ছা, তা কি খবর? বলছিলাম যে, উপায় করছো কিছু?”
“না, দেখছি।”
“দেহো না একটু তাড়াতাড়ি কোনো উপায় হয় কি না। টাকা আমার বড়ই দরকার।”
“কথার সাথে সাথে কি কাজ হয়ে যায় নাকি? এতো তাড়াহুড়ো হলে আমি পারবো না। অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিন।”
বলতে বলতে চায়ের কাপ হাতে নিলো সে। রাজীব সরকার নিজেও চায়ের কাপ নিয়ে তাকিয়ে পরিমাপ করলো তার ভাবটা। অন্যান্য লোকেরা দস্তাদস্তি লেগে যায় কাজ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। আর এই লোক কাজ হাতে পেয়েও নিজেই ছেড়ে দিতে চায়। তবুও লোকজন তাকেই ধরে বসে। কেননা তার কাজ নিখুঁত হয়। তাই চার্জ একটু বেশি দিতে হলেও তাকেই ডাকে। সাদাফ টিভির দিকে মনযোগ দিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে একেরপর এক। রাজীব সরকার লুঙ্গিতে গুজে রাখা টাকা হাতে নিয়ে পাঁচশো টাকার একটা নোট মুড়িয়ে সাদাফের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো,
“দরকারি কাজ, বুঝোই তো। দেহো একটু তারাতাড়ি ব্যবস্থা করা যায় কি না।”
সাদাফ হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,
“ধুর! এসব কি!”
“ধরো মিয়া। পান সিগারেট খাইয়ো।”
“পান সিগারেট খাবো আর কাজে যাতায়াতের জন্য কি ঘোড়ার গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন?”
“রাখো না আপাতত। কাজ হইলে দিমু না!”
“হবেটা কি করে সেটাই তো আগে দেখা প্রয়োজন।”
রাজীব সরকার আরও পাঁচশো টাকা এক করে এক হাজার টাকা মুঠোয় চেপে দিয়ে বললো,
“টাকা পয়সা নাই হাতে। একটা কাজ ধরতে হইবো তাইতো তোমারে তাগাদা দেওয়া। দেহো, বাজান, দেহো একটা ব্যবস্থা করা যায় কি না।”
সাদাফ টাকা মুঠোয় নিয়ে লম্বা চুমুকে চা শেষ করে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে উঠে গেলো। দোকান থেকে বের হওয়ার সময় রাজীব সরকারকে ইশারা করে এলো সিগারেটের বিল দেওয়ার জন্য। দাবা ঘরে এসে ঘন্টাদুয়েক পড়ে রইলো দাবার নেশায়। জয়ী হতেই খেলা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাড়ি ফিরে গোসল সেড়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“ভাত খাবেন না?”
“রান্না হয়েছে?”
“রান্না তো সকালেই করা হয়েছে।”
“দাও তবে। বাটিতে দিয়ো। তোমার ওই থালায় খাওয়া চলবে না।”
সাদাফ আবার ঘরে ফিরে এলো। শ্রাবণ এবার উল্টো কাজ করলো। বাটিতে ভাত দিয়ে প্লাস্টিকের প্লেটে তরকারি নিয়ে হাজির হলো সাদাফের ঘরে। বাটিতে নাড়াচাড়ায় সমস্যা হওয়াতে তরকারির প্লেটেই ভাত ঢেলে দিলো। শ্রাবণ তার মুখপানে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“অযথা কি দরকার ছিলো সোনার জলে পা ধোয়ার? সেই তো মাটিতে পা ফেলেই হাটতে হলো।”
খাওয়া শেষে সে আবার বেরিয়ে গেছে। পথমধ্যে সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়েছে। হায়দার বাড়ি পৌঁছানোর আগেই সিগারেট শেষ। বাড়ির সামনে এসে গেইট বন্ধ দেখে কয়েক সেকেন্ড পায়চারি করলো। তারপর গেইটে থাপ্পড় দিলো কয়েকবার। কোনো সাড়া নেই। দেখা হবে না ভেবে দুকদম ফিরে গিয়েছিলো, এরই মধ্যে গেইট খোলার শব্দ পেয়ে পেছনে ফিরে দেখলো দারোয়ান গেইট খুলে দিয়েছে। তাকে দেখে কেমন রহস্যময় চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকালো। সাদাফ জিজ্ঞেস করলো,
“হায়দার সাহেব বাড়িতে আছেন?”
“হু, আছে।”
সাদাফ বিনা সংকোচে ঢুকে পড়লো গেইট দিয়ে। আট তলা বাড়ির দোতলায় এসে দরজায় নক করলো। এই টোকার শব্দ বোধহয় কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না তাই পাশে থাকা কলিংবেলে চাপ দিলো। এদিকে সাথে সাথে দরজাও খুলে গেলো। তাহলে টোকাতেই কাজ হয়ে গিয়েছিলো। অযথা কলিং বেল চাপলো সে। দরজা খুলেছে হায়দার সাহেবের ছোট মেয়ে দিশা। সন্তানদের মধ্যে ধারাবাহিকতায় ছোট হলেও গড়নে ছোট নয়। ভার্সিটি পড়ার শেষ পর্যায়৷ বিয়ের প্রস্তাব আসছে যাচ্ছে হয়তো। সাদাফ হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
“আপনার বাবা বাসায় আছেন?”
দিশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে বললো,
“আসুন।”
সাদাফ ভেতরে এসে কারো বলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে নেই। সোফায় বসতে বসতে বললো,
“একটু ডেকে দিন।”
দিশা হাত ভাজ করে বললো,
“ডেকে আর কি দিবো। ডাকলে এখন আপনাকে বরাবরের মতো রুমেই যেতে বলবে। আচ্ছা, আপনি প্রায়ই বাবার কাছে আসেন। কেন আসেন বলুন তো?”
“যার যার প্রয়োজন তার কাছেই প্রকাশ করা কি ভালো না?”
“উনার মেয়ে হওয়া সত্ত্বে এটুকু জানার অধিকার কি আমার থাকতে পারে না?”
“তাহলে আপনার বাবার কাছেই জেনে নিতে পারেন।”
“আপনি জানালে একটু বেশি সুবিধা হয়।”
“কিন্তু আপনাকে আলাদা করে জানাতে গেলে আমার অসুবিধা হয়। একটা বিষয় বারবার বলতে হবে। তাছাড়া এক এক সময় এক এক কারণে আসি। সব ব্যাপার আপনি বুঝতেও পারবেন না। আপনি তাকে ডেকে দিলে সময়টা আমার কম নষ্ট হয়।”
দিশা যেন তার সময় খুব নষ্ট করে যাচ্ছে তাই কিছুটা মান নিয়েই চলে গেলো বাবার রুমের দিকে। রুমে যাওয়ার পরপরই আবার বেরিয়ে এসে দরজার সামনে থেকেই বললো,
“আসুন, বাবা ডেকেছে। হেনা, চা বিস্কিট দে তো বাবার ঘরে।”
কাজের মেয়েকে চা বিস্কুট দিতে বলে সাদাফের পিছু পিছু সেও ঘরে প্রবেশ করলো। হায়দার সাহেব বিছানার মাঝামাঝিতে আরাম করে বসে ছিলেন। তারা প্রবেশ করতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে সাদাফকে বললেন,
“এসো, বাবা। বসো।”
সাদাফ খাটের একপাশে বসলো। ওদিকে দিশা এসে বাবার টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে পড়লো। বসতে বসতে টেবিলে থাকা পত্রিকাটাও হাতে তুলে নিয়েছে। সাদাফের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সে কারণ জানতেই আজ এখানে বসেছে। অন্যসময় কেউ থাকে না রুমে। হায়দার সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দিশা মা, কিছু বলবে নাকি?”
“না।”
“বসলে যে?”
“কেন আমি থাকলে সমস্যা?”
তার জবাব দেওয়ার আগে সাদাফ হায়দারের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
“এসেছিলাম একটা জমির ব্যাপারে কথা বলতে। আপনার তো একটা প্রজেক্ট প্রয়োজন ছিলো। আমার হাতে একটা আছে।”
হায়দার সাহেব মেয়ের ব্যাপার বাদ দিয়ে সাদাফের কথায় মনযোগ দিলো এবং জিজ্ঞেস করলো,
“জায়গাটা কোথায়?”
“শ্যামপুর।”
“ওদিকে কি তেমন একটা…”
“আপনার জন্য ভালোই সুবিধাজনক হবে। নদীর ধারের জমি। আকারে কিছুটা লম্বাটে।”
“আমার তো স্কয়ার শেপ দরকার।”
“দরকার সেটা তো বুঝলাম। তবে পরিকল্পনা স্কয়ারেই যে রাখতে হবে এমন তো কথা না। আপনি প্রতিষ্ঠানের শেপটা ভিন্নভাবেও তো ভাবতে পারেন। যেহেতু জায়গাটা সুবিধাজনক আছে।”
জমির ব্যাপারে একের পর এক ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে সাদাফ। এসব শুনে হয়তো দিশা মেয়েটার কোনো কাজ নেই তাই পত্রিকা রেখে সে উঠে পড়লো। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কাজের মেয়ে চা বিস্কুটের ট্রে হাতে প্রবেশ করতে করতে বললো,
“আফা, চা।”
“উনাদের সামনে দিয়ে আয়।”
বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো দিশা। কথার সাথে সাথে চা উপভোগ করলো সাদাফ। তবে বিস্কুট নিলো না। জমিজমার ব্যাখ্যা শুনে হায়দার সাহেব নিজ চোখে দেখার জন্য রাজি হলেন। দু’চার দিনের মধ্যেই যাবেন তিনি। পছন্দ হলে তারপর হবে কথা পাকাপাকি। কথা শেষ করে সাদাফ উঠতে গেলে তিনি তার পূর্বের পাওনা বাবদ তিন হাজার টাকা হাতে দিয়ে বললেন,
“কাজের ব্যাপারে কিছু বললে না যে?”
সাদাফ টাকাটা পকেটে রাখতে রাখতে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
“যেকাজে এসেছি সেটা সম্পন্ন হয়েছে। এতোসব একসাথে চললে হজমে সমস্যা হবে। একসাথে এতো কাজ আমার দ্বারা হয় না।”
বলেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় কেবল কাজের মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলো তার। পকেট থেকে সিগারেট এবং লাইটার নিতে নিতে গেইটের বাইরে এসে দেখলো দিশা নামের মেয়েটা রিকশায় বসে আছে। তারা কথা সারতে সারতে সে পোশাক পাল্টে কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। সাদাফ গেইট ছেড়ে বের হতেই সে রিকশায় থেকে বললো,
“আপনার কি একটু সময় হবে আমার কাজ করে দেওয়ার জন্য? না মানে, কত লোকের কাজই তো আপনি করে দেন। আমার একটা কাজ করে দিতে পারবেন?”