মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ১৯

0
90

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১৯

🍁
সানজিদা বেগম তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছেন। এদিক ওদিক ছুটে জিনিস পত্র গোছাচ্ছেন। গত কালকের বিষন্ন মনটা আজ একটা কলেই ফুরফুরে হয়েছে তার। কিছুক্ষণ আগেও শুয়ে ছিলেন তিনি। মাগরিবের সালাত আদায় করে গা এলিয়ে দিয়েছিলেন বিছানায়। মাত্র চোখ লেগেছিলো নিদ্রায় তক্ষুনি ফোনের ভাইব্রেশনে ধরফর করে উঠে বসেছিলেন। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। আননোন নাম্বারে কল এলে অটোমেটিকেলি উনার দুঃচিন্তা করার অভ্যাস রয়েছে। কিয়ৎক্ষণ আগেও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। দুরুদুরু বুকে রিসিভ করতেই পরিচিত মানুষের গলা শুনে মুখ ভর্তি হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছিলো তার। কয়েক মিনিট কথা বলেই রেখে দিয়েছিলেন। চোখ মুখের ভাব ভঙ্গিতে ব্যাস্ততা ছড়িয়ে পরেছে তখনি।

সানজিদা বেগম ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে কল লাগালেন শওকত রহমান এর কাছে। জানিয়ে দিলেন দ্রুত তার ওখানে চলে আসছে সে। সানজিদা বেগমের কথার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে জরুরি তলব। ভাইজান কে কোনো রকমে ঘটনার সারাংশ টুকু বুঝিয়ে দিয়েই কলের সংযোগ বিছিন্ন করলেন। বাকি টুকু না হয় সামনা সামনি গিয়েই বুঝাবেন তিনি। ফোনে অনেক কথায় হীতে বিপরীত হয়। বোঝানো হয় একটা কিন্তু বোঝে আরেকটা। আর এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সামনাসামনি আলোচনা করাই উত্তম। সানজিদা বেগম সেই যে তাড়াহুড়ো লাগিয়েছেন, এর মধ্যে এক বোরকা তিন বার উল্টো করে পরে ফেলেছেন এই চক্করে। একবার উল্টো পাশে তো আরেক বার সামনের পার্ট পেছনের দিকে। উর্মির বাবা মোতালেব সাহেব স্ত্রীর কাজকর্মে মজা পাচ্ছেন বেশ৷ আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে চুপচাপ দেখেই যাচ্ছেন তার চল্লিশার্ধো অর্ধাঙ্গিনীর ষোড়শী বালিকার মতো আচরন। ম/ন্দ লাগছে না দেখতে।
অবশেষে সফল হলেন সানজিদা বেগম। কোনো রকমে হিজাব পেঁচিয়ে একায় ছুটলেন মীরাদের বাসার উদ্দেশ্যে।

_______________

রাইফ এবং উর্মির আড্ডা জমে উঠেছে। অর্ডার দিয়েছে আরো বিভিন্ন রকমের ফার্স্ট ফুড এবং কোমল পানীয়। উর্মি পূর্বের ন্যায় ঘপাঘপ খেয়েই চলেছে। মীরা শুধুমাত্র মানবতার খাতিরে কোল্ড ড্রিংকস এ চুমুক দিচ্ছে। বলতে গেলে অনেকটায় বাধ্য হয়ে। রাইফের সামনে মাক্স খোলার ইচ্ছে তার ছিলো না। কিন্তু এতো কিছু অর্ডার দিয়ে ফেলেছে, না খেলেও খারাপ দেখায়। উর্মি গাল ভর্তি খাবার ঠেসেও হরহর করে গল্প করছে। অনীহা নেয় তার একটুও।

