বিয়ে পর্ব ১১

0
258

#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

রাতে ঘুমাতে গিয়ে ধ্রুব আজেবাজে চিন্তা কর‍তে লাগলো। আচ্ছা, এডমিশনে চান্স পেলে অদ্রি যখন চলে যাবে তখন ধ্রুব কিভাবে থাকবে ওকে ছাড়া? তাছাড়া কাল থেকে অদ্রি যখন কোচিংয়ে যাবে সেখানে এতগুলো ছেলের সাথে ওকে কিভাবে সহ্য করবে? ধ্রুব তো মোটেও পারবে না। ওর দম বন্ধ হয়ে এলো এসব চিন্তা করে। ওঠে ঢকঢক করে পানি খেলো। অদ্রি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো ধ্রুব কেমন অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। ও জিজ্ঞেস করল,
— আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
ধ্রুব ওকে দেখে চোখদুটো বন্ধ করে দম নিলো। তারপর বলল,
— তোমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই?
অদ্রি অবাক হয়ে বলল,
— হ্যাঁ আছে।
— আর ছেলেবন্ধু?
অদ্রি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— থাকবে না কেন? আছে। কি ব্যাপার বলুন তো!
ধ্রুব উত্তরে বলল,
— এমনি। আচ্ছা তুমি কাউকে পছন্দ করো?
অদ্রির এত হাসি পেলো যে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো।গিয়ে নিজের বিছানায় বসলো। ধ্রুব করুণ দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। অদ্রি বলল,
— করি তো।
ধ্রুব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
— কাকে? কে সে? ও কি আমার থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম?
ধ্রুব’র ব্যাকুলতা ক্রমেই বাড়তে থাকলো। অদ্রি বিস্মিত হয়ে বলল,
— হ্যান্ডসাম তো বটেই। আপনার সাথে কখনো কম্পেয়ার করিনি তো, তাই কে বেশি হ্যান্ডসাম তা বলতে পারছি না। তবে বয়সের হিসেবে আপনার চেয়ে কম।
ধ্রুব আরেক গ্লাস পানি খেলো। ওর বুকে তীব্র জ্বালা হচ্ছে। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কে সে?
অদ্রি হেসে ফেললো। বলল,
— মামা।
ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে কয়েক সেকেন্ড বসে রইলো। পরক্ষণেই চেঁচিয়ে ওঠলো,
— হোয়াট দ্যা হেল অদ্রি? তোমার চয়েজ এত খারাপ?
অদ্রি অবাক গলায় বলল,
— আমার চয়েজ নিয়ে আপনার এত সমস্যা কোথায়?
ধ্রুব চোখমুখ কুঁচকে বলল,
— তাই বলে মামাকে তুমি লাইক করবে? নিজের লাইফ পার্টনার বানাতে আনইজি ফিল করতে না তুমি? ডিজগাস্টিং…
অদ্রি শক্ত গলায় বলল,
— আমি কখন লাইফ পার্টনার বানাতে চাইলাম?
— এক্ষুনি তাহলে কি বললে? নিজের কথা নিজেই মনে রাখতে পারো না?
— আপনার বুদ্ধি, আই-কিউ লেভেলের কথা চিন্তা করে আমার হাসি পাচ্ছে। সিরিয়াসলি? আমি কখন এসব বললাম?
ধ্রুব বলল,
— অদ্রি তুমি আমার সাথে মজা করবে না।
অদ্রি ওকে থামিয়ে দিয়ে রাগী গলায় বলল,
— আপনার সাথে আমার মজার সম্পর্ক থাকলে তো মজা করবো! আমি বলতে চেয়েছি মামাকেই আমি পছন্দ করি। সে আমার ছেলেবন্ধু। বয়সে আমার সমান। আমরা একই ক্লাসে পড়াশোনা করি। কিন্তু আপনার ডার্টি মাইন্ড তো পুরো ব্যাপার না শুনে নিজের মতো উল্টাপাল্টা ভেবে ফেললো।
ধ্রুবকে বিমূঢ় দেখালো। শুকনো গলায় বলল,
— স্যরি। বাট ও কি তোমার নিজের মামা?
অদ্রি বলল,
— না। আমি ওর নাম “মামা” দিয়েছি, ওকে মামা বলেই ডাকি!
ধ্রুব পুরো ব্যাপারটা শুনে রেগে গেলো। ছেলেবন্ধুর নাম মামা, সেও নাকি আবার নিজের মামা নয়। এটা কেমন মজা? অদ্রিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার সেই ‘মামা’ ও-কি তোমার কোচিংয়েই ভর্তি হবে?
অদ্রি বালিশ রাখতে রাখতে বলল,
— হ্যাঁ। একসাথে পড়লে সুবিধা হবে আমাদের।
ধ্রুব’র মেজাজ চরমে পৌঁছালো। জীবনটা কেমন বিস্বাদ লাগছে। মেয়ে মানুষ আসলেই বি’ষের বোতল।
তারা শুধু পুরুষের হৃদয়ে যন্ত্রণা দিতে জানে। ধ্রুব সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলো যেন। উৎকন্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— এডমিশনের পর সত্যিই চলে যাবে এখান থেকে?
অদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— হুম।
ধ্রুব’র কন্ঠে একরাশ ব্যাকুলতা,
— থেকে গেলে কি হয়?
অদ্রি চট করে চাইলো ওর দিকে। হুট করেই উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো ও। বুঝতে পেরে ধ্রুব আর ঘাটালো না ওকে। ধ্রুব’র খুব ইচ্ছে করছে অদ্রির মন পড়তে, মন ছুঁতে, ভালোবাসা পেতে। তবে কি ও অদ্রির প্রেমে পড়ে গেছে?

