মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ১৩

0
113

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১৩

🍁
ত’প্ত দুপুর। আবহাওয়া ভ্যাপসা গরম। ভোঁ ভোঁ করে কেঁপে উঠে বিছানার উপর রাখা ফোনটা বেজে উঠলো উচ্চশব্দে। খাদিজা বেগম এখন একটু পায়েস বসিয়েছেন চুলায়। এই ভর দুপুরে কাজের সময় কেউ কল করেছে বলে ক্ষাণিক বিরক্ত হলেন। মীরাকে ডাকবেন ফোনটা এনে দিতে সে উপায় ও নায়। নিচে গেছে টুপি নিয়ে৷ নিজেই এসে নাম্বারে চোখ বুলিয়ে হাসি মুখে রিসিভ করলেন। বললেন,

-‘আস সালামু আলাইকুম আপা। কেমন আছেন?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি খাদিজা। তোমরা কেমন আছো?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ আপা। সবাই ভালো আছি। উর্মি কই, এখনও আসল না যে?’

-‘ঘুমাচ্ছে এখন। সারারাত ঘুমাতে পারে নি গরমে। সকালের নাস্তা শেষে শুইছে৷ দু বার ডেকে আসছি, উঠার নাম ই নিচ্ছে না।’

-‘থাক আপা ঘুমাক। ঘুম হলে একাই উঠবে। খিচুড়ি আর পায়েস রান্না করছি। দ্রুত পাঠিয়ে দিবেন কিন্তু।’

-‘আচ্ছা যাবে। শোনো, ভাইজান কই?’

-‘নামাজের জন্য বের হলো একটু আগে।’

-‘আর মীরা?’

-‘ওর আব্বাজান ভুলে টুপি রেখেই চলে গেছে। সেটা দিতেই নিচে গেছে। চলে আসবে এখনি।’

সানজিদা বেগম এ পর্যায়ে এসে ফিসফিস করে করে কথা বলা শুরু করলেন। এমন একটা ভাব যেনো ফোনের কথা অন্য কেউ শুনে ফেলবে। অথচ দুই প্রান্তেই দুজন রুমে একা।

-‘শোনো খাদিজা, খুব ভালো একটা সমন্ধ আসছে বুঝছো। ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত। খুব ভালো ফ্যামেলি। ঢাকায় থাকে। বাবার বিজনেস আছে অনেক বড়। ছেলেও প্রতিষ্ঠিত। খুবই নম্র ভদ্র। তুমি ভাই আর মীরাকে বুঝাও। এমন সমন্ধ কিন্তু পরে নাও আসতে পারে।’

খাদিজা বেগম ভাবনায় পরলেন। মীরার বাবাকে নিয়ে তো কোনো সমস্যা না কিন্তু মেয়েকে বুঝাবে কি করে। দাদীর শোকে শোকার্ত হয়ে বিয়ে নামক জিনিসটা কে একের পর এক নাকচ করেই যাচ্ছে। শখ তো সবার থাকে, নূরজাহান বেগমের ও শখ ছিলো প্রিয় নাতনীর বিয়ে দু চোখ ভরে দেখার। তার জন্য ব্যাবস্থাও নিয়ে ছিলেন। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে ঠিক করেছিলেন তিনি। ক্রমে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসায় উৎসব ভাব বিরাজ করেছিলো পুরো বাড়িতে। কিন্তু হায়াত মউত কি আর বলা যায়। বিয়ের ঠিক দু দিন আগে ফজরের নামাজ পড়ে তসবিহ তেলাওয়াত করা অবস্থাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। দাদীকে হারানোর কষ্টে এবং তার শখ পূরণ হলো না বলে মীরা সেদিন ই শওকত রহমান কে সাফ সাফ জানিয়েছে সে এই বিয়ে আর করবে না। শুধু এটা না, কখনোই বিয়ের আসরে বসবে না সে। ভালো পরিবার হওয়াতে বর পক্ষ মীরার অবস্থা বুঝেছিলো সেদিন। তারাও আর জোর করেনি। কিন্তু মীরার মতো মেয়েকে ছেলের বউ করতে না পারার আফসোস রয়েই গেছে তাদুকদার সাহেবের স্ত্রীর মনে। খাদিজা বেগম অনেক বুঝিয়েছেন মীরাকে। মেয়ে মানুষ, স্বামীর সংসার এ যেতেই হবে। আল্লাহর বিধান। কিন্তু এই মেয়েকে যে কিছুতেই রাজি করাতে পারছেন না। অসহায় কন্ঠে বললেন,

