“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
তিনদিন পর, সকালের রান্নাবান্না শেষ করে ঘর ঝাড়ু দিয়ে দরজার সামনে বসে ময়লা তুলছিলো শ্রাবণ। হঠাৎ এক বোরকা পরনে মহিলা এসে তার দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,
“কি ব্যাপার? যাও না কেন তুমি?”
নেকাবে ডাকা মুখ, চোখে চশমা, হাতে মোজা, পায়ে মোজা দেখে শ্রাবণ কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়েছিলো। কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলো দোতলার সেই মহিলাটা। শ্রাবণ একটা হাসি দিয়ে বললো,
“সময় হয় না যাওয়ার।”
“আজ বিকেলে এসো। কাজকর্ম সেড়ে একটু সময় বের করে নিবে। আল্লাহর কাজে সময় না দিতে পারলে কিভাবে হবে? হেয়ালিপনা করো না। শিখতে পারলে তোমারই ভালো। এসো।”
বলেই চলে গেলেন তিনি। শ্রাবণ শুধুমাত্র সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো। দুদিন যাবত দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরেই কাটায় সাদাফ। আড্ডাখানার মেরামত চলছে তাই সেদিকে দেখাশোনা করতে হয় তাকে। আজ সকাল সকালই বেরিয়ে গেছে, মিস্ত্রি এসে ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে গেছে৷ সাদাফ ফিরলে তাকে নাস্তা দিয়ে তখন ইতস্তত বোধ করে কথাটা তুললো শ্রাবণ।
“উপরের ঘরে একটা হুজুর মহিলা আছে। বিকেলে বাচ্চাদের আরবি পড়ান। সেদিন বলেছিলো আমাকে নামাজ শিখিয়ে দিবে। পুরুষলোক কেউ নেই সেখানে। একা থাকেন। মুসলমানের তো নামাজটা শেখা জরুরি। আজ সকালেও দেখা হতেই বললেন, নামাজ শিখতে যাই না কেন! বলছিলাম নামাজটা শিখে নিবো উনার কাছে। যাবো শিখতে?”
সাদাফ সবসময়কার ন্যায় শান্ত গলায়ই বললো,
“কেন, নামাজ পড়তে পারো না তুমি?”
“উহুম।”
“তো যাও। আড্ডায় মজে থেকো না আবার। ঘরের দিকেও খেয়াল রেখো।”
শ্রাবণ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। মনে মনে খুশিও হলো। আল্লাহর কাজে যাবে, তাই সাদাফও নিষেধ করলো না। আজ বিকেল থেকেই যাওয়া শুরু করেছে সে। সাদাফ এসময় ঘরেই ছিলো। শ্রাবণ বাচ্চাদেরকে গেইট দিয়ে ঢুকতে দেখেই তার কাছে বলে চলে গেছে। ফিরে এসেও আবার ঘরেই পেয়েছে। সারাদিন বাইরে থেকে এসময়টা বিশ্রাম নিচ্ছে। শ্রাবণ ফিরতেই বেরিয়ে গেলো আবার। একা ঘরে সে রান্নাবান্নার কাজ সব সেড়ে নিলো। আজকাল ঠান্ডা বেশি পড়ছে। সন্ধ্যা হলেই যেন হাত পা জমে আসে। চাদরে হয় না। মাঝে মাঝে কাথা মুড়ে কাজ করে। গতকাল সাদাফ বলেছিলো সোয়েটার এনে দিবে। সে-ও অপেক্ষায় বসে রইলো সোয়েটারের। নিজ থেকে কিছু চাইতেও সাহস করে না। বিয়ের আগে তো টুকটাক প্রয়োজনের কথা বলতো যদিও নিজের প্রয়োজন নয়। কিন্তু এখন অধিকার থাকা সত্ত্বেও সে নিজের কোনো প্রয়োজনের কথা জানায় না তাকে। তার ধারণা, যে আদর যত্নে রাখছে সে নিশ্চয়ই নিজেই জানে কখন কি প্রয়োজন। তাকে নিশ্চয়ই সব খুলে বলতে হবে না। আসলে হচ্ছেও এমনটাই। একটু দেরি হলেও সাদাফ বুঝে তার প্রয়োজনগুলো। তাইতো গতকাল কাথা মুড়ে কাজ করতে দেখে সোয়েটার এনে দিবে বললো।
আজ রোদে শুকাতে দিয়েছিলো সাদাফের মায়ের দেওয়া সেই কাঁথা দুটো। পাতলা কাঁথাটা বাইরে রেখে ভারিটা আলমারিতে তুলে রাখবে। অপ্রয়োজনে অযথা বাইরে রেখে নষ্ট করে লাভ নেই। সাদাফ এসেছে একটু আগে। এখন বাথরুমে আছে তাই নিজেই আলমারির চাবিটা তুলে নিলো ড্রয়ার থেকে৷ স্ত্রী হিসেবে তার ঘরের জিনিসপত্র ব্যবহার করার অধিকার নিশ্চয়ই আছে শ্রাবণের। সেই ভেবে শ্রাবণ বিনা সংকোচে আলমারি খুললো। এখানে সাদাফের কিছু কাপড়চোপড় আছে এলোমেলো ভাবে। এখন এসব গোছাতে গেলে সময় লাগবে অনেক। কিছু ময়লা কাপড়ও আছে। ধুয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কাল নাহয় অবসরে বেছে বেছে সেগুলো নিয়ে ধুয়ে সুন্দর করে সব গুছিয়ে রাখবে৷ তাই সেগুলোর