এলার্মের শব্দে অদ্রির ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখদুটো কিছুতেই খুলতে চাইছে না। তবুও হাতড়ে হাতড়ে এলার্ম ঘড়িটা হাতে নিয়ে চোখ খুললো। ভোর সাড়ে পাঁচ’টা বাজে। অদ্রির কোচিং আটটা থেকে। আজ যেহেতু কোচিংয়ে ওর প্রথম দিন, তাই রাতে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো যাতে সকালে ওঠতে দেরি না হয়। এসির বাতাসে শীতল হয়ে আছে পুরো ঘর। অদ্রি গা থেকে কমফোর্টার সরালো বিরক্তিভাবে। এত সকালে ওর ঘুম থেকে ওঠতে কষ্ট হয় খুব।
কিন্তু তারপরও ওঠলো। এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা করে নিলো। বাইরে তখনো পুরোপুরিভাবে আলো ফোটেনি। ভোরের আলোর সাথে কেমন করে যেন অন্ধকার মিশে আছে। দু-একটা পাখি এদিকওদিক ওড়ছে, কিচিরমিচির শব্দ তুলছে।
হাতে আরও অনেকটা সময় থাকায় অদ্রি ফুরফুরে মেজাজে ব্যলকনিতে গেলো। এই ব্যলকনিতে ওর খুব একটা আসা হয় না। এখানে বিভিন্নরকম ফুলের গাছ লাগানো আছে। সেখানে ফোটে আছে নানা রঙের ভোরের ফুল, অদ্রি সেগুলোর নাম জানে না। নিচের লন থেকে ভেসে আসছে গোলাপের মৃদু সুবাস। ব্যলকনিতে বসার জন্য বাঁশের তৈরি দুটো মোড়া আছে। অদ্রি গিয়ে একটাতে আয়েশ করে বসে অন্যটাতে পা তুলে দিলো। এগুলো ওর খুবই পছন্দ।বসে বসে ভোর দেখা উপভোগ করলো অদ্রি। পূর্ব আকাশে লালিমা মাখা মিষ্টি রোদে ঝলমল করছিলো পৃথিবীর একপাশ। মৃদু হাওয়ায় কেঁপে ওঠছিলো সবুজাভ গাছগাছালির দল। অদ্রি বিভোর হয়ে উপভোগ করছিলো সবকিছু!

এভাবেই কিছুক্ষণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে অদ্রির মনটা ভালো হয়ে গেলো। এরপর রুমে চলে এলো। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে জানালার পর্দাগুলো টেনে সরিয়ে দিলো, নিজের বিছানা গুছিয়ে ঘর ঝাড়ু দিলো। সব কাজই নিঃশব্দে করলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ইজি চেয়ারটায় বসলো। জানালার গ্লাস ভেদ করে রোদ এসে পড়ছে ধ্রুব’র মুখে। ও তখনো ঘুমে বিভোর। কপাল কুঁচকে আছে তার। অদ্রি ওকে এভাবে দেখে আনমনে হাসলো। কাল রাতে কি অদ্ভুত ব্যবহারই না করেছে ওর সাথে। অদ্রির এত হাসি পাচ্ছিলো যে নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছিলো। আজকাল ঘুম ভাঙার পর ধ্রুব’র মুখটাই ও সবার আগে দেখে। সারাদিন ওর পিছনে লেগে থাকা মানুষটা ওর সাথে রাগ দেখায়, কটু কথা বলে। কিন্তু এই ক’দিনে অদ্রি বুঝতে পেরেছে ধ্রুব আসলে তেমন নয়। মনটা খুবই সরল৷ অদ্রি নিজের ভাবনা বন্ধ করে ব্যাগে বইপত্র গুছিয়ে নেয়। সুন্দর করে তৈরি হয়। তবে সবসময়ের মতোই স্নিগ্ধ।

