“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন” পর্ব- ১৩

0
552

“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যার পর সাদাফ বাড়ি ফিরলে শ্রাবণ তাকে খেতে দিলো। সব মাছের তরকারি দেখে বললো,
“আজ এতো মাছ কেন?”
“ওদের ফ্রিজে রেখেছিলাম কিছু। সব নিয়ে এসেছি। এরপর থেকে অল্প পরিমাণে ছোট ছোট মাছ আনবেন। অন্যের ফ্রিজে রেখে খাওয়া যায় না।”
“কে বলেছিলো অন্যের ফ্রিজে রাখতে?”
শ্রাবণ মাথা নত করে বিড়বিড় করে বললো,
“আমিই রেখেছিলাম এতো বেশি দেখে। আর রাখবো না কোথাও।”
“ভাত খাও।”
তিন-চারদিন যাবত ঠিকমতো গোসল হচ্ছে না তার। মাথা না ভেজালে কি সেই গোসলকে গোসল মনে হয়! আজ ভুলে মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছে আর ছোট ব্যান্ডেজটা খুলে পড়ে গেছে। শ্রাবণ কয়েকবার চেষ্টা করলো সেটা লাগাতে, সম্ভবই হলো না। ভেবেছিলো সাদাফ বুঝি বকা দিবে। কিন্তু সাদাফ লক্ষ্য করার পর কাছে ডেকে বললো,
“ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছো কেন? শুকিয়ে গেছে?”
“খুলে পড়ে গেছে।”
“দেখি।”
সাদাফ মাথা দেখে বললো,
“শুকিয়েই গেছে। আর প্রয়োজন নেই। ব্যাথা পাও কোনো?”
শ্রাবণ দুদিকে মাথা নাড়লে সাদাফ আর কিছুই বললো না।
দুদিন পরেই সাদাফ একটা বাক্স নিয়ে এলো। প্রথমে দেখে শ্রাবণ ভেবেছে সাদাফ বোধহয় আইস্ক্রিমের ব্যবসা শুরু করবে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলো তার জন্য ফ্রিজ এনেছে। এটা ফ্রিজ! মনে মনে হেসে মরে যাচ্ছে সে! আইস্ক্রিমের বাক্স এনে দিয়েছে তাকে মাছ মাংস রাখার জন্য! সাদাফ বললো,
“দুইমাস ব্যবহার করে বিক্রি করে দিচ্ছিলো তাই কিনে নিয়ে এলাম৷ এটাতেই তো হয়ে যাবে তোমার, না?”
বড্ড হাসি পেলেও শ্রাবণ শুধু মাথা নাড়ালো তার সামনে। আড্ডাখানা পুড়ে যাওয়ার পর সাদাফ এখন বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই কাটায়। মাঝে মাঝে হাটতে বের হয়, ঘুরেফিরে চলে আসে। যাওয়ার সময় একটা সিগারেট হাতে জ্বলতে থাকে, ফিরে আসার সময়ও একটা জ্বলতে থাকে। দুপুরে সাদাফ খেয়েদেয়ে বের হলে শ্রাবণ দরজায় তালা দিয়ে দোতলায় গেলো তৈরিকৃত জামাকাপড় নিয়ে আসতে। সকালে বাচ্চাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলো মহিলা। মজুরিটাও তার সঞ্চয় থেকেই নিয়ে সে দোতলায় এলো। দর্জির কাছ থেকে জামা নিয়ে পাশের ঘরে উঁকি দিলো। গত সপ্তাহে এক মহিলা এসে উঠেছে এঘরে। দুতিনদিন যাবত কয়েকটা বাচ্চাকে কায়দা নিয়ে গেইট দিয়ে আসতে যেতে দেখা যায়। তাহলে তারা ওই মহিলার কাছেই কুরআন শিক্ষা নিতে আসে। শ্রাবণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, কি সুন্দর মনযোগে বাচ্চারা মহিলাকে অনুসরণ করে পড়ে যাচ্ছে। একসাথে ভেসে আসা ধ্বনি যেন মধুর হয়ে ঠেকছে কানে। ভেতরে থাকা মহিলাটা তাকে দেখে ডাকলো,
“ভেতরে এসো, মা। কে তুমি? কাকে খুঁজো?”