উপরই কাথাটা রাখলো৷ কিন্তু আলমারি তাকে কাঁথা ফিরিয়ে দিচ্ছে। মোটা কাঁথা, এলোমেলো কাপড়ের উপর গুটিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। জ্যাকেট ও প্যান্টগুলো যেন জ্যাম করে রেখেছে। শ্রাবণ কাঁথাটা চেয়ারে রেখে সেগুলো একপাশে চাপিয়ে ঠিক করে রাখতে লাগলো। প্যান্ট ভাজ করে রেখে জ্যাকেটটা টান দিতেই কেমন ঘর্ষণজনিত শব্দের সৃষ্টি হলো। এখানে কি রাখা তা দেখতে শ্রাবণ জ্যাকেট সরিয়ে পুরনো ময়লাযুক্ত একটা লুঙ্গি দেখতে পেলো। সেটা সরাতেই শ্রাবণের আত্মা ধুক করে কেঁপে উঠলো! নিশ্বাস যা নিয়েছে তা যেন ভেতরেই আটকে গেছে। বাইরে বের করার আর সুযোগ হচ্ছে না। ছোট বড় অস্ত্রগুলো দেখে তার পুরো শরীরই থরথর করে কাঁপছে। এসব কি দেখছে সে! এখানে এসব অস্ত্র কেন? এগুলো তো থাকে আইনের লোকের কাছে কিংবা ডাকাত সন্ত্রাসের কাছে। এঘরে কেন এদের বসবাস? এগুলো কি প্রকৃত অস্ত্র নাকি খেলনার? খেলনার জিনিস কেন এখানে থাকবে? এগুলো দেখতে তো অনেক ভয়ংকর লাগছে! তাহলে কি সাদাফ কোনো ডাকাত সন্ত্রাস? সে ডাকাত সন্ত্রাসের সাথে সংসার করছে! একটা সন্ত্রাসকে বিয়ে করে নিয়েছে? তাইতো নুরু মিয়ার মতো একটা লোকও তার কথায় উঠে বসে! সারাদিন দাবাঘরে থেকে দিনশেষে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে। কখনো হাতে টাকা থাকেই না আবার হুটহাট এতো এতো টাকা হাতায়! লোকটাকে তো সে অন্যরকম ভেবেছিলো, তাহলে কি লোকটা সেই অন্যরকম নয়? নয়তো তার আলমারিতে এসব কেন লুকানো থাকবে! ভেবে ভেবে চোখে যেন সব ঘোলাটে দেখছে। হঠাৎই সাদাফের কণ্ঠ ভেসে এলে বৈদ্যুতিক শকের ন্যায় কেঁপে উঠলো শ্রাবণ।
“এখানে কি করছো?”
শ্রাবণ পিছু ফিরে কড়া ঢোক গিললো। কতটা কষ্ট হয়েছে ঢোক গিলতে নিজেও ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে তার দিন ফুরিয়ে এসেছে। সাদাফ দরজা লাগিয়ে আলমারির দিকে তাকালো। লুঙ্গি সরিয়ে নেওয়াতে একদমই চোখের সামনে অস্ত্রগুলো। শান্ত তার দৃষ্টি, শান্ত তার কণ্ঠ অথচ এদিকে শ্রাবণের অবস্থা নাজেহাল। ভয়ে চোখের কোটরে পানি চলে এসেছে। জবাব তো নেই ই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপাকাঁপি করা ছাড়া যেন আর কোনো কাজই নেই তার! সাদাফ পাশে রাখা চেয়ারে কাঁথা দেখে বললো,
“এটা রাখবে নাকি?”
শ্রাবণ মেঝের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। সাদাফ এগিয়ে এসে অস্ত্রের উপর লুঙ্গি রেখে তারউপর প্যান্টগুলো রাখলো। এরপর জ্যাকেটটা নামিয়ে নিয়ে বললো,
“রাখো।”
শ্রাবণ থরথর কাঁপানো হাতে কাঁথা তুলে রাখলো কোনোমতে। সাদাফ আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আরও কিছু রাখবে?”
এবারও শ্রাবণ মাথা নেড়েই জবাব দিয়ে দ্রুত সরে এলো। সাদাফ আলমারি লাগাতে লাগাতে বললো,
“রান্না হয়েছে?”
শ্রাবণ অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ।”
“ক্ষুধা লেগেছে আমার, খাবার দাও তাহলে।”
শ্রাবণ দিকবিক না তাকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো। রান্নাঘরে এসে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে৷ নিশ্বাসে নিশ্বাসে বেরিয়ে আসছে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ! চোখ থেকে ঝরঝর করে ঝরে যাচ্ছে বৃষ্টি। শীতকাল অথচ ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলেও মাথা যেন আগুন হয়ে আছে, চোখ কান ফেটে যেন ধোঁয়া বের হতে চাইছে! সে যেন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে তার কলিজা কাঁপছে। যদিও সেটা মনের ভয় ছাড়া কিছুই না। সেদিন মেরেও যতটা না খারাপ করে তুলেছিলো অবস্থা, আজ চোখের পলকে কিছু আটকাতেই তার অবস্থা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। বারবার একটা বিষয়ই উঁকি দিচ্ছে মনে, এ কার ধারে এসে আশ্রয় নিয়েছে সে?