মীরা নিশ্চুপ। হু হা বলতেও নারাজ সে। সেই যে মাথা নুয়েছে , নাম নিচ্ছে উপরে তোলার। যদিও কিছু বলতো, কিন্তু লোকটার ঠোঁটকা/টা অভ্যাস এ না জানি আবারও লজ্জায় ফেলে দেয় উর্মির সামনেই। নখ দিয়ে খুঁটিয়ে যাচ্ছে বোরকার জ্ব*লজ্ব*ল করা ছোট ছোট কালো পাথর। মাথার উপর ভনভন করে ঘোরা ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। তবুও সে ঘেমে একাকার ।
রাইফ কথার ফাঁকে মীরাকে দেখছে, নাহ আর মেয়েটাকে এভাবে রাখা উচিত হবে না। কেমন গুটিয়ে গেছে, বসে আছে এক কোণায়। উর্মি আছে বলেই সহ্য করছে, তা না হলে নির্ঘাত টেবিলের উপর রাখা স্বচ্ছ গ্লাস এতোক্ষণে রাইফের মাথার উপর ভা/ঙ্গতো তা সে ঢের জানে। আর বি’রক্ত করলো না।
শেষ বারের মতো এক পলক তাকালো মীরার দিকে। অস্বস্তি বোধ করছে মেয়েটা তা ঠিক বুঝতে পারল। এতো ক্ষণ সময় এক সাথে কাটানোর পরও মীরাকে দেখতে পায় নি মন ভরে। রাইফ কৌশলের সহিত গলা খাঁকারি দিলো মীরার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। সফল ও হলো সে। মীরা তাকিয়েছে ডাগর ডাগর চাওনিতে, দৃষ্টি এক হওয়াতে নজর ঘুরিয়েও নিয়েছে চরম সংকোচে। এই যে কয়েক সেকেন্ডের চোখাচোখি তাতেই মীরার হৃদয়ের ছন্দপতন হয়েছে বোধকরি। এমন কেনো হয় সে জানে না। এমন অনুভূতি তার জন্য নতুন। সে অপারগ এই লোকটির নজরে বেশিক্ষণ নজর ধরে রাখতে। তার মনে হয় রাইফের কিঞ্চিৎ লাল বর্ণের চোখ দুটি খুব আকৃষ্ট করে তাকে। আকুল নিবেদন জানায় প্রেমাহ্বানের।

রাইফ হাত ঘড়িতে এক পলকে সময়টা দেখে নিলো। ইচ্ছা থাকা স্বতেও আজ আর এখানে বসে থাকা সম্ভব না। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ টা তার আগে করা জরুরি। এভাবে আড্ডা তো পরেও অহরহ দেওয়া যাবে। খাওয়া দাওয়াও শেষ। রাইফ দুজনকে উদ্দেশ্য করে আদেশের সুরে বলল,

-‘রাত হচ্ছে উর্মি। আজ তাহলে উঠো দুজন। রিক্সা দিচ্ছি, চলে যাও বাসায়।’

-‘হ্যাঁ, অনেক খাওয়া হয়ে গেছে ভাইয়া, পেট ফুল। ধন্যবাদ আপনাকে।’

-‘হুম। এবার ওঠো। অন্যদিন না হয় আবার আড্ডা জমাবো।’

রাইফের কথায় উর্মি উঠে দাঁড়াবে এমন সময় মীরা হাত টে’নে ধরলো। বাঁধা দিলো উর্মিকে। রাইফের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে মিহি সুরে বলল,

-‘আপনি যান, আমার কাজ আছে একটা। আমরা পরে যাবো।’

-‘আর ইউ শিওর মীরা? বাহিরে মেঘ করছে। ভ্যাপসা গরমও, মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।’

মীরা বাহিরে তাকালো। কালো মেঘে ঢাকা আকাশ দেখে দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল বুক। কিন্তু এখন এই লোকটির কথায় চলে গেলে মীরা নিশ্চিত জানে আবারও দেখা হবে বাসার নিচে। অনেক ক্ষণ সহ্য করেছে, আর সামনা সামনি হতে চায় না সে। কন্ঠে জোর দিয়ে বলল,

-‘ইয়াহ, আ’ম শিওর৷ আপনি যেতে পারেন। কাজটা আমার খুব দরকারী। সেরেই যাবো।’

আর বসে থাকলো না রাইফ। উঠে দাঁড়ালো। বিল পরিশোধ করে মীরাদের কাছ থেকে বিদায় নিলো। নিজে কিনে নিলো পাঁচ কেজি বিভিন্ন রকমের মিষ্টি।
গুরুত্বপূর্ণ কাজটা হাসিল করার জন্য মিষ্টি নিয়ে যাওয়াটা তার খুব জরুরি।

___________

খাদিজা বেগম চা নাস্তা তৈরি তে ব্যাস্ত। মেহমান এসেছে, একদম নতুন মেহমান। হঠাৎ আগমন তাদের। মেহমান দের আসার খবরেই এখানে হন্তদন্ত হয়ে এসেছেন সানজিদা বেগম। উপস্থিত ভাবে যতটুকু সম্ভব আদর আপ্যায়ন এর জন্য উঠে পরে লেগেছেন তারা। কোনো ত্রুটি যেনো না থাকে।
শওকত রহমান হাঁক ছেড়ে ডাকলেন খাদিজা বেগম কে। বোনকেও সাথে আনতে বললেন। মেহমান সবার সাথেই সরাসরি কথা বলতে চায়। অতিথি তিনজন ব্যাক্তি একে অপরের মুখপানে চেয়ে বয়সে বড় বয়স্ক লোকটি বললেন,

