“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
পুরোটা পথেই জোড়াজুড়ি চলেছে। একটা লোকও কি দেখলো না তাকে, এলো না কেউ বাঁচাতে? এ কেমন পথ! ঠেলে ধাক্কিয়ে নিয়ে তাকে আসা হলো কোনো এক ঘরে। তাদের মধ্যে একজন বললো,
“ভাই, এই হালী অস্ত্র পাচার করতে দেইখা ফেলছে। এর কি করা যায়?”
বলতে বলতে কাপড়টা সরিয়ে নিলো মাথা থেকে। কিন্তু হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারেনি শ্রাবণ! এখানে সাদাফ! এখানে বসে আলোচনা এবং অস্ত্র পাঠানো লোকগুলোর ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলো সে। মাথার চুলগুলো কেমন উষ্কখুষ্ক, মুখটা কেমন শুকনো শুকনো! শ্রাবণকে দেখে যেন তার চোখে নেমে এসেছে অবাকের নক্ষত্র! কিন্তু শ্রাবণ খুবই ভয়ার্ত। কান্না বেড়ে যাচ্ছে তার। যা চেপে রাখতে অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। একচালা ঘরের দুইটা দরজা। পেছন দিক দিয়ে তাকে এনেছে, সামনের দিকের দরজাটা চাপিয়ে রাখা। ইচ্ছে করছে ছুটে পালাতে। তা যে সম্ভব হবে না তা-ও তার অজানা নয়। সাদাফ এগিয়ে এসে তার গালে হাত রেখে বিষ্ময়করভাবে প্রশ্ন করলো,
“কোথায় ছিলে এই দুদিন? কত খুঁজেছি আমি, জানো?”
শ্রাবণ থরথর করে কাঁপছে, ঝরঝর করে ঝরছে অশ্রু। একে তো পালিয়ে গেছে, অন্যথায় তাদের অস্ত্র পাচার দেখে ফেলে তাদেরই কাছে ধরা খেয়েছে। তাই তার ধারণা এখই মেরে ফেলবে তাকে। সাদাফ তার অবস্থা দেখে একজনকে বললো,
“একটা রিকশা ডাক তো।”
কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো মেয়েটাকে সে চিনে কি না, সাদাফ জানিয়ে দিলো তার বউ। সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সাদাফ রিকশার অপেক্ষায় বাইরে তাকিয়ে শ্রাবণের চোখ মুছে দিলো। একহাত শ্রাবণের পিঠে রেখে অন্যহাতে ঠান্ডা হাত দুটো মুঠোয় ধরলো নিজ হাতের উষ্ণতা দিতে। রিকশা চলে এলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে সে শ্রাবণকে সহ রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা চলছে, শ্রাবণ ভাবছে। কি হতে পারে এরপর? কি ঘটাতে চলেছে সাদাফ? এদিকে সাদাফ তার হাত ঘঁষতে ঘঁষতে বলছে,
“কি ঠান্ডা হয়ে গেছে শরীর। তুমি জানো, আমি তোমার জন্য কাল সকালেই সোয়েটার কিনতে যেতাম! কিন্তু তোমাকেই তো পেলাম না খুঁজে।”
ফুপিয়ে কান্না ছাড়া কোনো শব্দ নেই শ্রাবণের মুখে। খুব কাছেই, মাত্র এক-দেড় মিনিট লাগলো বাড়ি আসতে। এটুকুর জন্যই রিকশা নিয়েছে। শ্রাবণকে বেশ যত্নে নামিয়ে রিকশা ভাড়া দিলো। তারপর নিশ্চুপ ঘরে এলো। দরজা লাগাতে লাগাতে শান্ত গলায় বললো,
“পালিয়েছো কেন?”
শ্রাবণ আর পারছে না। ভয়ে তার কলিজা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। একদমই সহ্য করতে পারবে না সাদাফের শাস্তি। সেদিনের শাস্তিই আজও ভুলতে পারেনি। আর এখন তো খুনই করে ফেলবে! খুন হতে কার না ভয় লাগে! সাদাফ পিছু ফিরতেই শ্রাবণ হাত জোর করে কান্নাসহিত বললো,
“আমাকে যেতে দিন। আমি কিচ্ছু বলবো না কাউকে।”
“কোথায় যাবে?”
“অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো। সত্যি বলছি, কখনো কিচ্ছু জানাবো না কাউকে। বাঁচতে দিন আমাকে।”
যদিও সাদাফের ইচ্ছে করছিলো একটা থাপ্পড় দিতে কিন্তু সে তা করলো না। কারণ সে কতটা ভয় পাচ্ছে সেটা তার সর্বাঙ্গ জানান দিয়ে যাচ্ছে। সাদাফ খুব আদরে জড়িয়ে ধরলো তাকে৷ কিছু বললো না, জড়িয়ে নিয়ে মিশে রইলো চুপচাপ। শ্রাবণ একটুও বুঝতে পারছে না তাকে। অবশ্য বুঝতে চাইছেও না। মনের ভেতর চাপা পড়া ভয়টাই সব ইতিবাচক ভাবনা ভুলিয়ে দিয়েছে৷ কিছুক্ষণ নিরব থেকে সাদাফ বললো,
“দুদিন ধরে ভাত খেতে পাই না আমি, জানো সেটা? এভাবে পালিয়ে গেলে কেন? ভয় পাচ্ছো কেন, শুনি? আমি জানি তুমি কাউকে কিছু বলবে না, আর পালিয়ে যাওয়ার জন্যও কিছুই বলবো না তোমাকে। তবে পালিয়ে গিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছো তুমি। কেমন একটা অভাবে পড়ে গিয়েছিলাম দুটো দিন। আশেপাশে কত খুঁজলাম, ঘর থেকে কিভাবে হারিয়ে যেতে পারো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। কতটা ভালো লাগছে এখন তোমাকে পেয়ে, বুঝতে পারছো তুমি? কোথায় ছিলে, হ্যাঁ? আর কক্ষনো পালানোর চেষ্টা করবে না, বুঝলে? তুমি হারিয়ে গেলে এতো বড় পৃথিবীতে আমি কোথায় খুঁজবো তোমাকে, বলো! সবসময় কি কেউ আসবে ফিরিয়ে দিতে?”
কথার সাথে সাথে আরও জোরে চেপে ধরলো নিজের সাথে। এবার যেন মন থেকে ভয় দূর হতে লাগলো ধীরে ধীরে। অজানা কারণেই সাদাফের কথাগুলো বিশ্বাস করে নিতে লাগলো সে। বিশ্বাস করতে লাগলো খুন হতে হবে না তার কাছে। কথায় কথায় ভালোবাসাকে খুঁজে পেলো যে! এ কেমন অদ্ভুত তার হৃদয়! কান্না নিঃশেষ হলে শ্রাবণ বললো,
“আপনি ওসব কেন রাখেন ঘরে? আমি ভয় পাই।”
“ওসব আমার ব্যবসা। ভয় পেলে আলমারি খুলো না।”
“এসব কেন ব্যবসা হতে যাবে? ভালো লোকেরা এসব ব্যবসা করে না।”
“আমি ভালো লোক না। সে তো আজ নতুন জানার কথা না তোমার।”
“আপনি অনেক ভালো লোক। আপনি ওসব ব্যবসা করবেন না দয়া করে।”
“আমাকে যদি ভালো মনে করো তবে আমাকেই দেখো, আমার ব্যবসাকে দেখতে হবে না তোমার। আমি বিশ্বাস করে রাখছি তোমাকে, ধোকা দিয়ো না কখনো। খুবই ভালো লাগে তোমার সাথে থাকতে, ছেড়ে যেয়ো না কখনো। তোমার কি প্রয়োজন বলো, আমি সব দিবো তোমাকে। কিন্তু হারাতে দিবো না কিছুতেই। তোমার মতো এতো যত্ন করবে না তো কেউ, দেখো না দুদিন যাবত আমি ভাত খেতে পাই না!”
দুই বার বলে ফেললো ভাত খাওয়ার কথাটা, যা আপাতত সব ভুলিয়ে দিলো শ্রাবণকে। ভাতটা খুব দ্রুত রান্না করা দরকার এখন। কখন খেতে দিবে তাকে! শ্রাবণ তার কাছ থেকে মুক্তি নিতে নিতে বললো,
“ভাতটা বসিয়ে দিচ্ছি এখনই। আপনি অপেক্ষা করুন একটু।”
“ভাত বসিয়ে কি চলে যাবে আবার?”
শ্রাবণ মাথা দু’দিকে নেড়ে চলে গেলো। রান্নাঘরে এসে চাল নিয়ে ঝটপট ধুয়ে বসিয়ে দিলো রান্না। দুদিন যাবত বিনা গোসলে আছে সে, কিন্তু রাতে গোসল সম্ভব হবে না। তবে রান্নার ফাঁকে হাতমুখ ধুয়ে নিলো ভালো করে। রাতে আর সাদাফ বের হয়নি বাসা থেকে। কিছুক্ষণ রুমে বসে ছিলো, কিছুক্ষণ রান্নাঘরের সামনে পায়চারি করছিলো। শ্রাবণকে ঠান্ডায় জমে যেতে দেখে তার জ্যাকেট এনে জড়িয়ে দিলো দেহে। এই জ্যাকেটটা দেখে শ্রাবণের চোখে আবারও ভেসে উঠলো জ্যাকেটের নিচে লুকানো সে অস্ত্রগুলোর দৃশ্য। পরতে ইচ্ছে করছিলো না। তবুও চুপচাপ পরে নিতে হলো। অবশেষে সাদাফকে ভাত খাওয়াতে পেরে কমে এলো তার অস্বস্তি। পরদিন সকালে নুরু মিয়া এসে ভিড়লো দুয়ারে। থমথমে তার মুখখানা। অন্যান্য সময় হাসিমুখে দেখা যায়, অথচ আজ মেজাজ যেন চড়া! শ্রাবণের সামনে পড়তেই শ্রাবণ চাদর জড়িয়ে একটু কাচুমাচু হয়ে গেলো। শ্রাবণের দিকে নুরু মিয়া প্রশ্ন ছুড়লো,
“মিয়া কই?”