শ্রাবণ সোজা হয়ে একটু এগিয়ে এসে বললো,
“কাউকে খুঁজছি না। আমি নিচতলায় ভাড়া থাকি। বাচ্চাদের পড়া দেখছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।”
“কুরআন পড়তে পারো?”
শ্রাবণ দুদিকে মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিলো। মহিলাটি বললো,
“নামাজ পড়ো?”
এবারও না জবাব দিতেই মহিলাটি বিস্মিত হয়ে বললো,
“ওমা, কেন? পড়তে পারো না?”
“শিখছিলাম। ভুলে গেছি।”
“নাউজুবিল্লাহ। ভুলে বসে থাকলে চলবে! মরতে হবে না? কবরে কি নিয়ে যাবে? এই ধরনীর কিছু যাবে নাকি সাথে? যত তাড়াতাড়ি পারো নামাজ শিখে ফেলো। সময় করে আমার কাছে এসো, আমি শিখিয়ে দিবো।”
শ্রাবণ মাথা নাড়লো সে আসবে। পরক্ষণে বাচ্চাদের পাশে আরও কিছুক্ষণ বসে পড়া দেখতে লাগলো৷ তার ভালো লাগছে এই সুর। মাঝে মাঝে ঠোঁটের আড়ালে জ্বিভ নেড়ে উচ্চারণও করছে সাথে সাথে। বাচ্চাদের ছুটি হলে সে নেমে এলো তাদের সাথেই। আজ বাচ্চাদের ওযু করা শিখিয়েছেন তিনি৷ শ্রাবণও মনযোগে দেখে নিয়েছে। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বারবার সেই দৃশ্যই স্মরণ করছে সে। নিচে এসে দেখলো ঘরের সামনে সাদাফ পায়চারি করছে। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলে সাদাফ জিজ্ঞেস করলো,
“এতোক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?”
শ্রাবণ তালা খুলতে খুলতে বললো,
“জামা বানাতে দিয়েছিলাম যে, উপর তলায় গিয়েছিলাম জামা আনতে।”
“এতোক্ষণ লাগে উপর থেকে নিচে আসতে? আধ ঘন্টা আগে এসে ঘুরে গেছি, ঘর তালা দেওয়া। এখনো পাঁচ মিনিট হয় এসেছি সেই তালা ই দেওয়া। ডাকলাম, কাক পক্ষীও নেই!”
শ্রাবণ ঘরে প্রবেশ করতে করতে নিচু স্বরে বললো,
“একটু কথাও বলছিলাম বসে। ভেবেছি আপনি বুঝি দেরি করে আসবেন।”
“কার সাথে কথা বলছিলে? পরিচিত কেউ আছে?”
“উহুম। এমনিই কথা বলা যায় না…”
“না, যায় না। কারো সাথে এতো কথা বলার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে নুরু মিয়া শুধু সেই একটা না, আশেপাশে আরও হাজারটা নুরু মিয়া আছে। কথায় কথায় সবাই ভুলিয়ে নিতে পারে।”
শ্রাবণ বুঝতে পারছে পূর্বে ঘটা এমন বিপদ থেকে সাবধান করে দিতেই একথা বলছে সাদাফ, তাই সে বললো,
“মহিলার সাথে কথা বলছিলাম। পুরুষলোক ছিলো না।”
“মহিলাদের মাঝেও নুরু মিয়া লুকিয়ে আছে। মহিলা বলেই যে ভালো হবে, তা তো না। কোনোদিকে যাবে না আর।”
“একা একা ঘরে বসে থাকতে কি ভালো লাগে সবসময়।”
“একা কোথায়? আমি আছি না? আমার সাথে কথা বলো যা বলার। আমার সাথে গল্প করো।”
শ্রাবণ চুপচাপ জামা দুটো তুলে রাখলো। রান্নাবান্না শেষ করে নিয়েছে দুপুরেই। অবসরে যেন ঘুমানো ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ওদিকে সাদাফও কপালে হাত রেখে শুয়ে পড়েছে। গল্প করার ইচ্ছা মনে আসতেই শ্রাবণ পাশে অবস্থান করে বললো,
“আপনার পরিবার নেই?”
“না।”
“বাবা, মা, ভাই, বোন কেউই নেই?”
“ভাইবোন আছে। বাবা মা নেই।”
“ভাইবোনের সাথে যোগাযোগ নেই?”
