“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ৩
(নূর নাফিসা)
.
.
কাপড়ের ব্যাগের এক কোণে পলিথিনে মোড়ানো দুইটা রুটি আছে। এখানে আসার পথে তিনটা কিনেছিলো, একটা খাওয়া হয়েছে দুইটা রয়ে গেছে। পঞ্চাশ টাকা বাঁচিয়ে সেখান থেকে একটা রুটি দিয়েই নাস্তা সেড়ে নেওয়ার কথা ভাবলো। পানি পানের জন্য খালি বোতলটা নিয়ে বাথরুমে গেলো। ঠান্ডা পানি পেয়ে তৃপ্তি মিটিয়ে পান করার পর হাতমুখ ধুয়ে নিলো। সাদাফের ঘরের দরজা খোলা দেখে সে উঁকি দিয়ে কোনো মানুষ পেলো না। ভেতরে এসে বুঝতে পারলো দরজা খোলা রেখে চলে গেছে। কিন্তু কেন? তার কোন প্রয়োজন হতে পারে ভেবে?
শ্রাবণ ওড়নার আঁচলে মুখ মুছে মশারিটা খুলে বিছানাটা গুছিয়ে রাখলো। এই রুমটারও একই দশা! ফ্লোর কাদামাক্ত, উপরের কোণায় কোণায় মাকড়সার জাল আটকে অন্ধকারাবৃত হয়ে আছে। সে পাশের রুম থেকে ঝাড়ু এনে দুইটা রুমই ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে ফেললো৷ সাদাফের কাপড়ের আলনাটাও গুছিয়ে দিলো। তারপর চললো মোছামুছির কাজ। এতো ময়লা হয়েছে যে পরপর তিনবার মুছে সেই ময়লা তুলে ঝকঝকে করলো ফ্লোরকে। দিনের অর্ধেকটা সময় পাড় হয়ে গেছে তার এটুকু কাজ করতে। গোছলে যাওয়ার আগে সাদাফের বিছানা থেকে মাদুরটা তুলে নিলো। এবার খাটে একটা তোশক ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। উপরে একটা চাদর হলেই রুমটা পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। আলমারিতে চাদর রাখা আছে কি না তা ভাবলেও খোঁজে দেখার সাহস হলো না। লোকটা তার জিনিসপত্রে হাত দেওয়া নিশ্চয়ই পছন্দ করে না। তাইতো ঘরে প্রবেশের সময়ই নুরু মিয়াকে বলেছিলো জিনিসপত্রে যেন হাত না লাগায়। শ্রাবণ সেই দুঃসাহস না দেখিয়ে দরজা আটকে গোছলে চলে গেলো। বাড়িটা নির্জন নিস্তব্ধতায় ঘেরা। বাড়িতে আরও ভাড়াটিয়া আছে কিন্তু যে যার সীমানায় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে যাওয়া আসা নেই বললেই চলে। শুধু একটু পরপর গেইট দিয়ে ঢুকতে এবং বাহির হতেই দেখা যায় কিছু লোকজন। গোসল সেড়ে অবশিষ্ট রুটি খেয়ে দুপুরের খাবারটাও পুষিয়ে নিলো। বাঁচিয়ে রাখলো টাকাটা। পাশের রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নিশ্চিত হতে এলো সাদাফ এসেছে কি-না। কিন্তু রুমের সামনে এসে হতাশ সে! এতোক্ষণের পরিশ্রম অনেকটা ব্যর্থতায়ই দেবে গেলো! সাদাফ জুতা নিয়েই প্রবেশ করেছে ঘরে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোনো মূল্যই দিলো না। কিন্তু এই ব্যাপারে কিছু বলার প্রয়োজনও মনে করলো না শ্রাবণ। তার ঘর, সে যেভাবে ইচ্ছে চলবে। এখানে সে বলে দেওয়ার কে?
সাদাফ তাকে দরজার সামনে দেখে বললো,
“এরই মধ্যে ঝকঝকে চকচকে করে ফেলেছো সব! কাজের হাত ভালোই দেখছি।”
শ্রাবণ মনে মনে বললো, “ভালো হলেই কি, ভালোর যথাযথ মূল্য তো পেলাম না!”