-‘আপা, আপনি তো জানেন মীরা কেমন। আমি কি করতে পারি বলেন?’

-‘তুমি পারবা বুঝছ। ওর একটা সুন্দর জীবন দরকার। দেখোনা ঝিম মে/রে থাকে সব সময়। শক্ত হওয়া লাগবো। মেয়েকে বুঝাও খাদিজা। এর পর আর আমাকে পাবা না বলে দিলাম। মাথায় রাইখো, রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।’

-‘আপা…’

টুটটুট শব্দ করে কে টে গেলো কল। কথা আর সম্পূর্ণ করতে পারলেন না তিনি।

______________

মুখোমুখি দুজন। গেটের সাথে কাঁধের এক পাশ হেলান দিয়ে শান্ত ভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাইফ। হাত দুটো বুকের উপর ভাঁজ করা। পা একটা বাঁকা করে অন্যটার উপর আড়াআড়ি করে রেখেছে। শীতল তার চাহনি। গভীর দৃষ্টি প্রেয়সীর ঘর্মাক্ত মুখটার উপরেই নিবদ্ধ। মীরার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। সাথে আব্বাজানের উপর রাগ ও হচ্ছে। উনি নিজে না এসে কেনো এই লোকটাকেই পাঠালেন। শওকত রহমানের কল পাওয়ার সাথে সাথেই টুপি টা হাতে নিয়েই নিচে নেমে এসেছে। দ্রুততার সহিত সিঁড়ির ধাপ দুটো করে অতিক্রম করার ফলে এখনও হাঁপাচ্ছে সে। তিন মিনিট পার হতে চলল, কিন্তু রাইফ একই ভাবে দাঁড়িয়ে। মীরার হাতে সাদা টুপিটা এখনও বিদ্যমান। একবার এগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু রাইফ প্রত্যাখ্যান করেছে। অধৈর্য হয়ে মীরা মুখ খুলবে ঠিক তখনি রাইফ চোখ রাঙালো। ভ্রুকুটি করে বুঝিয়ে দিলো আর কিছুক্ষণ। মীরা অবাকের উপর অবাক হচ্ছে বারংবার। আশ্চর্য! এমন হাবভাব কেনো লোকটার! বার বার অধিকার খাটাচ্ছে তার উপর। মীরার এবার মনে হলো রাগে শরীরের রগ ছিড়ে যাবে৷ অধৈর্য হয়ে সামনে থেকে দু পা এগিয়ে এসে রাইফ কে অতিক্রম করে উঁকি দিলো গেটের বাহিরে। আব্বাজান কে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। রাগে গমগম করে আবারও রাইফের সামনে এলো। কাঠকাঠ কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘আপনি কিন্তু এবার বেশি বেশি করছেন। বিরক্ত হচ্ছি আমি।’

-‘বিরক্ত হওয়া রমনীকে দেখতে ভালো লাগছে আমার।’

-‘বিরক্ত করা পুরুষটাকে ভালো লাগছে না আমার।’

মীরার সোজাসাপ্টা জবাব শুনে রাইফ ধীরে ধীরে মুচকি হাসল। সে তো ভেবেছিলো এখনি চলে যাবে এখান থেকে। মন ভরে দেখেছে, আপাতত কয়েক দিন দেখা না হলেও এই স্মৃতি টুকু নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এই মেয়েটাও দেখি বেশ কথা জানে তার মতো। তাহলে আর দেড়ি কিসের। আসর একটু জমানো যাক আর দু মিনিটের জন্য। মীরার বিরক্তিতে ভরা মুখ পানে গভীর দৃষ্টি রেখে রাইফ শান্ত কন্ঠে বলল,