“ঘুমাচ্ছেন। দাঁড়ান, ডেকে দিচ্ছি।”
নুরু মিয়া দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলো। শ্রাবণ ঘরে এসে সাদাফকে ঠেলে জাগাতে লাগলো। ঘুম ঘুম চোখে সাদাফ তাকিয়ে বললো,
“কি হয়েছে তোমার? বাজার নেই?”
“আছে। বাইরে ওই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। আপনাকে খুঁজছেন।”
“কে?”
প্রশ্ন করে শ্রাবণের জবাবের অপেক্ষায় না থেকে সে-ই মাথা কাত করে দরজার দিকে তাকালো। নুরু মিয়াকে দেখে উঠতে উঠতে বললো,
“সকাল সকাল কেন দেখাও তোমার এই চেহারা? অন্যসময় আসতে পারো না?”
“তুমি বেকার থাকতে পারো, আমার কাজ পড়ে থাকে অন্যসময়।”
সাদাফ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“কাজ? তা কি জন্য এসেছো শুনি?”
“এই নাও তোমার পাওনা।”
বলেই টাকা এগিয়ে দিলেন তিনি। সাদাফ হাতে নিয়ে গণনা শুরু করেও বললো,
“কত?”
“বিশ হাজার। পাঁচ হাজার আগামী দু-এক সপ্তার মধ্যে দিয়া দিমু। এই মাইয়া, ব্যাগ-ট্যাগ গুছাইয়া চলো আমার সাথে।”
শ্রাবণ কেঁপে উঠলো তার কথায়। সত্যিই কি এখন নিয়ে যাবে তার সাথে? সে তো যাবে না। গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাবে, তবুও যাবে না এই লোকের সাথে। এদিকে সাদাফ গণনা থামিয়ে তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার গুণতে লাগলো। তার এই কাণ্ড দেখে শ্রাবণের ভয় আরও বেড়ে গেলো! সাদাফও কি চাইবে না সে থাকুক তার সাথে? কাল যে কত কথা বললো, তার মধ্যে কত ভরসাই না খুঁজে পেলো। তাহলে এখন তিনি কিছু বলছেন না কেন নুরু মিয়াকে? পাওনা টাকা পেয়ে গেছে বলে কি তার বিদায়?
শ্রাবণকে একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নুরু মিয়া ধমকে বললেন,
“কি ব্যাপার! দাঁড়ায় রইলা যে! বললাম না আমার সাথে চলতে!”
সাদাফের টাকা গণনা শেষ। টাকা ভাজ করে মুঠোয় নিতে নিতে বললো,
“সে কোথায় যাবে তোমার সাথে? সে তো আমার।”
“দেখো মিয়া, তোমার টাকা দরকার টাকা দিয়া দিছি। এখন বাটপারি কইরো না। আমার জিনিস আমারে ফিরায় দাও।”
“তোমার জিনিস? জন্ম দিয়েছো নাকি কিনে এনেছো কোনটা? কোনোটাই তো করোনি। তার সাথে তো তোমার কোনো পরিচয়ই নেই। তাহলে সে তোমার জিনিস হয় কি করে?”
“এতো কথা তোমার বলতে হইবো না। তোমার টাকা তুমি পাইছো, আমার লোক আমারে নিয়া যাইতে দাও।”
“তোমার লোক সে কোনোকালে ছিলোও না, এখনো না। আমার বিয়ে করা বউ সে। তোমার সাথে যাচ্ছে না কোথাও। চুপচাপ নিজের রাস্তা ধরো। যাও।”
“বেশি বাড়াবাড়ি কইরো না বললাম।”
সাদাফ তার কলার মুঠোয় ধরে বললো,
“এই, কথা কানে যায়নি? কি বলছি শুনতে পাওনি? বারবার বলতে হবে নাকি সে যে আমার বিয়ে করা বউ? আমার চেয়ে বেশি অধিকার এখন তার উপর কারো নেই। বুঝতে পেরেছো? চুপচাপ বের হও। দ্বিতীয়বার যেন তাকে নিয়ে যেতে কিংবা তার ব্যাপারে কোনো কথা বলতে না শুনি। বিক্রি করার হলে নিজের বউ বাচ্চাকে বিক্রি করো। দেখি কত পারো।”
কথার সাথে সাথে তাকে ধাক্কা মেরে ছেড়ে দিলো সাদাফ। শ্রাবণ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো, এই বুঝি কোনো হাঙ্গামা বেঁধে যায়! কিন্তু না। নুরু মিয়া চোখ পাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে চলে যাচ্ছেন। পারলে বোধহয় সাদাফকে খেয়েই ফেলতেন! পেছন থেকে সাদাফ বললো,
“বাকি টাকা তোমার দিতে হবে না। ঘটকালির বকশিস দিয়ে দিলাম। বউ এনে দিয়েছো যে…”