আর নতমুখে প্রকাশ্যে বললো,
“আপনার ঘরে কোনো চাদর নেই?”
“কেন, শীতের পোশাক সাথে আনো নি?”
“না, তা নয়। বিছানার চাদরের কথা বলছিলাম। তোশকের উপর কি করে ঘুমাবেন, চাদর হলে শরীর চুলকাবে না। বালিশেরও তো কভার নেই। এভাবে থাকলে জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায় তাড়াতাড়ি।”
“গেলে যাক। তাতে তোমার কি?”
কথাটা এক প্রকার আঘাত করে ফেললো শ্রাবণকে। এমনিতেই তো সংকোচে কোনোকিছুতে হাত লাগায় না, তারউপর এমন ব্যবহার তো মানুষের দেহমনে কাটা হয়ে ফোটে। এজন্যই পরের ভালো করতে নেই। শ্রাবণ চুপচাপ চলে এলো দরজার সামনে থেকে। মাগরিবের আজান পড়ছে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারদিকে। এসময় সাদাফ গোসলে গেছে। গোসল সেড়েই আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। নতুন জায়গায় অনেকটা ভয় লাগছে শ্রাবণের। এদিকে আরও লোকজন থাকলে হয়তো এতোটা ভয় লাগতো না তার। একা ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে সে। শীতকাল ফ্যানের আবশ্যকতা নেই, কিন্তু ভালো একটা লাইট থাকলেও তো চলতো রুমটায়। যা একটা আছে, আসবাবহীন এই ফাঁকা ঘরটাকেই আলোকিত করে তুলতে অক্ষম সে। হয়তো অনেকদিন যাবত অকেজো হয়ে পড়ার থাকারই ফলাফল এটা। কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকা পড়তেই ধুক করে কেঁপে উঠলো তার হৃদপিন্ড! সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“কে?”
“বাইরে এসো।”
সাদাফের গলা বুঝতে পেরে সে দরজা খুলে দেখলো সাদাফ সিগারেট টানছে। অন্যহাতে একটা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে। ডানে ঘুরে মুখের ধোঁয়া ছেড়ে আবার মুখোমুখি হয়ে বললো,
“এই নাও বাজার। মাছ মাংস ভালো পাইনি। ভালো পাওয়ার মতো টাকাও ছিলো না পকেটে। তাই আনিনি। ফ্রিজও নেই, রাখবে কোথায়? সেটাও তো ভাবতে হবে।”
“সমস্যা নেই। শীতের দিন তো। অল্প অল্প করে আনলে এমনিতে রেখে রেখেও খাওয়া যাবে।”
“তোমার সমস্যা না থাকলেই কি, আমার তো আছে। টাকা থাকতে হবে না! সপ্তাহে দু-এক দিন মাছ মাংস খাবো। প্রতিদিন খেতে হবে না।”
শ্রাবণ আর কোনো জবাব দিলো না। লোকটা নিজেই সমস্যা দেখায়, সমাধান দেখাতে গেলেও উল্টো গীত শুরু করে দেয়। সে চুপচাপ ব্যাগ হাতে নিয়ে ভেতরে চলে আসছিলো, আবার পিছু ফিরে বললো,
“আপনি কি এখন খাবেন?”
“না, খেয়েছি। আজ আর খাওয়া হবে না।”
শ্রাবণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কেননা দুইটা রুম পরিষ্কার করেই সে হাপিয়ে গেছে তাই রান্নাঘর পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। আর সাদাফ তো বলেছিলো বাজার করতে পারবে না এখন, তাই এতোটা গুরুত্বও দেয়নি। ভেবেছে পরদিন নাহয় সেই কাজ সেড়ে ফেলবে। রুমে এসে বাজারের ব্যাগ রেখেই আবার দরজার বাইরে ছুটে এসে বললো,
“আপনি কি আবার চলে যাচ্ছেন?”
“কেন?”
“এদিকের হোটেলে এক প্লেট ভাতের দাম কত?”
“দশ টাকা।”
“আর ডাল আলুভর্তা?”