“না।”
“কেন?”
“যে যার মতো ব্যস্ত, কে কার খবর রাখে এই দুনিয়ার মাঝে?”
“ওহ্। আপনার তো বাড়িও আছে তাহলে। আপনি এখানে কেন থাকেন?”
“এখানে কাজ আছে, তাই থাকি। কাজ করি, খাই, বাঁচি। আর বাড়িও নেই। বাবা মা মারা যাওয়ার পর জমিজমা সব বিক্রি করে চলে এসেছি।”
“কি কাজ করেন আপনি?”
“ইন্টারভিউ নিচ্ছো?”
শ্রাবণ লজ্জা পেয়ে বললো,
“না, জানতে চাইছি। কিছু জানিই তো না নিজের স্বামীর ব্যাপারে। কেউ জিজ্ঞেস করলেও বলতে পারবো না।”
“বলার দরকারও নেই। আমার নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। যখন যে কাজ পাই, তা-ই করি। আর কারো কাছে যেন কিছু বলতে নাহয়, সেজন্যই তো কারো কাছে যেতে নিষেধ করছি।”
শ্রাবণ আর কোনো কথা বললো না। চুপচাপ মিশে রইলো ঘুমের অপেক্ষায়।
.
সকালে বাজারে গিয়ে আজ হঠাৎ নুরু মিয়া সামনে পড়ে গেলো। নুরু মিয়াও হয়তো খেয়াল করেনি তাকে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সাদাফ তার কাধে হাত রেখে বাঁধা দিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার? চেহারাই দেখা যায় না আজকাল?”
“আরে, ভাই। কেমন আছো?”
“হুম, আছি ভালো। টাকার ব্যবস্থা হতে আর কয় বছর লাগবে?”
“ধুর মিয়া! বড় কিছু দিলাম, খুশি হইতে পারছো না!”
“আমি টাকা চেয়েছি। বড় কিছু চাইনি।”
বলতে বলতে খপ করেই শার্টের পকেটের টাকা গুলো তুলে নিলো সাদাফ। নুরু মিয়া যেন বাঁধা দেওয়ার সময়টুকুও পেলো না। সাদাফ খুচরা টাকাগুলো গণে দেখলো পাঁচ হাজারের বেশি আছে৷ পাঁচ হাজার যেহেতু পাঁচটা নোট একসাথে রাখা, নিশ্চয়ই টাকাটা কারো কাছ থেকে পেয়েছে তার ধারণা। আর বাকিগুলো হয়তো তার নিজেরই। এখানেও ছয় সাত শত টাকার কম হবে না। সে পাঁচ হাজার টাকা নিজের কাছে রেখে বাকি টাকাগুলো নুরু মিয়ার পকেটে দিতে দিতে বললো,
“এতো টাকা নিয়ে বাজারে এসেছো! নাকি কারো পকেট মেরে দিলে? হ্যাঁ?”
নুরু মিয়া পাঁচ হাজার টাকাও নিতে হাত বাড়িয়ে বললো,
“ধুর মিয়া! ফাজলামো কইরো না। দেও।”
“আমার টাকা আমি নিবো, এটা ফাজলামো বলছো? তাহলে তুমি যে বছরের পর বছর ঘোরাচ্ছ, সেটাকে কি বলা যায়?”
“আরে দাও তো। টাকা দরকার।”
সাদাফ টাকা প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে বললো,
“আমারও দরকার। বাকিটাও তাড়াতাড়ি দিয়ে দিয়ো। এক সপ্তাহ সময় দিলাম তোমাকে। এর মধ্যে টাকা না পেলে লোক পাঠাবো ঘরের চালা খুলে আনতে। সাথে তোমার কিডনি কলিজাও দিয়ে দিয়ো। তা-ও বিক্রি করে যদি কিছু পাই।”
কন্ঠ শান্ত কিন্তু দৃষ্টি ছিলো কঠিন। কথা শেষ করে বাজার নিয়ে চলে এলো সে। নুরু মিয়া চোখ মটকে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। টাকাটা নিয়ে যাওয়ায় খুব রাগ হচ্ছে তার, তবুও যেন কিছুই করার রইলো না! রাগে শুধু নিজের শরীর ফেটে যাচ্ছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here