-‘আমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাদের এখানে আসছি শওকত ভাই। আপনি যদি অনুমতি দেন তবেই শুরু করি।’

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নিসংকোচে বলতে পারেন।’

উনি গুছিয়ে বললেন সে কথা। উনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ কিছুটা মলিন হলো শওকত রহমানের। সাথে শুকিয়ে গেলো খাদিজা বেগম এর ও। সানজিদা বেগম নড়ে চড়ে বসলেন। আগ্রহ দেখালেন তাদের প্রস্তাবে। ভাই ভাবীর মতো মুখ ফ্যাকাসে না করে বরং তিনি আনন্দিত হলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন,

-‘মীরাকে আপনাদের পছন্দ হয়েছে তাতে আমরা খুব আনন্দিত। মেয়ে উপযুক্ত হলে তো সমন্ধ আসবেই। ‘

সানজিদা বেগমের কথায় আস্বস্থ হলেন তারা। বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটির পাশে বসে থাকা মধ্য বয়স্ক মহিলা খুশি হয়ে হাসি মুখে বললেন,

-‘আপনারা তো সব জানেন আমাদের সমন্ধে। তারপরেও খোঁজ খবর নিতে পারেন আমার ছেলের।যদি আপনাদের সম্মতি থাকে তবে খুব দ্রুত শুভ কাজটা সেরে ফেলতে চাই।’

শওকত রহমান সোজা হয়ে বসলেন। ভারী গলায় বললেন,

-‘খোঁজ নিতে হবে না আপা। আমাদের সামনেই তো মানুষ হলো আপনার ছেলে। জামাতা হিসেবে কেউ অপছন্দ করতে পারবে না। কিন্তু,’

-‘কিন্তু কি ভাইসাব?’

-‘আপনি তো জানেন, আমার মেয়েটা আম্মাজানের মৃত্যুর পর একেবারে ভে/ঙ্গে পরেছিলো। বিয়ে শাদী তে মত দিচ্ছিলো না কিছুতেই। এখন একটু অভারকাম করেছে। তার পরেও পরিস্থিতি বিবেচনায় মেয়ের সাথে আলাপ না করে আমি কথা দিতে পারছি না।’

এবার বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি বলে উঠলেন,

-‘কোনো অসুবিধা নেই শওকত ভাই। মীরার সাথেই কথা বলেই আমাদের জানান। ওর অমতেও আমরা কিছু করতে চাই না।’

এপর্যায়ে খাদিজা বেগম মুখ খুললেন। জানালেন মীরা বাসায় নেই।

____________

মীরা আর উর্মি রাইফ চলে আসার পর পর ই বেরিয়ে পরেছে। আকাশ খারাপ করাতে শহরের সবারই বাসায় ফেরার তাগদা। যার জন্য রাস্তায় লেগেছে অসহ্যকর জ্যাম। বাসায় আসতে পনেরো মিনিটের রাস্তা লেগেছে পাক্কা চল্লিশ মিনিট। তার উপর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ছাতা নেই সাথে, রিক্সাতে ভিজে গেছে পায়ের দিকের বেশির ভাগ অংশ।

কোনো রকমে জুবুথুবু হয়ে বাসায় আসলো দুজন। কলিং বেল চাপল উর্মি। মীরা ভেজা মুখ টুকু মুছে যাচ্ছে পেছন থেকে। দরজা খুলে দিতেই ঢুকে পরলো দুজন। মীরা খাদিজা বেগম কে দেখে জুতো জোড়া খুলে দরজার পাশে রাখা সেল্ফে রাখতে রাখতে আপন মনে স্বশব্দে বলে উঠলো,

-‘আম্মা, দেড়ি হয়ে গেলো। আব্বাজান রাগ করবে তাই না? কি করবো বলো। রাস্তায় জ্যাম ছিলো অনেক। এই উর্মিটাও….’

কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলো না মীরা। সামনের দৃশ্য দেখে অস্বাভাবিক রকমের বড় বড় হয়েছে তার চোখ জোড়া। স্থির হয়েছে তার সব কিছু। অল্পের জন্য স্থির হয়নি তার হৃদস্পন্দন। এক আকাশ পরিমাণ বিশ্ময় ফুটে ওঠেছে চোখে মুখে। এমন অপ্রত্যাশিত কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য ঘূনাক্ষরেও কল্পনা করেনি মীরা।

চলবে….

ভালো লাগলে এক মিনিট সময় নিয়ে গল্পপ্রেমী বন্ধুদের ইনভাইট করার অনুরোধ রইলো। ভালোবাসা সবাইকে💛💛

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here