“এক চিমটি ভর্তা পাঁচ টাকা, এক চোঙ্গা ডাল পাঁচ টাকা। মাছের তরকারি হলে বিশ টাকা, সাথে ডাল ফ্রি।”
“মাছ দরকার নেই। এক প্লেট ভাত আর ডাল ভর্তা হলেই চলে। এনে দিতে পারবেন?”
“হোটেলে গেলেই তো হয়। কাছেই তো…”
“এখন যাবো না। আমি বোল দিচ্ছি, আপনি সেটায় করে এনে দিন একটু। একটা মিনিট দাঁড়ান।”
শ্রাবণ বোল আর বিশ টাকার নোট এনে হাতে ধরিয়ে দিলে সাদাফ বললো,
“ভাতের প্লেট কিন্তু হাফ হয়।”
“হোক, তাতেই চলবে।”
সাদাফ ডালভাত এনে দিলে তা খেয়ে এবার সারাদিনের তৃপ্তি মেটাতে সক্ষম হলো। আর যা-ই পেটে ফেলুক না কেন, এই পেটে ভাতের মতো শান্তি আর কোনোকিছুই এনে দিতে পারবে না।
শ্রাবণের রাতটা কাটলো ভয়ে ভয়ে। ফ্লোরে মাদুর পেতে তার উপর নিজের দুইটা ওড়না বিছিয়ে কাপড়ের ব্যাগটা মাথার নিচে রেখে শুয়েছিলো সে। সাদাফের রুমে চাদর তো নেই ই, একটার বেশি বালিশও ছিলো না যে সে চাইতে যাবে। তাই এই ব্যবস্থা করতে হলো। নির্জন নতুন জায়গা, ঘুম এমনিতেই নামছে না চোখে। তারউপর একটু পরপর বাড়ির গেইটের ঠকঠক শব্দ এবং কুকুরের ঘেউ ঘেউ বারবার ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে তার। মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ভুত কিংবা ডাকাতের হট্টগোল বাঁধবার! মাঝরাতে পাশের রুমের দরজার শব্দ আরও একবার কাঁপিয়ে দিয়েছে তাকে। সে নিশ্চিত ছিলো এটা সাদাফের রুমের দরজার শব্দ। সে এতো রাতে যাচ্ছে কোথায়! নাকি সেই যে ভাত এনে দিয়ে বেরিয়েছিলো, এখন ফিরলো? ভাবতে ভাবতে আবারও ঘুম ফিরিয়ে এনেছে চোখে। এবারের ঘুমে একেবারে সকাল। ঘুম থেকে উঠেই সে রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলো। এর অবস্থা থাকবার ঘরের চেয়েও আরও করুণ! ছোটখাটো জায়গা পেয়ে পোকামাকড় যেন রাজ্য গড়ে তুলেছে। গ্যাসের চুলার অবস্থা নাজেহাল! ভাড়াটিয়া এমন লোকের কাছে ভাড়া দিয়েও বোধহয় নিজের ক্ষতি নিজে করে ফেলছে! কাজে যখন আসবেই না, তারই বা এগুলো আটকে রাখার কি প্রয়োজন! এসব পরিষ্কার করতে করতে শ্রাবণের ঘন্টারও বেশি সময় লেগে গেছে। তারপর হাড়িপাতিল ঘষামাজা। হাড়িপাতিল বলতে ছোট ছোট দুইটা সিলভারের পাতিল আর একটা ছোট আকৃতির দস্তার কড়াই সাথে স্টিলের দুইটা চামচ একটা বাটি। মাঝারি আকৃতির একটি বটিও আছে, তা-ও মরিচাধরা। শ্রাবণ বাইরে থেকে ইট কুড়িয়ে এনে বটির মরিচা পরিষ্কার করলো। তারপর বাজারের ব্যাগ এনে একে একে নামিয়ে দেখলো কিছু চাল, কিছু ডাল আর কিছু বেগুন, পটল, আলু পেয়াজ এনেছে সাদাফ৷ বেগুন পটল রান্না করতে যে তেল, হলুদ মরিচ, লবণের প্রয়োজন হয় তা কি জানে না লোকটা? এগুলো ছাড়া রান্না করবে কি দিয়ে! চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে বারকয়েক বার দরজার কাছে