ধ্রুব’র ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। এতক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে অদ্রিকে দেখছিলো। যেইনা অদ্রি রেডি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবে ধ্রুব সটান ওঠে বসলো। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— অদ্রি তুমি কোথায় যাচ্ছো?
অদ্রি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ তারপর উত্তরে বলে,
— কোচিংয়ে যাচ্ছি।
ধ্রুব কিছু মনে পড়ে যাওয়ার মতো করে বলল,
— ক’টা বাজে? তোমার কোচিং ক’টায়?
অদ্রি ঘড়ি দেখে সময় বলে,
— এখন সাতটা। আমার কোচিং আটটায়। পৌঁছাতে পৌঁছাতে একঘন্টা তো লেগেই যাবে।
ধ্রুব বিছানা থেকে তড়িঘড়ি করে নামলো। কাবার্ড থেকে কোনোমতে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল,
— আমার পাঁচমিনিট লাগবে। নড়বে না ওকে? দাঁড়িয়ে থাকো ওখানেই।
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলো। ধ্রুব কি ওর সাথে
যাবে নাকি? কিন্তু এটুকু পথ তো ও একাই যেতে পারবে। সাথে যাওয়ার কি দরকার? ধ্রুব খুব বেশি সময় নিলো না। খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে অদ্রিকে বলল,
— চলো।
— আপনার সাথে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
এটুকু রাস্তা…
ধ্রুব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— বাবা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। তোমার এত কথা বলার দরকার নেই তো। আমিই নিয়ে যাবো।
অদ্রি বিরক্ত গলায় বলল,
— আমি রিকশা করে যাবো। বড় গাড়িতে করে কোচিংয়ে যাওয়াটা হাস্যকর।
ধ্রুব বুঝলো না এখানে হাস্যকরের কি আছে। তবে অদ্রির কথায় সায় জানিয়ে বলল,
— ওকে, ইওর চয়েজ।
অদ্রি বলল,
— আপনি রিকশায় যাবেন?
ধ্রুব পালটা প্রশ্ন করল,
— কেন নয়?
অদ্রি ছোট্ট করে বলল,
— ভালো।
তারপর ওরা নিচে নামলো। শায়লা অদ্রিকে জোর করে ব্রেকফাস্ট করিয়ে দিলো। ধ্রুব শুধু কফি খেলো। তারপর দু’জন বেরিয়ে পড়লো৷ রিকশা খুঁজতে ওদের আরও পাঁচমিনিট লাগলো। ঢাকা শহরের ছোট রিকশায় ধ্রুব’র বসতে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। তবে অদ্রিকে বিষয়টা বুঝতে দিলো না। ওর পাশে বসে যেতে পারছে এতেই ধ্রুব অন্যরকম অনুভূতি টের পাচ্ছে মনের
ভেতর। কোচিংয়ে অদ্রি দশ মিনিট লেইটে ঢুকলো। পুরো একঘর ভর্তি ছেলে-মেয়ে। বসার জায়গা আলাদা। অদ্রিকে একটা মেয়ে প্রথম বেঞ্চে জায়গা করে দিলো। পড়ানো শুরু হলো একটা সময়। অদ্রি মনোযোগ দিয়ে স্যারদের কথা শুনছে। কিন্তু ছেলেরা সেদিনের মতোই অদ্রির প্রতি মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলো। এদের মধ্যে একজনের নাম রাহাত। খুব ব্রিলিয়ান্ট, দেখতেও বেশ ভালো। সে একটু পরপর অদ্রিকে আড়চোখে দেখতে লাগলো। পাশে বসা রাহাতের বন্ধু পরশ ওর কানেকানে জিজ্ঞেস করল,
— কি মাম্মা? এতদিন পরে মনে ধরছে নাকি
অবশেষে?
রাহাত হাসলো। বলল,
— এত কথা না বলে ফোন নাম্বারটা জোগাড় করে দেওয়ার ব্যবস্থা কর!
পরশ তার সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল,
— দু’দিন সময় দে দোস্ত!
— দিলাম।

[ যাঁদের কাছে অদ্রির ব্যবহার বাড়াবাড়ি লাগছে। ঠিক কী কারণে এমন লাগছে? স্বাভাবিক নয় কেন?]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here