-‘তোমার ভালো না লাগা পুরুষটি রমনীর হাসি দেখে নিজেকে ধন্য করতে চায়।’

-‘ভুলে যাক লোকটি, মেয়েটি এখন থেকে হাসি কে কোরবান করে দিলো।’

-‘আর লজ্জাটাকে! নিলজ্জ দেখতেও ইচ্ছা করছে লোকটির। হোক একটু, ক্ষতি কি তাতে। আসুক কাছে, ইচ্ছাকৃত ভাবে বসুক পাশে।’

মীরা এই মূহুর্তে এসে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। লজ্জাহীন কিংবা নিলজ্জ তো সে হতে পারবে না কস্মিনকালেও। এই যে লোকটির বেফাঁস কথাতেও এখন লজ্জায় লাল হলো। মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলল সাথে সাথেই। কি জবাব দিবে এই কথার প্রেক্ষিতে। কি বলে লোকটা থেকে রেহায় পাওয়া যায়। মন তো চাচ্ছে লোকটার গার্ডিয়ান কে ডেকে বলতে, “এমন অসভ্য কেনো আপনার ছেলে? নামাজে যাওয়ার আগেও অন্য মেয়েকে ডিস্টার্ব করে। কান মলে শাসন করতে পারেন না?” ওড়নার কোণা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিজেকে শান্ত করল। এতো অস্থির হলে চলবে না। ভেতরের লজ্জা মিশ্রিত রাগ টাকে হজম করে মীরা শান্ত কন্ঠে বলল,

-‘দেখেন..’

মীরার কথা শেষ না হতেই রাইফের ফটাফট উত্তর,

-‘দেখছি।’

মীরার এবার নিজের চুল নিজে টেনে ছিড়তে ইচ্ছা করছে। নিজের ভুল শুধরে বলল,

-‘শোনেন…’

-‘শুনছি। কিছু শুনবো বলেই সেদিন থেকে অপেক্ষা করছি। প্রহর গুনছি তীব্র আশায়। এই বুঝি সে আমার হয় যায়।’

-‘জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা ভালো। কেউ নিষেধ করবে না।’

-‘তুমিই তো আমার স্বপ্ন। তবে কেনো আড়াল থাকো? এতো কেনো লুকোচুরি, বলতে পারো?’

মীরা হতাশার শ্বাস ফেলল। এই লোকের সাথে কথায় পেরে উঠবে না সেটা এখন স্পষ্ট। আর কথা বাড়াতে চায় না সে। যতো প্যাঁচাবে ততই এই লোকের মনোবাসনা পূরণ হবে। কথায় জাল থেকে বেড়িয়ে এসে শুধালো,

-‘টুপি নিয়ে এখান থেকে বিদায় হবেন নাকি আমি বিদায় হবো।’

-‘তুমি বিদায় হও। অন্যদিন না হয় পাঁচ তলায় দেখব। চিন্তা করো না, আমার করেই দেখব।’

রাইফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। টুপির জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো সামনে। কিন্তু মীরা থমকে আছে। চোখ মুখ একেবারে থ মে/রে গেছে রাইফের শেষ কথায়। বুকের বা পাশের ছোট্ট হৃদযন্ত্রটা মনে হলো কয়েক সেকেন্ড এর জন্য ধড়াক করে থেমে আবার চালু হয়েছে। স্পন্দন বেড়ে গেছে বহুগুণ। অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে তার। শরীরেও যেনো শক্তি পাচ্ছে না একটুও। রাইফ টুপি না পেয়ে মীরার হাত থেকেই টুপিটা টেনে নিলো। ঘুড়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে গেলো আরো কয়েকটা শব্দ,

-‘ছোট মাথা এতো কিছু বুঝবে না। অপেক্ষা করো, আমি বুঝিয়ে দিবো। ভালোবাসার রঙে রাঙ্গাবো তোমায়।’

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here