এলো কিন্তু সাদাফকে ডেকে তোলার সাহস পেলো না। তার অপেক্ষা করতে করতে এদিকে ভাত হয়ে গেছে। শ্রাবণ আর অপেক্ষায় বসে না থেকে ভাতের মার গালতে দিয়ে নিজের সঞ্চয়ের টাকা থেকেই কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ির বাইরে৷ মুদি দোকানে এসে অল্প অল্প পরিমাণে তেল, হলুদ মরিচ ও লবন কিনে নিয়ে এলো। সাথে ভ্যান থেকে কাঁচামরিচ, প্লাস্টিকের দুইটা প্লেট এবং একটা কাঠের খুন্তিও কিনে নিলো। সাদাফ এখনো উঠেনি ঘুম থেকে। রান্নাবান্না সাড়তে সাড়তে বেলা প্রায় এগারোটা বাজতে চললো৷ অথচ এপর্যন্ত পাঁচটা মিনিটও বিশ্রাম নেয়নি সে। ক্ষুধায় শরীরে অস্থিরতা ভার করছে। কিন্তু মালিকের আগে দাসী খেয়ে নিবে সেটাও ভাবতে পারছে না কোনোমতে। লোকটা কখন উঠবে? আর কতক্ষণ ঘুমাবে? আর সইতে না পেরে চলে গেলো গোসলে। অর্ধেক গোসল হতেই দরজায় টোকা পড়লো,
“ভেতরে কে?”
বাথরুমে এসে পরিচয় দিতে বোকা বনে গেলো শ্রাবণ। সাদাফ হয়তো বুঝে নিয়েছে তাই দুইবার ডাকার পরই চলে গেছে। ঝটপট গোসল সেড়ে বের হতেই সাদাফ গেলো ফ্রেশ হতে। ততক্ষণে তার জন্য ভাত তরকারি রেডি করে এনে রেখে দিলো রুমে। বিছানাটাও গুছিয়ে ফেলেছে সাদাফ রুমে ফিরতে ফিরতে। হাত ধুয়ে ভাত খেতে বসলে শ্রাবণের মনে উশখুশ করছিলো কিছু বলবে। কিন্তু বলার সাহসটুকু যেন যোগাতে পারছে না কোনোমতে! সাদাফ বোতল থেকে গ্লাসে পানি নিতে নিতে বললো,
“কি? কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ, মানে…”
“বলো, কি বলবে?”
“আপনি কাঁচাবাজার এনেছেন কিন্তু তেল মশলা কিছুই আনেননি। রান্না করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে গেছি আমি। তাই পাশের দোকান থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে হয়েছে।”
“এই প্লেটও কিনে এনেছো?”
“হ্যাঁ। এসব কিনতে আমার একশো আশি টাকা খরচ হয়েছে।”
“ভালো। কিনতে পেরে সার্থক হয়েছো তো! কিন্তু এই প্লেটটা টিকবে না বেশি। দেখি, পারলে ভালো প্লেট নিয়ে আসবো।”
“না, মানে বলছিলাম যে টাকাটা আমার নিজের জমানো তহবিল থেকে খরচ করেছি।”
“তো কি হয়েছে? আমি খাবো, আর তুমি খাবে না নাকি? কাজে তো তোমারও লাগছে। গতরাতে বাজারও তো আমিই করে দিলাম। তাহলে এটুকু তো নিজে করতেই পারো।”
বলতে বলতে খাওয়া শুরু করলো সে। শ্রাবণ ভাতের প্লেটের দিকে এবং তার চেহারার দিকে কয়েকবার ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে নিশ্চুপ বেরিয়ে গেলো। এখন মনে হচ্ছে টাকাটা খরচ করা মহা অনুচিত হয়েছে। কাজে রেখেছে, কোথায় পারিশ্রমিক পাবে, উল্টো আরও ভর্তুকি দিতে হচ্ছে তাকে! এমন লোকের ঘরে কাজ করবে কেউ? এরচেয়ে তো ভালো ছিলো তার আগের কর্মস্থল! মাস শেষে হাত ভর্তি কিছু না পেলেও তো উল্টো ভর্তুকি দিতে হয়নি।